সালাফের সালাত, ধ্যানমগ্নতার কিছু ঘটনা

১- আবু যুরয়া আর রাযী! বিখ্যাত ইমাম। ইমাম মুসলিম, তিরমিজী, নাসায়ীর উস্তাদ তিনি। ইমাম যাহাবীর ভাষায়, "সায়্যিদুল হুফফাজ"! বায়হাকী ইমাম আহমদ থেকে বর্ণনা করেন, 'আবু যুরয়া ছয় লাখ হাদিসের হাফেজ"! (১)

আবু যুরয়া রাজী এক মসজিদের ইমাম। নামাজ পড়াচ্ছেন, ২০ বছর যাবত। একদিন তার কাছে কিছু মুহাদ্দিস আসলেন হাদিসের দরস নিতে। নামাজ শেষ হলো। তারা প্রশ্ন করলেন,

- আচ্ছা শায়েখ! নামাজরত ব্যক্তির সামনে মেহরাবে কোন কিছুর লেখার ব্যাপারে আপনার রায় কী?
- এটাকে আমি অপছন্দ করি। পূর্ববর্তীরাও অপছন্দ করতেন।
- কিন্তু শায়েখ, আপনার মেহরাবে যে কিছু বাক্য লেখা রয়েছে।
- সুবাহানাল্লাহ! আমি তো জানিই না।
-আশ্চর্য! এখানে আপনি এতবছর নামাজ পড়ছেন, তবুও দেখেন নি?
- ইমাম আবু যুরয়া বললেন "সুবাহানাল্লাহ! এটা কীভাবে সম্ভব যে বান্দা আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে, আবার তার সামনে কী লেখা আছে সেটাও দেখবে।"

এরপর ছাত্ররা জিজ্ঞেস করলেন,
- নামাজে এই খুশু খুজু নিশ্চয় বিশর বিন হারেস ও আহমদ বিন হানবলের সান্নিধ্যের বরকতে হয়েছে?
ইমাম রাজী উত্তর দিলেন- না! বিশর ও আহমদ বিন হানবল উম্মাহর ইলমের সর্দার নিঃসন্দেহে। কিন্তু আমি তাদের থেকে এটা পাই নি। বরং একজন দুনিয়াত্যাগী সুফীর সোহবতের বরকতে হয়েছে। দীর্ঘদিন আমি যার সান্নিধ্যে থেকেছি। তার কাছে নামাজের ধ্যান আমার হাসেল হয়েছে (২)

এই ছিল সালাফে সালেহীন এর সালাতের নমুনা। তারা নামাজে দাঁড়ালে দুনিয়ার কোন কথা, কাজ কল্পনা কোন কিছুই মনে আসত না। কীভাবে এই নামাজ শিখলেন? কিতাব পড়ে তো নামাজের পদ্ধতি জানা যায়। কিন্তু নামাজের প্রাণ ও খুশু আসে 'সান্নিধ্য' অর্জনের মাধ্যমে। 'আহলে আমল' যারা আছেন, তাদের মজলিসে উপস্থিত হওয়ার মাধ্যেম। সালাফের সালাতে মনযোগের আরো কিছু উদাহরণ :-

২- সাইদ ইবনে জুবাইর রহ, যখন নামাজ পড়তেন, তখন মনে হত যেন একটা লোহার পেড়েক স্থির হয়ে আছে। এমন ঘটনাও ঘটেছে, ইবরাহীম তাইমী রহ, সেজদা করছেন। আর পিঠে চড়ুই এসে বসে রয়েছে। যেন একটা খড়ি! কোন নড়াচড়া নেই, পূর্ণ মনযোগে সালাত আদায় করছেন। (৩)

৩- দাউদ তায়ী সালাত আদায় করছেন, হঠাৎ মসজিদের ছাদের একাংশ খসে পরল। ঠিক তার পাশেই। বর্ণনাকারী আবু খালেদ বলেন, আমি দেখলাম, তিনি একদমই টের পান নি। ঠিক তেমনই স্থির আছেন খসে পরার আগে যেমন ছিলেন। (৪)

৪- মুসলিম ইবনে ইয়াসার ঘরে নামাযে মগ্ন। হঠাৎ তার খুব কাছ দিয়ে আগুন লেগে গেল। লোকজন হইচই শুরু করল, কিন্তু তিনি নামাজেই ধ্যানমগ্ন। অনুভবই করেন নি আগুনের উত্তাপ! শেষপর্যন্ত লোকজন আগুন নিভিয়ে ফেলল।
তিনি তার পরিবারকে বলতেন, "আমি নামাজে দাঁড়িয়ে গেলে, তোমরা তোমাদের প্রয়োজনের কথাবার্তা বলতে পারো।" কারণ নামাজে দাঁড়ানোর পর তিনি আর শুনতে পাবেন না। (৫)

৫- ইমাম বুখারীর বুখারী থেকে সালাতে হাত তোলা, জোরে আমীন বলা নিয়ে তর্কবিতর্ক তো কম হয় নি। অথচ নামাজে অমনোযোগিতা, আলসেমি গাফলতি এটা নিয়ে কাংখিত পরিমাণে আলোচনা আমাদের মাঝে হয় না।
একরাতে ইমাম বুখারী সালাত আদায় করছেন। ভীমরুল এসে তার কানে ১৭ বার দংশন করল। অথচ তিনি অনুভবই করেন নি। নামাজ শেষে হঠাৎ তার মনে হলো, তার কানে হয়ত কিছু লেগেছে। বললেন "দেখো তো, আমার কানের কী হয়েছে?"! (৬)

৬- ইমাম মোহাম্মদ বিন খাফীফ! ইলম ও আমল আর আ'লা সনদের কারণে ইতিহাসে স্মরণীয়! ইমাম যাহাবীর ভাষায় "আশ শায়খুল ইমামুল আরেফ, আল ফকীহুল কুদওয়াহ, যুল ফুনুন"! সালাফের মধ্যে যারা দুনিয়াত্যাগী সুফী ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব।
একদিন তিনি কোমরে সাংঘাতিক ব্যাথা পেলেন। উঠে দাঁড়াতে গেলেই বসে পড়েন। এরপরেও যখন আযানের ধ্বনি ভেসে আসে, কারো কাধে চড়ে মসজিদে যান। জামাতের সাথে সালাত আদায় করেন।
একবার তাকে বলা হলো, 'আপনি নিজের প্রতি একটু যত্ন নেন। এভাবে কষ্ট করছেন কেন? তার উত্তর ছিল...
"যখন তোমরা 'হাইয়া আলাস সালাহ' শুনতে পাবে, অথচ দেখবে যে আমি কাতারে উপস্থিত নই। তখন তোমরা আমাকে গোরস্তানে তালাশ করো!" (৭)


তথ্যসূত্র -
১- তারীখে দিমাশক- ৩৮/২০, তাহযীবুত তাহযীব ৭/৩৩, মাগানীয়ুল আখইয়ার- ২/২৭৮, আল মু'লিম বিশুয়ুখিল বুখারী ও মুসলিম ৩৯৩
২- সিফাতুস সাফওয়াহ, ৪/৮৯, তারিখে দিমাশক ৩৮/৩২ আদ দুয়াফা লি আবু যুরয়া মুকাদ্দামা- ১/২৭৩,
৩- হিলইয়াহ- ৪/২১২, একই ঘটনা রাবী' বিন খুছাইম, সাল্লাম বিন মুতী রহ. এর ক্ষেত্রেও ঘটেছে। (৬/১৮৮, ২/১১৪)
৪- হিলইয়া ৭/২৫৮
৫- আযযুহদ লি আহমদ- ৩০৪
৬- সিয়ার- ১২/৪৪১
৭- সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৬/৩৪২, তাবাকাতুস সুফীয়া ৪৬২।

*****
ইমাম মোহাম্মদ বিন খাফীফ শায়খুস সুফীয়া হিসেবে প্রসিদ্ধ। ইলম ও আমল এবং হাদিস ও ফিকহের এতটা সমন্বয় অন্য কারো মধ্যে ঘটে নি। তার জীবনী জানতে পড়ুন, আল কামেল ফিত তারীখ ৯/১৬, তাবাকাতুস সুফীয়াহ, ১৮৩, ৪৬২, আল ওয়াফী বিল ওয়াফায়াত, ৩/৪২, তাবাকাতুশ শাফেয়িয়াহ ২/১৫০, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১১/২৯৯, তাযকেরাতুল হুফফাজ ৩/৯৫০। মহান এই বুজুর্গ ৩৭১ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।
*****
ইমাম আবু যুরয়ার ইন্তেকাল এর ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। ২৬৪ হিজরী! ইন্তেকালের আগ মুহুর্তে, মৃত্যুশয্যায় শায়িত তিনি। বড় বড় আলেম, সুলাহা ফুকাহারা জমায়েত হলেন তার পাশে। হাদিসে ভাষ্য অনুযায়ী, মরণাপন্ন ব্যক্তিকে কালেমার তালকীন করতে হয়। কিন্তু এত বড় ব্যক্তিত্বকে তালকীন করতে তারা লজ্জা পাচ্ছিলেন। হঠাৎ তারা উপায় পেয়ে গেলেন, শুরু করলেন হাদিসের মুযাকারা। উপস্থিত মুহাদ্দিসদের একজন, তালকীনের হাদিসের সনদ পাঠ শুরু করেছেন মাত্র, আর সাথে সাথেই মৃত্যুপথযাত্রী ইমাম আবু যুরয়া বলতে লাগলেন

حدثنا بندار و ساق إسناده ال محمد رسول الله صلى الله عليه وسلم أنه قال، "من كان اخر كلامه لا اله الا الله"

(আমাকে বুনদার বর্নণা করেছেন, তিনি অমুক থেকে.. এভাবে রাসূল সা. পর্যন্ত সনদ উল্লেখ করে বলেন, রাসূল সা. বলেছেন যার শেষ কথা হবে "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ..")
"লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ" পর্যন্ত বলেই তিনি ইন্তেকাল করলেন!

পূর্ণ হাদিস হচ্ছে, যার শেষ কথা হবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আল্লাহু আকবর! সারা জীবন হাদিসের খেদমত করেছেন। মৃতুকালেও সনদসহ হাদিস বর্ণনা... কালেমা পড়তেই মৃত্যু। 

দয়াময়ের কাছে দুয়া করি, এমন সৌভাগ্যের এন্তেকাল আর সালাফের মত নামাজের তাওফীক আমাদেরও নাসীব হোক! আমীন!

--------

এই সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

ডাউনলোড করুন মাকতাবায়ে শামেলা লেটেস্ট ভার্শন (মোবাইল এবং পিসির জন্য)

রুকইয়াহ আশ-শারইয়্যাহ (ডাউনলোড)

ইসতিখারার সুন্নত তরিকা + pdf