বই পর্যালোচনাঃ ব্যাংক : ভুল প্রশ্নের ভুল উত্তর

ইসলামী ব্যাংক নিয়ে বিতর্ক অনেক পুরাতন ইস্যু। এই প্রসঙ্গে সম্প্রতি পড়ে শেষ করলাম যাহিদ সিদ্দিক মুঘলের লেখা 'ব্যাংক : ভুল প্রশ্নের ভুল উত্তর' বইটি। আমার ব্যক্তিগত পাঠ-মূল্যায়ন তুলে ধরছি। 
ইসলামি ব্যাংকিং নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে লেখালেখি অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। বিপক্ষে যারা লেখছেন তাদের লেখাগুলো আবার দুই ধরনের। ফিকহী ও নযরী। আলোচ্য বইটি দ্বিতীয় শ্রেণির। মানে এতে ব্যাংকিং ব্যবস্থার নযরীয়াতি সমালোচনা করা হয়েছে। এবং এক্ষেত্রে লেখক যত্নের সাথে কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। যথা : পুঁজিবাদের ইসলামীকরণ, ব্যাংক কি আদৌ ইসলামী হতে পারে? ব্যাংকিংয়ের ইসলামীকরণের উপর পর্যালোচনা ইত্যাদি। 
এই বইয়ের একটি বিশেষ অংশ উপমহাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রাণপুরুষ মাওলানা তাকি উসমানী সাহেবের দৃষ্টিভঙ্গিকে খণ্ডণ করার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। সেখানে লেখক তকি সাহেবের উদ্ভাবিত পদ্ধতিসমূহের বিশুদ্ধতা পর্যালোচনা করার পরিবর্তে তার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই পুরোটা আলোচনা করেছেন। 
প্রথমে আমি লেখকের ব্যাপারে সংক্ষিপ্তাকারে কিছু মূল্যায়ণ পেশ করব। তারপর পয়েন্ট ধরে ধরে কিছু ব্যাপারের উপর আলোকপাত করব। সর্বশেষ যেসব বিষয় ভালো লেগেছে তা-ও তুলে ধরব। 
তকি সাহেবের উপর লেখকের ক্ষোভ আছে বলে মনে হলো বইটা পড়ে। কারণ হতে পারে তিনি পাকিস্তানে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রাণপুরুষ। আর লেখক যেহেতু এর বিপক্ষে তাই তার সব ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে তকি সাহেবের উপর। আর যখন কেউ ক্ষোভ থেকে কোন সমালোচনা লেখেন তখন এতে 'সমালোচনার জন্য সমালোচনা' এর একটা ছাপ থাকে। লেখকের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। অন্তত তিনি তকি সাহেবের বইয়ের যেসব পয়েন্ট ধরে যে তরিকায় সমালোচনা করেছেন তা দেখে আমার এমনই মনে হয়েছে। (হাকীকত আল্লাহই ভালো জানেন।)
সামনে কিছু উদাহরণও দিবো। 
পুরো বইয়ের মধ্যে লেখকের যে একটা শক্তিমান উপস্থিতি টের পেয়েছি  ৭৮ থেকে ১০৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত অংশটুকুতে (যেখানে তকি সাবের সমালোচনা করা হয়েছে) তা পাইনি। এখানে এসে মনে হয়েছে লেখক কেমন যেন হোঁচট খাচ্ছেন, নিজের দাবি প্রমাণে কিয়াস করতে গিয়ে বা নজীর পেশ করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন। এর মাধ্যমে অনুভূত হয়েছে লেখকের ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপর নযরিয়াতি জ্ঞানের বিস্তৃতি থাকলেও ফিকহী-জ্ঞান পর্যাপ্ত মানের নয়। কেন এমন মনে হলো সেগুলো সামনে কিছুটা ব্যাখ্যা করব। 
লেখক বলেছেন :
"(তকি সাহেব লিখেছেন 🙂 'প্রথমেই জানা দরকার যে, ইসলাম কোন অর্থব্যবস্থার নাম না। ইসলাম একটি ধর্ম। যার আদেশাবলী জীবনের প্রতিটি শাখাপ্রশাখার সাথে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে অর্থব্যবস্থাও আছে। তাই কোরআন-হাদিস প্রচলিত অর্থে কোন অর্থনৈতিক দর্শন বা মতবাদ উপস্থাপন করেনি।'
ওপরের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় মাওলানা তাকী উসমানীর মতে ইসলামের নিজস্ব কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা নিযাম নেই। কেবল কিছু বিক্ষিপ্ত নির্দেশনা আছে। যেগুলোর দ্বারা যে কোন ব্যবস্থার ইসলামীকরণ সম্ভব।" [৮০ পৃ.] 
তাকি সাহেবের কথা থেকে লেখক যে অর্থ বের করলেন তা যে সঠিক নয় এটি যে কোন সচেতন পাঠকেরই বুঝার কথা। তাকি সাহেব ইসলামের নিজস্ব অর্থব্যবস্থা না থাকার দাবি করেননি ওই বক্তব্যে। বরং তিনি বলেছিলেন 'প্রচলিত অর্থে কোন অর্থনৈতিক দর্শন বা মতবাদ ইসলাম উপস্থাপন করেনি।' লেখক মহোদয় এখানে 'প্রচলিত অর্থে' শব্দটি হয়ত খেয়াল করেননি। তাহলে আর এমন ভুল ব্যাখ্যা করার অবকাশ থাকত না। কারণ বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত অর্থে যে অর্থনৈতিক দর্শন দাড়িয়ে আছে, সেরকম শাস্ত্রীয় আকারে অর্থনৈতিক মতবাদ তো ইসলাম উপস্থান করেনি। কারণ ইসলাম কোন অর্থব্যবস্থার নাম না। 
তাকি সাহেব বলেছেন : 'ইসলাম বাজারের শক্তি তথা চাহিদা ও যোগান-নীতিকে মোটামুটি মেনে নিয়েছে।' এই বিষয়টিকে লেখক তার পুরো সমালোচনার অন্যতম ভিত্তি বানিয়েছেন। 
তাঁর সমালোচনার আরেকটা বিষয় ছিলো তাকি সাহেবের এই বক্তব্য : 'মানুষের উপকরণ সীমিত এর তুলনায় প্রয়োজন ও চাহিদা অনেক বেশি। এখন প্রশ্ন, এই অসীম প্রয়োজন ও চাহিদা সীমিত উপকরণ দ্বারা কীভাবে পূর্ণ করা হবে? একতেছাদ ও ইকোনমিক্স শব্দদ্বয়ের অর্থ হলো, ওই উপকরণগুলো এমনভাবে ব্যবজার করতে হবে, যেন তার দ্বারা অধিকাংশ প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায়।' [ ইসলাম ও আধুনিক অর্থব্যবস্থা, তাকি উসমানী : ১৯] 
এই বিষয়গুলোর আলোকে লেখক যেভাবে সমালোচনার পসরা সাজিয়েছেন তা পড়ে মনে হয় তিনি 'সমালোচনা করার জন্যই কেবল সমালোচনা' করছেন। এর কোন সারবত্তা নেই। 
তিনি এই কথাগুলোর আলোকে সমালোচনা করে বলেন :
"যোগান ও চাহিদার নীতিকে মেনে নেয়া, অর্থাৎ এর মাধ্যমেই 'কী উৎপন্ন হবে', 'কতটুকু উৎপন্ন হবে', আর 'কী উৎপন্ন হবে না' তা নির্ধারিত হবে এটা মেনে নেয়া মানবিক খাহেশাতকে মেনে নেয়ারই নামান্তর।" 
টীকাতে লিখেছেন : "জোগান ও চাহিদার নীতিকে স্বভাবজাত মনে করা খাহেশাতের সীমাহীনতাকে স্বীকৃতি দেয়ার নামান্তর।" [৮৩ পৃ.] 
অথচ যোগান চাহিদা এটি একটি প্রাকৃতিগত বিষয়। এই বিষষয়ে তাকি সাহেব দলিলভিত্তিক আলোচনা করেছেন। কুরআনের আয়াত ও হাদীসের বক্তব্য পেশ করেছেন। এক হাদীসে আছে, নবিজির কাছে যখন পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেবার আবেদন জানানো হলো, তখন তিনি বলেছিলেন, 'নিঃসন্দেহে আল্লাহই হলেন মূল্য নির্ধারণকারী। তিনিই পণ্যের হ্রাস-বৃদ্ধিকারী এবং তিনিই আহারদাতা।'
তাকী সাহেব বলেন, 'উল্লেখিত হাদীসে আল্লাহ তাআলাকে মূল্যনির্ধারণকারী স্থির করার সুস্পষ্ট অর্থ, আল্লাহই যোগান ও চাহিদার প্রকৃতিক বিধান নির্ধারণ করেছেন।' 
আমার একটা বিষয় বোধগম্য হচ্ছে না, সীমিত উপকরণ দিয়ে অসীম প্রয়োজন পূরণ করার বিষয়টাকে কেন লেখক মন্দ দৃষ্টিতে দেখছেন? ধরেন, আমার হাতে এক হাজার টাকা আছে। আমার বাসায় চাল/ডাল/মাছ/তরকারি/পেয়াজ/রসুন/তেল/বিস্কিট/পাউরুটি/ফলমূল কিছুই নাই। এখন আমার চাহিদা অনেকগুলো। আমি তো এক হাজার টাকা দিয়ে এক বস্তা চাউল কিনে আনবো না। বরং কিছু চাউল, কিছু ডাউল, কিছু তরকারি এভাবে সব কিছু কিছু কিনবো। আগে এগুলো কিনবো। পরে যদি টাকা থাকে ফলমূল কিনবো। না থাকলে কিনবো না। কারণ আমার বেশি প্রয়োজন ওগুলো, ফলমূল না। এখানে আমি সামান্য উপকরণকে এমনভাবে ব্যবহার করলাম যে, আমার অধিকাংশ প্রয়োজন পূরণ হয়েছে। এটাই ছিল একতেসাদ। লেখক মহোদয় সহজ বিষয়টাকে কেন এতো নেতিবাচকভাবে নিলেন আল্লাহু আলাম। 
লেখকের সমালোচনার সারকথা হলো, অসীম চাহিদার মূল সমাধান আত্মশুদ্ধি বা তাজকিয়ায়ে নফস। সসীম উপকরণের মাধ্যমে অসীম চাহিদার যোগান দেওয়া নয়। মানুষ যুহদ অবলম্বনের মাধ্যমে তার প্রয়োজনের লাগামকে নিয়ন্ত্রণ করবে, সেই প্রয়োজন পূরণ করার প্রচেষ্টার পেছনে দৌড়ে নয়। যেহেতু ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মানুষ মুনাফার পর মুনাফার পেছনে ছুটে তাই একে বৈধতা দেওয়া যাবে না। দিলে শরীয়ত মানুষের মধ্যে যে মেজায চায় তা তৈরি হবে না। [ দেখুন ৭৮-৭৯, ৮৬, পৃ.]
আগেই বলেছিলাম লেখক বইটিতে মূলত নযরি সমালোচনা করেছেন। এই হলো তার নযরী সমালোচনার খোলাসা। যার ভিত্তি বেশির থেকে বেশি তাকওয়া/যুহদ/ওয়ারা বলতে পারি আমরা। অথচ বৈধতা/অবৈধতার ভিত্তি তাকওয়া/যুহদের উপর হয়না। বিশেষকরে মুআমালা তথা লেনদেনের ক্ষেত্রে তো নয়ই। 
সবচে হালকা চালের ভাবনা মনে হয়েছে যে জায়গাটাতে তা হলো লেখকের এই বক্তব্য : "সীমাহীন কামনাবাসনা পূরণ করা ও লাভ অর্জনের ইচ্ছা যদি মাওলানার মতে প্রাকৃতিক বা স্বভাবজাত বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে তা অর্জনের প্রচেষ্টা হিসেবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠান, যেমন সুদ ও জুয়ার বাজারকেও, স্বাভাবিক বলে স্বীকৃতি দিতে হয়।" [৮৬ পৃ.] 
লেখক এখানে স্বাভাবিক বলে কী বোঝাতে চাইলেন? স্বভাবের তাড়নায় সৃষ্ট? তাহলে তো ঠিক আছে। আর কোন কিছু স্বভাবের তাড়নায় সৃষ্টি হলেই বৈধ হয়ে যায় না। আর যদি স্বাভাবিক বলে তিনি বৈধ বোঝান তবে এটি হাস্যকর। স্বভাবজাত হলেই তা বৈধ হতে যাবে কেন? 
মানুষের বিভিন্ন চাহিদা থাকবে, সেগুলো পূরণের প্রচেষ্টা থাকবে, ব্যবসা-বানিজ্য করলে লাভ অর্জনের ইচ্ছা থাকবে এগুলোকে কেন লেখকের কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে তা আমার বোধগম্য নয়; যতক্ষণ শরীয়তের সীমারেখাকে অতিক্রম করা না হয়। যে চাহিদা পূরণে ও লাভ অর্জনের ইচ্ছার জোয়ারে হারাম-হালালের বাঁধ ভেঙে যায় এর সমালোচনা তো তকি উসমানি সাহেব নিজেও করেছেন। তিনি বলেছেন, 'কিন্তু ভুল আরম্ভ হয়েছে প্রত্যেককে লাগামহীনভাবে বেশির চেয়ে বেশি মুনাফা অর্জনের স্বাধীনতা দিয়ে, যার মধ্যে হালাল-হারামের কোন পার্থক্য নেই এবং জনকল্যাণের দিকেও মনোযোগ নেই।   [ ইসলাম ও আধুনিক অর্থব্যবস্থা, তাকি উসমানী : ৩১] 
লেখকের সমালোচনাগুলো যে অনেকটা 'সমালোচনা করতে হবে' এমন মানসিকতা থেকে সৃষ্ট বলে আমার অনুভূত হয়েছে এর একটা বড় কারণ হলো, লেখক ৮৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, "তাকি সাহেব জুয়ার উপর নির্মিত লেনদেন শরীয়তের শর্তসমূহের প্রতি লক্ষ রাখার ভিত্তিতে বৈধ দাবি করেছেন। কেননা তিনি বলেছেন : 'অনুমান ও আন্দায সরাসরি হারাম হওয়ার যে কথাটি প্রসিদ্ধ আছে তা ঠিক নয়।'" 
এই কথাটা পড়ে আমার খটকা লাগল এই জন্য যে, যেই জিনিস জুয়ার উপর নির্মিত সেখানে আবার শরীয়তের শর্তসমূহের প্রতি লক্ষ্য রাখার প্রসঙ্গ আসবে কেন? জুয়ার উপর নির্মিত হবার দ্বারাই তো এটি শরীয়তের শর্তের খেলাফ হয়ে গেছে। কথাটার শুরু-শেষ সাংঘর্ষিক। তাই মূল বই খুলে পুরো বক্তব্যটা পড়লাম। পাঠক, আপনিও পড়ুন তারপর নিরপেক্ষ মন দিয়ে বিবেচনা করুন তাকি সাহেব কী বলতে চেয়েছেন আর তার কথার আংশিক বর্ণনা তুলে ধরে লেখক কী দাবি করে বসলেন। এটা দেখার পর তাকী সাহেবের ব্যাপারে লেখকের সমালোচনার প্রতি আমি পুরোই আস্থাহীন হয়ে পড়ি। 
তাকি সাহেবের পুরো বক্তব্যটা এমন :
"একটা কথা প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে, আন্দায অনুমানভিত্তিক লেনদেন মৌলিকভাবে হারাম। এ ধারণা ভুল। অনুমান হলো কোন্ বস্তুুর মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, কোন্ বস্তুর মূল্য কমছে এ জরিপ চালানো। যার মূল্য কমে যাওয়ার আশংকা আছে তা বিক্রি করে দেওয়া এবং যার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তা রেখে দেওয়া। এটা মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ নয়। এটা তো প্রতৌেক ব্যবসার মধ্যেই থাকে। নিষিদ্ধ হলো ক্রয়-বিক্রয়ের শরয়ী শর্তসমূহ রক্ষা না করা। যেমন মালিকানাহীন বস্তু বা দখলহীন বস্তু বিক্রি করা বা বিক্রয়-জুয়ার আকৃতি ধারণ করা। জুয়া হয় দুইটি বিষয় মিলে। এক. এক পক্ষ থেকে প্রদেয় নির্ধারিত হওয়া এবং অপরপক্ষ থেকে অনুমানভিত্তিক হওয়া। দুই. যার পক্ষ থেকে প্রদেয় আদায় হয়ে গেছে তার অর্থ দু'টি বিষয়ের মধ্যে আবর্তিত হওয়া। হয় এ অর্থ নিজেই চলে যাবে, নয় আরো অর্থ টেনে আনবে।" 
পাঠক, দুই কথার মধ্যে যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান সেটা আশা করি ব্যাখা করে বলার দরকার নাই। 
আগেই বলেছিলাম লেখকের মূল দর্শন হলো, মুনাফাকে উচ্চকিত করার বাসনা বৈধ নয়। আর ব্যাংক যেহেতু মুনাফাকে উচ্চকিত করার কাজ করে তাই ব্যাংকও কখনো ইসলামি হতে পারে না। অথচ এই বক্তব্য সঠিক নয়। মুনাফা উচ্চকিত করার বাসনাকে বেশির থেকে বেশি অপছন্দনীয় ও যুহহদের পরিপন্থী বলা যেতে পারে, হারাম কখনও নয়। একটি ইসলামি সমাজ অবশ্যই এমন অপছন্দনীয় পদ্ধতিকে পরিহার করতে যুহদ/তাকওয়ার নীতিতে গঠিত সমাজব্যবস্থা সৃষ্টিতে প্রচেষ্টা চালাবে এটি কাম্য। কিন্তু এই কাম্যকে যদি কেউ ফরজ/ওয়াজিবের কাতারে নিয়ে যায় তখনই সৃষ্টি হয় সমস্যা। 
ধরুন, এক ব্যক্তি ব্যবসা করে। সে মুনাফাকে উচ্চকিত করার চিন্তায় বিভোর থাকে। যা লাভ হয় সব আবার সেই ব্যবসায় পূঁজি হিসেবে খাটায়। দিনরাত এগুলোই করে। তবে সে ফরজ/ওয়াজিব ইবাদত পালনে ত্রুটি করেনা। তার এই কাজকে কি কেউ অবৈধ বা হারাম বলবে? কখনো না। সর্বোচ্চ এতটুকু বলা যায় তার ভেতরে উন্নত গুণাবলী তথা যুহদ/অল্পেতুষ্টি ইত্যাদি নাই। 
কিন্তু আমাদের লেখক মহোদয় এই যুহদের বিষয়কে ভিত্তি বানিয়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে হারাম বলতে চান। তার দর্শন হলো, যার ভিত্তি হারামের উপর সেটিও হারাম। এই দর্শনের মূল কথা তো ঠিকাছে। কিন্তু প্রয়োগ ঠিক নেই। কারণ এখানে ভিত্তিটা হারাম না; যেমনটা তিনি মনে করছেন। 
সবচে মজা পেয়েছি তিনি এই অশুদ্ধ  ধারণার ভিত্তিতে ইসলামি ব্যাংকিংকে 'ইসলামি পতিতালয়' এর সাথে কিয়াস করেছেন। মানে পতিতালয় যিনার ক্ষেত্র হওয়ায় তা যেমন হারাম, একে ইসলামি লেবেল লাগিয়ে 'ইসলামি পতিতালয়' বললেও তা হালাল হবে না, তেমনি ব্যাংকিংও মূলগতভাবেই হারাম। এর উপর ইসলামি সিল লাগালেও লাভ নেই। এটা যে স্পষ্টভাবে 'কিয়াস মাআল ফারিক' তা যে কোন মধ্যম মেধার তালিবুল ইলমও বুঝবেন। কারণ যিনা হলো কতঈ বা অকাট্য হারাম। তিনি এই  হারামের উপর কিয়াস করছেন এমন বিষয়কে, যা মূলত যুহদ/তাকওয়া/ওয়ারা ইত্যাদির দাবি, হারাম কখনো নয়।  
এই জাতীয় আরো কিছু দুর্বল কিয়াস তিনি করেছেন। এই জায়গাগুলো পড়ার সময় লেখকের ফাকাহাত খুব স্বল্পমাত্রার বলে আমার মনে হয়েছে। 
তাকি সাহেবের বইয়ের সমালোচনার সব যে অযৌক্তিক লেগেছে তা নয়। সুদি কারবারে যুক্ত কোম্পানির শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের বৈধতা তিনি দিয়েছেন শুধু এই শর্তে যে, বার্ষিক সাধারণ সভায় (A.M.G) সুদি কারবার বন্ধের প্রস্তাব দেওয়া। লেখক এর সমালোচনা করেছেন এবং তা যৌক্তিকই মনে হয়েছে। কারণ এটা তো জানা কথাই যে, বার্ষরিক একটা সভাতে এক দু'বার সুদি লেনদেন না করার প্রস্তাব দেওয়াতে কিছু যায়আসে না। কোম্পানি তার নিজের গতিতেই সুদি করবার করবে। তাই নাম কা ওয়াস্তে এতটুকু প্রস্তাব দেবার দ্বারাই সুদি কোম্পানির শেয়ার হালাল হওয়াটা খুবই দুর্বল মত। 
ইসলামী ব্যাংকিংকে নাকচ করার জন্য লেখক যেসব বিষয়ের উপর বেশি ফোকাস করেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো ফ্র্যাকশনাল ব্যাংকিং। এটি নিয়ে আমি এই লেখায় কোন মন্তব্য করছি না। কারণ মাঠপর্যায়ে ব্যাংকিং ব্যাবস্থার এই বিষয়ের সাথে আমার তেমন পরিচয় নাই। 
আমি বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু কিছু বিষয় তুলে ধরলাম নিজের পাঠ-পর্যালোচনার খাতিরে। পর্যাপ্ত সময় হাতে থাকলে আরো অনেক পয়েন্ট দেখাতাম। যাইহোক, কেউ যেন এমন না ভাবেন যে আমি তাকি সাহেবের সমালোচনা নিতে পারছি না বলে এসব বলছি। তাকি সাহেবের ব্যাংকিং নিয়ে উপস্থাপিত দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের একজন সালিমুল্লাহ খান সাহেবের নেতৃত্বে একদল মুফতিও করেছেন। বানূরি টাউন থেকে সেটি প্রকাশিত হয়েছে 'মুরাওয়াজা ইসলামি ব্যাংকারি' নামে। সেটি আমি পড়েছি। সেখানেও তাকি সাহেবের সেম বইয়ের পয়েন্ট ধরেধরে সমালোচনা করা হয়েছে। ওগুলো অনেক গোছালো, যৌক্তিক ও দলিল নির্ভর। মোঘল সাহেবের মত এমন বিক্ষিপ্ত, ভাসাভাসা আর নড়বড়ে না। (তকি সাহেব আবার 'মুরাওয়াজা ইসলামি ব্যাংকারি' বইয়ের জবাবে লিখেছেন 'গাইরে সূদি ব্যাংকারি'। ওটা এখনও পড়া শুরু করিনি। আগে সমালোচনাগুলো পড়লাম। এবার জবাব পড়া শুরু করা যাবে।) 
তবে তাকি সাহেবের সমালোচনার অধ্যায়টা বাদ দিলে বাকি আলোচনাগুলো ভালো ছিল। বিশেষত ১০৯ পৃষ্ঠার পর থেকে আলোচনাগুলো আমার ভাবনায় খোরাক যুগিয়েছে। তাত্ত্বিক আলোচনার বাইরে মাঠপর্যায়ে লেনদেনের দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামি ব্যাংকের কর্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলে একে ইসলামি বলার সুযোগ আসলেই তেমন থাকে না। বিশেষত যখন কিনা ইসলামি ব্যাংকিংয়ের মূল বিনিয়োগ ব্যবস্থা মুদ্বারাবা ও শিরকতকে বাদ দিয়ে মুরাবাহা মুআজ্জালা ও ইজারাকে ইসলামি ব্যাংক মূল বানিয়ে নিয়েছে। যা কিনা আসলে সুদেরই এক প্রকাল হীলা। ওজরের হালতে যেটাকে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়েছে, যাতে পর্যায়ক্রমে সেগুলো থেকে মুক্ত হয়ে মূল বিনিয়োগ-ব্যবস্থার দিকে ফিরে যাওয়া যায়, ইসলামি ব্যাংকগুলো সেটাকেই আজ আঁকড়ে ধরেছে। তাছাড়া মুরাবাহা আর ইজারার ক্ষেত্রেও যথাযথ শর্তগুলো ঠিক মতো পূরণ করে না। ফলে নামকাওয়াস্তে মুরাবাহ, ইজারা হলেও বাস্তবে তা বৈধ হয় না। 
সবমিলিয়ে বইটি পড়ে উপকৃত হয়েছি। ব্যাংকের ফিকহী সমালোচনার পাশাপাশি নযরী সমালোচনার সাথেও পরিচিত হলাম। লেখক এক তকি উসমানিকে টার্গেট না করে স্বাভাবিকভাবে আলোচনা করলে সেটি মনে হয় আরও মজবুত ও টেকসই হতো। এখন ব্যক্তি-কেন্দ্রিক আলোচনাতে ঢুকে পড়ায় পুরো বিষয়টি নড়বড়ে আর হালকা লাগল। 
সবশেষে প্রকাশনীকে ধন্যবাদ। বইটি আমাকে হাদিয়ে দেওয়া না হলে হয়ত এমন খুটিয়ে/দাগিয়ে পড়া সম্ভব হতো না। ফলে এই পাঠ-পর্যালোচনারও জন্ম হতো না।
------------------ 
লিখেছেনঃ Abdullah Al Masud



মন্তব্যসমূহ

এই সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

ডাউনলোড করুন মাকতাবায়ে শামেলা লেটেস্ট ভার্শন (মোবাইল এবং পিসির জন্য)

রুকইয়াহ আশ-শারইয়্যাহ (ডাউনলোড)

ইসতিখারার সুন্নত তরিকা + pdf