শিরক সমাচার (৫-৬)

আগের পর্বগুলো পড়ুন- শিরক সমাচার (১-২), শিরক সমাচার (৩-৪)

শিরক সমাচার-৫

আল্লাহর সত্তা, গুণ ও কাজ সবকিছুই অনন্য ও অতুলনীয়। তার সাথে তুলনীয় কিছুই নেই। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে কিছু গুণ দিয়েছেন। বিভিন্ন কাজের ক্ষমতা দিয়েছেন। মানুষের এসব গুণাবলীর নাম আল্লাহর কোন গুণ বা কাজের নামের সাথে মিলতে পারে। যেমন: মানুষ দয়া করে, আল্লাহও দয়া করেন। মানুষ সাহায্য করে আবার আল্লাহ তায়ালাও সাহায্য করেন।
এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এটি শুধু শাব্দিক মিল। কিন্তু মৌলিক দিক থেকে দু’টির মধ্যে কোন ধরণের সাদৃশ্য ও তুলনাও চলবে না। শাব্দিক এই মিলের কারণে মৌলিক দিক থেকে উভয়টিকে এক মনে করা কিংবা তুলনা করাটাই শিরক।
মানুষকে আল্লাহ তায়ালা যেই ক্ষমতা দিয়েছেন এটি সসীম। আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জির উপর নির্ভরশীল। এটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। আল্লাহ তায়ালা যে কোন মুহূর্তে তার চোখের দৃষ্টি কেড়ে নিতে পারেন। পায়ের চলার ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে পারেন। কথা বলার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে বোবা করে দিতে পারেন। শ্রবণ ক্ষমতা দূর করে বধির বানাতে পারেন।
যে কোন ধরণের সৃষ্টিই হোক না কেন, প্রত্যেকের ক্ষমতা ও গুণাগুণ সীমিত ও আল্লাহর ইচ্ছার অধীন। এসব গুণ ও ক্ষমতা আল্লাহর দেয়া।
জিন ও ফেরেশতাদের অস্বাভাবিক ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে আমরা সেগুলো কল্পনাও করতে পারি না। হযরত ইস্রাফিল আ.কে যে ক্ষমতা দিয়েছেন একটু চিন্তা করে দেখুন। তার এক ফুৎকারে মহাপ্রলয় সংঘঠিত হয়ে যাবে। তাদের এই অকল্পনীয় ক্ষমতাও সসীম এবং আল্লাহর দেওয়া। এগুলো কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। মোট কথা সৃষ্টির যতো ক্ষমতা, গুণাগুণ ও কাজ রয়েছে, এগুলো যতই অস্বাভাবিক হোক না কেন, সবই সসীম, আল্লাহর দেয়া এবং তার ইচ্ছা ও মর্জির উপর নির্ভরশীল।
সমস্ত সৃষ্টির সকল ক্ষমতা, গুণ ও কাজ যেহেতু সসীম এবং আল্লাহর দেওয়া, এজন্য সৃষ্টির কোন কিছুই কখনও আল্লাহর সাথে তুলনীয় হতে পারে না। যতো বেশিই ক্ষমতা হোক, যতো অকল্পনীয় কাজই হোক সৃষ্টির সব কিছুই সসীম ও আল্লাহর মুখাপেক্ষী।
কোন সৃষ্টিকে আল্লাহ তায়ালা অসীম, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন ক্ষমতা ও গুণ দিবেন না। এটি অসম্ভব। কারণ আল্লাহ তায়ালা যখন তাকে ক্ষমতা দিবেন তখন এটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রইলো না। এটি তখন অন্যের কাছ থেকে নেওয়া হলো। এভাবে আল্লাহ তায়ালার সাথে তুলনীয় কোন গুণই কোন সৃষ্টির মধ্যে থাকতে পারে না।
কোন কোন ধর্মে দেখা যায়, এক ভগবান আরেক ভগবানকে বিশেষ ক্ষমতা দিচ্ছেন। যাকে ক্ষমতা দেয়া হলো, তিনি তো আদৌ ভগবান হওয়ার যোগ্য নয়। কারণ তিনি অন্যের কাছ থেকে ক্ষমতা নিচ্ছেন। তিনি অন্যের ক্ষমতার মুখাপেক্ষী। সুতরাং যে অন্যের ক্ষমতার মুখাপেক্ষী, সে ভগবান হয় কীভাবে?
এজন্য আমাদের অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস থাকবে, সৃষ্টির কোন ক্ষমতা, কাজ বা গুণ কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন ও অসীম হতে পারে না। আর আল্লাহ তায়ালা কখনও কাউকে এধরণের ক্ষমতা বা গুণ দিবেন না।
জিন, ফেরেশতা, মানুষ, গাছপালা সব কিছুর সকল ক্ষমতা ও গুণ আল্লাহর দেওয়া। এরা সকলেই আল্লাহর সৃষ্টি ও আল্লাহর মুখাপেক্ষী। এগুলো নিজেরা স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন নয়। কখনও হতেও পারবে না। এজন্য কোন সৃষ্টিই ইবাদতের উপযুক্ত হতে পারে না। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই ইবাদতের উপযুক্ত।
একথা যেহেতু নিশ্চিত যে, কোন সৃষ্টিই স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন ও অসীম ক্ষমতা ও গুণের অধিকারী হতে পারবে না, এজন্য কোন সৃষ্টির মাঝে এটির কল্পনা করাই হলো শিরক। গরুর মধ্যে এধরণের কোন কিছু কল্পনা করলে শিরক। গাছ, মানুষ ইত্যাদি যার মধ্যেই এটি বিশ্বাস করা হোক না কেন, এটি শিরক হবে।
সৃষ্টির কাজ যত বড়ই বিস্ময়কর হোক না কেন, সেটি কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন হতে পারে না। একজন মুসলিম হিসেবে অবশ্যই এই বিশ্বাস রাখতে হবে।

আমাদের আলোচনার সারমর্ম হলো:
১. আল্লাহর গুণ ও কাজের সাথে মানুষের গুণ ও কাজের শাব্দিক মিল থাকলেও মৌলিক দিক থেকে কখনও একটি আরেকটির সাথে তুলনীয় হতে পারে না। মৌলিক দিক থেকে আল্লাহর গুণ বা কাজের সাথে তুলনা করলেই শিরক।
২. সৃষ্টির ক্ষমতা, গুণ ও কাজ কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন ও অসীম হতে পারে না। সৃষ্টির মধ্যে এজাতীয় কিছু বিশ্বাস করলেই শিরক।
কোন পীরের মধ্যে যদি বিশ্বাস করেন, তার নিজস্ব বিশেষ ক্ষমতা আছে তাহলে সেটিও শিরক। কোন সৃষ্টিরই নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। ওমুক বুজুর্গের মনে হয় নিজের বিশেষ কিছু আছে এজাতীয় চিন্তা চেতনাও শিরক। সৃষ্টির সকল ক্ষমতা আল্লাহর দেয়া এবং আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জির উপর নির্ভরশীল। কোন পীর আল্লাহর হুকুম ছাড়া চোখের পলকও ফেলার ক্ষমতা রাখে না। একজন মু’মিনের জন্য অবশ্যই এই বিশ্বাস রাখতে হবে।
৩. আল্লাহ তায়ালা কখনও কোন সৃষ্টিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন ও অসীম ক্ষমতা দিবেন না। কারণ অন্যের দেয়া ক্ষমতা কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে না। এজন্য এটি একটি স্ববিরোধী অসম্ভব বিষয়। মোটকথা আল্লাহ তায়ালা কখনও নিজের গুণ অন্য কাউকে দিবেন না। কারণ আল্লাহর গুণ অন্যকে দেয়ার অর্থ হলো আরেক জনকে আল্লাহ বানানো। যেটা স্ববিরোধী ও বাস্তবে অসম্ভব। এজন্য হিন্দু বা অন্য যেসব ধর্মে একেক ভগবানকে একেক ধরণের ক্ষমতা দেয়ার যে ধারণা প্রচলিত আছে, এটি সম্পূর্ণ অবাস্তব। অন্যের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করলে সে কখনও ভগবান হওয়ার যোগ্য হতে পারে না। এজন্য বিদ্যা বুদ্ধির জন্য এক ভগবানকে, রিজিকের জন্য আরেক ভগবানকে মানা হলো চরম মূর্খতা। যিনি রিজিকের ভগবান তিনি নিজেই অসম্পুর্ণ ও অন্যের মুখাপেক্ষী। এরকম অসম্পুর্ণ ও মুখাপেক্ষী কীভাবে ভগবান হওয়ার যোগ্য হয়?

শিরক সমাচার-৬

আমরা গত পর্বে আলোচনা করেছি, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কোন কিছুর মাঝেই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন ক্ষমতা বা অন্য কোন গুণ থাকতে পারে না। সমস্ত সৃষ্টিই আল্লাহর মুখাপেক্ষী। সমস্ত সৃষ্টির অস্তিত্বই আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জির অধীন।
সহজ কথা হলো, অন্যের মুখাপেক্ষী কেউ কখনও রব বা প্রভূ হতে পারেন না। যিনি নিজেই অন্যের উপর নির্ভরশীর তিনি কী করে প্রভূ হবেন? আর যে প্রভূ নয় তার সামনে মাথা নত করার প্রশ্নই ওঠে না। যে অন্যের মুখাপেক্ষী সে কখনও ইবাদত পাওয়ারও যোগ্য হতে পারে না। সমস্ত সৃষ্টি যেহেতু আল্রাহর মুখাপেক্ষী, আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জির অধীন, এজন্যই সৃষ্টির কোন কিছুই ইবাদত পাওয়ার যোগ্য না।
হিন্দুরা গাছের পূজা করছে। অথচ এই গাছ একটি নগন্য সৃষ্টি। হিন্দুরা গরুর পূজা করে। এটাও একটা নগন্য সৃষ্টি। মূর্তির পূজা করে। যা তাদের নিজস্ব বানানো। তাদের যেসব দেবতা বা ভগবান রয়েছে, এর কেউ-ই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন নয়। নতুবা তারা বহু খোদায় বিশ্বাসী হতো না।
কোন সৃষ্টিই যে ইবাদত পাওয়ার যোগ্য না একথা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হওয়ার পরও মানুষ সৃষ্টির সামনে মাথা নত করে। সৃষ্টির পূজা করে। সৃষ্টির ইবাদত করে। একজন মুসলিম হিসেবে আমাদেরকে অবশ্যই বিশ্বাস রাখতে হবে, সমস্ত সৃষ্টি যেহেতু আল্লাহর অধীন ও তার মুখাপেক্ষী, এজন্য কোন সৃষ্টিই ইবাদত পাওয়ার উপযুক্ত নয়। একমাত্র ইবাদত পাওয়ার উপযুক্ত হলেন আল্লাহ তায়ালা।

আমাদের পরবর্তী আলোচনা বোঝার জন্য ইবাদত কাকে বলে সেটি আগে বুঝতে হবে।
ইবাদতের শাব্দিক অর্থ হলো, বিনয প্রকাশ করা, নত হওয়া।
শুধু বিনয় প্রকাশ করলেই তাকে ইবাদত বলা হয় না। ছেলে পিতা-মাতার সামনে বিনয় প্রকাশ করে, কিন্তু এটি ইবাদত নয়। সাহাবীগণ নবীজী স. এর সামনে বিনয়ী থাকতেন, এটাও তাদের ইবাদত ছিলো না। ছাত্র উস্তাদের সামনে বিনয়ী হয়, এটাও উস্তাদের ইবাদত নয়। এজন্য ইবাদতের পারিভাষিক অর্থ আমাদেরকে জানতে হবে।
ইবাদতের পারিভাষিক অর্থ হলো,
الخضوع باعتقاد شيء من خصائص الربوبية في المخضوع له .
কাউকে রব বা প্রভূ হওয়ার যোগ্য মনে করে তার সামনে নত হলে তাকে ইবাদত বলা হয়। অর্থাত কারও মধ্যে প্রভূ হওয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে এই বিশ্বাস করে যদি তার জন্য বিনয় প্রকাশ করা হয় তাহলে তাকে ইবাদত বলে।
ইবাদত হওয়ার জন্য মৌলিক শর্ত হলো, যার ইবাদত করা হচ্ছে তাকে প্রভূ মনে করা বা তার মধ্যে প্রভূর কোন গুণ আছে এটা বিশ্বাস করা। অন্তরে যদি এই বিশ্বাস না থাকে তাহলে শুধু বাহ্যিক কাজকে ইবাদত বলা হবে না।
যেমন আপনি আপনার বাবার সামনে হাত বেধে দাড়িয়ে রইলেন। শুধু হাত বেধে দাড়ানোর কারণেই এটি ইবাদত হবে না। যতক্ষণ পয়র্ন্ত আপনার বাবাকে প্রভূ বা প্রভূর কোন গুণাগুণ বাবার মধ্যে আছে বিশ্বাস করবেন, ততক্ষণ এটি ইবাদত বলে গন্য হবে না।
আপনি বিপদে পড়ে কারও সাহায্য চাইলেন। কোন মানুষের কাছে শুধু সাহায্য চাইলেই সেটি ইবাদত হবে না। যার কাছে সাহায্য চাচ্ছেন তার ইবাদতের নিয়ত থাকতে হবে।
এ বিষয়ে ইমাম শাতবী রহ. খুবই চমৎকার একটি বিশ্লেষণ উল্লেখ করেছেন তার আল-মুয়াফাকাত কিতাবে। তিনি লিখেছেন,
المسألة الأولى : إن الأعمال بالنيات والمقاصد معتبرة في التصرفات من العبادات والعادات والأدلة على هذا المعنى لا تنحصر .
ويكفيك منها أن المقاصد تفرق بين ما هو عادة وما هو عبادة ، وفي العبادات بين ما هو واجب وغير واجب ، وفي العادات بين الواجب والمندوب والمباح والمكروه والمحرم والصحيح والفاسد وغير ذلك من الأحكام ، والعمل الواحد يقصد به أمر فيكون عبادة ، ويقصد به شيء آخر فلا يكون كذلك ، بل يقصد به شيء فيكون إيمانا ، ويقصد به شيء آخر فيكون كفرا كالسجود لله أو للصنم .
وأيضا فالعمل إذا تعلق به القصد تعلقت به الأحكام التكليفية ، وإذا عري عن القصد لم يتعلق به شيء منها كفعل النائم والغافل والمجنون .
অর্থ: সমস্ত কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। ইবাদত ও স্বাভাবিক সকল কর্মকান্ডে মূল ধর্তব্য বিষয় হলো অন্তরের নিয়ত বা উদ্দেশ্য। সকল কাজে অন্তরের নিয়ত যে মূল ধর্তব্য বিষয়, এর অসংখ্য দলিল রয়েছে।

দলিল হিসেবে আপনার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, ইবাদত ও আদত (অভ্যাসগত কাজ) সকল ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। ইবাদতের মধ্যে আবার ওয়াজিব ও গাইরে ওয়াজিবের মধ্যে নিয়তের পার্থক্য হয়ে থাকে। আদত বা অভ্যাসগত কাজের মধ্যেও ওয়াজিব, নফল, মুবাহ, মাকরুহ, হারাম, সহীহ, ভুল ইত্যাদি বিধানের ক্ষেত্রেও নিয়তের তারতম্য ধর্তব্য হয়।
একই কাজ এক ধরণের নিয়তের কারণে সেটি ইবাদত হয় আবার নিয়তের ভিন্নতার কারণে সেটি ইবাদত হয় না। একই কাজে এক ধরণের নিয়তের কারণে সেটি ইমান হয়, আবার নিয়তের ভিন্নতার কারণে সেটি কুফুরী হয়। যেমন, আল্লাহর জন্য সিজদা করলে ইমান হয়। কিন্তু একই সিজদা মূর্তির জন্য করলে কুফুরী হয়।
অতএব, আমল বা কাজের সাথে যখন নিয়ত যুক্ত হবে তখনই এর উপর শরয়ী বিধান প্রযোজ্য হবে। কোন কাজ যদি নিয়ত থেকে মুক্ত হয়, তাহলে এর সাথে শরয়ী বিধান যুক্ত হবে না। যেমন ঘুমন্ত ব্যক্তির কাজ। উদাসীন ও পাগলের কাজ। এগুলোর সাথে নিয়ত যুক্ত না হওয়ার কারণে এটি ধর্তব্য হবে না।
আল-মুয়াফাকাত, খ.৩,পৃ.৭-৯

মোটকথা নীচের তিনটি বিষয়ের যে কোন একটি যদি কোন কাজের মধ্যে যদি পাওয়া যায়, তাহলে সেটি ইবাদত ধরা হবে,
১. কারও মধ্যে প্রভূ হওয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে বলে বিশ্বাস করা।
২. কাউকে ইলাহ বা ইবাদতের উপযুক্ত বলে বিশ্বাস করা ।
৩. যে কোন কাজের সাথে ইবাদতের নিয়ত যুক্ত থাকা।
সুতরাং যে কোন কাজের সময় যদি উক্ত তিনটি বিষয়ের কোন একটি পাওয়া যায়, তাহলে সেই কাজকে ইবাদত বলে গণ্য করা হবে। নতুবা এটি ইবাদত হবে না।
ফেরেশতাগণ হযরত আদম আ. কে সিজদা করেছিলো। কিন্তু আদম আ. এর ব্যাপারে উপরের তিনটি বিষয়ের কোনটি না থাকার কারণে এটি ইবাদত হয়নি। ফেরেশতারা আদম আ. এর মধ্যে আল্লাহর কোন গুণ আছে বলে বিশ্বাস করতো না বা আল্লাহর কোন গুণের সাথে আদম আ. এর কোন গুণ বা কাজকে তুলনা করেননি। ফেরেশতারা আদম আ.কে ইলাহ মনে করেননি। সিজদা করার সময় আদম আ. এর ইবাদতের নিয়তও তাদের ছিলো ন। এজন্য এটি সিজদা হওয়া সত্ত্বেও আদম আ. এর ইবাদত বলে গণ্য হবে না।
কিন্তু এটি আল্লাহর ইবাদত বলে গণ্য হবে। কারণ ফেরেশতাগণ আল্লাহর আদেশ মানার উদ্দেশ্যে সিজদা করেছেন। আর সিজদার সময় তারা আল্লাহ তায়ালাকে প্রভূ হিসেবে বিশ্বাস করতেন।
ইবাদত নয়: আদম আ. এর ইবাদতের নিয়ত না থাকার কারণে তাকে সিজদা করা সত্ত্বেও এই সিজদাকে ইবাদত ধরা হবে না।
একইভাবে ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা তাকে সিজদা করেছিলো। ইউসুফ আ. কে সিজদা করার সময় তাদের অন্তরে উপরে কোন একটি বিষয়ও ছিলো না, যার কারণে ইউসুফ আ.কে সিজদা করা সত্ত্বেও এটি ইবাদত ধরা হবে না।
সমস্ত সৃষ্টিই আল্লাহর ইবাদত করে থাকে। তারা অন্য কারও ইবাদত করে না। রাসূল স. এর জন্য গাছ ও পাথর সিজদা করতো। কিন্তু এটি তাদের ইবাদত নয়। কারণ গাছ ও পাথর রাসূল স. এর ইবাদতের উদ্দেশ্যে সিজদা করতো না।
সুতরাং ইবাদত হলো, কাজ বা আমল + ইবাদতের নিয়ত। ইবাদতের নিয়ত না থাকলে শুধু কাজকে ইবাদত বলা হবে না।

সঠিক বুঝ কেন জরুরি?
আমাকে একজন প্রশ্ন করেছেন,
শায়েখ,কেউ যদি কোন ভন্ড পীরকে সেজদা দেয় কিন্তু পীরকে সে আল্লাহ মনে করে না তাহলে শিরক হবে??

আমি উত্তরে লিখেছিলাম:
ইসলামে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারও জন্য সিজদা করা সম্পূর্ণ হারাম। কেউ যদি পীরের কোন গুণ বা কাজকে আল্লাহ তায়ালার সমকক্ষ পর্যায়ে বিশ্বাস না করে তাহলে তার কাজটা হারাম হলেও শিরক হবে না।
আমাদের এক প্রিয় ভাই লিখেছেন,
/এটা শিরক হবে ।কারণ সিজদা কাকে করা যাবে বা যাবে না তা জায়েয নাজায়েয করবেন কেবল আল্লাহ ।বিনয় হোক ইবাদাত হোক সিজদা আল্লাহ কেবল তাঁর জন্যেই নির্দিষ্ট করেছেন ।তাই অন্য কাউকে বিনয় হোক বা ইবাদাত হোক সিজদা করা হারাম ।এক মাখলুক কে আরেক মাখলুকের কাছে মর্যাদাবান করতে আদম আং কে সিজদা তিনিই জায়েয করেছেন আর একই কারণে পিতামাতার জন্য জায়েয করলেও তিনিই করতেন যদিও এটি সেই উদ্দেশ্যেও কেবল তাঁরই যোগ্য ছিল ।তাই এটা তাঁর ইচ্ছা সুতরাং সেই উদাহরণ টানা যাবে না ।তাই কোন মুমিন যদি এই সিজদাতে কাউকে শরীক করে আল্লাহকে ছাড়া তবে তিনি আল্লাহকে (কেবল সিজদার যোগ্য বলে) বিশ্বাস করা সত্যেও শিরক করলেন ।এতে কোন সন্দেহ নেই ।/

প্রিয় ভাইয়ের কমেন্ট থেকে আমি যা বুঝেছি,
১. কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা ছাড়া সম্মান বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে সিজদা করলেও শিরক হবে।
২. আল্লাহ তায়ালা চাইলে অন্য কাউকে সম্মান বা বিনয়ের উদ্দেশ্যে সিজদা করার অনুমতি দিতে পারেন। যেমন আদম আ. কে সিজদার আদেশ করেছিলেন। মূল কাজটি শিরক হলেও আল্লাহর অনুমতির কারণে এটা জায়েজ হবে।
উপরের কমেন্ট থেকে আশা করি আমার বুঝটি ঠিক আছে। আসুন তার কথাগুলো একটু বিশ্লেষণ করি।
মৌলিকভাবে অন্য কাউকে সিজদা করা হলো শিরক। তবে আল্লাহ তায়ালা অনুমতি দিলে এটি জায়েজ।
আমি তো তার এই বুঝ দেখে প্রচন্ড অবাক হয়েছি। একটা কাজ মৌলিকভাবে শিরক কিন্তু কিন্তু আল্লাহ তায়ালা অনুমতি দিলে সেটা শিরক নয়। এর অর্থ দাড়ালো আল্লাহ তায়ালা শিরকের অনুমতি দেন।
আদম আ.কে সিজদা করা মূলত: শিরক ছিলো। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা অনুমতি বা আদেশ দেয়ার কারণে শিরকটা জায়েজ হয়েছে। আদম আ.কে সিজদার আদেশ করে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদেরকে শিরক করার আদেশ করেছেন। কিন্তু ইবলিশ আল্লাহ তায়ালার সাথে শিরক করার এই আদেশ লংঘন করেছে।
এটা হলো উক্ত ভাইয়ের বক্তব্যের পরিণতি। ইসলামের আগে অন্যান্য ধর্মে সম্মানের সিজদা জায়েজ ছিলো। এর অর্থ আল্লাহ তায়ালা অন্য সবাইকে তার সাথে শিরক করার অনুমতি দিয়েছেন। শুধু আমাদেরকে তার সাথে শিরক করার অনুমতি দেননি।
আল্লাহ তায়ালা শিরক করার অনুমতি দেন, এটা কীভাবে সম্ভব? কোন জিনিসকে হালাল করা বা হারাম আল্লাহ তায়ালা তার ইচ্ছা অনুযায়ী করেন। তবে আল্লাহ তায়ালা তার সাথে শিরক করার অনুমতি দিবেন এটা আপনি চিন্তা করলেন কী করে?
এটাই বুঝের সমস্যা। একটু বুঝের সমস্যার কারণে অভিশপ্ত ইবলিশের কাজ ভালো হয়ে গেলো। আল্লাহ তায়ালা সবাইকে শিরক করার আদেশ করেছেন। কিন্তু ইবলিশ শিরক করেনি। কোন লুকোচুরি ছাড়া বললে এটাই উপসংহার বের হয়। নাউযুবিল্লাহ।

শিরক একটি জঘন্য কাজ। আর পবিত্র কুরআনে রয়েছে, আল্লাহ তায়ালা কখনও জঘন্য ও গর্হিত কাজের আদেশ করেন না। إن الله لا يأمر بالفحشاء
এজন্য সঠিক বুঝ সব ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা গত পর্বে আলোচনা করেছি যে, যে কোন কাজের সাথে নীচের কোন একটি বিষয় সম্পৃক্ত হলে সেটি শিরক হবে।
১. কারও মধ্যে প্রভূ হওয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে বলে বিশ্বাস করা।
২. কাউকে ইলাহ বা ইবাদতের উপযুক্ত বলে বিশ্বাস করা ।
৩. যে কোন কাজের সাথে ইবাদতের নিয়ত যুক্ত থাকা।
কারও সামনে মাথা নত করা একটি কাজ। এর সাথে যদি উপরের তিনটি বিষয়ের কোন একটি সম্পৃক্ত থাকে, তাহলে সেটি শিরক হবে। নতুবা শুধু মাথা নত করার কারণে শিরক হবে না। যে কোন কাজই হোক, শুধু কাজকেই মৌলিক শিরক হিসেবে বিবেচনা করা হবে না। এর সাথে উপরের তিনটি বিষয়ের কোন একটি যুক্ত হলেই কেবল শিরক হিসেবে গণ্য করা হবে।
কিছু কিছু আলেম সরাসরি কিছু কাজকেই কুফুরী বা শিরকী বলেছেন। যেমন কেউ মূর্তির সামনে সিজদা করছে। অথবা কুরআন শরীফ ছুড়ে ফেলছে। সূর্যকে সিজদা করছে।
তবে সকল ক্ষেত্রেই মূল হলো অন্তরের নিয়ত। কাজের দ্বারা অন্তরের নিয়ত কিছুটা বোঝা যেতে পারে, তবে কাজই মৌলিক ফয়সালার মানদন্ড হতে পারে না। এ বিষয়ে আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি।

-------
- শাইখ মুফতি Ijharul Islam Al-kawsary
সূত্রঃ পর্ব-৫, পর্ব-৬ 

এই সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

ডাউনলোড করুন মাকতাবায়ে শামেলা লেটেস্ট ভার্শন (মোবাইল এবং পিসির জন্য)

রুকইয়াহ আশ-শারইয়্যাহ (ডাউনলোড)

ইসতিখারার সুন্নত তরিকা + pdf