ইলম অর্জনের লক্ষ্য - উদ্দেশ্য এবং দুটি কথা
ইলম হাসিলের পিছনে কয়েক ধরনের জজবা কাজ করে। যেমনঃ
১. আমল ও দাওয়াতের নিয়তে জানার জজবা।
২. শুধু আমলের নিয়তে জানার জজবা।
৩. শুধু দাওয়াতের নিয়তে জানার জজবা।
৪. জানানোর নিয়তে জানার জজবা।
৫. তর্ক ও বিতর্কের নিয়তে জানার জজবা।
.
উপরোক্ত পাঁচ প্রকার আবার ইখলাসের কারণে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
এখন কথা হল ইখলাস থাকা স্বত্বেও এই পাঁচ প্রকার জজবা সমান উপকারী নয়। আপনি আপনার সাধারণ জ্ঞান ও বিবেচনা দিয়েই এগুলোর ক্রম বিন্যাস করতে পারবেন।
অর্থাৎ ইখলাসের সাথেও সব জজবা সমান নয়।
.
আবার ইখলাস না থাকলে এ ধরণের জজবার যে কুফল আছে, তাও সমান নয়। অর্থাৎ ইখলাসহীন এ সকল জজবার একেকটার ক্ষতি একেকরকম।
ইখলাসহীন ইলম হাসিলের জজবার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর হল অন্যকে জানানোর নিয়তে ইলম হাসিলের জজবা। এরপরেই তর্ক ও বিতর্কের উদ্দেশ্যে ইলম হাসিলের জজবা।
এই দুই জজবায় মানুষ অধিকাংশ সময় উল্টোপথে হাঁটার নীতি বেছে নেয়। মানুষের মাঝে চমক সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে, নিজের পাণ্ডিত্য জাহিরের মানসে এবং অন্যদের চেয়ে নিজেকে আলাদা প্রমাণ করার খাহেশে ইলম ও আমলের উসুল ও সালাফের আঁকড়ে থাকা পথ থেকে দূরে সরে ভিন্ন পথ বেছে নেয়। এতে উম্মাতের চলমান বিশুদ্ধ ও প্রমানিত আমল ধাক্কা খায়। সাধারণ মানুষের মধ্যে সালাফের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ভাব চলে আসে।
.
বর্তমান সময়ে অনলাইন ও অফলাইনে কিছু মানুষ এমন সব মাসআলা দিয়ে বেড়াচ্ছেন, যা এই অঞ্চল সহ অধিকাংশ সালাফ ও খালাফের আমলের বিপরীত। এতে তারা উদারতা ও দীনকে সহজ করার প্রয়াস দেখিয়ে চমকপ্রিয় আমজনতার বাহবা কুড়াচ্ছেন ঠিক, কিন্তু এর অন্তরালে মানুষের দিল হতে সালাফ এমনকি সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারেও নেতিবাচক মানসিকতা গড়ে উঠছে। যেমনঃ
ক. তারাবীহর নামাজের রাকাত সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়ার অধিকার উমার রা. কে কে দিয়েছে?
উনি বললে বা করলেই কি আমাদের মানতে হবে নাকি? আমরা হাদিস জানি না?
অথচ খোদ সাহাবায়ে কেরাম এ ধরনের প্রশ্ন তোলেননি।
খ. ইমাম আহমাদ সহ কয়েকজন হায়েজ অবস্থায় মেয়েদের কুরআন তিলাওয়াতের অনুমতি দিয়েছেন। হানাফি মোল্লারা বললেই হল?
অথচ তারা সকলেই শর্তসাপেক্ষে জায়েজ বলেছেন। এবং জমহুর উলামায়ে কেরাম এর বিরোধিতা করেছেন। এবং জমহুর উলামায়ে কেরাম সাহাবি ইবনু উমারের হাদিস দ্বারা দলিলও দিয়েছেন। উক্ত হাদিসের সনদ যঈফ হলেও যঈফ হাদিস কিয়াসের চেয়েও শক্তিশালী।
গ. আয়েশা রা. এর গোলাম নামাজে দেখে দেখে কুরআন পড়েছেন। অথচ হানাফি মোল্লারা নিষেধ করে। এসব তারা কই পায়?
অথচ হানাফি মোল্লা সহ অধিকাংশ সালাফই একে এড়িয়ে গেছেন। সাহাবায়ে কেরাম তো করেনই নি।
তাছাড়া একটা মাসআলা দেয়ার সময় আঞ্চলিক ফকিহদের আমল দেখাও জরুরি।
নামাজের পদ্ধতিগত মতভেদ সারা দুনিয়া জানে। অন্য মাজহাবের লোকজন যখন নিজেদের মত করে নামাজ পড়ে তখন আমরা কিছুই বলি না। তারাও আমাদের কিছু বলে না।
অথচ দীর্ঘ সময়ের জন্য আফগানিস্তানে অবস্থান করতে এসে আব্দুল্লাহ আযযাম রহ. বললেন, এই অঞ্চলে থাকা অবস্থায় আমরা হানাফি পদ্ধতিতেই নামাজ পড়ব।
আমি একবার পঞ্চগড় সফরে গেলাম। গাইরে মুকাল্লিদ মসজিদে জুমা পড়াতে বলল। আমি খুতবা এবং নামাজ, দু' টোই তাদের মাসআলা অনুযায়ী পড়িয়েছি। উদ্দেশ্য, নামাজ তো আর ফাসিদ হচ্ছে না। ফিতনা ছড়ানোর কী দরকার?
.
মূলকথাঃ এসব বুঝ যাদের নেই। কিংবা যারা বুঝেও না বোঝার ভান করে বসে আছেন। তাদের কাছ থেকে ইলম না নেয়াই ভালো। এদের কাছ থেকে ইলম নিতে থাকলে আপনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। দ্বন্ধে পড়ে যাবেন।
.
এখন কথা হল আমাদের দেশের মোল্লারা লোকজনকে কুরআন হাদিস পড়ে মাসআলা মাসাঈল বের করতে নিষেধ করে তাদের কথামত চলতে বলে কেনো?
এর দু'টি উত্তরঃ
১. কিছু মানুষ আছে যারা বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, আর্টিকেল পড়ে, ভিডিও দেখে রোগ সম্পর্কে আইডিয়া নিয়ে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে রোগ সম্পর্কে নিজের মতামত দিতে শুরু করে। অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ ডাক্তার তখন খুব সহজেই বুঝে যায় যে, এই লোক রোগ সম্পর্কে কিছু সাধারণ জ্ঞান হাসিল করেছে বটে, কিন্তু শাস্ত্রীয় জ্ঞান, সঠিক গ্রন্থাদি এবং উপযুক্ত শিক্ষক ও চর্চার পরিবেশ ছাড়া রেডিমেড বিদ্যা তাকে তো বিপদে ফেলবেই, তার চেয়ে বেশি বিপদে ফেলবে তার গুনমুগ্ধ ভক্তবৃন্দকে। কারণ এই লোক জানে যে, রোগ বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান নেই। তাই সমস্যা বিপদসীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে সে অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যাবে। কিন্তু ভক্তকূল তো আর তা জানে না। তারা যাবে না। ভূল পথে মাথা ঠুকে মরবে।
তাই বিজ্ঞ ডাক্তারগণ এ ধরনের পণ্ডিত লোকজনকে কঠোর ভাষায় ভৎসর্না করে থাকেন। যাতে তারা ভাসাভাসা কিছু চিকিৎসা বিদ্যা হাসিল করলেও তা নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে না পারে। নিজে বিপদে না পড়ে। অন্যকে বিপদে না ফেলে।
২. ইবনু হাজার আসকালানী, ইমাম নববী থেকে শুরু করে কাসিম নানুতাবী রহ. ও হালের আবু গুদ্দা রহ. তকী উসমানী (দা. বা.) সাহেবের মত পণ্ডিত ও শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিগণ যদি এত জানার পর, এত বুঝার পরও আবু হানিফা, শাফিঈ, মালিক বা হাম্বল কিংবা ইবনু তাইমিয়া রহ. এর অনুসরণকে নিরাপদ মনে করে থাকেন, তাহলে আমার মত সাধারণ মোল্লা বা আপনার মত হালকা অসাধারণ মোল্লার কি করা উচিত? এক দুইটা তাফসীর ও হাদিসের কিতাবের অনুবাদ পড়া পাবলিকের তো নাম নেয়ারই সুযোগ নাই।
.
আপনি যে মাজহাবই মানেন, আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু জগাখিচুড়ি পাকাবেন না।
.
অতএব খুব সাবধান। পণ্ডিতি জাহির করার আগে চোখ বন্ধ করে নিজেকে প্রশ্ন করুন, উদ্দেশ্য কী? দুনিয়া না আখিরাত? আনুগত্য না বিদ্রোহ? ঐক্য না বিভেদ? সমাধান না ফিতনা? কোনটা?
খুব ভেবেচিন্তে!
الله اعلم بالصواب
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন