পাঠ সমালোচনা – কিতাবুত তাওহীদ (অসমাপ্ত)

পাঠ সমালোচনা – ১০ (প্রথম পর্ব) 
বই পরিচয়
বইয়ের নাম : কিতাবুত তাওহীদ
লেখক : ইমামুদ দাওয়াহ মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহহাব নজদি রহ.
অনুবাদক : মাওলানা এনামুল হক মাসউদ
প্রকাশনী : আর-রিহাব পাবলিকেশন
মুদ্রিত মূল্য : ৭০০ ৳
পৃষ্ঠাসংখ্যা : ৪৭৮ 

বইটির মূল (আরবি) যে সংস্করণটি আমার কাছে রয়েছে, তাতে মূল পাঠ হলো সর্বমোট ১৫৬ পৃষ্ঠা। ভূমিকা, সূচিপত্র, এমনকি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাসহকারে সর্বমোট ১৬৮ পৃষ্ঠা। অবশ্য বইটি আরবি থেকে অনূদিত হয়েছে নাকি উর্দু থেকে, তা আমার সামনে স্পষ্ট নয়। ভূমিকায় এ সম্পর্কিত কোনো আলোচনা আমার চোখে পড়েনি। মূল বইয়ের সঙ্গে অনুবাদের পৃষ্ঠাসংখ্যার এত তফাৎ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো এর অতিরিক্ত সংযোজন। বইটির প্রথম ১৫ পৃষ্ঠা ব্যয়িত হয়েছে অনুবাদকের কথা, সম্পাদকের কথা ইত্যাদিতে। এরপর এর ভূমিকা দীর্ঘ হয়েছে ৫৭ পৃষ্ঠা পর্যন্ত। সর্বশেষে একটি পরিশিষ্ট যোগ করা হয়েছে ৪০৪ থেকে ৪৭৭ অর্থাৎ দীর্ঘ ৭৩ পৃষ্ঠাব্যাপী। মাঝে মূল বই হচ্ছে ৫৮ থেকে ৪০৩ পৃষ্ঠা পর্যন্ত সর্বমোট ৩৪৫ পৃষ্ঠা। এর প্রায় প্রতিটি পৃষ্ঠায়ও ছোট-বড় টীকা রয়েছে। যার কারণে মূল ও অনুবাদগ্রন্থের পৃষ্ঠাসংখ্যার এই তফাৎটা যৌক্তিক। বইটির আরও একাধিক অনুবাদ বাংলা ভাষায় ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলোর পৃষ্ঠাসংখ্যা এর তুলনায় অনেক স্বল্প। 
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বইটিতে বানানভুল ও মুদ্রণপ্রমাদ রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত। কয়েকটি শিরোনামেও ভুল রয়েছে। যেমন : ‘পরিশিষ্ঠ’, ‘পারম্ভিক কথা’। ভুল শব্দের ব্যবহারও কম নয়। যেমন : ‘এখানে’ অর্থে ‘অত্র’ শব্দের প্রচলিত ভুল ব্যবহার। সম্ভবত বইটির প্রুফ রিডিং করা হয়নি। যাহোক, আমরা আমাদের রিভিউয়ে এসব বিষয়ের ওপর আলোকপাত করব না। শুধু মূল পয়েন্টগুলোর দিকেই আমাদের আলোচনার ফোকাস থাকবে ইনশাআল্লাহ। তবে যেখানে বই থেকে উদ্ধৃতি উল্লেখ করব, সেখানে বইয়ের বানান অক্ষুণ্ণ থাকবে। এ থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে। 
এ বইটির রিভিউ লেখার প্রেরণা
বইটির অনুবাদক শ্রদ্ধেয় মাওলানা এনামুল হক মাসউদ ভাই তার ফেসবুক টাইমলাইনে গত পহেলা এপ্রিল একটি পোস্ট করেন। তার লেখাটি ছিল নিম্নরূপ : 
//তাবিজ ব্যবহার হারাম কিংবা শিরক নয়। হারাম ও শিরক হল তামীমা। তামীমা আর তাবিজ এক নয়। তাবিজ আর তামীমার পার্থক্য জানতে ও বুঝতে পাঠ করুন মাজলুম দাঈ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল ওয়াহাব রাহি. এর আকীদা বিষয়ক প্রামাণ্য গ্রন্থ "কিতাবুত তাওহীদ" বাংলাভাষায় রচিত এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণমূলক এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে আর-রিহাব পাবলিকেশন্স।// 
এ লেখাটি আমাকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দেয়। শায়খ রহ.-এর এমন কোনো গ্রন্থ সম্ভবত নেই, যা আমার পড়া হয়নি। কিন্তু তার কোনো গ্রন্থেই এ ধরনের বিশ্লেষণ আমার চোখে পড়েনি। উলটো এর বিপরীতটা প্রচুর পেয়েছি। কিন্তু অনুবাদকও তো মিথ্যা বলার কথা নন। তিনি তাবিজের বৈধতার পক্ষে যে দাবি করেছেন, তার রেফারেন্স দিয়েছেন বক্ষ্যমাণ গ্রন্থ। এই পোস্টের যেকোনো সচেতন পাঠকই এটা দেখে বিভ্রমে পড়ে যাবে। বিশেষত, যারা পূর্বে এ গ্রন্থটি পাঠ করেছেন, তারা আরও বেশি হতচকিত হবেন। সেখান থেকে মূলত ইচ্ছা জাগে বইটি সময় করে পড়ে দেখার। অনুবাদকের উল্লিখিত উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায়, তিনি মূল বইয়ের রেফারেন্সেই কথাটি বলেছেন। যদি তার ইচ্ছা ভিন্ন কিছু হয়, তাহলে তিনি স্বভাবতই সেটা পরিষ্কারভাবে বলার কথা। যেমন : এতদ্‌সংশ্লিষ্ট আলোচনা অমুক বইয়ের টীকায় রয়েছে। কিন্তু এমনটা তিনি করেননি। তাই বাহ্যত এই লেখা দেখে মনে হবে, শায়খ রহ.-ই বোধ হয় তাবিজপন্থী ছিলেন। 
‘অনুবাদকের কথা’ থেকে
১. //আমি সাধারণ পাঠকদের সুবিধার্থে অনুবাদের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও সংযুক্ত করে দিয়েছি। তবে এ ক্ষেত্রেও আমার নিজের পক্ষ থেকে কোনো কিছু সংযোজনের পরিবর্তে অত্র গ্রন্থটির বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা গ্রন্থ অধ্যয়ন করে এর উপর সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ও সহজে বোধগম্য একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ মুহতারাম শাইখ সালেহ বিন আবদুল আযীয রচিত “গাইয়াতুল মুরীদ ফী শরহি কিতাবিত তাওহীদ” গ্রন্থটিকে সবচেয়ে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য মনে হয়েছে। তাই সকল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উক্ত গ্রন্থ থেকেই নেওয়া হয়েছে।//
অনুবাদক মহোদয়ের উপরিউক্ত বক্তব্য থেকে দুটো বিষয় স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হলো : 
(ক) এই গ্রন্থে তিনি নিজের পক্ষ থেকে কোনো কিছু সংযোজন করেননি। 
(খ) এর সকল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শাইখ সালেহের ব্যাখ্যাগ্রন্থ থেকে নিয়েছেন। 
২. //তবে পুরো গ্রন্থটি সহজে বুঝার সুবিধার্থে শুরুতে “পারম্ভিক কথা ও কয়েকটি জরুরী পরিভাষা” এবং সাত ও আট নং অধ্যায় দুটিতে লেখক রাহি.-এর একটি সুস্পষ্ট ভ্রান্তি ও প্রান্তিকতা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বর্তমান সমাজের চলমান বিতর্ক নিরসনকল্পে আমরা বক্ষমাণ গ্রন্থটির শেষে একটি পরিশিষ্ঠ সংযুক্ত করে দিয়েছি। আশাকরি সম্মানিত পাঠকগণ উক্ত “পারম্ভিক কথা ও কয়েকটি জরুরী পরিভাষা” ও পরিশিষ্ঠটি মনযোগ দিয়ে পাঠ করলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আর কোন প্রকার বাড়াবাড়ি ও প্রান্তিকতা থাকবে না ইন শা’আল্লাহ।//
অনুবাদক মহোদয়ের উপরিউক্ত বক্তব্য থেকে দুটো বিষয় স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হলো : 
(ক) দুটো অধ্যায়ে শায়খ রহ.-এর সুস্পষ্ট ভ্রান্তি ও প্রান্তিকতা রয়েছে। সেই অধ্যায় দুটো হলো : ১. রোগ-ব্যাধি ও বিপদাপদ দূর করা কিংবা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে আংটি কিংবা রিং, তাগা ও সূতা ইত্যাদি ব্যবহার করা শিরক। ২. ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ-কবজের বর্ণনা। 
(খ) তিনি অনেক দায়িত্বশীলতার সঙ্গে অনুবাদকর্ম সম্পন্ন করেছেন। তাহলে তার অনুবাদ ও সংযুক্ত বিষয়গুলোর ওপর আস্থা রেখে পাঠক বইটি অধ্যয়ন করলে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি ও প্রান্তিকতার শিকার হবে না। স্রেফ এ কারণে তিনি তাবিজের মতো এক মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শায়খ রহ.-এর ভ্রান্তি ও প্রান্তিকতা চিহ্নিত করে দিয়েছেন এবং এর জন্য প্রায় শত পৃষ্ঠা অতিরিক্ত নিয়েছেন। আর বলা বাহুল্য, তাবিজ-সংক্রান্ত এ ব্যাখ্যাগুলো তিনি এ বইয়ের কোনো ব্যাখ্যাগ্রন্থ থেকে নেননি; বরং সুবিধামতো অন্য জায়গা থেকে নিয়ে এ বইয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিয়েছেন। সুতরাং এ বইটি শুধু তার অনুবাদই নয়; বরং ব্যাখ্যাগ্রন্থও। এ বিষয়টি তিনি পরে আরও পরিষ্কারভাবে বলেছেন :
//আমাদের সাধারণ পাঠকদের একটি অভ্যাস হল যেকোন বই পাঠ করার সময় বইয়ের টীকাগুলো এড়িয়ে যাওয়া বা হালকাভাবে দৃষ্টি ভুলিয়ে যাওয়া। সুপ্রিয় পাঠক! এ গ্রন্থটির বেলায় এমনটি করলে কিন্তু আপনি অবশ্যই ভুল করবেন। কারণ, এ গ্রন্তের টীকাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই মূল পাঠ থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং মূল পাঠের মতোই সকল টীকাগুলোও মনযোগ দিয়ে পাঠ করার বিশেষ অনুরোধ রইলো।//
বইয়ে উপরিউক্ত কথাগুলো দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আন্ডারলাইন করে দেওয়া হয়েছে। যেকোনো সাধারণ পাঠক একজন আলিমের কলম থেকে এমন কথা দেখতে পেলে বেশ আস্থা ও নির্ভরতার সঙ্গেই পাঠ সম্পন্ন করবে। সে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করবে, লেখক রহ.-এর কোনো ভুল-ত্রুটি হলেও ব্যাখ্যাগ্রন্থে তা তো উঠে আসবেই। সেখানেও যদি না আসে, তবে অনুবাদকের টীকায় তো অন্তত এর আলোচনা চলে আসবে। এতজন আলিমের দ্বারা ফিল্টারিং হয়ে আমার সামনে যা পৌঁছাবে, তা তো নিরেট নির্ভেজাল হওয়া ছাড়া কোনো গতিই নেই।
৫২ নম্বর পৃষ্ঠায় অনুবাদক মহোদয় ‘শাইখের বিরোধীতা ও তার উপর মিথ্যা অপবাদ শিরোনামে’ আরও প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন :
//এ বরকতময় দাওয়াত থেকে উম্মাহকে দূরে রাখার জন্য একটি শ্রেণী এই বিশুদ্ধ মানহাজের অনুসারীদেরকে ওয়াহাবী এবং বিশুদ্ধ তাওহীদের দাওয়াতকে ওয়াহাবী আন্দোলন বলে গালি দেওয়াসহ বিভিন্ন রকম অপবাদ দিয়ে যাচ্ছে। এতো কিছুর পরেও আল্লাহ তা‘আলার অশেষ কৃপায় এবং দীনের জন্য নিবেদিত প্রাণ একদল আলেম ও দাঈদের নিরলস প্রচেষ্টায় গোটা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ন্যায় আমাদের উপমহাদেশেও আলহামদুলিল্লাহ, এই দাওয়াতের প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভবিষ্যতেও ব্যাপকহারে আমাদের উপমহাদেশের মুসলিমগণ বিশুদ্ধ তাওহীদের এই জাগড়ণের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার লক্ষণ অত্যন্ত সুস্পষ্ট।//
লেখকের জীবনী থেকে
অনুবাদক মহোদয় লেখকের জীবনীতে ‘শাইখের বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ ও তার জবাব’ শিরোনামে একটি অধ্যায় সংযুক্ত করেছেন। সেখানে (৪+২=) ছয়টা অভিযোগ উল্লেখ করে এর জবাব তিনি অতি সংক্ষেপে দিয়েছেন। বরং বলা যায়, অভিযোগের চাইতে জবাবের সাইজ বেশ ছোট। কিছু অভিযোগও অনেকটা হাস্যকর কিসিমের হয়ে গেছে। যেমন :
//গাইরুল্লাহ তথা আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত অন্যের নামে পশু জবাই করা হারাম বা নিষিদ্ধ করেছেন।//
এই অভিযোগ গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যক্তিত্ব আদৌ কি করেছে? আমার জানা নেই। যে জিনিস সরাসরি কুরআনের স্পষ্ট বক্তব্যের দ্বারা হারাম হয়েছে, তা আবার ব্যক্তিবিশেষের দিকে সম্পৃক্ত হবে কেন? শাইখ রহ.-কে নিয়ে বাস্তবিক যে অভিযোগগুলো আছে, সেগুলো উল্লেখ করে জবাব দেওয়া যেত। যেমন : তিনি উসমানি খেলাফতের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এর জবাব আসা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু না, এমন কিছু নজরে পড়ল না। যা নজরে পড়ল, তা আসলে অভিযোগের ক্যাটাগরির মধ্যেই পড়ে না। 
অনুবাদক মহোদয় আরও লেখেন :
//তিনি ছিলেন ঐ সকল বিজ্ঞ আলেমদের একজন যারা নিজেরাই ছিলেন মুজতাহিদ। যার ফলে মৌলিকভাবে তিনি ছিলেন মাজহাব অনুসরণের ঊর্ধ্বে।//
আচ্ছা, তিনি যদি বাস্তবেই মাজহাব অনুসরণের ঊর্ধ্বে থাকেন, তাহলে তার তাবিজ-কবচকে শিরক বলে আখ্যায়িত করা ‘সুস্পষ্ট ভ্রান্তি ও প্রান্তিকতা’ হতে যাবে কেন? প্রান্তিকতা মানে উগ্রতা ও শিথিলতা। এখানে আগপর দেখলে মনে হয়, অনুবাদক ‘উগ্রতা’ বুঝিয়েছেন। একজন মুজতাহিদের ইজতিহাদ যদি ভুলও হয়, সেটাকে কি ভ্রান্তি ও উগ্রতা বলে আখ্যায়িত করা যায়?

চলবে ইনশাআল্লাহ…
------------------ 
লিখেছেনঃ আলি হাসান ওসামা দা.বা. 

মন্তব্যসমূহ

এই সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

ডাউনলোড করুন মাকতাবায়ে শামেলা লেটেস্ট ভার্শন (মোবাইল এবং পিসির জন্য)

রুকইয়াহ আশ-শারইয়্যাহ (ডাউনলোড)

ইসতিখারার সুন্নত তরিকা + pdf