প্রসঙ্গ : ‘জাযাকাল্লাহ’

* জাযাকাল্লাহর ফাজায়েল

১- মহান রাব্বুল আলামীন বলেন,
هَلْ جَزَآءُ ٱلْإِحْسَٰنِ إِلَّا ٱلْإِحْسَٰنُ
এহসান এর প্রতিদান এহসান ছাড়া আর কী হতে পারে? (সুরা আররহমান- ৬০)
২- হযরত উসামা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমার প্রতি যদি কেউ কৃতজ্ঞতার আচরণ করে তখন যদি তুমি তাকে জাযাকাল্লাহ খাইরান (আল্লাহ তোমাকে উত্তম বিনিময় দান করুন) বল তাহলেই তুমি তার যথাযোগ্য প্রশংসা করলে।
-জামে তিরমিযী, হাদীস : ২০৩৫; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৪১৩- সহীহ
৩ - অন্য হাদীসে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন,. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি তোমাদের সাথে সদ্ব্যবহার করে তোমরা তার উত্তম প্রতিদান দাও। (অর্থাৎ মাল/সম্পদ এর মাধ্যমে) প্রতিদান দেয়ার মতো কিছু না পেলে তার জন্য দু‘আ করতে থাকো, যতক্ষণ না তোমরা অনুধাবন করতে পারো যে, তোমরা তার প্রতিদান দিতে পেরেছো।
-সুনানে আবু দাউদ ১৬৭২, নাসায়ী- ২৫৬৬ ; আল আদাবুল মুফরাদ লিলবুখারী ২১৬- সহীহ
৪- হজরত ওমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন "তোমরা যদি জানতে, তোমাদের ভাইদের জন্যে তোমাদের বলা কথা "জাযাকাল্লাহু খাইরান" এর মধ্যে কী কল্যাণ ও ফাযায়েল নিহিত রয়েছে, তাহলে একে অন্যের সাথে প্রতিযোগী হয়ে বেশি বেশি 'জাযাকাল্লাহু খাইরান' বলতে।
-আল আদাবু লি ইবনে আবী শাইবা ২৩৪- মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা- ২৬৫১৯ সহীহ,
৫- "জাযাকাল্লাহ খাইরান" এটি সাহাবীদের অভ্যাসের অংশ ছিল। বিভিন্ন হাদিসের দ্বারা বোঝা যায়, এটি সাহাবাদের মাঝে ব্যাপক প্রচলন ছিল। যেমন- বুখারী- ৩৩৬/ মুসলিম-৩৬৭/ মুসলিম-১৮২৩, ইবনে হিব্বান- ৭২৭৭/ আল ওয়ারউ লিইমাম আহমদ- ২৫০/ আযযুহদ লাহু- ১১৪০ ইত্যাদি। আকৃতি বেড়ে যাওয়ার আশংকায় শুধু হাদিস নাম্বারগুলো উল্লেখ করেই থামতে হলো।

* হাদিসে বর্ণিত শব্দ

হাদিসে বর্ণিত শব্দগুলো প্রায় কাছাকাছি..
হাদিসের বেশিরভাগ রেওয়ায়েতেই "জাযাকাল্লাহু খাইরান" আছে। বলতে গেলে প্রায় সবগুলোতেই। কখনো এমন আছে "জাযাকাল্লাহু আন্নি/ আন্না/ আন ফুলান/ খাইরান"। অর্থাৎ আমার পক্ষ থেকে/আমাদের পক্ষ থেকে বা অমুকের পক্ষ থেকে জাযাকাল্লাহু খাইরান। কখনো শুধু জাযাকাল্লাহু খাইরান আছে। যেসব হাদিসে কৃতজ্ঞতা জানানোর পরামর্শ এসেছে, সেখানে জাযাকাল্লাহু খাইরান বলা আছে।
শুধু জাযাকাল্লাহ আমি দেখি নি। বরং এর বাড়তি দেখেছি। জাযাকাল্লাহুল জান্নাহ। আবু সাইদ রা. এন্তাকালের সময় ইবনে আব্বাস রা. এটা বলেছেন।
فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: جَزَاكَ اللَّهُ يَا أَبَا سَعِيدٍ الْجَنَّةَ
মুস্তাদরাকে হাকেম - ২২৮২

* জাযাকাল্লাহর জবাব

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম "জাযাকাল্লাহু খাইরান" এর উত্তরে বলেছেন "ওয়া আনতুম ফাজাযাকাল্লাহু খাইরান"!
অবশ্য বর্ণনাকারী সন্দেহ করেছেন, সাহাবাগণ "জাযাকাল্লাহু খাইরান'' বলেছেন নাকি "জাযাকাল্লাহু আতয়াবাল জাযা" বলেছেন? আর এর উত্তরে রাসূল সা. ''ফাজাযাকাল্লাহু খাইরান" বলেছেন, নাকি "ফাজাযাকাল্লাহু আতয়াবাল জাযা'' বলেছেন?
فَقَالَ لَه أُسَيْدُ بْنُ حُضَيْرٍ مُسْتَشْكِرًا: جَزَاكَ اللهُ أَيْ نَبِيَّ اللهِ أَطْيَبَ الْجَزَاءِ، أَوْ قَالَ: «خَيْرًا» فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «وَأَنْتُمْ مَعْشَرَ الْأَنْصَارِ، فَجَزَاكُمُ اللهُ أَطْيَبَ الْجَزَاءِ» أَوْ قَالَ: «خَيْرًا
(নাসায়ী কুবরা 8287 ইবনে হিব্বান 7277, 7279 -সহীহ)
* সমার্থক শব্দ
জাযাকাল্লাহু খাইরান ছাড়াও আরো কিছু শব্দ আছারে সাহাবার মধ্যে পাওয়া যায়। যেমন, "জাযাকাল্লাহুল আহসানাল জাযা"! হজরত ওমর রা. যখন আবু লুলু আল মাজুসীর আক্রমণে মারাত্মক আহত হলেন। তখন তিনি দুধ সন্ধান করলেন। সাহাবগণ দুধ এনে দিলে তিনি তা পান করেন, আর দুধ পেটের ক্ষতস্থান দিয়ে বেরিয়ে আসে। সাহাবাগণ বুঝতে পারলেন, হজরত ওমর রা. এর খুব বেশি সময় নেই। তখন উপস্থিত সাহাবাগণ বলেছিলেন, "জাযাকাল্লাহু খাইরান। আপনি আমাদের মাঝে আল্লাহর কিতাব দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন এবং আপনার সংগীদ্বয় (নবীজী সা. ও আবু বকর রা.) এর সুন্নাহ অনুসরণ করেছেন। "জাযাকাল্লাহু আহসানাল জাযা"
(মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা- ৩৭০৭৪)
জাযাকাল্লাহু খাইরান ছাড়া আরেকটি শব্দ পাওয়া যায়। তবে সেটা রাবীর সন্দেহ থেকে বর্ণিত। সেটা হচ্ছে "জাযাকাল্লাহু আতয়াবাল জাযা"!
*** "বারাকাল্লাহু ফিক" বলা--
হাদিস থেকে প্রমাণিত, সাহাবাদের মাঝে কেও উপকার বা দান করলে, সেক্ষেত্রে জাযাকাল্লাহু খাইরান এর জায়াগায় কখনো "বারাকাল্লাহু ফিকুম" বলেছেন।
- আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. কে বকরী হাদিয়া দেয়া হলো। রাসূল সা. আয়েশা রা. কে সে বকরী সবার মাঝে ভাগ করে দান করে দিতে বললেন। আয়েশা রা. খাদেমার সাহায্যে বিভিন্ন স্থানে গোস্ত বিতরণ করলেন। তারপর খাদেমাকে জিজ্ঞেস করলেন "তারা তোমাকে কী বলল? খাদেমা বলল "তারা বলেছে বারাকাল্লাহু ফিকুম"! আয়েশা রা. তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন "ওয়া ফিহীম বারাকাল্লাহ"! তারপর আয়েশা রা বললেন "আমরা তাদের উত্তরে তাদের মতই বলে দিব, আর আমাদের দানের সওয়াব উদ্ধৃত থাকবে"!!
অর্থাৎ দুয়ার বিনিময়ে দুয়া করে দিলাম। এবার দানের বিনিময় পাওয়া আমাদের জন্যে বাকী থেকে গেলো।
- সুনানুল কুবরা লিননাসায়ী, ১০১৩৫- হাসান
* জাযাকাল্লাহ এর উত্তরে ওয়া ইয়্যাকা বলা
জাজাকাল্লাহু খাইরান এর উত্তরে ইয়্যাকা বলার অর্থ হচ্ছে "আপনাকেও" অর্থাৎ, আল্লাহ আপনাকেও উত্তম বিনিময় দান করুন। এতে সংক্ষিপ্ত দুয়া হয়ে যাবে। কিন্তু রাসূল সা. বা আছারে সাহাবার অনুযায়ী হবে না। সুতরাং রাসূল সা. এর শব্দেই জবাব দেয়াই সর্বোত্তম। তাছাড়া আয়েশা রা. এর কর্মপন্থা দ্বারা বোঝা যায়, উত্তর প্রদানের ক্ষেত্রে সুন্নাহ হচ্ছে তার অনুরূপ উত্তর দেয়া। অথবা বেশি।
* শুধু জাযাকাল্লাহ বলা
শুধু জাযাকাল্লাহ বলার দ্বারা না সুন্নাহ আদায় হয়, না দুয়া পূর্ণাংগ হয়। কারণ জাযাকাল্লাহ এর অর্থ হচ্ছে "আল্লাহ আপনাকে বিনিময় দান করুন"! এতে কল্যাণ এর অর্থ স্পষ্ট নয়। হতে পারে কল্যাণ কামনা করে দুয়া অথবা অকল্যাণ। সুতরাং অসম্পূর্ণ দুয়া না করে উচিত পূর্ণ দুয়াটা করা।

* জাযাকাল্লাহু খাইরান এর অর্থ কী?

জাযা শব্দের অর্থ প্রতিদান/বিনিময়। আর খায়র অর্থ কল্যাণ/উত্তম। বাক্যের অর্থ- আল্লাহ আপনার উত্তম প্রতিদান দান করুন। সারমর্ম হচ্ছে, আমি আল্লাহর কাছে দুয়া করছি, যেন আল্লাহ আপনাকে অধিক কল্যাণ দান করেন।
কোন এক রেওয়ায়েতে সাহাবাদের কারো থেকে এমন দেখেছিলাম 'জাযাকাল্লাহুল খাইর'... তবে "আল খায়ের'' এর বদলে নাকেরাহ রাখাই ভালো। অর্থাৎ জাযাকাল্লাহু খাইরান। কারণ "খায়রান'' বললে ব্যাপক অর্থ বোঝায়।
একবার শায়েখ বিন বাজ রহ. কে কেও বলেছিল ''জাযাকাল্লাহু আলফা খায়র"! (এক হাজার কল্যাণ দান করুন) তিনি বললেন "ইয়া আখী! জাযাকাল্লাহু আলফা খায়র না বলে "জাযাকাল্লাহু খাইরান" ই বলো। কারণ নাকেরাহ ব্যাপক অর্থ নির্দেশ করে। সুতরাং তোমার এক হাজার কল্যাণ এর চেয়ে "খায়রান" বললে মিলিয়ন, বিলিয়ন কল্যাণকেও শামিল করবে। তুমি সংখ্যা উল্লেখ করে এটাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছ। অথচ আল্লাহর প্রতিদান তো অসীম!
আরবীতে এই দুয়া না পারলে বাংলাতেও এই অর্থবোধক বাক্য বলা যাবে।

অন্যান্য উদ্ধৃতি...
- ফায়দুল কাদির ১/৪১০ 
- শারহু রিয়াদিস সালিহীন লিবনে উসাইমিন- ৪/২২ 
- মেরকাত শারহুল মেশকাত- ৬/২১৩

والله اعلم بالصواب
---------
লিখেছেনঃ মুহাতারাম শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ

এই সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

ডাউনলোড করুন মাকতাবায়ে শামেলা লেটেস্ট ভার্শন (মোবাইল এবং পিসির জন্য)

রুকইয়াহ আশ-শারইয়্যাহ (ডাউনলোড)

ইসতিখারার সুন্নত তরিকা + pdf