ভাগে বা অংশীদারিত্বে কুরবানি বৈধ

গতকাল সন্ধ্যায় শুরু হয়েছে পবিত্র যিলহজ মাস । আর কিছু দিন পরেই কুরবানি । কুরবানির বিভিন্ন মাসায়েলের মধ্যে একটি মাসআলা হলো, উট, গরু ও মহিষ সর্বোচ্চ সাত জন মিলে কুরবানি দেয়া যায়। এটা বৈধ । কিন্তু আমাদের সমাজের এক শ্রেণির লোক যারা নিজেদের হাদীসের অনুসারী দাবী করে । বাস্তবতা হলো, হাদীসের উপর নয়; বরং হাদীস নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা করে ঐ ব্যাখ্যাটাকে মানা তাদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ।
.
‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ আন্দোলন’ যার আমির জনাব আসাদুল্লাহ আল গালিব সাহেব । তাদের দাবী হলো, ‘অংশীদারিত্বে বা ভাগে কুরবানি দেয়া এটি প্রচলিত একটি প্রথা। ভাগে কুরবানি দিলে কুরবানি হবে না । ভাগে কুরবানি করার যে সকল হাদীস রয়েছে, তা নাকি সফরের সাথে সম্পৃক্ত । কেউ সফরে গেলে ভাগে কুরবানি করার অনুমতি আছে । মুকিম অবস্থায় ভাগে কুরবানি করার কোনো অবকাশ নেই । এ বক্তব্য তারা তাদের মাসিক ‘আত-তাহরীক’ পত্রিকায় ছেপেছেন । সেই সাথে গালিব সাহেব তার নিজের লেখা বইয়েও এমন ভ্রান্ত কথা লিখেছেন ।
.
এ হলো তাদের ভ্রান্ত দাবী । ভ্রান্ত মতবাদ । মনগড়া ব্যাখ্যা । এভাবে নিজেদের মন কর্তৃক গড়া ব্যাখ্যা করে তারা সেই ব্যাখ্যার উপর সাধারণ মানুষদের আহ্ববান করছে । বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে উম্মাহর মাঝে । আল্লাহ্ আমাদের হেফাজত করুন, আমীন ।
.
আমি এখন খুব সংক্ষেপে তাদের ভ্রান্ত মতবাদের জবাব দেবো, ইনশাআল্লাহ । সাথে দেখাবো সউদি আরবের উলামায়ে কেরামের বক্তব্য কী ।
.
বেশিরভাগ আহলুল ইলমের মতে কুরবানি ভাগে তথা অংশীদারিত্বে দেয়া বৈধ। এটিই ইমামে আযম আবু হানীফা নুমান বিনে সাবিত, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফেয়ি, ইমাম আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বল আশ-শাইবানি, ইমাম সুফইয়ান বিন সাঈদ আছ-ছাওরি, ইমাম আবু আবদুর রহমান আল আওযায়ি, ইমাম আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইবরাহিম আল আনসারি, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশ-শাইবানি রহ.-সহ প্রমুখের ।
.
হাম্বলি মাযহাবের প্রখ্যাত ফকিহ আল্লামা আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ ইবনে কুদামা হাম্বলি রহ. লিখেছেন,
.
وتجزئ البدنة عن سبعة ، وكذلك البقرة وهذا قول أكثر أهل العلم . روي ذلك عن علي وابن عمر وابن مسعود وابن عباس وعائشة رضي الله عنهم ، وبه قال عطاء وطاوس وسالم والحسن وعمرو بن دينار والثوري والأوزاعي والشافعي وأبو ثور ، وأصحاب الرأي
.

অর্থাৎ “একটি উট সাত ভাগে অনুরূপ গরু সাত ভাগে কুরবানি দেয়া জায়েয, এটা বেশিরভাগ আহলুল ইলমের বক্তব্য । এমনটি বর্ণিত হয়েছে, সাহাবী আলী, ইবনে উমর, ইবনে মাসউদ, ইবনে আব্বাস, আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) হতে । আর এই বক্তব্য ছিল, তাবেয়ী আতা, তাউস, সালেম, হাসান বসরি, আমর ইবনে দিনার, সুফইয়ান সাওরি, আওযায়ি, শাফেয়ি, আবু সওর, আবু হানিফা ও তাঁর ছাত্রদের মত।”
.
[আল মুগনী, লিইবনে কুদামা, ৯ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৬]
.
.
হাদীস :
.
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ، قَالَ: نَحَرْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَامَ الْحُدَيْبِيَةِ الْبَدَنَةَ عَنْ سَبْعَةٍ، وَالْبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ
.
অর্থাৎ জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, আমরা হুদায়বিয়ার বছর, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে একটি উটে সাতজন এবং একটি গরুতে সাতজন শরিক হয়েছি ।”
.
[সহীহ মুসলিম, ২/৯৫৫, হা. ১৩১৮; মুয়াত্তা মালিক, হা. ১৩৭৩, ২১২৯; মুসনাদে আহমাদ, ৩/২৯৩, ৩০১, ৩৭৮; সুনানে আবু দাউদ, হা. ২৮০৯; তিরমিযী, ১৫০২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হা. ৩১৩২; সুনানে দারিমী, হা. ১৯৬১, ১৯৬২; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হা. ২৯০০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হা. ৪০০৪, ৪০০৬]
.
হাদীসটি বর্ণনা করে ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন,
.
حَدِيثُ جَابِرٍ حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ. وَالعَمَلُ عَلَى هَذَا عِنْدَ أَهْلِ العِلْمِ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَغَيْرِهِمْ: يَرَوْنَ الجَزُورَ عَنْ سَبْعَةٍ، وَالبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ، وَهُوَ قَوْلُ سُفْيَانَ الثَّوْرِيِّ، وَابْنِ الْمُبَارَكِ وَالشَّافِعِيِّ، وَأَحْمَدَ
.
ইমাম তিরমিযী বলেন, “জাবের (রা.)-এর হাদীসটি حَسَنٌ صَحِيحٌ হাসান সহীহ।
.
আহলুল ইলমের মধ্যে সাহাবীগণ এবং প্রমুখের মত ও আমল ছিল এর উপর । তাঁরা একটি উটে সাতজন এবং একটি গাভীতে সাতজন মিলে কুরবানি করার মত পোষণ করেন । আর এটিই ইমাম সুফইয়ান সাওরি, ইবনুল মুবারক, শাফেয়ি এবং আহমাদ বিন হাম্বল রহ.-এর মত।”
.
[তিরমিযী, কিতাবুল আদ্বাহী (কুরবানী অধ্যায়), বাবু মা জা আ ফিল্ ইশতিরাকি ফিল্ উদ্বহিয়্যাহ (অংশীদারিত্বে কুরবানি সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ), হা. ১৫০২ এর আলোচনায়; এছাড়াও হা. ৯০৪ এর আলোচনায়]
.
হাদীস :
.
حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ إِسْمَاعِيلَ، حَدَّثَنَا حَمَّادٌ، عَنْ قَيْسٍ، عَنْ عَطَاءٍ، عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: الْبَقَرَةُ عَنْ سَبْعَةٍ، وَالْجَزُورُ عَنْ سَبْعَةٍ
.
অর্থাৎ জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “একটি গরু সাত ভাগে এবং একটি উট সাত ভাগে ।”
.
[সুনানে আবু দাউদ, অধ্যায় : কিতাবুদ্ দ্বাহায়া (কুরবানী অধ্যায়); অনুচ্ছেদ : বাবুন ফিল বাকারি ওয়াল জাযূরি কাম তুজযিউ? (গরু এবং উট কত ভাগে গণনা করা হবে সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ); ৪/৪৩২ হাদীস ২৮০৮; প্রকাশনায় : দারুর্ রিসালাহ্ আল্ ‘আলামিয়্যাহ; সনদ সহীহ]
.
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও মুহাক্কিক শায়খ শুআইব আল আরনাউত রহ. এই হাদীসের সনদকে সহীহ বলেছেন।
.
إسناده صحيح
.
[সুনানে আবু দাউদ, তাহকীক : শুআইব আরনাউত্ব, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪৩২ । প্রকাশনায় : দারুর্ রিসালাহ্ আল্ ‘আলামিয়্যাহ]
.
লা-মাযহাবিদের নিকট অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য আলেম, শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানি রহ.ও হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন ।-- [শায়খ আলবানি কৃত সহীহ ও যয়ীফ সুনানে আবু দাউদ, হা. ২৮০৮]
.
সহীহ মুসলিমের হাদীসটির ব্যাখ্যায় ইমাম নববী রহ. লিখেছেন,
.
فِي هَذِهِ الأَحَادِيث دَلالَة لِجَوَازِ الِاشْتِرَاك فِي الْهَدْي , وَأَجْمَعُوا عَلَى أَنَّ الشَّاة لا يَجُوز الاشْتِرَاك فِيهَا . وَفِي هَذِهِ الأَحَادِيث أَنَّ الْبَدَنَة تُجْزِئ عَنْ سَبْعَة , وَالْبَقَرَة عَنْ سَبْعَة , وَتَقُوم كُلّ وَاحِدَة مَقَام سَبْع شِيَاه
.
অর্থাৎ “এই হাদীসগুলো থেকে কুরবানির পশু অংশীদারিত্বে বা ভাগে কুরবানি করার দলিল পাওয়া যাচ্ছে । আর উলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে একমত যে, ছাগল ভাগে কুরবানি করা জায়েয নেই । আর এই হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, একটি উট সাত জন মিলে ভাগে এবং একটি গরু সাত জন মিলে ভাগে দিতে পারবে । আর একটি উট বা একটি গরু সাতটি ছাগলের সমান ।”
.
[শরহুন্ নববী আলা মুসলিম, হা. ১৩১৮ এর ব্যাখ্যায়]
.
.
এবার সউদি আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া বোর্ড এবং প্রসিদ্ধ উলামায়ে কেরামগণের কিছু মতামত উল্লেখ করছি :
.
সউদি আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি “আল্ লাজনাতুদ্ দায়িমা” তে ভাগে কুরবানি দেয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন আসলে, জবাব প্রাদান করা হয়,
.
تجزئ البدنة والبقرة عن سبعة ، سواء كانوا من أهل بيت واحد أو من بيوت متفرقين ، وسواء كان بينهم قرابة أو لا ؛ لأن النبي صلى الله عليه وسلم أذن للصحابة في الاشتراك في البدنة والبقرة كل سبعة في واحدة ، ولم يفصل ذلك
.
অর্থাৎ “একটি উটে সাত জন এবং একটি গরুতে সাত জন মিলে ভাগে কুরাবানি বৈধ । চাই তা এক পরিবারের থেকে সাত ভাগ হোক বা কয়েক পরিবারের থেকে সাত ভাগ হোক । আর চাই তাদের মধ্যে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকুক আর না থাকুক । তা জায়েয । কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের একটি উটে সাত জন এবং একটি গরুতে সাত জন শরীক হয়ে কুরবানী করার অনুমতি দিয়েছিলেন । …”
.
[ফাতাওয়া আল্ লাজনাতুদ্ দায়িমা, ১১/৪০১]
.
শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উছাইমিন (রহ.) “আহকামুল উদ্বহিয়্যাহ” কিতাবে লিখেছেন,
.
وتجزئ الواحدة من الغنم عن الشخص الواحد ، ويجزئ سُبْع البعير أو البقرة عما تجزئ عنه الواحدة من الغنم
.
অর্থাৎ “ছাগল এক ব্যক্তির জন্য যথেষ্ঠ করে দেয়া হয়েছে । আর একটি উট এবং একটি গরুতে সেই সাত জনের অংশীদারিত্বে যথেষ্ঠ করা হয়েছে । যাদের জন্য সাতটি ছাগল যথেষ্ঠ হতো ।”
.
সউদি আরবের অন্যতম প্রসিদ্ধ আলেম, শায়খ ইবনে বায, ইবনে উছাইমিন রহ.-এর অন্যতম ছাত্র শায়খ মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন,
.
يجوز الاشتراك في الأضحية إذا كانت من الإبل أو البقر ، أما الشاة فلا يجوز الاشتراك فيها .
ويجوز أن يشترك سبعة أشخاص في واحدة من البقر أو الإبل
.
অর্থাৎ “যদি উট অথবা গরু কুরবানি করা হয়, তাহলে তা ভাগে দেয়া যাবে । আর যদি ছাগল, ভেড়া অথবা দুম্বা কুরবানি দেয়া হয়, তাহলে ভাগে দেয়া যাবে না । আর একটি গরু অথবা একটি উটে সাত জন অংশীদার বা ভাগীদার শরিক হতে পারবে ।”
.
.
গুরুত্বপূর্ণ কথা : ভাগে কুরবানি দেয়া বৈধ । কিন্তু উত্তম হলো একাই পুরো একটি পশু কুরবানি দেয়া । আর ভাগে কুরবানি দিলে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি । তা হলো,
.
ক. সকলের নিয়ত ঠিক রাখা। অংশীদারদের মধ্যে যদি কোনো একজনের নিয়তে গরমিল থাকে, মাংস খাওয়ার নিয়ত থাকে, তাহলে অন্য সকল অংশীদারের কুরবানী নষ্ট হবে । তাই সতর্ক থাকা জরুরি ।
.
খ. গোশত অংশীদারদের প্রত্যেকের মধ্যে যথাযথ ভাবে বণ্টন করতে হবে । কারো ভাগে কম, কারো ভাগে বেশি এমন হওয়া যাবে না ।
.
গ. ভাগীদারদের মধ্যে কারো কুরবানি অর্থ যদি অধিকাংশ বা অর্ধেক সম্পদ হারাম উপার্জনের হয়, তাহলে কারো কুরবানি হবে না ।
.
আশা করি উপর্যুক্ত আলোচনার দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় যে, উট বা গরু ভাগে বা শরিকে কুরবানি দেয়া বৈধ । এটা যে শুধু সফর অবস্থায় বৈধ তা নয়; বরং সর্বাবস্থায় বৈধ । মুহাদ্দিসিনে কেরাম এবং ফুকাহায়ে কেরাম এটিই বলেছেন । তাঁরা তো উক্ত হাদীসগুলোকে সফর অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত করেন নাই । তাঁরা তো এটি সর্বাবস্থায় জায়েয বলেছেন । সউদি আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি, প্রখ্যাত উলামা এটিকে সর্বাবস্থায় বৈধ বলেছেন।
.
তাহলে কেন আমাদের দেশের লা-মাযহাবি, কথিত আহলে হাদীস ভাইয়েরা এই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন?

------------------
লিখেছেনঃ সামীউর রহমান শামীম

মন্তব্যসমূহ

এই সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

ডাউনলোড করুন মাকতাবায়ে শামেলা লেটেস্ট ভার্শন (মোবাইল এবং পিসির জন্য)

রুকইয়াহ আশ-শারইয়্যাহ (ডাউনলোড)

ইসতিখারার সুন্নত তরিকা + pdf