মহিলারা কি ঘরে ইতিকাফ করতে পারবে না?

মহিলাদের এতেকাফের অবস্থানস্থল সালাফে সালেহীনদের যুগ থেকেই কয়েকটি মত রয়েছে। সাহাবী হোযায়ফা রা. এর মতে মসজিদে নববী, মসজিদে হারাম ও মসজিদে আকসা। কেবল এই ৩ মসজিদেই এতেকাফ করা যাবে। তাবেয়ী আতা রহ. এর মতে মাত্র দুটি মসজিদে এতেকাফ করা যাবে। মসজিদে নববী ও মসজিদে হারাম! অপর তাবেয়ী ইবনুল মুসায়্যিব এর মতে শুধুমাত্র মসজিদে নববীতেই এতেকাফ করা যাবে।
(মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৪/৩৪৯)

এদিকে, অনেক ইমামের মতে কেবল জুময়া হয় এমন মসজিদে এতেকাফ করা যাবে।
এই জাতীয় বিভিন্ন মতামত সাহাবী তাবেয়ীদের থেকে প্রমাণিত। হানাফী মাজহাব মতে, মহিলাদের এতেকাফ বাসার যে স্থানে নামাজ আদায় করে। সে স্থানে বা কক্ষে এতেকাফ করতে হবে। নির্দিষ্ট না থাকলে নির্দিষ্ট করে নিতে হবে। একই মত ইমাম শাফেয়ী রহ.। এছাড়া মালেকী মাজহাবের অনেক ফকীহদের মতও তাই। কারণ, হাদিসে নফল ঘরকে ইবাদাতের স্থান বলা হয়েছে।

সম্প্রতি প্রচার করা হচ্ছে যে, মহিলারা মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও এতেকাফ করতে পারবে না। সাথে স্বভাবসুলভ এ দাবীও করা হচ্ছে, মসজিদের বাইরে এতেকাফের কোন দলীল নেই! এই লেখায় কিছু দলীল উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ, যাতে ঘরে মহিলারা এতেকাফ করতে দ্বিধা ও হীনম্মন্যতায় না ভোগেন। যারা মনে করেন মসজিদের বাইরে এতেকাফ হবেই না, তাদেরকে আমাদের মত মানতে বাধ্য করা মোটেও উদ্দেশ্য না।

দলীল-

১- মেয়েদের মসজিদ হচ্ছে, মেয়েদের ঘর। একাধিক সহীহ হাদিসে মহিলাদেরকে ঘরের কোণে নামাজ আদায় করতে বলা হয়েছে।
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ أَنّ رَسُولَ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - قَالَ: "خَيْرُ مَسَاجِدِ النِّسَاءِ قَعْرُ بِيُوتِهِنَّ ".
উম্মে সালাম রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. বলেন
"মেয়েদের উত্তম মাসজিদ হচ্ছে তাদের ঘরের কোণ।"
মুসনাদে আহমদ- ২৬৫৪২, সহীহ ইবনে খুযাইমা- ১৬৮৩, তাবারানী কাবীর- ৭০৯, মুস্তাদরাক ৭৫৬, (ইমাম যাহাবী, বুসীরী প্রমুখের মতে হাদিসটি সহীহ। শায়খ আরনাউত, শায়খ আলবানি এটাকে হাসান বলেছেন)

এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, ঘরই হচ্ছে মহিলাদের জন্যে উত্তম মসজিদ। মহিলারা ঘরেই একটা স্থান নির্ধারণ করে এতকাফ করবে।

২- আয়েশা রা. মসজিদের বাইরে এতেকাফ করেছিলেন।
عَنِ ابْنِ أَبِي مُلَيْكَةَ قَالَ: «اعْتَكَفَتْ عَائِشَةُ بَيْنَ حِرَاءَ، وَثَبِيرٍ فَكُنَّا نَأْتِيهَا هُنَاكَ، وَعَبْدٌ لَهَا يَؤُمُّهَا»
ইবনে আবী মুলাইকা বলেন, আয়েশা রা. হেরা ও ছাবীর/ছুবাইর পাহাড়ের মাঝে এতেকাফ করলেন। আমরা তাকে সেখানে নিয়ে যেতাম, আর তার এক গোলাম তাকে পথনির্দেশ করত।
(মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক- ৮০২১ সহীহ)

৩- বিখ্যাত তাবেয়ী ইবরাহীম নাখয়ী রহ. এর মতেও মহিলারা তাদের ঘরের নির্ধারিত নামাজের স্থানে এতেকাফ করতে পারবে।
عَنْ مُغِيرَةَ قَالَ: سَأَلْتُ إِبْرَاهِيمَ عَنِ امْرَأَةٍ اعْتَكَفَتْ فِي مَسْجِدِ بَيْتِهَا، أَتَمُرُّ فِي ظُلَّتِهَا؟ قَالَ: «نَعَمْ، هُوَ طَرِيقٌ» قَالَ: قُلْتُ: اعْتَكَفَتْ فِي ظُلَّتِهَا، أَتَمُرُّ فِي بَيْتِهَا؟ قَالَ: «لَا»
মুগীরা রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন। আমি ইবরাহীম নাখয়ী রহ. কে জিজ্ঞেস করলাম ঐ মহিলা সম্পর্কে যে তার নিজ ঘরে নামাজের স্থানে এতেকাফ করেছে। উক্ত মহিলা কি তাবুতে যেতে পারবে? ইবরাহীম নাখয়ী বললেন, হ্যা পারবে। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, যে মহিলা তাবুতে এতেকাফ করেছে। সে কি ঘরে যেতে পারবে? তিনি বললেন, পারবে না।
(মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক- ৮০২৩ সহীহ)

৪- এছাড়াও শাবী, সুফিয়ান ছাওরী, ইবনে উলাইয়্যাহ প্রমুখ ফকীহ তাবেয়ীদের মতও অনুরুপ!
(মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক- ৮০২৪)


- ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, 'মহিলাদের ঘরের নির্দিষ্ট নামাজের স্থান এর বাদে মসজিদে এতেকাফ করাকে আমি অপছন্দ করি। কারণ সেখানে মুসাফির থেকে নিয়ে নানারকম পুরুষ রাত্রিযাপন করে।'
(মারেফাতুস সুনানি ওয়াল আছার- তাহাবী ৬/৪০২- ৯১১৪)

ইমাম শাফেয়ীর অন্য একটি মত হচ্ছে, মহিলারা, গোলাম ও মুসাফির যেখানে খুশি এতেকাফ করতে পারবে। কেননা তাদের উপর জুময়া ফরজ নয়। সুতরাং জামে মসজিদে এতেকাফ করা জরুরি না।
(শারহু সাহিহীল বুখারী - ইবনে বাত্তাল ৪/১৬৯, আল এস্তেযকার - ইবনে আব্দিল বার ৩/৩৮৬)
.
ইমাম শাফেয়ী রহ. এই মতটি দেয়ার পিছনে যে দলীলটি দেন, যে একবার রাসূল সা. এতেকাফ এর নিয়ত করেও সেটা বাদ দিয়ে দেন, কারণ রাসূল সা. এর তাবুর পাশে একাধিক স্ত্রী তাবু গেড়েছিল এতেকাফের জন্যে। পরবর্তীতে রাসূল সা. তা কাযাও করেন।
এই ঘটনাটি বুখারীসহ বিভিন্ন কিতাবে শব্দের বর্ণনার ভিন্নতাসমেত উদ্ধৃত হয়েছে। (বুখারী ২০৩৩, এতেকাফ অধ্যায়। ফাতহুল বারী এই সংশ্লিষ্ট পুরো আলোচনাটা অধ্যয়ন করা যেতে পারে।)
এখানে রাসূল সা. মহিলাদের এভাবে মসজিদে এতেকাফ করাকে পছন্দ করেন নি।

أولا كان ذلك خفيفا بالنسبة إلى ما يفضي إليه الأمر من توارد بقية النسوة على ذلك فيضيق المسجد على المصلين ، أو بالنسبة إلى أن اجتماع النسوة عنده يصيره كالجالس في بيته ، وربما شغلنه عن التخلي لما قصد من العبادة فيفوت مقصود الاعتكاف .
ইবনে হাজার রহ. কতক কারণ উল্লেখ করেছনে কেন রাসূল সা. এতেকাফ ছেড়ে দিলেন। তার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে, মহিলাদের এভাবে উপস্থিতির কারণে স্থান সংকীর্ণ হয়ে যাবে মুসল্লীদের জন্যে। অথবা মহিলাদের এভাবে উপস্থিতির ফলে রাসূল সা. এর কাছে মনে হতে পারে যে তিনি মসজিদে নয়, যেন বাড়িতেই অবস্থান করছেন। এতে এতকাফের উদ্দেশ্যই বিঘ্নিত হয়।
(ফাতহুল বারী ৪/২৭৫)

আরো দেখুনঃ
বাদায়েউস সানায়ে' খন্ড ২ পেজঃ১১২ ,কিতাবুল ই'তেকাফ-সিহহাতু শারায়িত্বিল ইতেকাফ; আবুল হাসান আব্দুল্লাহ আল মুবারাকপুরির কিতাব(আহলে হাদিস) ''মিরয়াতুল মাফাতীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ ৭/১৪৪;উমদাতুল কারি ১১ /২৮৭,কিতাবুল ইতেকাফ

এখানে একটি অভিযোগের খন্ডন সংযোজন করা হল-

অনেকেই বলে থাকে কুরআনে আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ
ওয়া আনতুম আ'কিফুনা ফি মাসাজিদ.......
সুতরাং এতেকাফের জন্য মাসজিদ জরুরী!

জবাবঃ
আসলে এখানে মাসজিদের সাথে আল্লাহ্‌ ই'তেকাফকে শর্ত করেছেন তার স্পষ্ট কোন কিনায়া(ইশারা) পাওয়া যায়না।বরং এর ভিন্নই বুঝা যায়। উপরন্তু মাসজিদ যদি শর্ত হয়েও থাকে তবুও উপরে সহীহ হাদিস প্রদান করা হয়েছে যে ্মহিলাদের উত্তম মাসজিদ তাদের ঘর।

উল্লেখ্য যে এ বাক্যের মাঝে আল্লাহ্‌ জাল্লা শানূহু 'ওয়াও' অক্ষরটি এনেছেন আর তা নাহু ও সরফের ভাষায় ''জরফে যামানী'' তথা ''ওয়াওয়ে হালিয়্যাহ'' ।
মূলত এই হরফ ''ওয়াও'' আরবী ভাষায় ৯ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় আবার কেউ কেউ ১৫ টি ক্ষেত্রেও বলেছেন। এই আয়াতে উল্লেখিত 'ওয়াও'টি এই নয় প্রকারের মাঝে হালিয়্যাহ যা 'জুমলায়ে ইসমিয়্যাহ' বা 'ফে'লিয়া'র মাঝে প্রবেশ করে। কাজেই এটি এই ওয়াও এ হালিয়্যাহ ইসম বা ফা'য়েলের অবস্থা বুঝায় কিন্তু কোন শর্ত বুঝাবেনা।
এছাড়াও ওয়াও এ হালিয়্যা হওয়ার ৩ টি শর্ত রয়েছে যা সবই এই আয়াতের ওয়াওয়ের মাঝে পাওয়া যায় । আর ওয়াও এ হালিয়্যার খুসুসিয়্যাত হচ্ছে এটি জুমলায়ে খবরিয়্যা হয় ইনশাইয়্যাহ নয় অর্থাৎ ইসতেফহাম, আমর ও নিদার কোন নির্দেশনা সূচক অক্ষর এতে বা ইঙ্গিত পাওয়া যাবেনা।

সুতরাং উক্ত আয়াতের 'ওয়াও'টি হালিয়্যা হওয়ার কারনে বরং ই'তেকাফের স্থানের হুকুম মাসজিদের সাথে আ'ম হয়েছে খাছ হয়নি, যার কারনে এতে এই শর্ত যুক্ত হয়নি যে,মাসজিদ ছাড়া একদমই এ'তেকাফ হবেনা

যাহোক, আলোচনা দীর্ঘ না করে এখানেই থামতে হচ্ছে। যারা প্রচার করছেন যে মহিলারা ঘরে এতেকাফ করবে না। তাদের প্রতি বিনয়াবনত অনুরোধ, অযথা উম্মাহকে পেরেশান করবেন না। এতেকাফের স্থান নিয়ে সালাফে সালেহীনদের থেকেই নানা মত ছিল। আপনার কাছে কোন মত প্রাধান্য পেলে মানতে থাকুন, অন্যকে মানানোর জন্যে জোর করতে গেলেই ফেতনা ও অশান্তি সৃষ্টি হয়। কী দরকার নতুন নতুন পেরেশানি সৃষ্টি করার?




-
প্রবন্ধটি যৌথভাবে প্রস্তুত করেছেন-
শায়খ আব্দুল্লাহ আল মাহমূদ এবং শায়খ আব্দুল্লাহ আল মামূন (হাফিজাহুমুল্লাহ)
.
মহিলাদের ইতেকাফের বিস্তারিত মাসায়েল জানতে দেখুন- http://talimtube.blogspot.com/2017/06/meyeder-itekafer-bidhan.html

মন্তব্যসমূহ

এই সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

ডাউনলোড করুন মাকতাবায়ে শামেলা লেটেস্ট ভার্শন (মোবাইল এবং পিসির জন্য)

রুকইয়াহ আশ-শারইয়্যাহ (ডাউনলোড)

ইসতিখারার সুন্নত তরিকা + pdf