মহিলাদের মসজিদে গমন : একটি পর্যালোচনা

জমহুর আলিমগণ একমত যে, মহিলাদের মসজিদে সালাত আদায় করা অপেক্ষা ঘরে সালাত আদায় করা উত্তম। এ ব্যপারে বেশ কয়েকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে সহিহ সনদে । এর বিপরীতে মহিলাদের মসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করার ফজিলত সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না।
হজরত ইবনু উমর রা. রাসুলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণনা করেন,
তোমরা স্ত্রীদের মসজিদে যেতে বারণ করো না। তবে নিজের বাড়িতে সালাত আদায় করা তাদের জন্য সর্বোত্তম। (আবু দাউদ : ৫৬৭, মুসনাদে আহমাদ : ৫৪৬৮, সহিহ ইবনু খুজাইমা : ১৬৮৪)
এ হাদিসটিকে ইমাম নববি (আল-মাজমু', ৪/১৯৭), ইবনু দাকিক (আল-ইকতিরাহ : পৃ.৯১), আহমাদ শাকের (তাহকিকুল মুসনাদ, ৭/২৩৪), নাসিরুদ্দীন আলবানী (সহিহ সুনানু আবি দাউদ, পৃ.৫৬৭) প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ সহিহ বলেছেন। হাদিসটি এব্যাপরে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন যে, নারীদের জন্য মসজিদে সালাত আদায়ের চেয়ে নিজের ঘরে সালাত আদায় করা উত্তম।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. রাসুলু্ল্লাহ সা.-থেকে অন্য একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, যা মহিলাদের মসজিদে সালাত আদায়ের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সা.-এর দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও স্পষ্ট করে তুলে। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন :
নারীদের ক্ষুদ্র কক্ষের নামায বড় কামরার নামাযের তুলনায় উত্তম। ঘরের নির্জন কোণের নামায ক্ষুদ্র কক্ষের নামাযের তুলনায় উত্তম। (আবু দাউদ : ৫৭০, বাজ্জার : ২০৬৩, ইবনু খুজাইমা : ১৬৯০)
ইমাম নববি এ হাদিসটিকে ইমাম মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহিহ বলেছেন। (আল-মাজমু’ : ৪/১৯৮) ইবনু কাসির রহ. এর সনদকে উত্তম বলেছেন। (তাফসিরুল কুরআন : ৬/৪০৬) আলবানী রহ.-ও হাদিসটিকে সহিহ সাব্যস্ত করেছেন। (সহিহ সুনানু আবি দাউদ : পৃ. ৫৭০)
প্রায় কাছাকাছি শব্দযোগে আরও বেশ কয়েকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এ সকল হাদিসে ‘আম’ বা সাধারণভাবে সকল নারীর ক্ষেত্রে এ বিষয়টি সাব্যস্ত করা হয়েছে যে, তাদের জন্য ঘরের নামাজ মসজিদের চেয়ে উত্তম। এসকল হাদিসকে সামনে রেখে জমহুর আলিমগণ একমত, মহিলাদের ঘরে নামাজ পড়া মসজিদে পড়ার চেয়ে উত্তম।
এখন প্রশ্ন হলো, নারীদের মসজিদে গমণ করা কি বৈধ? বৈধ হলে রাসুলুল্লাহ সা. প্রদত্ত এ বৈধতার ধরণ কি? এটি কি শর্তযুক্ত, নাকি শর্তহীন বৈধতা?
একবার উম্মে হুমাইদ রা. রাসুলুল্লাহ সা.-এর নিকট গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল আমি আপনার সাথে নামায আদায় করতে আগ্রহী। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, “আমি জানি তুমি আমার সাথে নামায আদায় করতে পছন্দ করো। কিন্তু তোমার জন্য গৃহের অন্দরমহলে নামায পড়া উত্তম; বড় কামরার তুলনায়। বড় কামরায় নামায পড়া উত্তম বারান্দার চেয়ে। বারান্দা উত্তম তোমার পাড়ার মসজিদের চেয়ে। নিজ পাড়ার মসজিদ উত্তম আমার মসজিদ থেকে।” এ কথা শোনার পর উম্মে হুমাইদ রা. তাঁর গৃহের নির্জন স্থানে একটি নামাযের স্থান বানানোর নির্দেশ দিলেন এবং সেখানেই মৃত্যু পর্যন্ত নামায আদায় করেন। (মুসনাদে আহমাদ : ২৭০৯০, সহীহ ইবনে খুজাইমা : ১৬৮৯)।
হাফেজ ইবনু হাজার আসকালানী রহ. হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। (ফাতহুল বারী : ২/২৯০)
এ হাদিসের নিষেধাজ্ঞাকে কেউ কেউ কেবল উম্মে হুমাইদ রা.-এর সাথে ‘খাস’ করেন। এটি মোটেও শুদ্ধ নয়। কারণ আমরা সহিহ হাদিস থেকে দেখেছি যে, মহিলাদের মসজিদে গমনের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সা.-এর দৃষ্টিভঙ্গিই এমন ছিল। তাহলে এ হাদিসটির হুকুম কেবল তাঁর সাথে খাস হয় কিভাবে! বিভিন্ন বর্ণনায় তাঁর স্বামীর সাথে কোলহের যে ঘটনা পাওয়া যায়, তা এ হাদিসটির প্রেক্ষাপট, তবে এর বিধানকে ‘খাস’ করার মতো কারণ নয়।
কুরআন ও সুন্নাহতে এমন অসংখ্য নজির রয়েছে যে, কোন একটা বিশেষ ব্যাক্তিকে কেন্দ্র করে একটি বিধান বর্ণনা করা হলেও বিধানটি সবার ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য হয়। এক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটেছে। রাসুলুল্লাহ সা.-এর এ নিষেধাজ্ঞাটি কেবল উম্মে হুমাইদ রা.-এর জন্য নয়, বরং সকলের জন্যই প্রযোজ্য। আর এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো অন্যান্য সহিহ হাদিস, যা আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি। এসকল হাদিসে রাসুলুল্লাহ সা. আমভাবে সকল নারীর ক্ষেত্রে মসজিদে সালাত আদায় করাকে উত্তম বলেছেন।
যাহোক, এ হাদিসটি রাসুলুল্লাহ সা.-থেকে বর্ণিত প্রথম হাদিসটির শুরুর অংশের সাথে আপাত দৃষ্টিতে সাংঘর্ষিক মনে হয় (হাদিসটিকে ‘খাস’ গণ্য করা হলেও)। সেখানে তিনি বলেছেন যে, মসজিদে গমন করতে চাইলে নারীদেরকে যেন নিষেধ করা না হয়। অথচ এখানে তিনি নিজেই নিষেধ করছেন। এ বিরোধের সমাধান কি? হজরত আয়েশা রা.-থেকে বর্ণিত একটি আসারে এর সমাধান মেলে। তিনি বলেন :
নারীরা যে অবস্থার সৃষ্টি করেছে তা যদি রাসুলুল্লাহ সা. দেখতেন, তবে বনি ইসরাঈলের নারীদের যেমন নিষেধ করা হয়েছিল, তেমনি এদেরও মসজিদে আসতে নিষেধ করে দিতেন।” (সহিহ বুখারি : ৮৬৯)
এ হাদিসটি এ মাসআলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মূলনীতিকে উপস্থাপন করে। পরবর্তীতে সাহাবি, তাবেয়ি ও ফকিহগণ এ মূলনীতিকেই আকড়ে ধরেছেন। মূলনীতিটি হলো, ‘নারীদের মসজিদের গমনের বৈধতা শর্তসাপেক্ষ। স্থান-কাল-পাত্রভেদে এটি পরিবর্তনশীল।’ তাছাড়া নারীদেরকে মসজিদে যেতে বাধা না দেওয়ার হুকুমটিও ছিল ‘পরামর্শ মূলক’, ‘আদেশসূচ’ নয়। এর প্রমাণ হলো পরবর্তী সাহাবি ও তাবেয়িগণের আমল।
সহিহ মুসলিমে বেশ কয়েকটি সনদে আব্দুল্লাহ ইবনু উমার ও তাঁর পুত্র বিলাল রহ.-এর একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ইবনু উমর রা. তাঁর পুত্রকে হাদিস শোনালেন যে, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর বান্দিদের মসজিদে যেতে বারণ করো না।’ এ হাদিস শুনে বিলাল রহ. বলেন,
আল্লাহর শপথ, আমি অবশ্যই বাঁধা দিবো!
পুত্রের এমন অকপট বক্তব্য শুনে ইবনু উমরা রা. খুব রেগে গিয়েছিলেন এবং তাকে খুব বকাঝকা করেছিলেন। (সহিহ মুসলিম : ৮৭৫)
এ হাদিসে হজরত ইবনু উমর রা.-এর আচরণ থেকে খুব সরল মাসআলা নির্গত করেন কেউ কেউ। অথচ একটি সূক্ষ্ম বিষয় এড়িয়ে যান। ইবনু উমর রা. এর পুত্র বিলাল রহ. ছিলেন একজন তাবিয়ি। উপরন্তু তিনি হজরত উমরের নাতি এবং ইবনু উমরের মত একজন সাহাবির সন্তান। তাঁর পক্ষে এটা কিভাবে সম্ভব হলো যে, তিন রাসুলুল্লাহ সা.-এর নির্দেশ শোনার পরে আল্লাহর নামে শপথ করে তার বিপরীত মত প্রকাশ করলেন! আমাদের মত নগণ্য ইমানদারদের জন্যও তো এটি কল্পনা করা যায় না! তাহলে হজরত উমরের পরিবারে এতটুকু আদব-কায়েদার শিক্ষা ছিল না কি?
বাস্তবতা হলো, আমরা মূল পয়েন্টটা ধরতে পারিনি। বিলাল রহ.-ও রাসুলুল্লাহ সা.-এর এ হাদিসটি থেকে বুঝেছিলেন যে, এটি শর্তযুক্ত বিধান। তাছাড়া মসজিদে যেতে বাধা না দেওয়ার নির্দেশটিও ছিল পরামর্শমূলক, আদেশসূচক নয়। পরবর্তী ফকিহগণও এমনটিই বুঝেছেন। এর প্রমাণ দেখি চলুন।
জমহুর আলিমগণ বলেন, স্ত্রী মসজিদে গমনের অনুমতি চাইলে স্বামী যদি কোন কারণ না থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীকে অনুমতি না দেয়, তাহলে তা হারাম হবে না। অর্থাৎ, স্বামীর জন্য স্ত্রীকে বাঁধা দেওয়া কিংবা নিষেধ করা বৈধ, যদিও কোন কারণ না থাকে। কেউ কেউ অবশ্য কারণ থাকার শর্ত দিয়েছেন। তবে মূল পয়েন্টে সকলেই একমত যে, স্ত্রীকে নিষেধ করার অধিকার রাখেন স্বামী। এটিই মালেকি, শাফেয়ি ও হাম্বলিদের মাজহাব। বিস্তারিত দেখুন— মাওয়াহিবুল জালিল (২/২৫১), আল-মাজমু’ (৪/১৯১), কাশশাফুল কিনায়ি (১/৪৬৯)
ইমাম নববি রহ. বলেন,
স্বামীর জন্য মুস্তাহাব হলো, স্ত্রী মসজিদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তাকে অনুমতি দেওয়া, যদি সে বৃদ্ধ হয়ে যায়। কারণ তার প্রতি আর কোন আকর্ষণ বাকি থাকে না। সে যেমন ফিতনা থেকে নিরাপদ, তেমনি তার থেকেও অন্যরা নিরাপদ। আর যদি স্বামীরা তাদেরকে বাধা দেয়, তবুও তা তার জন্য হারম নয়। এটিই আমাদের অভিমত। বায়হাকি রহ. বলেন, সাধারণ আলিমগণ এমনটিই বলেন। (আল-মাজমু’ : ৪/১৯৯)
এই মতের পেছনে ফকিহগণ যুক্তি দেখিয়েছেন, যদি স্বামীর জন্য অনুমতি প্রদান করা ওয়াজিবই হত, তাহলে স্ত্রীর জন্য তার অনুমতি ব্যাতীতই মসজিদে যাওয়া বৈধ হতো। কারণ তখন তা স্ত্রীর হক সাব্যস্ত হত। অথচ ফকিহগণ এ ব্যাপারে একমত যে, স্বামীর অনুমতি ব্যাতীত স্ত্রীর মসজিদে গমন করা বৈধ নয়।
এবার ফিরে যাই বিলাল রহ.-এর কাছে। তিনি তাঁর স্ত্রীকে মসজিদে যাবার অনুমতি দিবেন না বলে যে তিনি শপথ করেছিলেন, তা কি অপরাধ ছিল? মোটেও না। তিনিও বুঝেছিলেন যে, রাসুলুল্লাহ সা.-এর এ নির্দেশটি মুতলাক নয়, মুকাইয়াদ। আম নয়, খাস। যেমন ইমাম মালেক রহ. বলেন, এ বিধান ছিল কেবল বৃদ্ধ মহিলার জন্য।
এখানে প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে ইবনু উমর রা. রেগে গেলেন কেন পুত্রের উপরে? হয়ত তিনি রাসুলুল্লাহ সা.-এর কথার বিপরীতে কথা বলাটাকে বেয়াদবি মনে করেছেন। এ ধরণের বিভিন্ন নজির হাদিসের গ্রন্থে পাওয়া যায়। যেমন : হজরত আবু হুরায়রা ও ইবনু আব্বাস রা.-এর ঘটনা।
আবু হুরায়রা রা. একবার হাদিস বর্ণনা করছিলেন যে, আগুন স্পর্শ করেছে এমন কিছু ভক্ষণ করলে অজু করতে হবে। ইবনু আব্বাস রা. অকপটে জবাব দিলেন, গরম পানি খেলে কিংবা তেল মালিশ করলেও অজু করতে হবে তাহলে? আবু হুরায়রা রা. রেগে গিয়ে বললেন, ‘ভাতিজা, আমি যখন তোমার নিকটে রাসুলুল্লাহ সা.-থেকে কোন হাদিস বর্ণনা করি, তখন এর বিপরীত কোন উদাহরণ পেশ করবে না।’ (ইবনু মাজাহ : ২২)
খেয়াল করুন, এখানে ইবনু আব্বাস রা.-এর প্রশ্নে কোন ত্রুটি ছিল না। এটি সম্পূর্ণ যৌক্তিক প্রশ্ন। পরবর্তীতে ফকিহগণও এ প্রশ্ন উত্থাপন করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, আগুনে স্পর্শকৃত বস্তু ভক্ষণের কারণে অজু আবশ্যক হয় না। তাহলে আবু হুরায়রা রা. রেগে গেলেন কেন? বস্তুত এটি ছিল রাসুলুল্লাহ সা.-এর প্রতি তাঁদের একান্ত ভালোবাসার প্রভাব। তাঁরা রাসুলুল্লাহ সা.-এর বিপরীতে কোন কথাকে বরদাস্ত করতে পারতেন না।
এমন অনেক ঘটনা হাদিসের ভাণ্ডার খুঁজলে পাওয়া যাবে। হজরত ইবনু উমর রা.-এর ক্ষেত্রে হয়েছে। হাদিসের বিপরীতে সন্তানের আশু জবাবকে তিনি সৈহ্য করতে পারেননি। আর তিনি নিজেও মহিলাদের মসজিদে গমণ করা পছন্দ করতেন না। এ ব্যাপারে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহ. তাঁর সহিহ বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, জুমআর দিনে দিনে মহিলারা মসজিদে এলে তিনি নুড়ি পাথর নিক্ষেপ করে তাদেরকে বের করেতেন। (উমদাতুল কারী : ৬/১৫৭)
ইবনু আবি শাইবা রহ. তাঁর মুসান্নাফে ইবনু মাসউদ রা. সম্পর্কেও এমন ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনিও মহিলাদের নুড়ি পাথর মেরে মসজিদ থেকে জুমআর দিনে মহিলাদের বের করে দিতেন। (মুসান্নাফে ইবনু আবি শাইবা : ৭৬১৭)
এসকল ঘটনায় মূলত পাথর মারা বলতে আঘাত করা উদ্দেশ্য নয় বরং ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া উদ্দেশ্য। এভাবে অন্যান্য সাহাবি থেকেও নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। তাবিয়িগণের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়।
ইবরাহিম নখয়ী রহ.-এর তিনজন স্ত্রী ছিল, তিনি কাউকেই জামাআত কিংবা জুমআর জন্য বের হতে দিতেন না। (মুসান্নাফে ইবনু আবি শাইবা : ২/২৭৭)
হজরত হাসান বসরি রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন মহিলা যদি এই শপথ করে যে তার স্বামী কারামুক্ত হলে সে বসরার সকল জামে মসজিদে দুই রাকাত করে নামাজ আদায় করবে, তাহলে এর বিধান কি? তিনি বললেন,
সে কেবল তার নিজের কওমের মসজিদেই নামাজ আদায় করে নিবে। কেননা তার জন্য এ শপথ প্রযোজ্য হবে না। হজরত উমর রা. যদি তাকে পেত, তাহলে তার মাথায় আঘাত করত। (মুসান্নাফে ইবনু আবি শাইবা : ২/২৭৭, উমদাতুল কারী : ৬/১৫৭)
মোটকথা, অনেক সাহাবি ও তাবিয়িগণের আমল থেকে স্পষ্ট হয় যে, মহিলাদের মসজিদে গমনে বাধা না দেওয়ার নির্দেশকে তাঁরা ‘আবশ্যক’ অর্থে গ্রহণ করেননি, বরং সাধারণ পরামর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তা নাহলে কখনোই কোন সাহাবি কিংবা তাবিয়ির পক্ষে মসজিদে গমণ করতে নিষেধ করা কিংবা মসজিদ থেকে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হত না। আমরা পেছনের আলোচনায় দেখেছি, জমহুর আলিমগণও এ নিষেধাজ্ঞাকে ‘আবশ্যক’ অর্থে গ্রহণ করেননি।
হজরত আয়েশা রা.-এর হাদিসটিও স্পষ্ট নির্দেশ করে যে, মহিলাদের মসজিদে প্রবেশের অনুমতি ছিল শর্তযুক্ত, যা স্থান-কাল-পাত্র ও অবস্থাভেদে পরিবর্তীত হতে পারে। তাছাড়া মসজিদে গমনের অনুমতি এবং বাধাদানে নিষেধ সম্বলিত হাদিসগুলোর উদ্দেশ্য কি, তা নিয়েও আলিমগণ মতভেদ করেছেন। যেমন : ইমাম মালেক রহ.সহ একদল ফকিহ বলেন যে, এসকল হাদিসের উদ্দেশ্য কেবল বয়স্ক-বৃদ্ধ নারী, যারা ফিতনার আশঙ্কামুক্ত। (উমদাতুল কারী : ৬/১৫৭)
এ মুহুর্তে আমাদেরকে আরেকটি গ্ররুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সমাধান দিতে হবে। রাসুলুল্লাহ সা.-এর মুখে সুস্পষ্টভাবে ঘরের নামাজ উত্তম শোনার পরেও কিছু কিছু মহিলা সাহাবি মসজিদে যেতেন কেন? এই প্রশ্নটি আরও গভীর শোনাবে যদি ইবনু উমর রা.-এর হাদিসটিকে সামনে রাখি—‘তোমরা স্ত্রীদের মসজিদে যেতে বারণ করো না। তবে নিজের বাড়িতে সালাত আদায় করা তাদের জন্য সর্বোত্তম।’ এ হাদিসের প্রথম অংশকে আপাতদৃষ্টিতে দ্বিতীয় অংশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয় না। অনুত্তম হওয়া সত্ত্বেও কেন পুরুষরা নারীদের বাধা দিবে না?

আমরা জানি, শরিয়ার কোন বিধানই অন্যটির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। পুরুষ নারীর অভিভাবক এবং তার কল্যাণ কামনার দ্বায়িত্ব তার উপরে ন্যাস্ত। তাহলে কেন সে অধিনস্তকে একটি অনুত্তম কাজ থেকে বিরত রাখবে না? আর রাসুলুল্লাহ সা. কিভাবে এমন একটি পরামর্শ দিতে পারেন? তাছাড়া রাসুলুল্লাহ সা. সর্বদা উত্তম আদর্শকে ধারণ করেছেন। তাহলে কেন তিনি অনুত্তম হওয়া সত্ত্বেও মহলিাদেরকে মসজিদে যেতে বারণ করেননি?

রাসুল্লাহ সা.-এর সাহাবিগণ সর্বদা ফাজায়েলের সন্ধান করতেন। রাসুলুল্লাহ সা.-এর মুখ থেকে বেড়িয়ে পড়া মাত্র তাঁরা আমল করতে ঝাপিয়ে পড়তেন। তাহলে বাড়িতে নামাজ উত্তম জানা সত্ত্বেও কেন তারা মসজিদে গমণ করতেন? এসকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া অত্যন্ত জরুরী। তা নাহলে এ বৈধতার প্রকৃতি ও কারণ সম্পর্কে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হবে।
ইবনু উমরের হাদিসে ফিরে যাই—সেখানে দুটি অংশ পাবো আমরা। একটি হলো, ‘মসজিদে গমন করতে নিষেধ করো না’, আরকেটি অংশ ‘বাড়িতে সালাত তাদের জন্য উত্তম’। এই দুটি অংশে মনোযোগ দিতে হবে। বাড়িতে সালাত উত্তম হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা মসজিদে যেতেন—এ থেকে বুঝা যায়, তাঁদের মসজিদের গমনের পেছনে নামাজ ছাড়াও অন্যকোন উদ্দেশ্য ছিল। তাছাড়া রাসুলুল্লাহ সা. বাড়িতে সালাত উত্তম হওয়া সত্ত্বেও যে তাঁদেরকে বাধা দিতে নিষেধ করেছেন, এর কারণও এটিই। শুধু নামাজ পড়া ছাড়াও এতে অন্য উপকার ছিল। উপকারটা কি? রাসুলুল্লাহ সা.-এর সোহবত।
রাসুলুল্লাহ সা. ছিলেন সাহাবিগণের সর্বোচ্চ মোটিভেশন। তাঁর মুবারক চেহারা দর্শন করাই ছিল তাঁদের ঈমানকে শাণিত করার জন্য যথেষ্ট। হাদিসেরে ভাণ্ডারে এর অসংখ্য নজির রয়েছে।রাসুলুল্লাহ সা.-এর কাতিব হানজালা আল-উসাইদী রা.-থেকে এমন একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন :
একবার আবু বকর সিদ্দীক রা. আমার সঙ্গে দেখা করলেন এবং আমাকে প্রশ্ন করলেন, হানজালাহ, তুমি কেমন আছ? জবাবে আমি বললাম, হানজালাহ্ তো মুনাফিক হয়ে গেছে। সে সময় তিনি বললেন, সুবহানাল্লাহ তুমি কি বল্‌ছ? আমি বললাম, আমরা রসূলুল্লাহ সা.- এর কাছে থাকি, তিনি আমাদের জান্নাত জাহান্নামের কথা শুনিয়ে দেন, যেন আমরা উভয়টি চাক্ষুষ দেখছি। সুতরাং আমরা যখন তাঁর নিকট থেকে বের হয়ে স্ত্রী-পুত্র এবং ধন-সম্পদের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে যাই, তখন আমরা এর অনেক বিষয় ভুলে যাই। এ কথা শুনে আবু বকর রা. বললেন, আল্লাহর কসম আমারও একই অবস্থা। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং : ২৭৫০)
বিভিন্ন হাদিসে দেখা যায়, মহিলারা আক্ষেপ করতেন যে, পুরুষরা ইবাদতের ক্ষেত্রে এগিয়ে রাসুলুল্লাহ সা.-এর অধিক সাহচার্যের কারণে। এজন্য রাসুলুল্লাহ সা. মহিলাদেরকে মসজিদে গমণে বাধা দিতে নিষেধ করেছেন। তিনি চাইতেন যে, তাঁর সাহচার্যের মাধ্যমে মহিলাদেরও উপকার হোক, তাদেরও ঈমানের শক্তি বৃদ্ধি পাক। তাছাড়া আরেকটি উপকার ছিল, মহিলারা মসজিদে গেলে কুরআন শোনার সুযোগ পেত। সাধারণত তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই কুরআনকে পুরোপুরি হিফজ করেছিলেন। তাই কুরআন শ্রবণের সুযোগ ছিল না খুব বেশি। মসজিদে সালাত আদায়ের মাধ্যমে এ সুযোগ হত তাদের।
এ ব্যাপারে শক্ত সমর্থন পাওয়া যায় উম্মে আতিয়্যা রা.-এর হাদিস থেকে। তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন কুমারী, তরুণী, প্রাপ্তবয়স্কা, পর্দানশিন এবং ঋতুবতী সব মহিলাদের বের হওয়ার হুকুম করতেন। ঋতুবতী মহিলারা নামাযের জামা'আত হতে এক পাশে সরে থাকতো কিন্তু তারা মুসলিমদের দু'আয় শারীক হত। এক মহিলা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! যদি কোন নারীর নিকট চাদর না থাকে? তিনি বললেন, তার (মুসলিম) বোন তার অতিরিক্ত চাদর তাকে ধার দিবে। (সুনানুত তিরমিজি : ৫৩৯)
এ হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, মহিলাদের জন্য মসজিদে বা ঈদগাহে যাওয়ার যে অনুমতি ছিল তার মৌলিক উদ্দেশ্য সালাত আদায় করা ছিল না। যদি তাই হত, তাহলে ঋতুবতী নারীদেরকে ঈদগাহে যাওয়ার আদেশ করেছেন কেন? মূল উদ্দেশ্য ছিল রাসুলুল্লাহ সা.-এর সাহচর্য লাভ করা, তাঁর মুবারক মুখ থেকে নসিহা শ্রবণ করা এবং তাঁর দুআয় শরীক হওয়া।
রাসুলুল্লাহ সা.-এর ওফাতের পরে মসজিদে গমনের মাধ্যমে এই বাড়তি উপকার লাভ করার আর সুযোগ ছিল না। তাই মহিলাদের মসজিদে গমন করাটা ‘নিছক অনুত্তম’ কাজে পরিণত হয়। এর পরে সময় বাড়তে থাকলে অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ফিতনার আশঙ্কা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এজন্য এ বিষয়টি সম্পর্কেও সাহাবা-তাবেয়িগণ নতুন করে ভাবতে থাকেন। এজন্য মাসআলায় বিবর্তন আসতে থাকে।
এই মাসআলার ক্ষেত্রে চারটি ধাপ চিহ্নিত করা যায়—
  • রাসুলুল্লাহ সা.-এর মুবারক যুগ
  • রাসুলুল্লাহ সা.-এর ওফাতের নিকটতমযুগ
  • সাহাবাগণের শেষ যুগ ও তাবেয়িগণের যুগ
  • মুতাআখখিরীন ফকিহদের যুগ
আমরা দেখেছি, রাসুলুল্লাহ সা. তাঁর যুগে নারীদেরকে শর্তযুক্ত অনুমতি দিয়েছিলেন মসজিদে যাওয়ার জন্য। পাশাপাশি এও জানিয়ে দিয়েছেন যে, তোমাদের জন্য বাড়িতে নামাজ উত্তম। অর্থাৎ, শুধু নামাজের বিচারে ঘরই উত্তম, মসজিদে আসার দরকার নেই। রাসুলুল্লাহ সা.-এর সাহচার্য ও পূর্বে বর্ণিত কারণগুলোর জন্য অনেক মহিলা সাহাবা মসজিদে আসতেন। স্বামীরাও তাদেরকে সাধারণত বাধা দিতেন না।
রাসুলুল্লাহ সা.-এর ওফাতের পরে দৃশ্যপটে কিছুটা পরিবর্তন আসে। শুরু হয় দ্বিতীয় যুগের। তখন হজরত উমর রা.-এর মত বিজ্ঞ সাহাবিও স্ত্রীদের জন্য মসজিদে গমন করা পছন্দ করতেন না। তাঁরা স্ত্রীদের মৌখিকভাবে নিষেধ করতেন তবে ফিতনার প্রকোপ ব্যাপক না হওয়ায় কারণে বাধা দিতেন না, কিংবা এ নিষেধাজ্ঞা জোড়ালো ছিল না। তবে তাঁদের অপছন্দের ব্যাপারটি ছিল সাধারণের মধ্যেও প্রসিদ্ধ।
সহিহ বুখারিতে ইবনু উমর রা.-থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, উমর রা.-এর স্ত্রী ফজর ও ইশার নামাজের জামাতে মসজিদে উপস্থিত হতেন। তাঁকে বলা হল, আপনি জানেন যে, উমর রা. আপনার মসজিদে আসাকে অপছন্দ করেন এবং মর্যাদা হানিকর মনে করেন, তাহলে কেন আপনি মসজিদে আসেন? তিনি বললেন, তাহলে উমর স্বয়ং কেন আমাকে বাধা দিচ্ছে না? তাঁকে বলা হল, তাঁকে বাধা দেয় রাসুলুল্লাহ সা.-এর বাণী—‘তোমরা আল্লাহর বান্দিদের মসজিদে যেতে বারণ করো না?’ (সহিহ বুখারি : ৯০০)
আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানি লিখেছেন,
উমর রা. তাঁর স্ত্রীকে বলতেন, ‘আল্লাহর শপথ, তুমি জানো যে আমি তোমার এ ব্যাপারটি পছন্দ করি না। স্ত্রী বলতেন, আল্লাহর শপথ, আপনি আমাকে নিষেধ না করলে মসজিদে যাওয়া বন্ধ করবো না।’ (ফাতহুর বারি : ২/৪৪৫-৪৪৬)
হজরত উমর রা. অপছন্দ করা সত্ত্বেও তাঁকে বাধা না দেওয়ার কারণ হলো, আতিয়্যা রা. বিয়ের সময়েই শর্ত করেছিলেন যে, তাঁকে মসজিদে যেতে বাধা প্রদান করা হবে না। এ প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে তিনি বাধ্য ছিলেন, তাই তাঁকে নিষেধ করতে পারছিলেন না। (মুফতি তাকি উসমানি, ইনআমুল বারী : ৪/৮১) তাছাড়া উমর রা.-এর অন্য কোন স্ত্রীর ব্যাপারে মসজিদে গমনের বর্ণনা পাওয়া যায় না।
হজরত উমর রা.-এর এই অপছন্দকে নিছক ‘ব্যাক্তিগত গায়রত’ হিসেবে ব্যাখ্যা করাটা মোটেও যৌক্তিক নয়। কারণ ইসলামের পছন্দ-অপছন্দকেই তাঁরা ব্যাক্তিগত রুচিতে পরিণত করে নিয়েছিলেন। মসজিদে স্ত্রীদের গমনের মধ্যে যদি বিন্দুমাত্র কল্যাণ অবশিষ্ট থাকত, তাহলে তা অপছন্দ করতে কিংবা ‘আমি পছন্দ করি না’— মুখ ফুটে একথা উচ্চারণ করতে পারতেন না হজরত উমরের মতো এত কট্টর মানুষ। তাঁর ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সা.-এর বাণীটিও স্মরণ রাখুন—
‘আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে কট্টর হলো উমর।’ (তিরমিজি : ৩৭৯০, ইবনু মাজাহ : ১৫৪)
হজরত উমরের মৃত্যুর পরে, বিশেষ করে উসমান রা.-এর খিলফতের শেষ দিকে এসে ফিতনা ব্যাপকরূপ লাভ করে। মানুষের মধ্যে তাকওয়ার পরিমাণ হ্রাস পায় আগের যুগের তুলনায়। তখন আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদসহ অন্যান্য অনেক সাহাবি মহিলাদের মসজিদে আসতে নিষেধ করেন। কেউ মসজিদে আসলে তাদেরকে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিতেন। কখনও কখনও নুড়িপাথর নিক্ষেপ করে তাড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসকল হাদিসগুলো ইবনু আবি শায়বা রহ. তাাঁর মুসান্নাফ গ্রন্থে পৃথক একটি অনুচ্ছেদে সংকলন করেছেন।
এসময়ে মহিলাদের জন্য মসজিদে গমন করাকে অনেক সাহাবি ও তাবেয়ি মাকরুহ হিসেবে গণ্য করতেন। তবে এ মাকরুহ ছিল ‘তানজিহি’ অর্থে, ‘তাহরিমি’ অর্থে নয়। এটি ছিল এ মাসআলার ক্ষেত্রে তৃতীয় যুগ। তখন ইমামগণ বয়স্ক-বৃদ্ধ মহিলাদেরকে ফজর, মাগরিব ও ইশার নামাজের জন্য মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দিতেন। কারণ এসময়টা নিরাপদ ছিল। এটা ছিল ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মাজহাব। সাহেবাইন রহ. অবশ্য বৃদ্ধাদের জন্য সব ওয়াক্তেরই অনুমতি দিয়েছিলেন। কারণ বৃদ্ধাদের প্রতি সাধারণত আকর্ষণ থাকে না মানুষের। আর মহিলাদের এ অনুমতির মূল উদ্দেশ্য ছিল সংখ্যাধিক্য দেখানো। (উমদাতুল কারী : ৬/১৫৬) ইমামগণের এই ফতোয়ার দীর্ঘদিন বলবত ছিল।
এর পরে আসে এ মাসআলার চতুর্থ যুগ। নারী-পুরুষ উভয়ের চরিত্রের ব্যাপক পদস্খলন, অনিরাপত্তা বৃদ্ধি পাওয়া এবং নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও এর ক্ষতিকর দিকগুলো যখন সামনে আসে, তখন এ মাসআলা আরও জটিলরূপ ধারণ করে। পরবর্তী ফকিহগণ-বিশেষত আহনাফ-নারীদের বিনা প্রয়োজনের জামাতে শরীক হওয়ার উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন করাকে মাকরুহ তাহরিমি বলে ফতোয়া প্রদান করেন।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহ. বলেন,
‘আমাদের সঙ্গিরা বলেছেন, তাদের বের হওয়ার দ্বারা ফিতনার ভয় রয়েছে। অতএব, এটি হারাম হওয়ার কারণ হবে। কেননা যা হারামের দিকে নিয়ে যায়, তা নিজেও হারাম। এজন্য এখানে ‘মাকরুহ’ অর্থ হবে তাহরিমি, বিশেষ করে আমাদের এই যুগের জন্য, যখন মানুষের চারিত্রিক পদস্খলন চূড়ান্ত সীমায় পৌছে গেছে। (উমদাতুল কারী : ৬/১৫৬)
এটিই বর্মান সময়ের জন্য গৃহীত আহনাফের সর্সম্মত মত। (রদ্দুল মুহতার : ২/৩০৭)
মনে রাখতে হবে, এই মাসআলার ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো, স্থান-কাল-পাত্রভেদে এর পরিবর্তনশীলতা। যারাই এ মাসআলা সম্পর্কে কলম ধরেছেন, তারাই এ বিষয়টিকে সামনে রেখেছেন। পাশাপাশি প্রায় সকলেই ‘ফিতনার আশংঙ্কা’কে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিয়েছেন।
ফিতনার আশঙ্কাকে মাথায় রেখেই কেউ শুধু বৃদ্ধাদের অনুমতি দিয়েছেন, কেউে কেউ আবার কাউকেই অনুমতি দেননি। কেউ সাধারণভাবে মাকরুহ বলেছেন, কেউ হারাম অর্থে মাকরুহ বলেছেন। তবে সকল মাজহাবের পূর্ববর্তীদের চেয়ে পরবর্তী ফকিহগণ অপেক্ষাকৃত বেশি কঠোরতা দেখিয়েছেন। কারণ আমরা আগেই বলেছি, এ মাসআলার মূল ফোকাসটি যুগের পরিবর্তন ও ফিতনার আশঙ্কার দিকে।
এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে এখন আমাদের দেশ কিংবা উপমহাদেশের অবস্থা বিবেচনা করুন। এখানে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধর্ষণ। রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির, মাদরাসা—কোথাও বাকি নেই। ছোট ছোট শিশু পর্যন্ত মক্তবে পড়তে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। মাদরাসাগুলো পর্যন্ত লাওয়াতাতের অভিযুগে অযিুক্ত হচ্ছে। পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ছে বন্ধু বান্ধবীকে, শিক্ষক ছাত্রীকে, পথচারী পথচারীকে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বিচার প্রত্যাশীকে, এমনকি পিতা কন্যাকে ধর্ষণ করছে। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।
শহরের স্কুলগুলোর সামনে দীর্ঘ অভিভাবকের লাইন। তাদের এতটুকু ভরসা নেই যে মেয়েকে একা স্কুলে পাঠাবে! এর বাইরেও আছে নারী-পুরুষ উভয়ের মিউচুয়াল হারাম সম্পর্ক। অবস্থা এতদূর গড়িয়েছে যে জামাই শাশুড়ি নিয়ে ভেগে যাচ্ছে। শ্বশুর পুত্রবধুর সাথে সম্পর্ক করে সন্তানের হাতে খুন হচ্ছে। ওয়াল্লাহি, চৌদ্দশো বছরে মুসলিম উম্মাহ কখনোই এমন সংকটে পতিত হয়নি। এই অবস্থায় মহিলাদের নামাজের জন্য মসজিদে যাওয়ার অনুমতির প্রশ্ন উত্থাপন করাটা নিতান্তই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত, অন্তত ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য।
শরিয়ার একটা মূলনীতি হলো, সাদ্দুজ জারায়ি। অর্থাৎ, ক্ষতির পথকে রুদ্ধ করতে হবে। এই মুলনতি আমরা পেছনে উল্লেখ করেছি, যা হারামের দিকে নিয়ে যায়, তা নিজেও হারাম। বস্তুটি সত্তাগত হারাম নাও হতে পারে। যেমন : হারবী কাফেরদের নিকটে লোহা বিক্রয় করাকে হারাম বলেছেন আলিমগণ। এই ক্রয়-বিক্রয় হারাম হয়েছে ফলাফলের বিবেচনায়, অথচ এটি সত্তাগত হারাম নয়। একই মূলনীতিকে সামনে রেখে আলিমগণ সহশিক্ষাকে হারাম বলেন। একই মূলনীতিতে বর্তমান সময়ের জন্য মহিলাদের জন্য মসজিদে গমনের বিষয়টি নিষিদ্ধ সাব্যস্ত হবে। কারণ এখন মসজিদে মহিলাদের নিয়ে আসার অর্থ হলো, রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজের ধর্ষণকে টেনে মসজিদে নিয়ে আসা। অথচ মহিলাদের মসজিদে আসার কোন ফজিলত নেই, তাদের ঘরের নামজ যে উত্তম, এ ব্যাপারে সকল মাজহাবের জমহুর আলিমগণ একমত।
কুরআনুল কারিমের সাথে আহনাফের এই মতটিই অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘তোমরা নিজের ঘরেই অবস্থান করবে।’ (সুরা আহজাব : ৩৩)
এ আয়াতটির অর্থ দাঁড়ায়, নারীর আসল অস্থান ক্ষেত্র হলো তার গৃহ। শুধুমাত্র শরয়ি প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সে ঘর থেকে বের হকে পারে। (ইবনু কাসির, তাফসিরে মুয়াসসার)
এখান্যে লক্ষ্যনীয় যে, নারীর মসজিদে সালাত আদায় করার ব্যাপারে কোন ফজিলত বর্ণিত হয়নি। বরং হদিসের ভাষ্যমতে এটি অনুত্তম কাজ। কাজেই নারী যদি শুধু নামাজের উদ্দেশ্যে বের হয়, তাহলে এটি হবে অনর্থক কাজের জন্য বের হওয়া, যা শরয়ি প্রয়োজন নয় মোটেও। কাজেই তার বাইরে যাওয়া বৈধ হবে না।
হাদিসে নববির ভাষ্যে এটি আরও পরিষ্কার হয়। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন,
যখন সে বের হয়, শয়তান তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে এবং তখনই সে আল্লাহর রহমতের নিকটবর্তী হয়, যখন সে নিজের গৃহে অবস্থান করে। (সহিহ ইবনু খুজাইমা : ১৬৮৫, সহিহ ইবনু হিব্বান : ৫৫৯৯)
কুরআন-সুন্নাহর বর্ণনা, সাহাবি-তাবেয়ি ও আয়িম্মায়ে মুজতাহিদিন এর চিন্তা, শরিয়ার মূলনীতি এবং আমাদের সমাজের বাস্তবচিত্রকে সামনে রেখে দেখুন এই মাসআলায় আহনাফের মাজহাবটি কত শক্তিশালী এবং বিপরীত মতগুলো কতটা দূর্বল।
পুনশ্চ : শরাঞ্চলের মসজিদগুলো নারীদের জন্য নামাজের ব্যাবস্থা রাখার মাসআলাটি ভিন্ন। এ ব্যাপারে আলিমগণ সুপারিশ করেন। কেননা, এটি জরুরতের অন্তর্ভূক্ত। এ ব্যবস্থা না থাকলে অনেক নারীদের নামাজ কাজা হবে।
.
------------------ 
লিখেছেনঃ  মুজাজ্জাজ নাঈম

মন্তব্যসমূহ

এই সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

ডাউনলোড করুন মাকতাবায়ে শামেলা লেটেস্ট ভার্শন (মোবাইল এবং পিসির জন্য)

রুকইয়াহ আশ-শারইয়্যাহ (ডাউনলোড)

ইসতিখারার সুন্নত তরিকা + pdf