ইস্তেখারা এবং আমাদের সমাজ

ইসলামপূর্ব জাহিলী যুগে মক্কার কাফেররা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেখা দিলে যেমন ক্রয়-বিক্রয়, বিবাহ-শাদী, সফর ইত্যাদিতে শর দ্বারা ভাগ্য নির্ধারণ করতো। কল্যাণ অকল্যাণ তারা এর দ্বারাই নির্ধারণ করতো। তিনটি শর নিয়ে একটিতে লিখতো ‘আমার রব আদেশ করেছেন’ আরেকটিতে লিখতো, ‘আমার রব নিষেধ করেছেন’ আরেকটি খালি রাখতো। অত:পর যেটি হাতে উঠতো সে অনুযায়ী আমল করতো। আদেশ সূচকটি উঠলে কাজ করতো, নিষেধ সূচকটি উঠলে বিরত থাকতো আর তৃতীয়টি উঠলে আবার লটারির ব্যবস্থা করতো।

এই ছিল জাহিলী যুগের কল্যাণ অকল্যাণ নির্ণয়ের পদ্ধতী। যা ছিল সম্পূর্ণ কাল্পনিক এবং আল্লাহর উপর অপবাদ দেয়ার শামিল। কেননা তারা ধরে নিত এটা তাআলার আদেশ ওটা আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেছেন অথচ আল্লাহ তাআলা এমন আদেশ নিষেধ জারি করেন নি।

এর পরিবর্তে মুসলমানদেরকে কল্যাণ কামনার বাস্তব সম্মত একটি পদ্ধতী শিক্ষা দেয়া হয়েছে। দেখুন, সেই পদ্ধতিটি কি।

সহীহ বুখারী শরীফ (হাদীস নং-১১৬৬) সহ হাদীসের অসংখ্য কিতাবে হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে এমনভাবে ইস্তেখারা শিক্ষা দিতেন যেমনভাবে কোরআনের সূরা শিক্ষা দিতেন। নবীজী বলতেন, তোমাদের কেউ যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার মনস্থ করবে তখন সে যেন দু’রাকাত নফল নামায পড়ে এ দু‌‘আ পাঠ করে-

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيمِ فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلَا أَقْدِرُ وَتَعْلَمُ وَلَا أَعْلَمُ وَأَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي فَاقْدُرْهُ لِي وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ شَرٌّ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي فَاصْرِفْهُ عَنِّي وَاصْرِفْنِي عَنْهُ وَاقْدُرْ لِي الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ رَضِّنِي بِهِ وَيُسَمِّي حَاجَتَهُ
‘হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আপনার ইলমের দ্বারা কল্যাণ কামনা করছি। আপনার কুদরতের ওসীলায় কাজে শক্তি চাচ্ছি এবং আপনার বিশাল অনুগ্রহ চাচ্ছি। কেননা আপনি সক্ষম, আমি অক্ষম। আপনি সবকিছু সম্পর্কে অবগত, আমি অনবগত। আপনিই অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে মহাজ্ঞানী। হে আল্লাহ! যদি এ কাজ আমার দ্বীন, দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণকর হয়, তবে তা আমার জন্য নির্ধারণ করুন। আর তা সম্পন্ন করা আমার পক্ষে সহজ করুন। অত:পর তা আমার জন্য করকতময় করুন। আর যদি এ কাজ আমার দ্বীন, দুনিয়া ও আখেরাতর জন্য এবং পরিণামের দিক থেকে ক্ষতিকর হয়, তবে এটাকে আমার থেকে দূরে রাখুন এবং আমাকেও এটা থেকে দূরে রাখুন। আর যাতে কল্যাণ রয়েছে এরই তাওফীক আমাকে দান করুন। এবং এর উপরই আমাকে সন্তুষ্ট করে দিন।'

বড় সাইজ দেখতে পিকচারে ক্লিক করুন


ইস্তেখারার সারকথা হলো, গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ করার ইচ্ছা করলে প্রথমে দু’রাকাত নামায পড়বে অত:পর উপরোক্ত দুআ পড়বে। নামায এবং দু'অার পর কি করবে?

কেউ কেউ বলেছেন, মন যে দিকে সায় দে তাই করবে। এসম্পর্কে একটি রেওয়ায়েতও অাছে। তবে হাফিজ ইবনে হাজার রহ. বলেছেন, রেওয়ায়েতটি অত্যন্ত দুর্বল। সঠিক হলো অপর বর্ণনায় যে يعزم এসেছে এর উপর অামল করবে। অর্থাৎ যে কাজ করার ইচ্ছা তা শুরু করে দেবে। (কেননা সে তো দু'অা করেছে, কল্যাণ থাকলে যেন কাজটি হয় অার অকল্যাণ থাকলে অাল্লাহ তাঅালা যেন ঐ কাজ থেকে দূরে রাখেন। তাই কাজ শুরু করে দেবে। যদি অকল্যাণ তাকে তাহলে কাজটি হবে না ইনশাঅাল্লাহ)

ওয়াজিব, সুন্নাত, কিংবা হারাম এর জন্য তো ইস্তেখারা হবে না এছাড়া সকল বৈধ কাজের জন্যই এই ইস্তিখারা।
কখনো এমন হতে পারে, কেউ রাস্তায় অাছে কিংবা অন্য কোনো ব্যস্ততার কারণে হয়তো নামায পড়ার সুযোগ নেই অথচ এখনি একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখন কিভাবে ইস্তেখারা তথা কল্যাণ কামনা করবে।

হ্যাঁ, হাদীস শরীফে বিষয়টি সহজ করে দেয়া হয়েছে। সুনানে তিরমিযিতে হযরত অায়েশা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে নবীজী সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোনো কাজের ইচ্ছা করতেন কলতেন-
اللهم خرلي واختر لي
'ইয়া অাল্লাহ! অামার জন্য উপযোগী বিষয়টি নির্বাচন বরুন এবং এতে কল্যাণ দান করুন।'

যখনি কোনো কাজ করার ইচ্ছা এই দুঅাটি পড়বে অত:পর কাজ শুরু করে দেবে। উপরুক্ত হাদীসটি যদিও সনদের বিচারে দুর্বল কিন্তু এমন দুর্বল হাদীস ফাযায়েলের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য।

এই হচ্ছে ইস্তেখারার হক্বীকত। দেখুন বিষয়টি কত সহজ। কিন্তু অত্যন্ত দু:খজনক এক বাস্তবতা হচ্ছে যে, অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো অামরা ইস্তেখারাকে জটিল বানিয়ে ফেলেছি।

ইস্তেখার জন্য ঘুমাতে হবে এরপর স্বপ্নে এই দেখলে কাজটি করবে এই দেখলে কাজটি করবে না। অাবার অনেকে মনে করেন, ইস্তেখারা অামাদের মতো সাধারণদের কাজ নয়, কোনো বুযুর্গকে দিয়ে করাতে হবে।

এগুলোর কোনো কিছুই হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এগুলো বিভিন্ন মাশায়েখ থেকে বর্ণিত। অামি এগুলোকে অবৈধ বলছি না কিন্তু হাদীসে কতটুকু বর্ণিত অার মাশায়েখ থেকে কতটুকু বর্ণিত এর মধ্যে তো পার্থক্য রাখতে হবে। মাশায়েখ থেকে যা বর্ণিত এগুলোকে হাদীসের মতো জরূরী মনে করা যাবে কি? এর দ্বারা ইস্তেখারার হক্বীকতই হারিয়ে যাচ্ছে।

পরিশেষে থানভী রহ. এর একটি কথা উল্লেখ করেই অালোচনার ইতি টানবো। তিনি 'বাওয়াদিরুন নাওয়াদির' গ্রন্থে ২/৪৬৪ বলেন, ইস্তেখারা কল্যাণ কামনার নাম এটা 'ইস্তেখবার' তথা জিজ্ঞাসাবাদ নয়। সুতরাং নামায এবং দুঅার পর যে কাজ করার ইচ্ছা তা শুরু করে দেবে। স্বপ্নে কিছু দেখার প্রয়োজন নেই।

------------------
লিখেছেনঃ Mahbubul Hasan Arife

মন্তব্যসমূহ

এই সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

ডাউনলোড করুন মাকতাবায়ে শামেলা লেটেস্ট ভার্শন (মোবাইল এবং পিসির জন্য)

রুকইয়াহ আশ-শারইয়্যাহ (ডাউনলোড)

ইসতিখারার সুন্নত তরিকা + pdf