মুহাদ্দিসদের সিদ্ধান্ত মানাও তাকলিদের অন্তর্ভুক্ত

তথ্যটা অনেকের কাছে নতুন মনে হতে পারে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটা অতোটা আলোচনায় আনতে পারি নি আমরা। ব্যর্থতাটা আমাদেরই।

আসল কথায় যাবার আগে ভূমিকা স্বরূপ একটা কথা বলে নেই। তা হল,
তাকলিদ বলা হয় অন্যের কথাকে দলিল ছাড়া মেনে নেওয়া। স্মর্তব্য যে, এর মানে এই নয় যে সে বিষয়ে কোন দলিলই নেই। বরং দলিল তো থাকে, কিন্তু সেটা উল্লেখ করা হয় না। 'স্মর্তব্য' এর কথাটা অনেকের স্মরণে নাই। কারণ তারা বিষয়টি জানেনই না।

এবার মূল প্রসঙ্গে যাই। আমরা নানান সময়ে বিভিন্ন পইপত্রের মধ্যে এবং লেকচারারদের লেকচারে হাদিস উল্লেখ করার পর দেখি সেখানে হাদিসের তাহক্কিক বলা হয়ে থাকে- সহিহ, হাসান বা যইফ। তো কথা হল, এই যে হাদিসের বিষয়ে শুধু একটি সিদ্ধান্ত বলে দেওয়া হল কিন্তু এর স্বপক্ষে দলিল দেওয়া হল না যে, কোন কোন ত্রুটির কারণে এটাকে যইফ বলা হল এটাও কিন্তু এক ধরণের তাকলিদ। মানে দলিল ছাড়াই একটা বিষয়কে মেনে নেওয়া।

সমস্যা হল, কিছু ভাই এটাকে তাকলিদ বলে মানতে চান না। তারা নানান রকম যুক্তি দাড় করিয়ে বলতে চান, হাদিস বিষয়ক এই ধরনের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া তাকলিদের আওতায় পড়ে না। কারণ হল, একদিকে তারা নিজেরা ফিকহি মাসআলাতে তাকলিদের প্রচন্ড বিরোধিতা করে থাকেন। অন্যদিকে হাদিসের ক্ষেত্রে এসে মুহাদ্দিসের সিদ্ধান্তগুলো দলিল বিহীন মেনে নিতে দ্বিধাবোধ করেন না। ফলে এটাকে যদি তাকলিদ বলা হয় তাহলে তারা ফেঁসে যান। সেজন্যই তাদের এতো কসরত ও চেষ্টা-তদবির।

মুহাদ্দিসদের হাদিস বিষয়ক সিদ্ধান্ত দলিল বিহীন মেনে নেওয়াও যে তাকলিদের অন্তর্ভুক্ত সে বিষয়টির প্রমাণ দিবো এখন। আমার নিজের কোন যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা নয়। বরং দুইজনের বক্তব্য পেশ করবো। তাদের দুইজনই হলেন সর্বজন স্বীকৃত ও খ্যাতিমান মুহাদ্দিস। প্রথমজন তো মুতাআখখিরিন মুহাদ্দিসদের মাথার তাজ হয়ে আছেন। আসুন দেখি তাদের বক্তব্যগুলো।

এক.
নবম শতাব্দির বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও সহিহুল বুখারির সবচে বেশি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফতহুল বারির লেখক আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি রাহ. (৮৫২ হি:) বলেন:
'যারা সুনানে আরবা থেকে দলিল দিতে চান, বিশেষকরে ইবনে মাজাহ, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ইত্যাদি কিতাব থেকে -যেগুলোর অবস্থা খুবই মারাত্মক- তো তার কর্তব্য হচ্ছে, যদি সে হাদিসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের সক্ষমতা রাখে তবে পূর্ণ যাচাই করা ছাড়া সেসব হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করা তার জন্য উচিত হবে না। আর যদি সে এই সক্ষমতা না রাখে তবে তার কর্তব্য হচ্ছে, যদি সে এমন কাউকে পায় যিনি হাদিসের শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাই করতে সক্ষম তবে তার 'তাকলিদ' করবে। অন্যথায় সে হাদিস দিয়ে দলিল দিতে যাবে না। কারণ এমন হলে আশংকা আছে যে, সে নিজের অজান্তেই বাতিল হাদিস গ্রহণ করে ফেলতে পারে।' (পুরো বক্তব্যটি মোল্লা আলি ক্বারি রাহ. তার মেশকাতের ব্যাখ্যাগ্রন্থ মেরকাতে [১/২১] উল্লেখ করেছেন।)

দুই. দশম শতাব্দির অন্যতম বিখ্যাত মুহাদ্দিস যাকারিয়া আল-আনসারি রাহ. (৯২৬ হি:) বলেন:
'যিনি সুনান বা মুসনাদ জাতীয় হাদিসগ্রন্থ থেকে দলিল গ্রহণ করতে চান তার জন্য কর্তব্য হল, যদি তিনি হাদিস যাচাই-বাছাইর যোগ্যতা রাখেন তবে সনদের অবিচ্ছিন্নতা ও বর্ণনাকারীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া হাদিস দ্বারা দলিল দিবেন না। আর যদি এই যোগ্যতা না থাকে তবে হাদিসকে হাসান বা সহিহ সাব্যস্ত করেছেন এমন কোন ইমামকে পেলে তার 'তাকলিদ' করবে। অন্যথায় হাদিস দ্বারা দলিল দিতে যাবে না। (ফতহুল বাকি শরহু আলফিয়াতিল ইরাকি ১/১০৭)

পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য বলছি,
এই উভয় মুহাদ্দিস সরাসরি তাকলিদ শব্দ ব্যবহার করেছেন মূল আরবি পাঠে।

এই বিষয়ে সৌদি থেকে ডক্টরেট করা আলেম আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ., যিনি কিছুদিন পূর্বে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন এবং যেসব ভাইরা মুহাদ্দিসদের দলিলবিহীন সিদ্ধান্ত মানাকে তাকলিদ বলতে নারাজ তাদের অনেকের কাছেও তিনি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ত্ব, তার লেখা একটি বইতেও যতোদূর মনে পড়ে আমি এমন কথা পড়েছি। সেটা পেলে জানাবো ইনশাআল্লাহ।

মজার কথা হল, অনেকে তাকলিদ বিরোধী বই লিখেছেন। সেসব বইতে হাদিস উল্লেখ করে ব্র্যাকেটে হাদিসের মান লিখে দিয়েছেন। তো তাকলিদ বিরোধী বইতে কি তিনিই তাকলিদ করে ফেললেন না?

উপরোক্ত দুই মুহাদ্দিসের কথাকে সামনে রেখে বিচার করলে তাকলিদ-বিরোধী ভাইদের বই-পত্রে আমরা তাকলিদের ছড়াছড়ি দেখতে পাবো। পার্থক্য হল, সে তাকলিদ ফিকহ বিষয়ক কোন সিদ্ধান্তের নয়, বরং হাদিস বিষয়ক সিদ্ধান্তের।

আমি আমার পড়াশোনা অনুযায়ী কথাগুলো লিখলাম। কারো যদি ভুল মনে হয় বা এরচে আরো শক্তিশালী দলিল পেশ করেন তবে আমি আমার উপস্থাপিত কথাগুলো নিয়ে পুনরায় বিবেচনা করবো।

---------------
লিখেছেনঃ মুহতারাম শাইখ Abdullah Al Masud

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ডাউনলোড করুন মাকতাবায়ে শামেলা লেটেস্ট ভার্শন (মোবাইল এবং পিসির জন্য)

রুকইয়াহ আশ-শারইয়্যাহ (ডাউনলোড)

হাদিসে কিরতাস বা কাগজের ঘটনা প্রসঙ্গে শিয়া কাফেরদের অপবাদের জবাব