মাহরাম ছাড়া নারীদের ভ্রমণ করার শরঈ বিধান

পর্ব - ১
মূল বিষয়ে আলোচনার পূর্বে ভূমিকাস্বরূপ কিছু কথা বলা প্রয়োজন।
মানুষের সাধ্যের বাইরে আল্লাহ তায়ালা কোন বিধান আরোপ করেন না। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে পাকে বলেন;
لَا يُكَلِّفُ الله نَفسًا إِلَّا وُسعَهَا
“অর্থাৎ সাধ্যের বাহিরে আল্লাহ তায়ালা কোন বিষয় কারো উপর চাপিয়ে দেন না।”
(সুরা বাকারা, ২৮৬)
সুতরাং যেকোনো বিধান সামনে আসলেই এই কথাটি মাথায় রাখতে হবে যে, এটা আমাদের সাধ্যের মধ্যেই রয়েছে। অন্যথায় আল্লাহ তায়ালা এই বিধান অবতীর্ণ করতেন না।
ইসলাম কোন বিষয়ের উপকার অর্জনের পূর্বে সেই বিষয়ের ক্ষতিকে দূর করার প্রতি মনযোগ দিয়েছে। এইজন্য মদের মধ্যে বাহ্যিক কিছু উপকার থাকলেও তার ক্ষতির দিকটি প্রাধান্য পাওয়ায় ইসলাম মদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন,
يَسـألُونَكَ عَنِ الخَمرِ والمَيسِر، قُل فِيهِمَا إِثم كَبِير وَمَنافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثمُهُمَا أَكبَرُ مِن نَّفعِهِمَا
“তারা আপনাকে মদ এবং জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে, আপনি বলুন উভয়ের মধ্যে রয়েছে অনেক ক্ষতি এবং মানুষের জন্য বহু উপকার। তবে উপকারের চেয়ে ক্ষতিটা বেশি।”
(সুরা বাকারা, ২১৯)
এক্ষেত্রে ফিকহী একটি মূলনীতিও উল্লেখ করা যেতে পারে।
دفع الضرر مقدم على جلب المنفعة
“অর্থাৎ উপকার অর্জনের পূর্বে ক্ষতি দূর করা আবশ্যক।”
সুতরাং বাহ্যিকভাবে কোন কাজের মধ্যে উপকার পরিলক্ষিত হওয়ার পরেও যদি ইসলাম তা থেকে বারণ করে তাহলে বুঝতে হবে যে এর ক্ষতি অনেক বড়। যদিও তা আমার বুঝে না আসুক।
ইসলাম ধর্ম নারীকে যেই সম্মান, মর্যাদা এবং নিরাপত্তা দিয়েছে পৃথিবীর কোন ধর্ম কিংবা সমাজব্যবস্থা তা দিতে পারেনি। কখনো পারবেও না। নারীর সম্মানকে ইসলাম এতটাই গুরুত্ব দিয়েছে যে, একজন নারীর শ্লীলতাহানিকে কেন্দ্র করে রাসুল সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কাইনুকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। নারীর ইজ্জত সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রেখে ইসলাম নারীকে ঘরের মধ্যে থাকতে উদ্বুদ্ধ করেছে। প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাহিরে যেতে বারণ করেছে। উদ্দেশ্য একটাই, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তার সম্মান রক্ষা করা।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَقَرنَ فِي بُيُوتِكُنَّ
“তোমরা (নারীরা) নিজ ঘরে অবস্থান করবে।” (সুরা আহযাব, ৩৩)
রাসুল রাসুল সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“নিঃসন্দেহে সে (নারী) তখনই আল্লাহর পছন্দনীয় থাকে যখন স্বীয় বাড়ির সবচেয়ে গোপন স্থানে অবন্থান করে।” (সহীহ ইবনে খুজাইমা, হা ১৬৮৬)
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,
“নারীদের জন্য বাড়িতে নামায পড়া বাড়ির বাহিরে নামায পড়ার চেয়ে উত্তম।”
(আল মুজামুল আওসাত, হা ৯১০১)
নারীদের নিরাপত্তা এবং সম্মান রক্ষার স্বার্থেই মূলত তাদেরকে ঘরের বাহিরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। নারী হলো প্রকৃতপক্ষে ভ‚পৃষ্ঠের রাণী। আপন ঘর হলো তার রাজপ্রাসাদ। তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্বও পুরুষের উপর আরোপ করা হয়েছে। মাহরামকে বানানো হয়েছে তাদের দেহরক্ষী। এই সম্মান কে দিবে একবার ভেবে দেখেছেন?
স্বার্থবাজ পুজিবাদি সমাজ কখনো বিনা স্বার্থে অন্যের পাশে দাড়ায় না। তাই তারা চায় নারীদের দায়িত্ব নারীদের উপর ছেড়ে দিতে। যাতে তারা অন্যের বোঝা বহন করা থেকে মুক্তি পেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে বড় বাধা হলো ইসলাম। এইজন্য সরাসরি ইসলামের এই বিধানের বিরুদ্ধে না বলে তারা মুসলমানদের মাঝে এই কুচিন্তার অনুপ্রবেশ করাতে চাচ্ছে যে “ইসলাম নারীকে ঘর-বন্দী করে রাখতে চায়। ইসলাম নারী অধিকার হরণ করছে।” প্রকৃতপক্ষে তারা ফ্রিতে নারীদের দায়িত্ব নিতে চায় না। এজন্য এসব কথার অবতারণা করে।
দ্বিতীয়ত, নারীরা অবাধভাবে বাহিরে বের হলেই তারা তাদের কুচরিত্র বাস্তবায়নের ক্ষেত্র পেয়ে যাবে। নারীদের কোমলতার সুযোগ নিয়ে তাদের ইজ্জত সম্মান লুন্ঠন করার মোক্ষম সুযোগ তৈরি হবে। চরিত্রহীন পশ্চিমা সমাজ তো এটাই চায়। তাইতো দেখা যায় ইউরোপ আমেরিকাতেই নারীরা সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার। এখন তারা মুসলিম নারীদের ইজ্জতও লুন্ঠন করতে চায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ইসলামী শরীয়াহ। তাই পশ্চিমা সমাজ এবং লিবারেল জাতি ঘুরে ফিরে শরীয়াহকে মুসলিম সমাজে প্রশ্নবিদ্ধ করার পায়তারা চালায়। যাতে তারা আপন লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে।
সুতরাং মুসলিম নারীদের উচিৎ এসব মতলববাজদের ব্যাপারে সচেতন থাকা। ইসলামের দেয়া সম্মান এবং নিরাপত্তা অনুধাবন করা। তাদের মিষ্টি কথায় মোহগ্রস্ত না হয়ে ইসলামের বিধান যথাযথভাবে পালন করা এবং সমাজে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা। এতেই রয়েছে তাদের ইহকালীন এবং পরকালীন কল্যাণ।

মাহরাম ব্যতীত নারীদের ভ্রমণ এবং অন্যত্র বসবাসের বিধান

আমরা তিনটি শিরোনামের অধীনে উক্ত বিষয়ের উপর আলোকপাত করবো।
১.মাহরাম ব্যতীত হজ্জে গমন।
২.মাহরাম ব্যতীত সাধারণ (যেকোন উদ্দেশ্যে) ভ্রমণ।
৩.মাহরাম ব্যতীত অন্যত্র বসবাস।
১.মাহরাম ব্যতীত নারীদের হজ্জে গমন।
হজ্জে গমনে ইচ্ছুক নারীর আবাসস্থল এবং মক্কার মাঝে যদি ৪৮ মাইল (প্রায় ৭৮ কি.মি.) বা তার বেশি দূরত্ব হয় তাহলে মাহরাম ব্যতীত তার জন্য হজ্জে গমন বৈধ নয়। মাহরাম ব্যতীত হজ্জের জন্য ভ্রমণ করলে গুনাহগার হবে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বলেন,
لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا وَمَعَهَا ذُو مَحْرَمٍ، وَلَا تُسَافِرِ الْمَرْأَةُ إِلَّا مَعَ ذِي مَحْرَمٍ، فَقَامَ رَجُلٌ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّ امْرَأَتِي خَرَجَتْ حَاجَّةً، وَإِنِّي اكْتُتِبْتُ فِي غَزْوَةِ كَذَا وَكَذَا، قَالَ انْطَلِقْ فَحُجَّ ‌مَعَ ‌امْرَأَتِكَ
“কোন মহিলা মাহরাম ছাড়া কোন পুরুষের সাথে নির্জন স্থানে অবস্থান করবে না। কোন মহিলা মাহরাম ছাড়া ভ্রমণ করবে না।”
তখন এক ব্যক্তি দাড়িয়ে বললো, হে আল্লাহর রাসুল! আমার স্ত্রী তো হজ্জ করার জন্য বের হয়ে গেছে। কিন্তু আমার নাম অমুক অমুক যুদ্ধে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বললেন, “তুমি চলে যেয়ে তোমার স্ত্রীর সাথে হজ্জ করো।”
(সহীহ মুসলিম, হা ১৪৩১)
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বলেন,
لَا تَحُجَّنَّ امْرَأَةٌ إِلَّا وَمَعَهَا ذُو مُحْرِمٍ
“মাহরাম ব্যতীত কোন নারী হজ্জ করবে না।” (সুনানু দারি কুতনী, হা ২৪৪০)
আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বলেন,
لَا تُسَافِرِ امْرَأَةٌ سَفَرًا ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ أَوْ تَحُجَّ إِلَّا وَمَعَهَا زَوْجُهَا
“কোন নারী স্বামী ছাড়া তিন দিনের দূরত্বে ভ্রমণ করবে না অথবা হজ্জ করবে না”
(সুনানু দারি কুতনী, হা ২৪৪২)
আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বললেন,
لَا يَحِلُّ لِامْرَأَةٍ مُسْلِمَةٍ أَنْ تَحُجَّ إِلَّا مَعَ زَوْجٍ أَوْ ذِي مَحْرَمٍ
“কোন মুসলিম মহিলার জন্য স্বামী অথবা মাহরাম ব্যতীত হজ্জ করা বৈধ নয়।”
(আল মুজামুল কাবীর ত্ববরানী, হা ৮০১৬)
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বলেন,
لَا تُسَافِرِ الْمَرْأَةُ إِلَّا مَعَ ذِي مَحْرَمٍ
“মাহরাম ব্যতীত নারীগণ ভ্রমণ করবে না।”
(সহীহ বুখারী, হা ১৮৬২)
#কোন নারীর যদি মাহরামই না থাকে কিংবা মাহরাম যেতে রাজি না হয় তাহলে তার হুকুম নিয়ে হানাফী ফুকাহায়ে কেরামের দুটি অভিমত রয়েছে।
(এক) মৃত্যু পর্যন্ত যদি মাহরামের ব্যবস্থা না হয় তাহলে তার উপর হজ্জ আবশ্যক নয় এবং মৃত্যুর পূর্বে তার পক্ষ থেকে হজ্জ করার ওয়াসিয়াত করাও জরুরি নয়।
(দুই) যদি হজ্জ ফরজ হওয়ার অন্যান্য শর্তাবলি পাওয়া যায় কিন্তু মৃত্যুর আগপর্যন্ত মাহরামের ব্যবস্থা না হয় তাহলে মৃত্যুর পূর্বে তার পক্ষ থেকে হজ্জ করার ওয়াসিয়াত করে যাওয়া জরুরি। এই দ্বিতীয় অভিমতটিই অধিক বিশুদ্ধ।
আল্লামা কাসানী রহঃ বলেন,
أن يكون معها زوجها أو محرم لها فإن لم يوجد أحدهما لا يجب عليها الحج
“মহিলার উপর হজ্জ ফরজ হওয়ার জন্য শর্ত হলো তার সাথে স্বামী বা মাহরাম থাকা। যদি উভয়ের কেউ না মিলে তাহলে তার উপর হজ্জ আবশ্যক নয়।”
(বাদাইয়ুস সানায়ী, ২/১২৩)
ফতোয়ায়ে হিন্দিয়্যাতে রয়েছে,
ووجود المحرم للمرأة شرط لوجوب الحج أم لأدائه، بعضهم جعلوها شرطا للوجوب وبعضهم شرطا للأداء، وهو الصحيح، وثمرة الخلاف فيما إذا مات قبل الحج فعلى قول الأولين لا تلزمه الوصية وعلى قول الآخرين تلزمه كذا في النهاية
“মাহরামের ব্যবস্থা হওয়া মহিলার উপর হজ্জ ফরজ হওয়ার জন্য শর্ত না কি হজ্জ আদায় হওয়ার জন্য শর্ত? কতেক ফুকাহায়ে কেরামের মতে হজ্জ ফরজ হওয়ার জন্য শর্ত। আর কতেক ফুকাহায়ে কেরামের মতে হজ্জ আদায় হওয়ার জন্য শর্ত। দ্বিতীয় অভিমতটিই বিশুদ্ধ। এই মতপার্থক্যের ফলাফল প্রকাশ পাবে যদি মাহরামের ব্যবস্থা না হওয়ার কারণে মহিলা হজ্জ করতে না পারে এবং মৃত্যু বরণ করে তাহলে প্রথম দলের অভিমত অনুযায়ী তার উপর ওয়াসিয়াত করে যাওয়া আবশ্যক নয়। দ্বিতীয় শ্রেণীর ফুকাহাদের অভিমত অনুযায়ী তার উপর ওয়াসিয়াত (তার পক্ষ থেকে হজ্জ করার ওয়াসিয়াত) করে যাওয়া আবশ্যক।”
(ফতোয়ায়ে হিন্দিয়্যাহ, ১/২১৯)
#কিন্তু হজ্জে গমনে ইচ্ছুক নারীর আবাসস্থল এবং মক্কার মাঝে যদি ৪৮ মাইল (প্রায় ৭৮ কি.মি.) এর কম দূরত্ব হয় তাহলে মাহরাম ব্যতীত তার জন্য হজ্জে গমন অনুত্তম হলেও বৈধ।
আল্লামা কাসানী রহঃ বলেন,
ثم المحرم أو الزوج إنما يشترط إذا كان بين المرأة، وبين مكة ثلاثة أيام فصاعدا، فإن كان أقل من ذلك حجت بغير محرم؛ لأن المحرم يشترط للسفر، وما دون ثلاثة أيام ليس بسفر فلا يشترط فيه المحرم كما لا يشترط للخروج من محلة إلى محلة
“মাহরাম বা স্বামী থাকা তখনই শর্ত যখন মহিলার বাসস্থান এবং মক্কার মাঝে তিন দিন বা ততাধিক (৪৮ মাইল বা প্রায় ৭৮ কি.মি.) দূরত্ব হবে। তবে যদি এর কম হয় তাহলে মাহরাম ছাড়া হজ্জ করতে পারবে। কেননা সফরের দূরত্ব পরিমাণ ভ্রমণের জন্য মাহরাম শর্ত। আর তিন দিনের কম দূরত্বকে (শরীয়তের বিধানের বিবেচনায়) সফর বলে না। সুতরাং এ ক্ষেত্রে (তিন দিনের কম দূরত্বে ভ্রমণের জন্য) মাহরাম থাকা শর্ত নয়। যেমনিভাবে এক মহল্লা থেকে অপর মহল্লায় যাওয়ার জন্য মাহরাম থাকা শর্ত নয়।”
(বাদাইয়ুস সানায়ী, ২/১২৪)

পর্ব-২

মাহরাম ব্যতীত সাধারণ (যেকোন উদ্দেশ্যে) ভ্রমণ এর বিধান


 নারীদের জন্য মাহরাম ব্যতীত ৪৮ মাইল (প্রায় ৭৮ কি.মি.) বা তার বেশি দূরত্বে ভ্রমণ করা জায়েয নেই। ইসলামী শরীয়াহ এব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে।
ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বলেন,
لَا يَحِلُّ لِامْرَأَةٍ، تُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، تُسَافِرُ مَسِيرَةَ ثَلَاثِ لَيَالٍ، إِلَّا وَمَعَهَا ذُو مَحْرَمٍ
“আল্লাহর উপর এবং কিয়ামত দিবসের বিশ্বাস রাখে এমন কোন মহিলার জন্য মাহরাম ব্যতীত তিন রাতের দূরত্বে ভ্রমণ করা বৈধ নয়।”
(সহীহ মুসলিম, হা ১৩৩৮)
ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বলেন,
لا تسافر المرأة ثلاثة أيام إلا مع ذي محرم
“কোন মহিলা মাহরাম ব্যতীত তিন দিনের দূরত্বে ভ্রমণ করবে না।”
(সহীহ বুখারী, হা ৬৮০১)
আবু সাইদ রা. থেকে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বলেন,
لا يحل لامرأة تؤمن بِاللهِ واليوم الآخر، أن تسافر سفرا فوق ثلاثة أيام فصاعدا إلا ومعها ابوها، أو أخوها، أو زوجها، أو ابنها، أو ذو محرم منها
“আল্লাহর উপর এবং কিয়ামত দিবসের বিশ্বাস রাখে এমন কোন মহিলার জন্য পিতা, ভাই, স্বামী, ছেলে অথবা অন্য কোন মাহরাম ব্যতীত তিনদিন বা ততাধিক দূরত্বে ভ্রমণ করা বৈধ নয়।”
(আবু দাউদ, হা ১৭২৬ তিরমিজী, হা ১১৬৯)

বিঃ দ্রঃ

হাদীসসমূহে উল্লিখিত তিন দিন বা তিন রাতের দূরত্ব দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, একজন ব্যক্তি স্বাভাবিক গতিতে পায়ে হেটে তিন দিনে যেই পরিমাণ পথ অতিক্রম করতে সক্ষম সেই পরিমাণ দূরত্ব। ফুকাহায়ে কেরাম মানুষের সহজার্থে এটাকে ৪৮ মাইল (বর্তমান হিসেবে প্রায় ৭৮ কি.মি.) নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
(রদ্দুল মুহতার, ২/১২২-১২৩ আওযানে শরইয়্যাহ, ৪৯)
  • তবে মাহরাম ব্যতীত ৪৮ মাইল (প্রায় ৭৮ কি.মি.) এর কম দূরত্বে প্রয়োজনে ভ্রমণ করা বৈধ। কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া ভ্রমণ করা অনুচিত।
নাফে রহঃ থেকে বর্ণিত,
كان ‌يسافر ‌مع ‌ابن ‌عمر رضي الله عنهما مواليات له ليس معهن ذو محرم
“ইবনে উমর রাঃ এর সাথে মাহরাম ব্যতীত কিছু মহিলা ভ্রমণ করেছেন।”
(শরহু মাআনিল আসার, ৩৫১৪, আবু দাউদ, হা ১৭২৮)
ইমাম ত্বহাবী রহঃ ইবনে উমর রা. এর উক্ত বর্ণনা সম্পর্কে বলেন,
يجوز أن يكون السفر الذي كان يسافره معه هؤلاء المواليات بغير محرم هو السفر الذي لم يدخل فيما نهى عنه ما رويناه عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم
“হতে পারে মাহরাম ব্যতীত ইবনে উমর রা. এর সাথে সেই মহিলাদের ভ্রমণের দূরত্ব ঐ পরিমাণ ছিলো না যে পরিমাণ দূরত্বে (অর্থাৎ ৪৮ মাইল বা তার বেশি দূরত্ব) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভ্রমণ করতে নিষেধ করেছেন।”
(শরহু মাআনিল আসার, ২/১১৬)
আল্লামা কাসানী রহঃ বলেন,
المحرم يشترط للسفر، وما دون ثلاثة أيام ليس بسفر فلا يشترط فيه المحرم كما لا يشترط للخروج من محلة إلى محلة
“সফরের দূরত্ব পরিমাণ ভ্রমণের জন্য মাহরাম শর্ত। আর তিন দিনের কম দূরত্বকে (শরীয়তের বিধানের বিবেচনায়) সফর বলে না। সুতরাং এ ক্ষেত্রে (তিন দিনের কম দূরত্বে ভ্রমণের জন্য) মাহরাম থাকা শর্ত নয়। যেমনিভাবে এক মহল্লা থেকে অপর মহল্লায় যাওয়ার জন্য মাহরাম থাকা শর্ত নয়।”
(বাদাইয়ুস সানায়ী, ২/১২৪)
ইবনুল হুমাম রহঃ বলেন,
وقد روي عن أبي حنيفة وأبي يوسف كراهة الخروج لها مسيرة يوم بلا محرم
“মাহরাম ব্যতীত নারীদের জন্য একদিনের দূরত্বে (প্রায় ২৬ কি.মি.) ভ্রমণ করা অনুত্তম হওয়ার ব্যাপারে আবু হানিফা রহঃ এবং আবু ইউসুফ রহঃ এর থেকে অভিমত বর্ণিত রয়েছে।”
(ফাতহুল কাদীর, ২/৪২২)
ইবনে আবেদীন শামী রহঃ উল্লেখ করেন,
(قوله في سفر) هو ثلاثة أيام ولياليها فيباح لها الخروج إلى ما دونه لحاجة بغير محرم
“সফর হলো তিনদিন তিন রাতের দূরত্ব। সুতরাং প্রয়োজনে এরচেয়ে কম দূরত্বে নারীর জন্য মাহরাম ছাড়া ভ্রমণ করা বৈধ।”
(রদ্দুল মুহতার, ২/৪৬৪)
  • কারো যদি মাহরাম না থাকে কিংবা মাহরামকে সঙ্গে নেয়া সম্ভব না হয় অথচ ৪৮ মাইল (বর্তমান হিসেবে প্রায় ৭৮ কি.মি.) বা তার বেশি দূরত্বে ভ্রমণের প্রয়োজন দেখা দেয়।
তাহলে দেখতে হবে তার প্রয়োজন শরীয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য কি না। যদি গ্রহণযোগ্য হয় এবং ৪৮ মাইল (বর্তমান হিসেবে প্রায় ৭৮ কি.মি.) বা তার বেশি দূরত্বে ভ্রমণ করা ছাড়া সেই প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভাব না হয় তাহলে বিশ^স্ত সৎ ব্যক্তিদের সাথে মাহরাম ব্যতীত তার জন্য ভ্রমণ করা বৈধ।
নাফে রহঃ থেকে বর্ণিত,
كان ‌يسافر ‌مع ‌ابن ‌عمر رضي الله عنهما مواليات له ليس معهن ذو محرم
“ইবনে উমর রাঃ এর সাথে মাহরাম ব্যতীত কিছু মহিলা ভ্রমণ করেছেন।”
(শরহু মাআনিল আসার, ৩৫১৪, আবু দাউদ, হা ১৭২৮)
হাম্মাদ রহিমাহুল্লাহ বলেন,
لا بأس للمرأة أن تسافر ‌بغير ‌محرم مع الصالحين
“নারীর জন্য মাহরাম ব্যতীত নেককার লোকদের সাথে ভ্রমণ করাতে কোন সমস্যা নেই।”
(ফতোয়ায়ে হিন্দিয়্যাহ, ৫/৩৬৬)
মুফতী তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ বলেন,
أما إذا كانت المرأة ليس لها زوج أو أب، أو غيرهما من أقاربها الذين يتكفلون لها بالمعيشة، وليس عندها من المال ما يسد حاجتها، فحينئذ يجوز لها أن تخرج للاكتساب بقدر الضرورة، ملتزمة بأحكام الحجاب، فيكفي لها في مثل هذه الحال أن تكتسب في وطنها، ولا حاجة لها إلى السفر إلى البلاد الأجنبية، ولو لم تجد بدا من السفر في وطنها من بلد إلى آخر، ولم تجد أحدا من محارمها، ففي مثل هذه الحالة فقط يسع لها أن تأخذ بمذهب مالك، والشافعي، حيث جوزوا لها السفر مع النساء المسلمات الثقات
“মহিলার যদি স্বামী, পিতা বা অন্য কোন নিকটাত্মীয় না থাকে যে তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিবে এবং মহিলার প্রয়োজন পূরণ করার মতো ধন-সম্পদ না থাকে তাহলে সে মহিলার জন্য প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ অর্জনের জন্য পর্দাসহকারে ঘরের বাহিরে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে। এ অবস্থায় অর্থ উপার্জনের জন্য স্বদেশই যথেষ্ট। তাই বিদেশে পড়ি জামানোর কোন প্রয়োজন নেই। তবে বিদেশে পাড়ি জমানো ছাড়া যদি কোন উপায় না থাকে এবং কোন মাহরামের ব্যবস্থাও না হয় তাহলে এমতাবস্থায় ঐ মহিলার জন্য মালেকী মাযহাব এবং শাফেয়ী মাযহাব অনুযায়ী আমল করার অনুমতি রয়েছে। তারা বিশ^স্ত নারীদের সাথে (মাহরাম ব্যতীত) ভ্রমণ করাকে বৈধ বলে থাকেন।”
(বুহুস ফী কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআসারাহ, ১/৩৩৭) (আরো দ্রষ্টব্যঃ ফতোয়া কাসিমিয়্যাহ, ১২/১২৪, ইলাউস সুনান, ১০/১৪)

প্রাসঙ্গিক কিছু মাসআলা

  • বিনোদনের জন্য মাহরাম ব্যতীত ৪৮ মাইল (প্রায় ৭৮ কি.মি) বা তার বেশি দূরত্বে ভ্রমণ করা জায়েয নেই।
  • উচ্চ শিক্ষার জন্য মাহরাম ব্যতীত বিদেশে কিংবা ৪৮ মাইল (প্রায় ৭৮ কি.মি) বা তার বেশি দূরত্বে ভ্রমণ করা জায়েয নেই।
  • দেশে কিংবা ৪৮ মাইল (প্রায় ৭৮ কি.মি) দূরত্বের কম দূরত্বে থেকে জীবনযাপন পরিমাণ উপার্জন করা সম্ভব হওয়া সত্বেও চাকরি, শ্রম বা উচ্চ আয়ের জন্য বিদেশে কিংবা ৪৮ মাইল (প্রায় ৭৮ কি.মি) বা তার বেশি দূরত্বে ভ্রমণ করা জায়েয নেই।
  • ৪৮ মাইল (প্রায় ৭৮ কি.মি) বা তার বেশি দূরত্বে অবস্থিত কোন আত্মীয়ের বাসায় মাহরাম ব্যতীত যাওয়া বৈধ নয়।
  • দেশে কিংবা ৪৮ মাইল (প্রায় ৭৮ কি.মি) দূরত্বের কম দূরত্বের মধ্যে সুচিকিৎসা গ্রহণের ব্যবস্থা থাকা সত্বেও অযথা বিদেশে কিংবা ৪৮ মাইল (প্রায় ৭৮ কি.মি) বা তার বেশি দূরত্বে মাহরাম ব্যতীত চিকিৎসার জন্য ভ্রমণ বৈধ নয়।

৩.মাহরাম ব্যতীত অন্যত্র বসবাস।

তিন শর্তে মেয়েদের জন্য মাহরাম ব্যতীত অন্যত্র বসবাস করা বৈধ।
(ক) মেয়ে সাবালিকা এবং ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে।
(খ) আবাসন নিরাপদ হতে হবে।
(গ) দীন পালন এবং পর্দার ব্যাপারে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার আশংকা মুক্ত হতে হবে।
বুরহানুদ্দীন ইবনে মাযাহ হানাফী রহঃ উল্লেখ করেন,
فأما إذا دخلت في السن واجتمع لها رأيها وعقلها فليس للأولياء ‌حق ‌الضم، ولها أن تنزل حيث أحبت حيث لا يتخوف عليها
“মেয়ে যখন সাবালিকা হবে এবং তার মধ্যে ভালো-মন্দ নির্ধারণ করে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা চলে আসবে তখন তার জন্য যেখানে খুশি সেখানে বসবাস করা বৈধ রয়েছে যদি (আখলাক চরিত্র, ইজ্জত-সম্মান, দীন পালনসহ) কোন বিষয়ে ঝুকি না থাকে। এমতাবস্থায় অভিভাবকদের জন্য তাকে জোর করে নিজেদের কাছে রাখার অনুমতি নেই।”
(আল-মুহীতুল বুরহানী, ৪/২৪৬)
মুফতী তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ বলেন,
إذا كانت المرأة قد توطنت إحدى هذه البلاد مع محارمها، ثم بقيت مفردة لموت محارمها، أو انتقالهم من ذلك المكان لسبب ما، فإنه لا مانع لها من الإقامة بمفردها، ما دامت ملتزمة بأحكام الشرع في الحجاب
“কোন নারী যদি এই দেশগুলোর কোন একটি দেশে মাহরামের সাথে এসে বসবাস শুরু করে, অতঃপর মাহরামের মৃত্যুর কারণে বা সেখান থেকে যেকোন কারণে মাহরাম চলে আসার কারণে যদি সেই মহিলা একা হয়ে যায়, তাহলে এক্ষেত্রে একাকী থাকার মধ্যে শরয়ী কোন নিষেধাজ্ঞা নেই যতক্ষণ পর্যন্ত সে পর্দার সাথে শরীয়তের অন্যান্য বিধান মেনে চলবে।”
(বুহুস ফী কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআসারাহ, ১/৩৩৮)
  • তবে বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতি যেহেতু নিরাপদ নয় তাই নিজ ঘর বা মাহরাম ছাড়া অন্যত্র বসবাস করা উচিত নয়।
والله أعلم بالصواب وإليه المرجع والمآب

------------------ 
সংকলনেঃ মাসুম বিল্লাহ - [১] [২]





মন্তব্যসমূহ

এই সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

ডাউনলোড করুন মাকতাবায়ে শামেলা লেটেস্ট ভার্শন (মোবাইল এবং পিসির জন্য)

রুকইয়াহ আশ-শারইয়্যাহ (ডাউনলোড)

ইসতিখারার সুন্নত তরিকা + pdf