সালাতুত তাসবিহ : যয়িফ নয়, বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত

কিছু দিন পূর্বে আমার এক মুসুল্লি-- যিনি দীনদার সাধারণ মানুষ-- আমাকে ফোন করলেন, হুজুর আপনার সাথে জরুরি কথা আছে। আমি ভাবলাম, বিরাট কোনো সমস্যা হবে হয় তো। সাক্ষাতে সে জানাল, হুজুর! আমি অনেক দিন যাবৎ ‘সালাতুত তাসবিহ’ পড়ে আসছি। আমার এক আহলে হাদিস বন্ধু আমাকে বলল, তুমি এটা কী নামায পড়? সালাতুত তাসবিহ বলতে কোনো নামায নেই। এগুলো দুর্বল হাদিস। আমি তাকে বললাম, কোনো সমস্যা নেই; দুর্বল নয় শক্তিশালী হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এরপর বিভিন্ন হাদিসের কিতাবের লম্বা উদ্ধৃতি তার হাতে ধরিয়ে দেওয়ার পর সে খুশি হয়। কিন্তু এর কিছু দিন পর আবার জরুরি সাক্ষাৎ করার পর সে বলল, হুজুর! তিরমিযি শরিফে নাকি ওই হাদিসকে ‘গরিব’ বলা হয়েছে। আর ‘গরিব’ হাদিসের ওপর আমল করা যাবে না বলল আমার বন্ধুটি।
চিন্তা করুন, একজন সাধারণ শিক্ষিত মানুষকে তথাকথিত আহলে হাদিসরা কত ধোঁকা ও প্রতারণায় ফেলছে। সে ‘গরিব’ কিংবা ‘জঈফ’ বা ‘মুরসাল’ হাদিসের সংজ্ঞা ও হুকুম সম্পর্কে কী জানে?

আজকে বিখ্যাত এক দীনি ভাইকে দেখলাম সালাতুত তাসবীহ সম্পর্কে পোস্ট দিয়েছেন যে, জঈফ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। রাসূল সা. সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীন কেউ এ নামায পড়েননি। তাঁর পোস্টে সবাই ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ ও সঠিক বলে মন্তব্য করছেন। তাঁরা তো বলে বেড়ান, আমরা অন্ধ অনুসরণ করি না। যারা সঠিক বলছেন তাঁরা কি নিজে মাসআলাটি তাহকীক করে মন্তব্য করেছেন? বুকে হাত দিয়ে বলুন।

এবার হাদিসটি দেখব : 



অর্থ : আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন স্বীয় চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে বলেন, হে আব্বাস! হে আমার সম্মানিত চাচা! আমি কি আপনার খেদমতে একটি মূল্যবান হাদিয়া ও দামি উপঢৌকন পেশ করব? আমি কি আপনাকে বিশেষ কথা বলব? আমি কি আপনার দশটি কাজ ও দশটি খেদমত করব? অর্থাৎ আপনাকে এমন আমল বলে দিব, যার দ্বারা দশটি বড় উপকার সাধিত হবে। তা এমন আমল যা করলে আল্লাহ তাআলা আপনার সকল গোনাহ মাফ করে দিবেন। আগে-পরের, নতুন-পুরাতন, জ্ঞাত-অজ্ঞাত, সগিরা-কবিরা, গোপন ও প্রকাশ্য সকল গোনাহ। সে আমল হল ‘সালাতুত তাসবিহ’।
তা আদায় করার পদ্ধতি হচ্ছে- আপনি চার রাকাত নামায পড়বেন। প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতেহা ও অন্য সূরা পড়বেন। অতঃপর আপনি যখন প্রথম রাকাতে কেরাত পড়ে ফেলবেন, তখন দাঁড়িয়ে পনের বার : سُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ وَاللّٰهُ أَكْبَرُ ‘সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ এই তাসবিহ পড়বেন। এরপর রুকুতে গিয়ে তা দশবার পড়বেন। তারপর রুকু থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, সেজদায়, সেজদা হতে বসে, দ্বিতীয় সেজদায় এবং দ্বিতীয় সেজদা হতে বসে দাঁড়ানোর পূর্বে দশবার করে এই তাসবিহ পড়–ন। এভাবে চারো রাকাতে তা পড়বেন। এ হিসাবে প্রত্যেক রাকাতে সেই তাসবিহ ৭৫ বার পড়বেন। হে আমার চাচা! সম্ভব হলে প্রতিদিন এই নামায পড়বেন। যদি না হয় তবে প্রতি শুক্রবারে পড়বেন। তাও না হলে প্রতি বৎসর একবার পড়বেন। এটাও সম্ভব না হলে অন্তত জীবনে একবার তা পড়বেন।
(তিরমিযি- ১/১০৬, হাদিস নং- ৪৮২; আবু দাউদ- ১/১৮৩, হাদিস নং- ১২৯৯; ইবনে মাজাহ- ১০০, হাদিস নং- ১৩৮৬; সুনানে কুবরা লিলবায়হাকি, হাদিস নং-৫১১৩)

হাদিসটি সম্পর্কে ইমামদের মন্তব্য :

ইমাম তিরমিযি রহ. ‘সালাতুত তাসবিহ-সংক্রান্ত হাদিসকে (৪৮১ নম্বর হাদিস) বলেছেন : قال أبو عيسى حديث أنس حديث حسن صحيح
এরপর আবার ইমাম তিরমিযি ও শায়খ আলবানির মন্তব্য :
قال أبو عيسى حديث أنس حديث حسن غريب
قال الشيخ الألباني : حسن الإسناد
আর ৪৮২ নম্বর হাদিসের ব্যাপারে ইমাম তিরমিযি ও আলাবানির মন্তব্য :
قال أبو عيسى هذا حديث غريب من حديث أبي رافع
قال الشيخ الألباني : صحيح
এ হাদিস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন ইমাম হাকেম নিশাপুরি :
هذا حديث صحيح على شرط مسلم و شاهده حديث اليمانيين في صلاة التسبيح
এ মন্তব্যটি কত উচ্চাঙ্গীন তা কেবল শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিই জানেন। (আল-মুসতাদরাক আলাস সহীহহাইন : খ.১, পৃ. ৪৬২)

শায়খ আলবানির তিনটি মন্তব্য পাওয়া যায় : উপরে ‘হাসানুল ইসনাদ’ বলেছেন। আবার এক জায়গায় জঈফ বলেছেন। কিন্তু আরও কয়েক জায়গায় সহিহ বলেছেন। নিচে দেখুন :
قال الألباني : إسناده ضعيف كما أشار المصنف لكن له شواهد يتقوى بها لذا أوردته في صحيح أبي داود
(সহিহ ইবনে খুজাইমা তাহকীকসহ : খ.২, পৃ. ২২৩)
قال الألباني : صحيح
(আলবানির তাহকীকসহ আবু দাউদ : খ.১, পৃ. ৪৯৯; ১২৯৯ নম্বর হাদিসের অধীনে। আলবানীর তাহকীকসহ ইবনে মাজাহ : খ.১, পৃ. ৪৪৩; ১৩৮৭ নম্বর হাদিসের অধীনে।)

বি.দ্র. শায়খ আলবানি তিনরকম মন্তব্য করলেন কেন? এর দুটি উত্তর :
০১. বিভিন্ন সনদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে মন্তব্য করেছেন। কারণ, সনদের ভিন্নতার কারণে হাদিসের মানও ভিন্ন হয়।
০২. শায়খ আলবানির তাহকীক, বিশ্লেষণ ও হুকুমের মাঝে স্ববিরোধিতা ও দ্বন্দ্ব রয়েছে। এক হাদিসকে কোথাও সহিহ বলেছেন; আবার কোথাও জঈফ এমনকি মাওযু পর্যন্ত বলে দিয়েছেন। শায়খের এ স্ববিরোধিতার বিরুদ্ধে স্বয়ং আহলে আরব আলেমগণ কলম ধরেছেন। উপরের তিনটি মন্তব্য এর জাজ্বল্য প্রমাণ।

এ উপমহাদেশের বিখ্যাত আহলে হাদিস আলেম তুহফাতুল আহওয়াযির লেখক আল্লামা মুবারকপুরী রহ. বলেন : كان عبد الله بن المبارك يفعلها وتداولها الصالحون بعضهم من بعض وفيه تقوية للحديث المرفوع
অর্থ : আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. সালাতুত তাসবিহ আদায় করতেন। নেককার-বুযুর্গগণ একজনের কাছ থেকে আরেকজন এ নামায শিখতেন। এর দ্বারা মারফু হাদিস আরো শক্তিশালী হয়েছে। অর্থাৎ আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারকের মতো মুহাদ্দিস এবং বুযুর্গ ব্যক্তিবর্গ সালাতুত তাসবিহ পড়ার দ্বারা বুঝা যায়, মারফু হাদিসটি সহিহ ও আমলযোগ্য। কারণ, কোনো বিষয়ে সালাফদের আমল থাকার অর্থই হচ্ছে বিষয়টি প্রমাণিত। [খ- ২, পৃ. ৪৮৯]

আরেকজন আহলে হাদিস আলেম আবুল হাসান উবায়দুল্লাহ রাহমানী মুবারকপুরী মেশকাতের একটি আরবি ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখেন। নাম মিরআতুল মাফাতীহ (مرعاة المفاتيح شرح مشكاة المصابيح)। কিতাবটি জামিআতুস সালাফিয়া, বেনারস, ভারত থেকে প্রকাশিত। এই কিতাবের সালাতুত তাসবীহ পরিচ্ছেদে ১৩৩৭ নং হাদিসের অধীনে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সারসংক্ষেপ হল :
সালাতুত তাসবীহ সম্পর্কে প্রায় দশজন সাহাবি থেকে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কে ইমামদের দুটো দল রয়েছে। কেউ কেউ এসব হাদিসকে জঈফ বলেছেন। যেমন : ইবনুল আরাবী, নববী, ইবনে তাইমিয়া রহ. প্রমুখ। আরেকদল সহিহ ও হাসান বলেছেন। যেমন : ইমাম মাকদিসী, ইমাম মুসলিম, তিরমিযি, নাসায়ী, খতিব বাগদাদী, ইবনুস সালাহ, তাকি উদ্দিন সুবকী, সিরাজুদ্দীন বালকিনী, যারকাশী প্রমুখ। আর ইমাম ইবনুল জাওযী এ হাদিসকে তাঁর ‘আল-মাওযুআত’ কিতাবে উল্লেখ করে মারাত্মক অতিরঞ্জন করেছেন। সব ইমামগণ তাঁর এ কাজের বিরোধিতা করেছেন, তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। আর আমার মতে সত্য কথা হল, সালাতুত তাসবীস সংক্রান্ত হাদিসগুলো জঈফ নয়, মওযু হওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। বেশির চেয়ে বেশি হাসান বলা যেতে পারে। এর নিম্নস্তরে কখনোই যেতে পারে না।
তাঁর পুরো আলোচনা পড়লে আরও বিস্তারিত জানতে পারবেন। নিচে আরবি ইবারত দেখুন :
مرعاة المفاتيح شرح مشكاة المصابيح - (৪ / ৩৭৪)
والحق عندي أن حديث ابن عباس ليس بضعيف فضلاً عن أن يكون موضوعاً أو كذباً، بل هو حسن لا شك في ذلك عندي، فسنده لا ينحط عن درجة الحسن، بل لا يبعد أن يقال إنه صحيح لغيره لما ورد من شواهده، وبعضها لا بأس بإسناده، كما ستعرف. (খ.৪, পৃ.৩৭৪)
.
হা, এ কথা ঠিক যে কেউ কেউ এ হাদিসকে জঈফ বা মুনকার বলেছেন। ইবনুল জাওযী রহ. তাঁর ‘আল-মাওযুআত’ গ্রন্থে এ হাদিসটির বিভিন্ন সনদ উল্লেখ করে ইমামদের নেতিবাচক মন্তব্য উল্লেখ করেছেন। ইবনুল জাওযী মুসা ইবনে আবদুল আজিজ নামক রাবীকে মাজহুল বলেছেন। অথচ ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, ইবনে মাঈন ও ইমাম নাসায়ী এ রাবীকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। শুধু তাই না নিচের আলোচনা পড়ে দেখুন, ইবনে হাজার আসকালানী রহ. ইবনুল জাওযীর ওপর মারাত্মক ক্ষেপেছেন তিনি কেন এ হাদিসকে ‘আল-মাওযুআতে’র মধ্যে উল্লেখ করেছেন। এবং তাঁর সবগুলোর আপত্তির উত্তর দিয়েছেন।
وقد رد الحافظ على ابن الجوزي في إيراده الأحاديث الثلاثة في الموضوعات وأورد الحافظ ابن حجر حديث ابن عباس في كتاب الخصال المكفرة وقال رجال إسناده لا بأس بهم وقد أساء ابن الجوزي بذكره في الموضوعات وقوله أن موسى بن عبد العزيز مجهول لم يصب فيه فإن ابن معين والنسائي وثقاه فلا يضره أن يجهل حاله من جاء بعدهما وشاهده ما أخرجه الدارقطني من حديث العباس والترمذي وابن ماجه من حديث أبي رافع وأبو داود من حديث ابن عمر وله طرق أخرى انتهى وقال في أمالي الأذكار حديث ابن عباس أخرجه البخاري في القراءة خلف الإمام وأبو داود وابن ماجه وابن خزيمة في صحيحه والحاكم في مستدركه والبيهقي
(تنزيه الشريعة المرفوعة عن الأحاديث الشنيعة الموضوعة খ.২, পৃ.১২৪)

শুধু তাই না, ইমাম শাওকানী ও ইমাম সুয়ুতী রহ. প্রচণ্ড প্রতিবাদ করে ইবনুল জাওযীর উত্তর দিয়েছেন।
(দেখুন : الفوائد المجموعة في الأحاديث الموضوعة পৃ.৩৭)
.
হাদিসের মান নির্ণয় হয় রাবী বা বর্ণনাকারীদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে। এ হিসেবে হাদিস তিন প্রকার :
ক. কিছু হাদিস সকল ইমামের মতে সহিহ।
খ. কিছু হাদিস সকল ইমামের মতে জঈফ।
গ. মতানৈক্যপূর্ণ হাদিস। কোনো ইমাম সহিহ বলেছেন। আবার কোনো ইমাম জঈফ বলেছেন।
আমাদের আলোচ্যবিষয়ে সহিহ আখ্যাদানকারীদের সংখ্যা অনেক বেশি। যারা জঈফ বলেছেন তাঁদের সংখ্যা নিতান্তই কম। আর আমরা জানি, নফল ও ফাজায়েলের ক্ষেত্রে জঈফের ওপর আমল করা যায়। জঈফের হুকুম সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে জঈফ হাদিস সম্পর্কে মন্তব্য করা দরকার। জঈফ মানেই প্রত্যাখ্যাত বা পরিত্যাজ্য-- বিষয়টি এমন না। যারা সহিহ-জঈফ বানিয়েছেন তাঁরা যে হুকুম বর্ণনা করেছেন, সেটাই আমাদের মানতে হবে। কারণ, সহিহ-জঈফ এগুলো ইমামদের বানানো। তাঁদের পরিভাষা।

এতসব আলোচনার পর তাঁরা কিভাবে সালাতুত তাসবীহকে জাল, বানোয়াট বা জঈফ বলে? মুবারকপুরির চেয়ে বড় আহলে হাদিস এ উপমহাদেশে কোত্থেকে এলো? একটি প্রতিষ্ঠিত সুন্নাহকে জঈফ বলার দুঃসাহস কিভাবে দেখায়?
.
সালাতুত তাসবীহ সম্পর্কে কোনো বানোয়াট ফজিলত কেউ বর্ণনা করলে সেগুলো অবশ্যই পরিহার্য, পরিত্যাজ্য। যেমন সালাতুত তাসবীহ জীবনে একবার না পড়লে জান্নাতে যাবে না, এসব সহিহ কথা নয়। কিন্তু বানোয়াট ফজিলতের কারণে মূল সুন্নাহকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে? সালাতুত তাসবীহ একটি নফল সালাত। জীবনে একবার না পড়লেও সমস্যা নাই। তবে নফলের প্রতি উৎসাহ দেওয়া দরকার। কোথায় উৎসাহ দিবে উল্টো যারা পড়ছে তাদেরকে বিমুখ করছে! আফসোস!!

------------------------
লিখেছেনঃ Mohiuddin Kasemi

এই সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

ডাউনলোড করুন মাকতাবায়ে শামেলা লেটেস্ট ভার্শন (মোবাইল এবং পিসির জন্য)

রুকইয়াহ আশ-শারইয়্যাহ (ডাউনলোড)

ইসতিখারার সুন্নত তরিকা + pdf