মাযহাব বিষয়ে ইমাম আবু হানিফার উক্তি নিয়ে ধোঁকাবাজির জবাব..

 প্রশ্নঃ
ইমাম আবু হানিফার এই উক্তিগুলোর ব্যাপারে আপনারা কি বলেন?
১- যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমার মাজহাব’। [হাশিয়াহ ইবনে আবেদীন ১/৬৩]
২- আমরা কোথা থেকে গ্রহণ করেছি, তা না জেনে আমাদের কথা গ্রহণ করা কারো জন্য বৈধ নয় [হাশিয়াহ ইবনে আবেদীন ৬/২৯৩]
৩- যে ব্যক্তি আমার দলীল জানে না, আমার কথা দ্বারা ফতোয়া প্রদান করা তার জন্য হারাম [ড. অছিউল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আববাস, আত-তাক্বলীদ ওয়া হুকমুহু ফী যুইল কিতাব ওয়াস-সন্নাহ, পৃঃ ২০]
৪- নিশ্চয়ই আমরা মানুষ। আমরা আজকে যা বলি, আগামীকাল তা থেকে ফিরে আসি [ ড. অছিউল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আববাস, আত-তাক্বলীদ ওয়া হুকমুহু ফী যুইল কিতাব ওয়াস-সন্নাহ, পৃঃ ২০]
উত্তর
উক্ত বক্তব্যগুলো যাচাই বাছাই ছাড়া আপনি নিশ্চয় কারো অন্ধ তাকলীদ করে কপিপেষ্ট করেছেন। এটি নিশ্চিত। যদি আপনি হাশিয়ায়ে ইবনে আবিদীন কিতাবটি দেখতেন। আর যদি আল্লাহ তাআলা আপনাকে কিতাবটি বুঝার তৌফিক দিতেন, তাহলে আপনি এরকম দাম্ভিকতার সাথে কিছু মিথ্যা, কিছু অর্থ বিকৃতি আর কিছু আগের বক্তব্য বাদ দেয়া ধোঁকাবাজীপূর্ণ বক্তব্যগুলো উদ্ধৃত করতেন না।
মিথ্যাচারের নমুনা দেখুন-
ধোঁকাবাজী নং-১ঃ 
“যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমার মাজহাব’। [হাশিয়াহ ইবনে আবেদীন ১/৬৩]”
এটি জঘন্য মিথ্যাচারমূলক বক্তব্য। ইমাম আবু হানীফা রহঃ একথা এভাবে বলেননি। এটি ধোঁকাবাজ আর মিথ্যুকদের সৃষ্টি ধুম্রজাল। আর রেফারেন্সও দেয়া হয়েছে ভুল। রেফারেন্সটি হবে- ১/১৬৭, জাকারিয়া লাইব্রেরী। ইমাম আবু হানীফা রহঃ বলেছেন-
اذا صح الحديث فهو مذهبى তথা যখন হাদীস সহীহ হয়, তাহলে সেটিই আমার মাযহাব। {হাশিয়ায়ে ইবনে আবেদীন-১/৬৩}
“পাবে” শব্দ আরবীতে কোথায় আছে? এটি গায়রে মুকাল্লিদদের বানানো শব্দ। একথা ইমাম আবু হানীফা রহঃ বলেননি। পাবে শব্দ থাকলে আরবীতে থাকতো وجد কিন্তু উক্ত ইবারতের কোথাও এ শব্দটি নেই। তাহলে “পাবে” অর্থ কোত্থেকে আমদানী করা হল?
যিনি বলছেন, হাদীস সহীহ হলে, সেটি তার মাযহাব, তিনি কি করে গায়রে সহীহ হাদীসের উপর তার মাযহাব প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন? একথাইতো সুষ্পষ্ট প্রমাণ যে, ইমাম আবু হানীফা রহঃ তার মাযহাবের ভিত্তি রেখেছেন কেবল সহীহ হাদীসের উপর। কোন দুর্বল হাদীসের উপর তিনি তার মাযহাব প্রতিষ্ঠা করেননি। এ ব্যাপারে আরো জানতে আগের পোষ্টটি আবার পড়–ন।
বাংলায় “পাবে” শব্দ বাড়িয়ে বক্তব্যটিকে বিকৃতকারীর নাম আহলে হাদীস হয় না, হয় আহলে ধোঁকা।
ধোঁকাবাজী নং-২ঃ 
 “আমরা কোথা থেকে গ্রহণ করেছি, তা না জেনে আমাদের কথা গ্রহণ করা কারো জন্য বৈধ নয়।হাশিয়াহ ইবনে আবেদীন ৬/২৯৩]”
এ বক্তব্যটি যেভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। সাধারণ পাঠকগণ বুঝবেন যে, এটি বুঝি ইমাম সাহেবের মুকাল্লিদদের উদ্দেশ্যে ইমাম আবু হানীফা রহঃ বলে গেছেন। অথচ এ বক্তব্যটি তিনি মুকাল্লিদদের উদ্দেশ্যে বলেন নি। বলেছেন মুজতাহিদদের উদ্দেশ্যে। তাই এটিই একটি ধোঁকাবাজিমূলক বক্তব্য।
যদি তিনি এটি মুকাল্লিদদের উদ্দেশ্যেই বলে গিয়ে থাকেন, তাহলে প্রশ্নকারীর কাছে আমাদের আবেদন, উক্ত কিতাবের মূল আরবিটা দিন। তাহলে আপনার মিথ্যার খোলস খুব সহজেই বেরিয়ে আসবে।
ধোঁকাবাজী নং-৩ঃ 
 তোমার জন্য আফসোস হে ইয়াকুব (আবু ইউসুফ)! তুমি আমার থেকে যা শোন তাই লিখে নিও না। কারণ আমি আজ যে মত প্রদান করি, কাল তা প্রত্যাখ্যান করি এবং কাল যে মত প্রদান করি, পরশু তা প্রত্যাখ্যান করি [ ড. অছিউল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আববাস, আত-তাক্বলীদ ওয়া হুকমুহু ফী যুইল কিতাব ওয়াস-সন্নাহ, পৃঃ ২০]
এ বক্তব্যেরও আরবী ইবারত কাম্য হানাফী নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে। গায়রে মুকাল্লিদ দাবিদার ভ্রান্ত কারো কিতাব থেকে নয়। অথচ এখানে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে একজন গায়রে মুকাল্লিদের লেখা বই থেকে। তাই হানাফী নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ থেকে এ বক্তব্যটিকে ইমাম আবু হানীফা রহঃ থেকে প্রমানিত দেখাতে হবে। কেননা, অর্থ বিকৃতি ও মিথ্যা কথা বলা গায়রে মুকাল্লিদদের মাযহাবের মূল ভিত্তি।
যদি উক্ত বক্তব্যটি সঠিক হয়, তাহলেও কোন সমস্যা নেই। কারণ ইমাম সাহেব একথা কাকে বলছেন? গায়রে মুজতাহিদকে না মুজতাহিদকে?
ইমাম আবু হানীফা রহঃ বক্তব্যটি কি মুকাল্লিদকে লক্ষ্য করে না মুজতাহিদকে লক্ষ্য করে?
নিশ্চয় মুজতাহিদকে লক্ষ্য করে। ইমাম আবু ইউসুফ মুজতাহিদ ফিল মাযহাব ছিলেন। মুজতাহিদ ফিল মাযহাব বলা হয়, যিনি ইমামের নির্দিষ্ট করা মূলনীতির আলোকে দলীলের আলোকে স্বীয় মূলনীতি নির্ধারণের যোগ্যতা রাখেন। যে মূলনীতির আলোকে তিনি নিজেই কুরআন ও হাদীসে অবর্ণিত মাসায়েলকে বের করতে পারেন। তার নাম মুজতাহিদ ফিল মাযহাব।
এমন মুজতাহিদের জন্য শুধু ইমামের দলীলের উপর নির্ভর করে মাসআলা মেনে নেয়া জায়েজ নয়, যতক্ষণ না তিনি উক্ত মাসআলার দলীল নিজে যাচাই বাছাই করে নিশ্চিত হন।
তাহলে যেহেতু ইমাম আবু ইউসুফ রহঃ নিজেই মুজতাহিদ ছিলেন। আর মুজতাহিদের জন্য দলীল ছাড়া ইমামের বক্তব্য মেনে বৈধ নয়, তাই তাকে ইমাম আবু হানীফা রহঃ সতর্ক করে বলেছেন যে, “হে ইয়াকুব (আবু ইউসুফ)! তুমি আমার থেকে যা শোন তাই লিখে নিও না।”
যেহেতু কুরআন ও হাদীসে যেসকল মাসআলা বর্ণিত নেই। সেসব ক্ষেত্রে সমাধান কেবল মুজতাহিদের স্বীয় ইজতিহাদ। আর ইজতিহাদী সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হতে পারে। তাই ইমাম আবু ইউসুফ রহঃ এর মত মুজতাহিদের জন্য যাচাই বাছাই ছাড়া ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর বক্তব্য মেনে নেয়া বৈধ নয়।
কিন্তু এর দ্বারা মুকাল্লিদের মেনে নেয়ার কি কথা রইল? এ কথাতো মুকাল্লিদের জন্য বলাই হয়নি। তাহলে মুকাল্লিদদের ক্ষেত্রে কেন ধোঁকাবাজির সাথে এ বক্তব্য উদ্ধৃত করা হচ্ছে?
ধোঁকাবাজী নং-৪ঃ 
 যে ব্যক্তি আমার দলীল জানে না, আমার কথা দ্বারা ফতোয়া প্রদান করা তার জন্য হারাম [ ড. অছিউল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আববাস, আত-তাক্বলীদ ওয়া হুকমুহু ফী যুইল কিতাব ওয়াস-সন্নাহ, পৃঃ ২০]
এটিও একটি ধোঁকাবাজিমূলক প্রশ্ন। একেতো এ বক্তব্যটি ইমাম আবু হানীফা রহঃ থেকে প্রমানিত কি না? তাই সন্দেহ আছে। কারণ গায়রে মুকাল্লিদরা প্রচুর পরিমাণ মিথ্যা রেফারেন্স দিয়ে থাকে। আর অনবরত মিথ্যা কথা বলে থাকে। তাই প্রথমে উক্ত বক্তব্যটি যতক্ষণ পর্যন্ত হানাফী কোন নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে আরবী ইবারতসহ না দেখাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এর কোন বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। কারণ মিথ্যুক কত কথাই বলতে পারে।
আর যদি উক্ত বক্তব্যটি প্রমাণিত করতেও পারে, তাহলে দেখা যাবে যে, উক্ত বক্তব্যটি পূর্বের মত ইমাম আবু হানীফা রহঃ মুজতাহিদদের উদ্দেশ্য করেই বলেছেন। মুকাল্লিদদের উদ্দেশ্য করে বলেননি। তাই এ অপরিচিত গায়রে মুকাল্লিদের লেখা বইয়ের রেফারেন্স দেয়া বক্তব্যটি দ্বারা ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর পক্ষ থেকে মুকাল্লিদদের তাকলীদ করা নিষিদ্ধ প্রমানিত হয় না।
ধোঁকাবাজী নং-৫ঃ 
 নিশ্চয়ই আমরা মানুষ। আমরা আজকে যা বলি, আগামীকাল তা থেকে ফিরে আসি [ ড. অছিউল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আববাস, আত-তাক্বলীদ
ওয়া হুকমুহু ফী যুইল কিতাব ওয়াস-সন্নাহ, পৃঃ ২০]
এ ধোঁকাবাজীর ব্যাপারেও আমাদের পূর্বোক্ত বক্তব্যটি প্রযোজ্য। তথা আগে হানাফী নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে উক্ত বক্তব্যটি ইমাম আবু হানীফা রহঃ বলেছেন, তা প্রমাণ করতে হবে মূল আরবী ইবারত দিয়ে। তারপর বিশ্বাস হবে যে, আসলেই ইমাম আবু হানীফা রহঃ এমন বলেছেন। নতুবা ফাসেক মিথ্যুকের কথাকে অন্তত আমরা বিশ্বাস করি না।
তারপরও যদি তা ইমাম আবু হানীফা রহঃ থেকে প্রমাণিত করেও, তবুও মুকাল্লিদের কোন সমস্যা নয়। কারণ আমরা জানি যে, মুজতাহিদের ভুল হলেও একটি সওয়াব। আর সঠিক হলে দুটি সওয়াব। সুতরাং মুজতাহিদের যারা মুকাল্লিদ তাদের ঘাবড়ানোর কোন কারণ নেই। ভুল হলেও সওয়াব থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন না। তাই চিন্তার কোন কারণ নেই।
ধোঁকাবাজী নং-৬ঃ
‘আমি যদি আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ওরাসূলুললাহ (ছা:)-এর কথার (হাদীছ) বিরোধী কোন কথা বলে থাকি,তাহ’লে আমার কথাকে ছুঁড়ে ফেলে দিও [ছালেহ ফুল্লানী, ইক্বাযু হিমাম, পৃঃ ৫০]
এখানেও একই কথা প্রযোজ্য। আগে তা হানাফী নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর বক্তব্য প্রমাণ করতে হবে। নতুবা এটি মিথ্যাচার বৈ আর কিছু নয়। যা তাদের মজ্জাগত স্বভাব।
আর যদি প্রমানিত হয়, তাহলে দেখা যাবে, ইমাম সাহেব রহঃ এর বক্তব্যটি মুজতাহিদের জন্য ছিল। গায়রে মুজতাহিদ তথা মুকাল্লিদের জন্য ছিল না। সুতরাং এ বক্তব্যের দ্বারা মুকাল্লিদের ক্ষেত্রে কোন কিছুই প্রমাণিত হচ্ছে না।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
মুফতি লুৎফুর রহমান ফরায়েজী 
পরিচালক- তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার

মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
আচ্ছা তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম এগুলা ভুল। কিন্তু আবু হানিফাকে মানতে কোরয়ানের বা হাদিসের কোন জায়গায় বলা আছে ??? আপনারা ত নবীকে বাদ দিয়ে আবু হানিফা নিয়ে আছেন।

এই সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

ডাউনলোড করুন মাকতাবায়ে শামেলা লেটেস্ট ভার্শন (মোবাইল এবং পিসির জন্য)

রুকইয়াহ আশ-শারইয়্যাহ (ডাউনলোড)

ইসতিখারার সুন্নত তরিকা + pdf