বাহাওয়ালপুর মোকদ্দমা : পিতা ও কন্যার ত্যাগের গল্প

(পর্ব-১)
-------
মধ্যরাত। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ।
বাহাওয়ালপুরের এক নির্জন পথে হেঁটে যাচ্ছেন মৌলবী এলাহি বখশ ও তার কিশোরী মেয়ে। আকাশে উঠেছে মস্ত চাঁদ। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে মাঠ-ঘাট-পথ। রাস্তার দুপাশে থাকা গাছের সারি পথের মাঝে ছোপ ছোপ অন্ধকার জন্ম দিয়েছে। এলাহি বখশ পথ চলছেন দ্রুত, এক হাতে শক্ত করে ধরেছেন প্রিয় মেয়ের হাত। অন্য হাতে আছে কাপড়ের থলে। একটু পর পর আতংকিত চেহারা নিয়ে তিনি পেছনে তাকাচ্ছেন। বুঝার চেষ্টা করছেন ধাওয়াকারিরা পেছন চলে এলো কিনা। খুব দ্রুত পালাতে হয়েছে তাদের। এমনকি বের হওয়ার সময় পিতা-কন্যা দুজনের কেউই জুতা নিয়ে আসতে পারেননি। পথ চলছেন খালি পায়ে। মাঝে মাঝে কংকরে পা পড়লে ব্যাথায় বিকৃত হয়ে যাচ্ছে চেহারা।
পিতা-কন্যা দুজন কোনো কথা বলছেন না। গত এক বছর ধরে তারা এই পালানোর সাথে অভ্যস্ত। পালাতে পালাতে তারা ক্লান্ত হয়ে গেছেন। কত গ্রাম ঘুরলেন, কত জনপদ দেখলেন এলাহি বখশ । যেখানেই কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর সন্ধান পেয়েছেন, ছুটে গেছেন তার বাড়িতে। চেয়েছেন আশ্রয়। ফিরিয়ে দেননি কেউ। থাকার ব্যবস্থা করেছে সবাই। কিন্তু দ্রুত সংবাদ জেনে যায় ধাওয়াকারীরা। তারা ছুটে আসে হিংস্রতা নিয়ে। বাধ্য হয়ে মেয়েকে নিয়ে আবার ভিন্ন পথ ধরেন এলাহি বখশ ।
‘সব কিছুর সূচনা বছর কয়েক আগে একটি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার মাধ্যমে’ তিক্ত মনে ভাবলেন এলাহি বখশ।
-
বাহাওয়ালপুরের আর দশজন কৃষকের মতই সাদামাটা ছিল এলাহি বখশের জীবন। ছোটবেলা থেকে শিখেছেন কৃষিকাজ, পিতাকে সাহায্য করেছেন ফসলের মাঠে। গ্রামে শিক্ষার কোনো পরিবেশ ছিল না। শুধু স্থানীয় জমিদারের ছেলেরাই পড়তে যেত অনেক দূরের জেলা স্কুলে। ঘোড়ার পিঠে চড়ে তারা যখন স্কুলে যেত, এলাহি বখশ ফসলের মাঠ থেকে সে দৃশ্য দেখে আবার কাজে মন দিতেন। সময় গড়ালো, এলাহি বখশ যুবক হলেন। বাল্যকাল থেকে পরিশ্রম করে তিনি এখন সুঠামদেহের অধিকারী। গ্রামের রীতি অনুযায়ী দেরি না করে পিতা তার বিয়ে দিলেন স্থানীয় এক মেয়ের সাথে।
বিয়ের পর এলাহি বখশের ভেতরে কিছু পরিবর্তন এলো। এই প্রথম তিনি ইলম অর্জনের প্রতি আগ্রহ বোধ করলেন। তার বারবার মনে হলো ইলম অর্জন না করলে জীবন বৃথা। ভেবে দেখলেন বছরে কয়েক মাস মাঠে কাজ করলেই সারা বছরের প্রয়োজনীয় ফসলের ব্যবস্থা হয়ে যায়। এর পর সামান্য যে খরচ দরকার হবে তা গবাদি পশুর মাধ্যমে সহজেই ব্যবস্থা করা যাবে। এই চিন্তা থেকে প্রতিবছর দুই মাস ফসলের মাঠে কাজ করতেন এলাহি বখশ। সারা বছরের জন্য প্রয়োজনীয় গমের ব্যবস্থা হলেই তিনি পরিবার থেকে বিদায় নিয়ে ছুটে যেতেন দুর এলাকায়। সেখানে কোনো আলেমের সন্ধান করে তার কাছে ইলম অর্জন শুরু করতেন।
বিয়ের পর বছর ঘুরতেই এলাহি বখশের ঘর আলো করে জন্ম নিলো এক কন্যাশিশু। এলাহি বখশ মেয়ের নাম রাখলেন আয়েশা। আয়েশার জন্মের পরেও এলাহি বখশের ইলম অর্জন ব্যহত হলো না। প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময় তিনি ইলম অর্জন করতে থাকেন। ধীরে ধীরে মেয়ে বড় হয়, এদিকে এলাহি বখশও উস্তাদদের সামনে বসে অনেক কিতাবাদি পড়ে ফেলেছেন। এখন এলাকার মসজিদে তিনিই ইমামতি করেন। লোকে তাকে ডাকে মৌলবী এলাহি বখশ।
-
আয়েশার ৭ বছর বয়সে মারা গেলেন এলাহি বখশের স্ত্রী। এতিম মেয়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে পাহাড়সম শোক বুকে চাপা দিলেন এলাহি বখশ। মেয়েকে নিয়েই কাটতে থাকে তার বেশিরভাগ সময়।
-
সুন্দর আখলাক ও নির্মল চরিত্রগুনে এলাহি বখশ ছিলেন উস্তাদদের প্রিয় ছাত্র। এমনই এক উস্তাদের ঘরে ছিল বিবাহযোগ্য মেয়ে। তিনি এলাহি বখশকে বললেন, আমার মেয়েকে তুমি বিয়ে কর। আর আমার ছেলে আবদুর রাযযাকের সাথে তোমার মেয়ের বিবাহ দাও। কিছু চিন্তাভাবনার পর এলাহি বখশ রাজি হয়ে গেলেন। আবদুর রাযযাকের সাথে বিয়ে হলো আয়েশার। কিন্তু আয়েশা বয়সে অনেক ছোট। দুই পরিবারের সিদ্ধান্ত হলো আয়েশা সাবালিকা হলে আবদুর রাযযাকের হাতে তুলে দেয়া হবে তাকে।
-
দুবছর পর মারা গেলেন এলাহি বখশের শ্বশুর। এদিকে তার মৃত্যুর পর থেকে আবদুর রাযযাক চাপাচাপি করতে থাকে আয়েশাকে যেন তার হাতে তুলে দেয়া হয়। এলাহি বখশ মেয়ের বয়স বিবেচনা করে প্রস্তাব এড়িয়ে যান। কিন্তু ক্রমেই তার চাপাচাপি বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ব্যপারটি ঝগড়ার দিকে মোড় নেয়। যেহেতু আবদুর রাযযাকের বোন ছিল এলাহি বখশের স্ত্রী ফলে পারিবারিকভাবেও নানা অশান্তির সূচনা হয়। শেষমেশ এলাহি বখশ ভাবলেন অশান্তি এড়াতে মেয়েকে তুলে দিবেন। কিন্তু আবদুর রাযযাকের আচরণ তার কাছে একটু অদ্ভুত মনে হওয়ায় তিনি আরেক দফা খোজখবর শুরু করেন। এবার তিনি জানলেন ভয়ংকর এক তথ্য।
তিনি জানলেন, পিতার মৃত্যুর পর আবদুর রাযযাক ইসলাম ত্যাগ করে কাদিয়ানি হয়ে গেছে।
-
এলাহি বখশের মাথায় যেন আসমান ভেঙ্গে পড়লো। চিন্তায় সারারাত তার ঘুম হলো না। আরেকটু হলেই তিনি মেয়ের জীবন বরবাদ করতে যাচ্ছিলেন, এই ভাবনা তাকে ঘিরে ধরে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, কিছুতেই এই কাফিরের হাতে নিজের মেয়েকে তুলে দিবেন না। পরদিনই আবদুর রাযযাককে জানিয়ে দিলেন নিজের সিদ্ধান্ত। বললেন, তুমি আমার মেয়েকে তালাক দাও। আবদুর রাযযাক সাফ জানিয়ে দিল সে তালাক দিবে না।
তর্কাতর্কি করেও কোনো ফল হলো না। শেষমেশ এলাহি বখশ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আদালতে যাবেন।
-
১৯২৬ সালে আয়েশা ও আবদুর রাযযাকের মামলা আদালতে উঠলো। মামলার বিষয়, আয়েশার দাবী তার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। কারণ, স্বামী কাফের হয়ে গেছে। অপরদিকে আবদুর রাযযাকের দাবী সে কাদিয়ানি হলেও কাফের হয়নি এবং সে আয়েশাকে তালাক দিবে না। আয়েশা তার বৈধ স্ত্রী। মুলতান আদালতে মামলা চলতে থাকে। আদালতে রায় আসে আবদুর রাযযাকের পক্ষে। বিচারক জানিয়ে দেন বিয়ে ভাংগেনি। আদালতের রায় মানতে অস্বীকৃতি জানান এলাহি বখশ। এদিকে যে কোনো মূল্যে আয়েশাকে নিজের কাছে নিয়ে আসার হুমকি দেয় আবদুর রাযযাক।
এবার শুরু হলো পিতা-কন্যার ফেরারি জীবন। আবদুর রাযযাকের লেলিয়ে দেয়া লোকজনের হাত থেকে বাঁচার জন্য এলাহি বখশ নিজের এলাকা ছেড়ে অন্যদিকে চলে গেলেন। তাকে ধাওয়া করলো আবদুর রাযযাকের লোকেরা। মাসের পর মাস পিতা-কন্যা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় পালিয়ে চললেন। অনেক সময় মানুষের গোয়ালঘরেও লুকাতেন। কখনো গোলাঘরে গমের বস্তার পাশে শুয়ে রাত কাটাতেন পিতা-কন্যা। আবদুর রাযযাকের বোন ছিল এলাহি বখশের স্ত্রী ফলে সে প্রায়ই তাদের অবস্থান জেনে যেত। আর তখনই নিজের লোকজন নিয়ে চলে আসত আয়েশাকে ধরতে। টের পেয়ে পালিয়ে যেন পিতা-কন্যা। অনেক সময় জুতা ছাড়া খালি পায়ে মাইলের পর মেইল হেঁটেছেন তারা। এই পলাতক অবস্থার মধ্যেই তিনি বাহাওয়ালপুর আদালতেও মামলা করলেন। তার আশা ছিল এই আদালতে তার পক্ষে ফায়সালা আসবে।
-
এলাহি বখশের জন্য সময়টা ছিল কঠিন। তিনি ছিলেন সামান্য একজন দরিদ্র কৃষক। বাহাওয়ালপুর শহর থেকে তার গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলো। মামলার শুনানির জন্য তাকে এই দূরত্ব অতিক্রম করে আদালতে আসতে হতো। বেশিরভাগ সময়ই যাতায়েতের জন্য ঘোড়া গাড়ি বা গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারতেন না। শুনানির নির্ধারিত তারিখের দুই তিন দিন আগে পিতা-কন্যা গ্রাম থেকে বের হতেন। সারাদিন হাঁটতেন, পথে রাত নামলে কারো বাড়িতে আশ্রয় নিতেন। পরদিন আবার শুরু হত হাঁটা। এভাবে ২/৩ দিন হেঁটে বাহাওয়ালপুর শহরে পৌঁছতেন তারা। মামলার শুনানি শেষ হলে আবার ২/৩ দিন হেঁটে ফিরতে হত গ্রামে।
সময় গড়ায়, আয়েশার বয়স বাড়ে, এদিকে চলতে থাকে মামলা। কৃষিকাজের পাশাপাশি এলাহি বখশ মামলা চালাতে থাকেন। বাহাওয়ালপুর আদালতে একের পর এক তিনটি রায় হয়। প্রতিটি রায়েই সিদ্ধান্ত দেয়া হয়, বিয়ে ভাংগেনি। আবদুর রাযযাক তালাক না দিলে তালাক হবে না।
তৃতীয় রায়ের পর প্রচন্ড হতাশ হন এলাহি বখশ। তিনি জানেন প্রতিটি রায় চলে গেছে আবদুর রাযযাকের পক্ষে। এখন তার সামনে শুধু একটি উপায়ই আছে। তাকে আপিল করতে হবে জুডিশিয়াল কমিশনে। যার প্রধান হলেন বাহাওয়ালপুরের নবাব সাদেক মুহাম্মদ খান। সাদেক মুহাম্মদ খান যদি আবেদন মঞ্জুর করে জুডিশিয়াল কমিশনের মাধ্যমে মামলা পুনর্বিবেচনা করেন তাহলে এখনো কিছুটা আশা থাকে।
-
গ্রামের একজন হতদরিদ্র মৌলবীর জন্য নবাবের সাক্ষাৎ পাওয়া সহজ নয়। তবে সুযোগ হয়ে গেল অপ্রত্যাশিতভাবে। এলাহি বখশ খবর পেলেন নবাব যেদিন শহরে বের হন সেদিন পথের পাশে দাঁড়িয়ে কেউ যদি হাত নাড়ে তাহলে তিনি থেমে তার কথা শুনেন। এলাহি বখশ জেনে নিলেন পরবর্তীতে কবে নবাব শহর পরিদর্শনে বের হবেন।
তারিখ জেনে নির্ধারিত দিনে তিনি রওনা হলেন বাহাওয়ালপুরের পথে।
.  
-----
(পর্ব-২) 
------
এক উজ্জ্বল রোদমাখা দিনে নবাব সাদেক মুহাম্মদ খান দেখলেন পথের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক মধ্যবয়সী মৌলবী। হাতে ধরে রেখেছে কাগজ। বারবার হাত নাড়িয়ে সে নবাবের দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করছে। বাহন থামিয়ে নেমে এলেন নবাব।
‘কিছু বলবেন?’ নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন নবাব।
‘অনেকদূর থেকে এসেছি একটা অনুরোধ নিয়ে। আপনি ফিরিয়ে দিলে আমার আর কোনো আশা থাকবে না। আমার কিশোরি মেয়ের বিয়ে হয়েছে একজনের সাথে। সেই ব্যক্তি এখন কাদিয়ানি ধর্ম গ্রহণ করেছে। যেহেতু কাদিয়ানিরা কাফের তাই আমি চাই বিবাহ বাতিল করতে। কিন্তু মুলতান আদালত ও বাহাওয়ালপুর আদালত রায় দিয়েছে স্বামী তালাক না দিলে বিয়ে বাতিল হবে না। বাহাওয়ালপুর আদালতে তিনটি রায় হয়েছে, প্রতিটিতে সেই ব্যক্তির পক্ষে রায় এসেছে। এখন আমি চাই জুডিশিয়াল কমিশনে আপিল করতে, কিন্তু আপনার অনুমতি ছাড়া তো সে সুযোগ নেই’ হড়হড় করে বলে গেলেন এলাহি বখশ।
এলাহি বখশের আকুতি নবাবের হৃদয় স্পর্শ করে। তিনি এলাহি বখশের চোখে দেখলেন একজন পিতার হাহাকার। তখনই কাগজ কলম এনে তিনি জুডিশিয়াল কমিশনের প্রতি লিখে দিলেন, আপিল যেন গ্রহণ করা হয়।
এলাহি বখশকে বলে দেয়া হলো, মামলা চালু হয়ে যাবে, তিনি যেন প্রস্তুতি নেন।
-
মামলা চালু হয়ে যাওয়াই তো শেষ কথা নয়, একে আবার নতুন করে চালিয়ে নেয়াই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো এলাহি বখশের সামনে। সামান্য একজন দরিদ্র কৃষক হিসেবে এতদিন মামলা টেনে তিনি আরো দরিদ্র হয়েছেন। আবদুর রাযযাকের অবশ্য সেই সমস্যা নেই। কাদিয়ানিদের পক্ষ থেকে তাকে দেয়া হচ্ছে মামলা চালানোর প্রয়োজনীয় অর্থ।
এলাহি বখশ মনোবল হারালেন না। ঈমান কুফরের এই দ্বন্দ্বে পিছিয়েও আসলেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যেভাবে হোক মামলা চালিয়েই যাবেন।
-
এলাহি বখশের আপিল গৃহিত হলো বাহাওয়ালপুর আদালতে। নতুন করে আবারও আইনি লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হলো দুই পক্ষ। বিচারক আকবর বলে দিলেন, এবার আগের মত শুধু দুই পক্ষের উকিলের বক্তব্য শুনে ফায়সালা দেয়া হবে না বরং দুই পক্ষের পন্ডিতদের ডাকা হবে আদালতে। তারা একে অপরের প্রতি অভিযোগ করবেন ও জবাব দিবেন। দুপক্ষের কথা শুনে আদালত ফায়সালা করবে। কাদিয়ানিরা শেষবারের মত মরণ কামড় দেয়ার জন্য নিজেদের পক্ষের বিখ্যাত তার্কিক কাজি নজিরকে নিয়ে এলো বাহাওয়ালপুরে। কাজি নজিরের যেমন ছিল মেধা, তেমন ছিল প্রখর বিশ্লেষনী ক্ষমতা। সাথে যুক্ত হয়েছিল ক্ষুরধার বাকশক্তি। কাজি নজিরের আগমনে মুসলমানদের মধ্যে কিছুটা হতাশা দেখা দেয়। তারা আগেই শুনেছে এই কাদিয়ানি তার্কিক সম্পর্কে। হতাশা আকড়ে ধরে অনেককে। বাহাওয়ালপুরেও আলেম ছিলেন অনেক। এলাহি বখশকে সাহায্য করতে তাদের আগ্রহেরও কমতি ছিল না, কিন্তু কাজি নজিরের আগমনের কথা শুনে সবাইই ঘাবড়ে গেলেন।
শুধু কাজি নজিরকে পাঠিয়েই ক্ষান্ত হলো না কাদিয়ানিরা। কয়েকদিন পর পাঠানো হলো আরেক বিখ্যাত কাদিয়ানি পন্ডিত জালালুদ্দিন শামসকে। তার সাথে দেয়া হলো মামলা পরিচালনা করার জন্য বিপুল পরিমান অর্থ। অনেক পরে নিজামুদ্দিন আসির আদরবি সেই সময়ের ইতিহাস বর্ননা করতে গিয়ে লিখেছেন, তখন কাদিয়ানের কোষাগার খুলে দেয়া হয়েছিল।
-
স্যার আবদুর রহিম ছিলেন নবাবের অভিভাবক। তিনি এই মামলার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন। একজন বিশুদ্ধ আকিদার মুসলমান হিসেবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যদি মামলার রায় কাদিয়ানিদের পক্ষে আসে তাহলে এক মুসলিম কন্যাকে কাফিরের সাথে সংসার করতে হবে, যা কোনোভাবেই মেনে নেয়ার মত নয়। স্যার আবদুর রহিম ভাবতে থাকেন, কী করনীয়। অনেক চিন্তার পর তিনি দেখলেন কাদিয়ানিদের মোকাবেলা করার মত যোগ্য ব্যক্তি আছেন। তবে বাহাওয়ালপুরে নন, তিনি আছেন গুজরাটে। তার নাম আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী।
-
স্যার আবদুর রহিমের অনুমান ভুল ছিল। ১৯৩২ সালের এই সময়টায় আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী গুজরাটে নয়, বরং দেওবন্দে অবস্থান করছিলেন। কিছুদিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। যদিও এ সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৫৭ বছর, কিন্তু অসুস্থতা তাকে বেশ কাবু করে ফেলেছিল। বন্ধুদের পরামর্শে তিনি হাওয়া বদল করতে দেওবন্দ আসেন। পুরনো প্রতিষ্ঠানে তাকে পেয়ে আনন্দিত হয় উস্তাদ-ছাত্র সকলে। আল্লামা কাশ্মিরীও স্মৃতিকাতর হয়ে উঠেন। কয়েক সপ্তাহ এখানে কাটিয়ে কিছুটা সুস্থবোধ করলেন তিনি। ইচ্ছা করলেন ডাবেল ফিরে যাবেন।
কিন্তু আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী ডাবেল ফেরার আগেই বাহাওয়ালপুর থেকে একটি পত্র এলো তার কাছে। পত্রটি লিখেছেন মাওলানা গোলাম মুহাম্মদ ঘুটি। শাহ সাহেবের সাথে তার গুরু-শিষ্য ধরণের সম্পর্ক। পত্রের বিষয় ছিল খুবই সাদামাটা। গোলাম মুহাম্মদ ঘুটি লিখেছেন, কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে বাহাওয়ালপুর আদালতে। কাদিয়ানিদের পক্ষে বড় বড় পন্ডিত চলে এসেছে এখানে। এখন আপনি না এলে আমরা বিপদে পড়ে যাবো।
মূলত গোলাম মুহাম্মদ ঘুটিকে দিয়ে এই পত্র লিখিয়েছেন স্যার আবদুর রহিম। তিনি খোঁজখবর নিয়ে জেনেছিলেন শাহ সাহেব ডাবেলে নেই বরং দেওবন্দে বেড়াতে গেছেন।
অসুস্থ শরীরে কাঁপা কাঁপা হাতে পত্র পড়লেন আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী। পত্রের মধ্যে লুকানো আকুলতা তিনি অনুভব করলেন। উত্তর প্রদেশ থেকে বাহাওয়ালপুর এক দীর্ঘ সফর। এই ক্লান্ত শরিরে এতদূর যেতে কষ্ট হবে, একবারও এই চিন্তা মাথায় আনলেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি যে কোনো মূল্যে বাহাওয়ালপুর যাবেন।
-
১৯৩২ সালের ১৯ আগস্ট বাহাওয়ালপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে পা রাখলেন আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী। তার চেহারায় ছিল দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি। কিন্তু আচরণে ছিল শান্তভাব, দীর্ঘদিন পর নিজের ঘরে ফিরে যে অনুভূতি হয় মানুষের। আনোয়ার শাহ কাশ্মিরীর বাহাওয়ালপুর পৌঁছার সংবাদ ছড়িয়ে যেতেই রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল এই মামলা। পুরো ভারতবর্ষের চোখ ঘুরে গেল এই মামলার দিকে। পাঞ্জাব এবং সিন্ধের বরেণ্য আলেমরা ছুটলেন বাহাওয়ালপুরের উদ্দেশ্যে। শাহ সাহেবের বিশ্রাম কক্ষে ভিড় করতে থাকেন শীর্ষ আলেমরা। কেউ এসেছেন তাকে এক নজর দেখতে, কেউ এসেছেন তার কাছ থেকে ইলমি কোনো বিষয় সমাধান করতে। স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরাও ছুটে এলেন বাহাওয়ালপুর।
২৫ আগস্ট আল্লামা কাশ্মিরী যখন প্রথমবারের মত আদালতে উঠলেন নিজের বক্তব্য রাখতে, তখন আদালতের ভেতরে বাইরে মানুষের ভিড়, চুল পরিমান জায়গা ছিল না কোথাও। অন্য সকল ইস্যু সরিয়ে মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল শাহ সাহেবের উপস্থিতি।
-
আল্লামা কাশ্মিরীর প্রতি মানুষের এই আগ্রহ অস্বাভাবিক ছিল না। নিজের ইলমি পান্ডিত্য ও অবিশ্বাস্য স্মৃতিশক্তির জোরে অনেক আগেই তিনি মুসলমানদের মধ্যে পেয়েছিলেন খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা। দারুল উলুম দেওবন্দ ও ঢাবেলে অধ্যাপনার ফলে সারাদেশেই তৈরী হয়েছে তার ছাত্র। হাদিসশাস্ত্রে তার দক্ষতার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। ডক্টর ইকবাল ও আল্লামা রশিদ রেজার স্বীকৃতি তাকে করেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পরিচিত।
--
আল্লামা কাশ্মিরী বাহাওয়ালপুর আদালতে কাদিয়ানিদের উপর মোট ৫টি অভিযোগ করেন। প্রতিটি পয়েন্টে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন।
১। নবুওয়তের দাবী।
২। নতুন শরিয়তের দাবী।
৩। আম্বিয়াদের অবমাননা।
৪। মুতাওয়াতির ও জরুরিয়্যাতে দ্বীন অস্বীকার।
৫। আম্বিয়াদেরকে গালি দেয়া।
এই পাঁচ পয়েন্টে তিনি টানা ৫ দিন আলোচনা করেন আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী। তার আলোচনার সময় পুরো আদালতের চোখ ছিল তার দিকে। যদিও তিনি কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে আলোচনা করেছিলেন এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস পর্যালোচনা করেছিলেন কিন্তু এই আলোচনায় তিনি ঈমান, কুফর ও ইরতিদাদের মূল বিষয়টি স্পষ্ট করে দেন। তার পুরো বক্তব্যটি লিখিত আকারে প্রায় ৬০ পৃষ্ঠা হয়েছিল। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে কাদিয়ানিরা নানা প্রশ্ন করছিল, আপত্তি তুলছিল। তিনি সাবলিলভাবে সেগুলোর জবাব দেন।
-
শুনানি চলাকালে একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। একদিনের শুনানিতে কাদিয়ানী পন্ডিত বলে বসে, হানাফিদের লেখা ফাওয়াতিহুর রহমুত শরহু মুসাল্লামিস সুবুত কিতাবে আমাদের পক্ষে কথা আছে। এই বলে সে একটি ইবারত পড়ে শোনায়।
আল্লামা কাশ্মীরি তখন বিচারককে বললেন, জজ সাহেব! কিছু কিতাব তো আমরাও পড়েছি। এ মুহূর্তে আমার কাছে কিতাবটি নেই। তবে ৪০ বছর আগে আমি এ কিতাব পড়েছিলাম। সেই স্মৃতি থেকে বলছি, আমার বিবাদী যে উদ্ধৃতি পড়ছে, এতে কিছু লুকোচুরি করছে। মাঝখানে মাঝখানে বাদ দিয়ে আগেপিছে থেকে পড়ছে। আমাকে কিতাব দেয়া হোক। বিচারক আকবর খান তখন কিতাব চেয়ে পাঠান। শাহ সাহেবের সামনে কিতাব নিয়ে আসা হলে তিনি পুরো ইবারত দেখে বললেন, এ ব্যক্তি সবাইকে ধোঁকা দিচ্ছে। সে মাঝখান মাঝখান থেকে কিছু কিছু বাদ দিয়ে পড়ছে। বিচারক কিতাবটি নিজের হাতে নিয়ে দেখলেন শাহ সাহেব সত্যই বলেছেন। কিতাবের উদ্ধৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে কাদিয়ানি পন্ডিত কমবেশি করেছে।
শাহ সাহেবের বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তির প্রমান পেয়ে মুগ্ধ হলেন বিচারক ও আদালতে উপস্থিত অন্যরা।
-
২৬ আগস্ট ছিল শুক্রবার। সেদিন শাহ সাহেব জুমার নামাজ পড়ালেন জামে মসজিদ সাদেকে। মসজিদে তিল ধারণের ঠাই ছিল না। জুমার বয়ানে তিনি বললেন, আমার কাছে তো পথের কোন সম্বল নেই, আশা করি এই মামলা আমার নাজাতের উসিলা হবে। আমি বলতে পারবো খতমে নবুওয়তের সৈনিক হিসেবে কাজ করেছি।
এক পর্যায়ে আবেগের আতিশয্যে তিনি বলেন, যদি খতমে নবুওয়তের পক্ষে কাজ না করা হয়, তাহলে আমাদের চেয়ে গলির কুকুরও ভালো।
-
বাহাওয়ালপুর আদালতে শুধু আনোয়ার শাহ কাশ্মিরীই আসেননি। এসেছিলেন আরেকজন বিখ্যাত আলেম ও সুবক্তা। তিনি আবুল ওয়াফা শাজাহানপুরী। সিরাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে তার ছিল অসামান্য জানাশোনা। বিস্তৃত ভারতবর্ষের যেখানেই সীরাত সম্পর্কে আলোচনা হত, নিমন্ত্রিত হতেন তিনি। বাহাওয়ালপুর মোকদ্দমায় তাকেও আমন্ত্রন জানানো হলো। ছুটে এলেন তিনি। তাকে ডাকার কারণ ছিল তিনি জনমানুষের ভাষায় কথা বলতে পারতেন। কঠিন থেকে কঠিন বিষয়কেও তিনি একদম পানি করে দিতেন। আনোয়ার শাহ কাশ্মিরির ইলমি তাত্ত্বিক আলোচনার পাশাপাশি তার সহজ আলোচনাও দরকার ছিল। আবুল ওয়াফা শাহজাহানপুরী সকল ব্যস্ততা ফেলে বাহাওয়ালপুর এলেন এবং পরের দেড় বছর মামলার কাজে এখানেই কাটিয়ে দিলেন। নিঃসন্দেহে এটি ছিল অনেক বড় ত্যাগ ও কোরবানি।
-
৫ দিন আদালতে নিজের বক্তব্য ও দলিল প্রমাণ রেখে দেওবন্দের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন আল্লামা কাশ্মিরী। তার শরিরের অবস্থা তখন খুবই নাজুক। ট্রেনে উঠার আগ মুহূর্তে তিনি বললেন, এই মামলার ফায়সালা আমাকে জানাবে।
-
বাহাওয়ালপুর থেকে ফেরার কিছুদিন পরেই ইন্তেকাল করেন আল্লামা কাশ্মিরী। দিনটি ছিল ১৯৩৩ সালের ২৮ মে। বাহাওয়ালপুর মোকদ্দমার শুনানি তখনো চলছে। একে একে সেই আদালতে বক্তব্য রেখেছেন মুফতি শফি ও মাওলানা মোর্তজা হাসান চাঁদপুরির মত বরেন্য আলেমরা।
.
--------------
(৩য়/শেষ পর্ব)
---------------
বাহাওয়ালপুর মোকদ্দমার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন নবাব সাদেক মুহাম্মদ খান। বিচারক আকবর খানকে তিনি বলে রেখেছিলেন, প্রতিদিনের শুনানির বিস্তারিত বিবরণ তাকে রাতের বেলা শোনাতে হবে। দিনের সকল ব্যস্ততা সত্ত্বেও সাদেক মুহাম্মদ খান অপেক্ষায় থাকতেন, কখন তার প্রাসাদে আসবেন আকবর খান। রাত নামলে নবাবের প্রাসাদে জ্বলে উঠতো আলো। বিশাল ফটক পেরিয়ে প্রাসাদে প্রবেশ করতেন আকবর খান। রাতের খাবার খেতে খেতে নবাবকে তিনি শোনাতেন মামলার বিবরণ। মামলার বিবরণ পড়ে শোনানোর ফাঁকে একদিন আকবর খান বললেন, আসলে এই মামলার ফলাফল নির্ভর করছে আল্লামা কাশ্মিরির বক্তব্যের উপর। তিনি যা বলেছেন এরপর আসলে খুব বেশি চিন্তার কিছু নেই। কাদিয়ানিদের মূল চেহারাই তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
মুচকি হেসে আকবর খানের কথায় সায় দেন নবাব সাদেক মুহাম্মদ খান। তিনি জানেন আকবর খান বাড়িয়ে বলেননি। আল্লামা কাশ্মিরী এর আগে ১৯২৫ সালেও  কাদিয়ানিদের নাকানি-চুবানি খাইয়েছেন। সে সময় তিনি মুফতি শফি, মাওলানা বদরে আলম মিরাঠি, মাওলানা শাব্বির আহমাদ উসমানি, মাওলানা মোর্তজা হাসান চাঁদপুরী, মাওলানা ইদরিস কান্ধলবী, ক্বারী মুহাম্মদ তৈয়ব প্রমুখকে সাথে নিয়ে এবোটাবাদ, রাওয়ালপিন্ডি, লুধিয়ানা, অমৃতসর, গুজরাট এসব এলাকা সফর করেছিলেন। একের পর এক আলোচনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আকিদা পরিশুদ্ধ করেছেন। তার এই সফরের ফলে এসব অঞ্চলে কাদিয়ানিদের তৎপরতা কমে আসে। 
-
কাদিয়ানিরা নিজেরাও জানতো, আল্লামা কাশ্মিরি তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। এখন আর নিজেদের মুসলিম বলে পথচলার সুযোগ নেই। সবাই জেনে গেছে তাদের কুফর ও ইরতিদাদ। জনমত চলে গেছে তাদের বিপক্ষে। কাদিয়ানে বসলো সভার পর সভা। হলো নানা পরামর্শ। সিদ্ধান্ত হলো যে কোনো মূল্যে আটকাতে হবে আদালতের রায়। আল্লামা কাশ্মিরী যা বলেছেন বলেছেন, এখন যদি মামলার রায় আয়েশার পক্ষে আসে তাহলে পুরো ভারতবর্ষ জেনে যাবে কাদিয়ানিদের কুফর। 
কিন্তু মামলার রায় ঠেকানোর উপায় কী ? নবাব সাদেক মুহাম্মদ খান কারো কথায় প্রভাবিত হওয়ার লোক নন। বিচারক আকবর খানও স্বাধীনচেতা মানুষ। যা সত্য মনে হবে তা থেকে তাকে সড়ানো যাবে না। 
তাহলে উপায় কী? 
পরামর্শে উঠে এলো সহজ সমাধান, ‘মাথা যদি ব্যথার কারণ হয় তাহলে মাথা কেটে ফেলো’। 
-
বসন্তের এক বিকেলে কাদিয়ানি বন্ধুদের সাথে পিকনিকে গেলো আবদুর রাযযাক। নানা কথা ও হাসি আড্ডায় কাটছিল সময়। আবদুর রাযযাকের অজান্তে তার খাবারে মিশিয়ে দেয়া হলো বিষ। বন্ধুদের চোখের সামনেই খাবার খেতে খেতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো আবদুর রাযযাক। তার লাশ ফেলে দেয়া হলো পাশের নদীতে। 
নদীতে ডুবে যাওয়া লাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কেউ কেউ। বন্ধু হত্যার কাজটা অমানবিক, কিন্তু তাদের সামনে আর কোনো উপায়ও ছিল না। আবদুর রাযযাককে হত্যার নির্দেশ এসেছে সরাসরি কাদিয়ান থেকে।
-
আবদুর রাযযাকের মৃত্যুর পর এলাহি বখশের সাথে দেখা করলো কাদিয়ানি প্রতিনিধি। এলাহি বখশকে বলা হলো, আবদুর রাযযাক তো মারা গেছে। এখন আর মামলা চালিয়ে লাভ কী? বিয়ে তো এমনিতেই শেষ হয়ে গেছে। আপনি মামলা তুলে নিন। এজন্য যত অর্থ দরকার আমরা দিব। এতদিন যা খরচ করেছেন তাও দিব।
কয়েক লক্ষ টাকা দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হলো এলাহি বখশকে। 
-
এলাহি বখশ আবারও নিজের দৃঢ়তা ও মজবুত ঈমানের পরিচয় দিলেন। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন তিনি কোনো অর্থ গ্রহণ করবেন না। মামলাও তুলবেন না। যেভাবে আগাচ্ছে সবকিছু সেভাবেই আগাতে থাকবে। হতাশ হয়ে ফিরে গেল কাদিয়ানি প্রতিনিধি। আবদুর রাযযাকের মৃত্যু তাদের কোনো বাড়তি সুবিধা দেয়নি। 
-
মামলার শুনানি চলতে থাকে, সাথে গড়িয়ে চলে দিন। আল্লামা কাশ্মিরী ইন্তেকাল করলেও তার অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নিলেন অন্যরা। ১৯৩৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারীতে এই আলোচিত মামলার রায় দেয়া হয়। যেদিন রায় হবে সেদিন বাহাওয়ালপুরে মানুষের ভিড়ে পথচলা মুশকিল হয়ে পড়েছিল। আদালতের ভেতরে বাইরে অপেক্ষা করছিল বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিনিধিরা। 
আদালতের রায়ে বিচারক লিখেছিলেন, দুপক্ষের সকল দলিল প্রমাণ বিবেচনা করে আদালত এই বিয়েকে বাতিল বলে ঘোষণা করছে।  
-
এতদিন আইনি প্রক্রিয়ায় আয়েশার বিবাহ আটকে ছিল। কিন্তু আবদুর রাযযাকের মৃত্যু ও রায়ের ফলে আর কোনো বাধা রইলো না। এলাহি বখশ আয়েশার জন্য পাত্র সন্ধান করতে থাকেন। পেয়েও গেলেন সুলতান মাহমুদ নামে এক তরুণ আলেমের সন্ধান। দেরি না করে তার সাথে বিয়ে দিলেন আয়েশার।
-
এদিকে এ রায়ের সংবাদে ভারতবর্ষের মুসলমানদের মধ্যে আনন্দের ফল্লুধারা বয়ে গেল। মোবারকবাদ জানালেন বরেন্যজনরা। মাওলানা মওদুদি তার এক লিখিত অভিমতে বলেন, বিজ্ঞ বিচারক বিস্তর যাচাই-বাছাই শেষে লিখেছেন, কাদিয়ানিরা তাদের বিশ্বাসের কারণে কাফের। 
আল্লামা শামসুল হক আফগানি লিখেন, বাহাওয়ালপুর মোকদ্দমা ইতিহাসেরই অংশ। আল্লামা ইদরিস কান্ধলবী লিখেন, মামলার রায় এতটাই মজবুত হয়েছে এখানে কলম ধরার সুযোগ নেই। এই মামলার রায় দেয়ার বহু বছর পরে শায়খ এহসান এলাহি জহির বলেছিলেন, আমার মতে এই মামলার বিবরণ, কাদিয়ানি মতবাদ সম্পর্কে লিখিত একাধিক কিতাবের সমতূল্য। 
-
মামলার রায় হয়ে যাওয়ায় এলাহি বখশের জীবনে নেমে আসে স্বস্তি। দীর্ঘদিন ধরে চলা পরিক্ষার অবসান হয়। এই পরীক্ষায় তিনি ঈমানের পক্ষে ছিলেন, কুফরের সামনে মাথা নত করেননি। সামান্য দ্বিধাও করেননি। আয়েশার জীবনও হাসি আনন্দে কেটেছিল। তবে তিনি খুব অল্প বয়সে মারা যান। বিয়ের মাত্র সাত বছর পরেই তিনি ইন্তেকাল করেন। 
তার ইন্তেকালের পর তার স্বামী সুলতান মাহমুদ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লেখেন, তার সাথে অতিবাহিত সময়টি ছিল আমার জন্য বরকতময়। তিনি ছিলেন অসাধারণ একজন জীবনসঙ্গী। আমি আবেগকে পাশে রেখে বাস্তবতাই বলছি। আমাদের ৭ বছরের সংসারে কখনো তাকে আমি রাগ করতে দেখিনি। এলাকার মহিলাদের সাথে তার কখনো ঝগড়া হয়নি। তিনি ঘরে বাচ্চাদের পড়াতেন, কিন্তু কখনো কোনো বাচ্চার সাথে রাগ দেখাননি। শরিয়তের বিধিবিধান পালনে তিনি ছিলেন খুবই আন্তরিক। কখনো কারো গীবত করতে দেখিনি। পর্দার ব্যাপারে ছিলেন খুবই শক্ত। আমি এবং তার পিতা ছাড়া আর কোনো বালেগ পুরুষ তার চেহারা দেখেনি।  
-
শেষ কথা
বাহাওয়ালপুর মোকদ্দমা ভারতবর্ষে মুসলমানদের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ন ঘটনা। এই ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরাই ছিল এই লেখার উদ্দেশ্য। বলতে দ্বিধা নেই, এত বৃহৎ একটি ঘটনাকে সংক্ষেপে লেখার কাজটি বেশ কঠিন এবং এতে আমি পুরোপুরি সফল হইনি। ইচ্ছা আছে, কখনো সময় সুযোগ হলে বিষয়টি নিয়ে আরো বিস্তারিত লেখার। এই লেখার ক্ষেত্রে আমি নির্দিষ্ট কোনো বইকে অনুসরণ করিনি। বরং বিক্ষিপ্তভাবে যা তথ্য পেয়েছি তার সব একত্র করেছি। এই মামলার বিবরণ নিয়ে মুকাদ্দামায়ে মিরজাইয়্যা বাহাওয়ালপুর নামে ৩ খন্ডে সুবিশাল একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। অনেক তথ্যের জন্য এই গ্রন্থের উপর নির্ভর করেছি। আল্লামা কাশ্মিরীর সম্পৃক্ততা সম্পর্কিত তথ্যের জন্য সাইয়েদ আখতার হুসাইন প্রণিত মুকাদ্দামায়ে বাহাওয়ালপুর গ্রন্থটির সাহায্য নিয়েছি। আয়েশা ও তার পরিবারের বিষয়গুলো এসব গ্রন্থে তেমনটা ফুটে উঠেনি। এ সংক্রান্ত তথ্যের জন্য আয়েশার ছেলে প্রফেসর মুহাম্মদ ইয়াহইয়ার বিবরণের উপর নির্ভর করেছি। এই মামলা সম্পর্কে ইউটিউবে তার ভিডিও আলোচনা আছে। কিছু তথ্য নিয়েছি হংকং প্রবাসী মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস সাহেবের ভিডিও আলোচনা থেকে। 
বাহাওয়ালপুর মোকদ্দমার মূল আকর্ষণ এর ঘটনাপ্রবাহে নয় বরং আলেমদের উপস্থাপিত ইলমি দালায়েলে, যার মাধ্যমে তারা কাদিয়ানিদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এই লেখায় আমি সেসব কিছুই আলোচনা করিনি। কেউ আগ্রহী হলে মুকাদ্দামায়ে মিরজাইয়্যা বাহাওয়ালপুর পড়ে নিতে পারেন।
.
------------------ 
লিখেছেনঃ মাওলানা ইমরান রাইহান। 
উৎস- [১] - [২] - [৩]


image

মন্তব্যসমূহ

এই সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

ডাউনলোড করুন মাকতাবায়ে শামেলা লেটেস্ট ভার্শন (মোবাইল এবং পিসির জন্য)

রুকইয়াহ আশ-শারইয়্যাহ (ডাউনলোড)

হাদিসে কিরতাস বা কাগজের ঘটনা প্রসঙ্গে শিয়া কাফেরদের অপবাদের জবাব