সুপারিশের প্রতীক্ষা

বাজার থেকে ফিরছিলাম। সাথে আমার ফুফাতো ভাইসহ আরো কয়েকজন লোক ছিলেন। তারা কথায় কথায় বললেন, মাসউদ থাকতে অতো চিন্তা কী! সে যখন জান্নাতে যাবে তখন কি আর আমাদের না নিয়ে যাবে? শুনেছি একজন হাফেজ নাকি অনেকজনকে জান্নাতে নিয়ে যেতে পারবে সুপারিশ করার মাধ্যমে। একজনের এমন কথায় অন্যরাও দেখলাম সায় দিল। মাথা দুলিয়ে নিজেদের সহমতের কথা জানান দিল। আমি শুনছিলাম আর মুচকি মুচকি হাসছিলাম।

উনার কথা শেষ হবার পরে বললাম, আপনার কথার ভেতর ছোট একটা বাক্য ছুটে গেছে। সবাই এবার একযোগে আমার দিকে তাকালো। কী সেটা? বললাম, সেটা হল, যদি হাফেজ নিজে জান্নাতে যেতে পারে তাহলে। মানে সে নিজে যদি আগে জান্নাতে যেতে পারে তখন হয়তো আল্লাহ তাআলা তাকে সুযোগ দিবেন কিছু মানুষের ব্যাপারে সুপারিশ করতে। কিন্তু আগে তো হাফেজের নিজেকে জান্নাতে যেতে হবে। এখন আমি যে জান্নাতে যাবো তার নিশ্চয়তা কী? আমার পাল্টা জবাব শুনে এবার তারা কিছুটা থতমত খেয়ে গেল। বললো, এভাবে তো কেউ বলে না। সবাই বলে, একজন কুরআনে হাফেজ এতোজনকে জান্নাতে নিয়ে যাবেন।

আসলেও আমাদের সমাজে সুপারিশ নিয়ে এক ধরণের ভ্রান্তি আছে মানুষের ভেতর। অনেক মা-বাবা আগেভাগে নিয়ত করে রাখে ছেলেকে মাদরাসায় দিবে। যাতে পরকালের পথটা সুগম হয়। ছেলের হাত ধরে জান্নাতে চলে যেতে পারেন। এরপর ছেলেকে মাদরাসায় দিয়ে নিজে ধর্মেকর্মে অতোটা মনোযোগী হন না। হালাল রুজি রোজগার করছেন নাকি হারাম তার খবর থাকে না। তাদের ভেতর সেই ধারণাটা কাজ করতে থাকে- সন্তান তো আছেই আমাদের জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সুতরাং আমাদের অতো চিন্তা করার কী আছে!

অথচ কুরআনুল কারীম আমাদেরকে বিচার দিবসের ঘটিতব্য ঘটনা সুস্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে এভাবে:
'সেদিন মানুষ তার ভাই, মা-বাবা, স্ত্রী ও সন্তানসন্ততি সবার থেকে পলায়ন করবে। প্রত্যেকে সেদিন নিজস্ব চিন্তায় নিমগ্ন থাকবে।'¹

এই হল কুরআনের বক্তব্য। সেদিন তো সন্তানও মা-বাবাকে চিনবে না। যতোক্ষণ না সে নিজে হিসাবকিতাবের ঝামেলা থেকে নিজে মুক্ত হচ্ছে। সুতরাং এমন সন্তানের উপর ভরসা করে নিজে নিজের আখের গোছানো থেকে বিমুখ থাকা কি স্পষ্ট নির্বুদ্ধিতা নয়?

আপনি-আমি তো বহুত দূর কি বাত, খোদ আল্লাহর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই নিজের মেয়ে ফাতেমাকে অসিয়ত করেছেন নিজের আখেরাত গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। তিনি তাকে বলেছেন, 'হে মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতেমা, তুমি নিজেকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করার বন্দোবস্ত করো। আল্লাহর সিদ্ধান্তের মোকাবেলায় আমি তোমাদের জন্য কিছু করার ক্ষমতা রাখি না।'² আর একথা তো জানাই আছে যে, আমাদের তুলনায় ফাতেমা রা. তাঁর অনেক বেশি প্রিয় ছিলেন। তো তাঁর বিষয়েই যদি তিনি এমনটি বলে থাকেন তবে আমি আপনি কোন ছাড়!

অবশ্য নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতদের জন্য সুপারিশ করার অনুমতি লাভ করবেন আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে। তিনি এক হাদীসে ইরশাদ করেছেন, প্রত্যেক নবীরই এমন একটি বিশেষ দোআ ছিলো যার মাধ্যমে তিনি তার উম্মতের জন্য প্রার্থণা করেছেন। পরবর্তীতে সে দুআ কবুলও করা হয়। আল্লাহ চাহে তো আমি আমার উম্মতের জন্য কেয়ামতের দিন সুপরিশ করার লক্ষ্যে আমার দুআকে পরবর্তীতে করার ইচ্ছা পোষণ করি।³

সুপারিশ নিয়ে আমাদের সমাজের মানুষের মধ্যে দুই ধরনের প্রন্তিকতা পরিলক্ষিত হয়। এক শ্রেণী সুপারিশকে মানতেই চান না। বরং সুপারিশের কথা কেউ যদি বলে তবে তার দিকে শিরকের মতো গুরুতর অভিযোগের আঙ্গুল উত্থিত করেন। আরেক শ্রেণী আছে, যারা সুপারিশকে এতো বেশি বিশ্বাস করেন যে, এর উপর ভিত্তি করে নিজেরা নেক আমল করা থেকে পিছিয়ে থাকেন। নিঃসন্দেহে এই দুই শ্রেণীই বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়িতে লিপ্ত। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এই দুইয়ের মাঝামাঝি মধ্যমপন্থা বা সীরাতে মুস্তাকীমকে অনুসরণ করা।

সুপারিশের ব্যাপারে সঠিক বিশ্বাস কী হবে? চলুন প্রথমেই কুরআনুল কারীমের বক্তব্য দেখি। সূরা বাকারাতে আল্লাহ তাআলা বলছেন, 'কে আছে এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া?'⁴

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
'সেদিন সুপারিশ কোন উপকারে আসবে না। তবে দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দিবেন ও যার কথায় সন্তুষ্ট হবেন তার ব্যাপারটা ব্যতিক্রম।'⁵

তাঁর মানে একজন মুমিন অন্যজন মুমিনের জন্য সুপারিশ করতে পারবে তবে সেটা শর্তসাপেক্ষে। শর্তটা হলো, আগে আল্লাহর অনুমতি লাগবে। যে কেউ মন চাইলেই নিজের মতো সুপারিশ করতে পারবে না।

হাদীস থেকেও এই বিষয়ের সমর্থন পাওয়া যায়। সাহাবী ইবনু আবিল জাদআ রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন, 'আমার উম্মতের এক ব্যক্তির সুপারিশের কারণে তামীম গোত্রের চেয়েও বেশি লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে।' সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলো, 'সেই ব্যক্তি কি আপনি ভিন্ন অন্য কেউ?' তিনি উত্তর দিলেন, হা, আমি ভিন্ন অন্য কেউ।'⁶

তারমানে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়াও তার উম্মতের অন্য লোকেরাও আল্লাহর অনুমতিক্রমে সুপারিশ করার অধিকার লাভ করবে।

এই হাদীসের একজন ব্যক্তির দ্বারা অনেকে হযরত উসমান রা., আবার অনেকে হযরত উয়াইস আলকরনী রাহ. কে ইঙ্গিত করার মত ব্যক্ত করেছেন। আবার অনেকে কারো সাথে বিশেষায়িত না করে বিষয়টা স্বাভাবিক অবস্থায় রেখেছেন। কাউকে সুনির্দিষ্ট করে দেন নি। আর আমার মনে হয় এটাই সবচে সুন্দর। তাহলে বিষয়টা অনেক বেশি ব্যাপক থাকে।⁷

উসমান বিন আফফান রা. থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদীসে তো একেবারে খোলাখুলি বলা হয়েছে, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তিন শ্রেণির লোক কেয়ামতের দিন সুপারিশ করার সুযোগ পাবে। নবীগণ, আলেমগণ ও শহীদগণ।⁸

এবার সুপারিশ বিষয়ক একটা ঘটনা শুনাই। কেয়ামতের মাঠে ঘটিতব্য ঘটনা। এটি আনাস রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। হিসাবনিকাশ শেষ হয়ে যাবার পর একজন জান্নাতি ব্যক্তি জহান্নামীদের পাশ দিয়ে যাবে। তখন জাহান্নামের একব্যক্তি তাকে ডাক দিয়ে বলবে, হে অমুক, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছো না? সে বলবে, না তো! আল্লাহর কসম আমি তোমাকে চিনতে পারছি না। বলো তুমি কে? সে বলবে, আমি হলাম সেই ব্যক্তি, দুনিয়াতে তুমি যার পাশ দিয়ে যাবার সময় একটু পানি পান করতে চেয়েছিলে। তখন আমি তোমাকে পানি পান করিয়েছিলাম। সুতরাং তুমি আমার জন্য তোমার রব্বের কাছে এতটু সুপারিশ করো। তখন সে ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে গিয়ে বলবে, হে আমার রব্ব, আমি জাহান্নামীদের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন তাদের মধ্য হতে একব্যক্তি আমাকে ডেকে বললো, হে অমুক, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছো না? আমি বললাম, না চিনতে পারছি না। তখন মে জানালো, আমি হলাম সেই ব্যক্তি, দুনিয়াতে তুমি যার পাশ দিয়ে যাবার সময় একটু পানি পান করতে চেয়েছিলে। তখন আমি তোমাকে পানি পান করিয়েছিলাম। সুতরাং তুমি আমার জন্য তোমার রব্বের কাছে এতটু সুপারিশ করো। সুতরাং তুমি তার বিষয়ে আমাকে সুপারিশ করার সুযোগ দাও। তখন আল্লাহ তাআলা তাকে ওই ব্যক্তির ব্যাপারে সুপারিশ করার সুযোগ দিবেন এবং সে তাকে জাহান্নাম থেকে বের করে আনবে।⁹

তো আল্লাহ তাআলা এই অধিকার তার কোন বান্দাদের দান করবেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই অধিকার তারাই লাভ করবে, যারা দুনিয়াতে তাকে ভয় করে যথাযথ ইবাদাত পালন করার মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং কেউ যদি লেংটা বাবার মুরিদ হয়ে ভাবে, বাবা থাকতে আমার আর চিন্তা কী! তিনিই আমাকে রোজহাশরে পার করাবেন তবে অবশ্যই সে ধোকাগ্রস্থ ও কঠিন বিপদে আক্রান্ত।

পীর সাহেব ও বাবা সাহেব নিজে জান্নাতে যাবেন কিনা তারই তো কোন গ্যারান্টি নাই। সুতরাং বাবার পেছনে না পড়ে নিজের জান্নাত নিজেকেই অর্জন করে নিতে হবে। অবশ্য দীনের পথে অটল থাকার জন্য এবং নিজের আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য সৎ লোকদের সংস্রব গ্রহণ অবশ্যই প্রসংশনীয় ও পছন্দনীয় কাজ। তবে তার মানে এই নয় যে, কোন এক দরবারের মুরীদ হয়ে নিজেকে নিরাপদ ভেবে হাতপা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে। শুধু বছরে একবার করে ওরশ অনুষ্ঠানে কিছু হাদিয়া-তোহফা সাথে করে হাজির হলেই হবে!

সুপারিশ কেন্দ্রিক এই প্রান্তিকতা অবশ্যই বর্জনীয়। বরং এই বিষয়ে শরীয়তের যে মধ্যপন্থী নির্দেশনা তা মেনে নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে আমাদের মঙ্গল।

তবে এটা তো বাস্তব যে, একজন হাফেজে কুরআন আল্লাহর কাছে প্রভূত সম্মানের অধিকারী হবে। সে অন্যদের জন্য সুপারিশ করার সুযোগ পাক বা না পাক কুরআন কিন্তু ঠিকই তার জন্য উপযাজক হয়ে সুপারিশ করতে আসবে। এই বিষয়ে হাদীস থেকে একটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি।

সাহাবী আবু উমামা রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন, তোমরা কুরআন পাঠ করো। কারণ সে কেয়ামতের ময়দানে তার পাঠকারীর জন্য সুপারিশকারীরূপে আগমন করবে।¹⁰

তবে যেসব মা-বাবা তার সন্তানকে হাফেজ বানান তাদেরও এই লেখা পড়ে নিরাশ হবার কিছু নাই। কারণ হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে ও সে অনুযায়ী আমল করে কেয়ামতের দিন তার মা-বাবাকে এমন মুকুট পরিধান করানো হবে, যার আলো সূর্যের আলোর চেয়েও বেশি সৌন্দর্যমণ্ডিত।¹¹

তো এখন সন্তান যদি হাফেজ হয় আর কুরআনের বিধান অনুযায়ী আমল না করে তাহলে কিন্তু এই সম্মান থেকে মা-বাবাকে বঞ্চিত হতে হবে। সুতরাং সন্তানকে হাফেজ বানানো যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তারচে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাকে আমলদার ও পরহেযগার হিসেবে গড়ে তোলা। অন্যথায় স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই রয়ে যাবে। বাস্তব রূপ আর লাভ করবে না।

[তথ্যসূত্র:
① সূরা আবাসা, আয়াত নং: ৩৪-৩৭
② মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং: ৮৪০২
③ মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং: ৯৩০৯
④ সূরা বাকারা, আয়াত: ২৫৫
⑤ সূরা ত্বহা, আয়াত: ১০৯
⑥ মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং: ১৫৮৫৮, ইবনে মাজাহ, হাদীস নং: ৪৩১৬
⑦ মিরকাত লি মুল্লা আলী ক্বারী, হাদীস নং: ৫৬০১
⑧ ইবনে মাজাহ, হাদীস নং: ৪৩১৩, হাদীসটির সনদ নিয়ে কেউ কেউ আপত্তি করেছেন। আবার কেউ কেউ এই আপত্তিকে সহনীয় পর্যায়ের বলেছেন।
⑨ মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস নং: ৩৪৯০
10. সহীহুল বুখারী, হাদীস নং: ৫০২৬
11. আবু দাউদ, হাদীস নং: ১৪৫৩]

------------------
লিখেছেনঃ Abdullah Al Masud

মন্তব্যসমূহ

এই সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

ডাউনলোড করুন মাকতাবায়ে শামেলা লেটেস্ট ভার্শন (মোবাইল এবং পিসির জন্য)

রুকইয়াহ আশ-শারইয়্যাহ (ডাউনলোড)

ইসতিখারার সুন্নত তরিকা + pdf