হায়াতুল আম্বিয়া বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন ও তার জবাব
-মাওলানা তাহমীদুল মাওলা
.
[আকীদায়ে হায়াতুন্নাবী একটি শাশ্বত ও স্বীকৃত বিষয়। সম্প্রতি এ নিয়ে অহেতুক কিছু আক্রমনাত্মক বিভ্রান্তি তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিষয়টির স্বরূপ ও ব্যাখ্যায় গভীর ইলমী সূ²তা বিদ্যমান। শাস্ত্রীয় একটি বিষয় হওয়া সত্তে¡ও বিষয়টিকে সর্বসাধারণের জন্য সহজবোধ্য করে পেশ করার চেষ্টা করা হয়েছে এই নিবন্ধে। এতে পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফের বিভিন্ন দলিল উল্লেখ করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আকীদায়ে হায়াতুন্নাবীর সত্যতা এবং এর অস্বীকারকারীদের দাবির অসারতা। এটি এ লেখার দ্বিতীয় কিস্তি।]
.
[আকীদায়ে হায়াতুন্নাবী একটি শাশ্বত ও স্বীকৃত বিষয়। সম্প্রতি এ নিয়ে অহেতুক কিছু আক্রমনাত্মক বিভ্রান্তি তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিষয়টির স্বরূপ ও ব্যাখ্যায় গভীর ইলমী সূ²তা বিদ্যমান। শাস্ত্রীয় একটি বিষয় হওয়া সত্তে¡ও বিষয়টিকে সর্বসাধারণের জন্য সহজবোধ্য করে পেশ করার চেষ্টা করা হয়েছে এই নিবন্ধে। এতে পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফের বিভিন্ন দলিল উল্লেখ করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আকীদায়ে হায়াতুন্নাবীর সত্যতা এবং এর অস্বীকারকারীদের দাবির অসারতা। এটি এ লেখার দ্বিতীয় কিস্তি।]
১.‘হায়াতুল আম্বিয়া বা হায়াতুন্নবী’ পরিভাষাটা কি ভারতীয়?
জনৈক ব্যক্তি বলেনÑ ‘হায়াতুন্নবী’ অর্থ সীরাতুন্নবী। মৃত্যু পরবর্তী বিশেষ জীবন অর্থে ‘হায়াতুল আম্বিয়া’ পরিভাষা নাকি ভারতীয়দের দেওয়া। আরব আলেমরা ‘হায়াতুল আম্বিয়া’ পরিভাষা বুঝেনই না। এ কারণে এ পরিভাষা পরিত্যাগ করা উচিত।
আমি বলব যাদের এমন ধারণা রয়েছে তাদের জানা থাকা উচিত যে, নবীগণের কবরে জীবিত থাকা অর্থে ‘হায়াতুল আম্বিয়া’ পরিভাষাটির ব্যবহার অনেক পুরানা। হাজার বছর আগের হাদীস শাস্ত্রের ইমাম বাইহাকী রাহ. রচিত এ বিষয়ের গ্রন্থের নামই তো হল, ‘হায়াতুল আম্বিয়া’। অতঃপর বিখ্যাতদের মধ্যে ইবনে তাইমিয়া, ইবনে হাজার আসকালানী, জালালুদ্দীন সুয়ূতী, মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ ছালেহী, ইবনে হাজার হাইতামী প্রমুখের মত বড় বড় ইমাম, মুহাদ্দিস ও ফকীহগণ নির্দ্বিধায় এ পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। সুতরাং এ পরিভাষা বুঝতে না পারা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা বৈ কিছু না। আর ‘হায়াতুল আম্বিয়া’-কে ভারতীয় পরিভাষা বলা তো রীতিমত হাস্যকর বিষয়। কারণ উপরিউল্লিখিত যারা হায়াতুন্নবী পরিভাষাটি ব্যবহার করেছেন তাদের কেউই ভারতীয় নন।
মূলত ‘হায়াতুল আম্বিয়া’ পরিভাষাটি সরাসরি হাদীস থেকে নেওয়া। হাদীসে বলা হয়েছেÑ ‘আল-আম্বিয়াউ আহ্ইয়াউন্ ফী কুবূরিহিম’Ñ নবীগণ কবরে জীবিত। এর একবচন ‘আন্নবীই-উ হাইউন্ ফি কাব্রিহি’Ñ নবী কবরে জীবিত। আর কোরআনে শহীদদের জন্য স্পষ্টভাষায় আর নবীদের জন্য ইঙ্গিতে বলা হয়েছেÑ ‘তাদের মৃত বলো না’। বরং বলা হয়েছেÑ ‘তাদের মৃত মনেও করো না’। সুতরাং তাঁদের জীবিত মনে করা ও বলাতে কোনো দোষ থাকতে পারে না। লক্ষ্য করুন, একজন জীবন্ত মানুষকে মৃত বলতে কুরআনে-হাদীসে কোথাও নিষেধ করা হয়নি। তবুও কোনো জীবন্ত মানুষকে মৃত বলাটাকে অন্যায় মনে করা হয়। অথচ এ জীবন্ত মানুষটাই শহীদ হওয়ার পর তাকে মৃত বলতে কুরআনে নিষেধ করা হয়েছে। কেউ যদি জেদ করে বলে আমি শহীদকে মৃত বলবই। তাহলে সে কুরআনের সুস্পষ্ট নিষেধ অমান্য করল। নবীদের জীবন তো শহীদের চেয়ে আরো পূর্র্র্ণাঙ্গ ও উন্নত। হাদীসে তাদেরকে জীবিত বলা হয়েছে। তাই কেউ যদি বলে, না আমি তাদেরকে মৃত বলব তাহলে সে এ হাদীসের অবাধ্য হল বৈ কি?
২. নবীগণের কবরের জীবনের সাথে দুনিয়ার জীবনের কি কোনোই সাদৃশ্য নেই!
কেউ কেউ বলেনÑ ‘মৃত্যুর পর নবীগণ জীবিত এটা মানি। কিন্তু কবর র্বাযাখের জগত। সে জগত সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। আর বারযাখের জীবনের সাথে দুনিয়ার জীবনের কোনো মিল নেই। এর সাথে দুনিয়ার জীবনের কোনোই সাদৃশ্য নেই। কুরআনে বলা হয়েছেÑ
“জীবিত (মুমিন) ও মৃত (অবিশ্বাসী) সমান নয়”। Ñসূরা ফাতির () ২২
আসলে এটি হল কৌশলে নবীগণের কবরের জীবনকে অস্বীকার করা বা তুচ্ছ করে দেখার একটি মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। অন্যথায় এ কথার কোনো দালিলিক ভিত্তি নেই। কারণÑ
ক. ‘র্বাযাখ্’ অর্থ দুই বস্তুর মধ্যবর্তী প্রতিবন্ধক বা পর্দা। কারো কারো মতে মৃত্যু থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত সময়টাকেই বারযাখ বলে। তাই বারযাখে যাওয়া মানে এমন আড়ালে চলে যাওয়া যেখান থেকে আমরা সরাসরি কিছু দেখতেও পারি না, জানতেও পারি না। কিন্তু কুরআন-সুন্নাহর মাধ্যমে বারযাখের কোনো বিষয় যখন জানা হয় তখন তা বিশ্বাস করে মেনে নিতে হয়। বারযাখের কথা বলে এ বিষয়ে কিছু জানি না, বা কোনো প্রমাণিত বিষয়কে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ থাকে না। তদ্রƒপ নবীগণও মৃত্যুর পর বারযাখে প্রবেশ করেছেন বলে তাদের সেখানকার কোনো অবস্থা আমাদের জানার কথা নয়। কিন্তু কুরআন-সুন্নাহ থেকে জেনেছিÑ তাঁরা কবরে স্বশরীরে জীবিত। নামায আদায় করেন। রিযিকপ্রাপ্ত হন। তাঁদের কাছে ছালাত ও সালাম পেশ করা হয় এবং কবরের নিকটস্থ ব্যক্তি থেকে ছালাত ও সালাম শুনতেও পান। সালামের জবাব দেন। তাই এ বিষয়গুলো অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
খ. নবীদের দুনিয়ার জীবন ও কবরের জীবনে কোনোই সাদৃশ্য নেইÑ কারো নিজস্ব বক্তব্য। কুরআন-সুন্নাহয় সাদৃশ্যের কথা স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সাদৃশ্যের কথা বলার অর্থ এই নয় যে, দুই জীবনে শতভাগ মিল রয়েছে। যেমন কাউকে বাঘের সাথে তুলনা করলে তার লেজ খুঁজতে যাওয়া উচিত নয়, বরং এটা হবে চরম নির্বুদ্ধিতা।
গ. আয়াতে বলা হয়েছেÑ “জীবিত (মুমিন) ও মৃত (অবিশ্বাসী) সমান নয়”। এর দ্বারা একথা কখনো বুঝা যায় না যে, নবীগণের জীবন দুনিয়ার জীবনের সাথে কোন সাদৃশ্য রাখে না। কারণÑ
(১) এ আয়াতে জীবিত ও মৃত বলে রূপকার্থে মুমিন ও অবিশ্বাসী কাফের বুঝানো হয়েছে। যা আয়াতের তরজমায় বন্ধনীতে ব্যক্ত করা হয়েছে। আর তরজমাটি নেয়া হয়েছে ‘হায়াতুল আম্বিয়া’ আকীদার উপর আপত্তি উত্থাপনকারী একজন লেখকের বই ‘তাবলীগ জামাত ও দেওবন্দীগণ’ (পৃ. ১০৩) থেকে। সুতরাং নবীগণের দুনিয়ার জীবন ও কবরের জীবনের মাঝে মিল থাকা বা না থাকার ব্যাপারে এ আয়াতে কিছুই নেই।
(২) নবীগণকে কুরআন-সুন্নাহ্য় জীবিত বলা হয়েছে। তাই জীবিত ও মৃত এক নয়, এ প্রসঙ্গ এখানে আসতেই পারে না।
(৩) তাছাড়া সাদৃশ্যের কিছু কিছু বিষয় কুরআন-সুন্নাহয় স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে, যা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তাই যারা অস্বীকার করেন তাদের জন্য সহীহ ও বিশুদ্ধ হাদীসগুলোর উপর নানারকম অন্যায় আপত্তি উত্থাপন করা ছাড়া আর করার কিছু থাকে না। সুতরাং যারা এ ধরনের আয়াত থেকে ‘হায়াতুল আম্বিয়া’ আকীদার উপর আপত্তি করেন তাদের প্রতি নিবেদন রইল, বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে দেখার।
৩. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি কবর থেকে কোনো কিছু শুনতে পান না?
অনেকে বলে থাকেন, কুরআন থেকে বুঝা যায়, কবরবাসী দুনিয়ার কিছুই শুনতে পায় না। তাদেরকে কিছুই শোনানো যায় না। সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরে ছালাত ও সালাম পড়লেও তিনি তা শুনতে পান না। এর দলিল হিসেবে তারা তিনটি আয়াত পেশ করেন। প্রথমত পেশ করেন সূরা নাম্ল-এর ৮০ নং আয়াত ও সূরা রূমের ৫২ নং আয়াত । যাতে রয়েছেÑ (তরজমা) “নিশ্চয় আপনি মৃতদের শুনাতে পারবেন না”। দ্বিতীয়ত পেশ করেন সূরা ফাতিরের ২২ নং আয়াত, যাতে রয়েছেÑ (তরজমা) “আর আপনি কবরবাসীদেরকে শুনাতে পারবেন না”। (১)
উপরিউল্লিখিত আয়াত থেকে নবীগণের কবর থেকে শুনতে না পারার কথা প্রমাণিত হয় না। কেননাÑ
(ক.) প্রথমোক্ত আয়াতদুটিতে বলা হয়েছে ‘আপনি মৃতদের শুনাতে পারবেন না’। আর কুরআন-হাদীস দ্বারাই প্রমাণিত যে, নবীগণ মৃত্যুবরণ করার পর পুনরায় বিশেষ জীবন পেয়ে জীবিত। তাই তাঁরা মৃত নন। সুতরাং তাঁদের শুনতে পাওয়া সম্পর্কে আয়াতে কিছুই বলা হয়নি।
(খ.) আসলে আয়াত দুটির প্রকৃত অর্থ এটি নয় যে, মৃত বা কবরস্থ ব্যক্তি কিছুই শুনতে পায় না। বরং উভয় আয়াতেই মূল উদ্দেশ্য হল, মৃতকে এমনভাবে শুনাতে পারবে না যাতে তারা উপকৃত হয়। অর্থাৎ তাঁরা শুনতে পেরেও জবাব দিতে পারবে না। কথা অনুযায়ী কাজ করতে পারবে না।
আয়াত দুটির প্রকৃত অর্থ
উপরিউল্লিখিত আয়াতগুলোর প্রকৃত অর্থ কী, সে বিষয়ে তাফসীর গ্রন্থসমূহে সুস্পষ্ট ও বিশদ আলোচনা রয়েছে। যে কোনো আলেমের জন্য তা পড়া ও সংশয় দূর করা কঠিন কিছু নয়। এখানে আমি শুধু এমন কিছু ব্যক্তিত্বের বক্তব্য উল্লেখ করছি যাঁদের উপর আমার ঐ ভাইদেরও যথেষ্ট আস্থা রয়েছে যারা হায়াতুন্নবী আকীদার বিষয়ে বিভিন্ন সংশয়ে আক্রান্ত রয়েছেন।
(১) ইবনে তাইমিয়া রাহ.
হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেনÑ ‘কবরস্থ ব্যক্তি দাফনকারী সঙ্গীদের জুতার আওয়াজ শুনতে পায়’। (সহীহ বুখারী, হাদীস ১২৭৩) তদ্রƒপ ইবনে উমর রা. বর্ণনা করেনÑ ‘বদরযুদ্ধে নিহত কাফেরদেরকে লক্ষ্য করে বলা নবীজীর কথাগুলো মৃত্যুর পরও তারা শুনতে পেয়েছে’। (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩০৪) তন্মধ্যে হযরত ইবনে উমর রা.-এর বর্ণনার দুটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় হযরত আয়শা রা. ও তাবেয়ী কাতাদা রাহ. থেকে। এ প্রসঙ্গে ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন, ‘হাদীস ও সুন্নাহর সকল শাস্ত্রবীদ হযরত আনাস ও ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত হাদীস দুটি সহীহ হওয়ার বিষয়ে একমত...’।
অতপর তিনি বলেনÑ ‘আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত সহীহ ও সুস্পষ্ট বক্তব্য সাহাবী ও পরবর্তীদের ব্যাখ্যা অপেক্ষা অগ্রগণ্য। মৃত ব্যক্তিদের শ্রবণ বিষয়ক এ হাদীসের বিরোধী কোনো বক্তব্য কুরআনে নেই। কেননা (إنك لا تسمع الموتى ) “আপনি মৃতদেরকে শোনাতে পারবেন না” আয়াতটি দ্বারা উদ্দেশ্য হল স্বাভাবিক পর্যায়ের শ্রবণ, যা শ্রবণকারীর উপকারে আসে। কেননা আয়াতাংশটি এখানে প্রবাদ অর্থে এসেছে, যা কাফেরদের অবস্থা বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। আর কাফেররা তো আওয়াজ শুনতে পায়। কিন্তু বুঝে শোনে গ্রহণ ও অনুসরণ করার জন্য শোনে না। এতে এটি প্রমাণিত হয় না যে, মৃত ব্যক্তি শুনেই না। Ñমাজমূউল ফাতাওয়া ৪/২৯৬-২৯৮
আমি সংক্ষেপে উল্লেখ করলাম। আলেমগণ তার কিতাবের আরবী পাঠ দেখে নিতে পারেন।
(২) আল্লামা ইবনে কাসীর রাহ.
ইমাম ইবনে কাসীর রাহ. বলেন, “মৃতদের শ্রবণ বিষয়ে ইবনে উমর রা.-এর বর্ণনাই উলামাদের নিকট সহীহ। এর অনেক সমর্থক বর্ণনাও রয়েছে। আবার এর সহীহ হওয়ার অনেক দিকও রয়েছে।... পূর্ববর্তী সালাফের সকলেই মৃতদের শুনতে পাওয়ার বিষয়ে একমত। আর এ বিষয়ে সালাফ থেকে মুতাওয়াতির (অসংখ্য সূত্র বিশিষ্ট) বর্ণনা রয়েছে যে, মৃতব্যক্তি কবর যিয়ারতকারীকে চিনতে পারে এবং তাতে আনন্দিত হয়।... ” Ñসূরা রূম আয়াত : ৫২-এর অধীনে
(৩) ইবনুল কায়্যিম রাহ.
ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন, “আর আপনি কবরবাসীদেরকে শুনাতে পারবেন না” এ আয়াত দ্বারা প্রমাণ পেশ করাও ঠিক নয়। কারণ, উপস্থাপন ভঙ্গি থেকে আয়াতের এ অর্থ বুঝা যায় যে, কাফিরদের অন্তঃকরণ মৃত, আপনি তাদেরকে এমনভাবে শোনাতে পারবেন না যে, তারা এই শ্রবণের দ্বারা উপকৃত হবে। যেমন আপনি কবরবাসীকে এমনভাবে শোনাতে সক্ষম না, যেভাবে শোনালে তারা উপকৃত হয়। এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, কবরবাসী কিছুই শুনতে পায় না। এটা কী করে হয়, অথচÑ (১) নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মৃতব্যক্তি তাকে কবরস্থকারীদের (প্রস্থানকালে) জুতার আওয়াজ শুনতে পায়। (২) এবং এও বলেছেন যে, বদরের নিহত কাফেররা তাঁর কথা ও সম্বোধন শুনেছে। (৩) তাছাড়া তিনি মৃতব্যক্তিদের সালামের ক্ষেত্রে সম্বোধন পদ ব্যবহার করেছেন, যা এমন উপস্থিত ব্যক্তিকেই করা যেতে পারে, যে শুনতে পায়। এবং তিনি কবরে সালাম দেওয়াকে সুন্নত সাব্যস্ত করেছেন। (৪) এ কথাও বলেছেন যে, যে মুমিন তাদেরকে সালাম করে, তারা তার সালামের জবাব দেয়।
...প্রকৃতপক্ষে আয়াতের অর্থ হল: “আল্লাহ তাআলা যাদের শোনাতে চান না আপনি তাদের শোনাতে পারবেন না। (আপনার কথা শুনেও ওরা না শুনার মতই কোন উপকার পাবে না) আপনি তো শুধু সতর্ককারী। আপনাকে ভীতি প্রদর্শনের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এবং আপনি সে সম্পর্কেই জিজ্ঞাসিত হবেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যাদেরকে শোনাতে চান না, তাদের ব্যাপারে আপনাকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি। Ñকিতাবুর রূহ, বাংলা অনুবাদ, এমদাদিয়া লাইব্রেরী ২য় প্রকাশ ২০০১ইং পৃ. ৭২-৭৩; মূল আরবী পৃ. ৪৬
৪.‘আল্লাহ আমার রূহ আমার মধ্যে ফিরিয়ে দেন’ কথার অর্থ কী?
অনেকে হায়াতুল আম্বিয়া আকীদার উপর আপত্তি করেন এই বলে যে, হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে রয়েছেÑ “যখনই কেউ আমার উপর সালাম করে, আল্লাহ তা‘আলা আমার মধ্যে রূহ ফিরিয়ে দেন...”(২)। সুতরাং রূহ ফিরিয়ে দেওয়ার আগে দেহে রূহ ছিল না। সালামের জবাব দেওয়ার পর আবার রূহ চলে যায়। তাই তিনি কবরে মৃত!
প্রবন্ধের শুরুর দিকে (প্রথম কিস্তিতে) হাদীসটি উদ্ধৃত করা হয়েছে এবং এর প্রকৃত অর্থ ব্যাখ্যাসহ সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে। ভালোভাবে ব্যাখ্যাটা বুঝে নিতে পারলে আর কোনো প্রশ্ন বাকী থাকার কথা নয়। তবুও এখানে শুধু এতটুকু বলা যে, যারা এমন দাবি করেন তাদের দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণÑ
(ক) এ কথার ভিত্তি হল উক্ত হাদীসের ভুল ব্যাখ্যার উপর। বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী ও তাঁর শিষ্য হাফেজ সাখাবী রাহ. ভুল ব্যাখ্যাটিকে প্রত্যাখ্যান করে হাদীসের যৌক্তিক পাঁচটি ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছেন। (ফাতহুল বারী ৬/৬০৬) কারণ, ‘কেউ সালাম দিলেই কেবল উত্তর দেওয়ার জন্য তাঁকে জীবিত করা হয়,’ Ñএ অর্থ করা হলে হাদীসটি পূর্বোক্ত সবগুলো সহীহ হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। নবীগণ কবরে জীবিত, নামায আদায় করেন, রিযিক প্রাপ্ত হন, সালাম শুনতে পান ইত্যাদি হাদীসের সাথে এর কোনো মিল থাকে না।
তাই হাদীসের সহীহ ব্যাখ্যা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে হাফেজ ইবনুল্ মুলাক্কিন রাহ. বলেন, এ হাদীসের অর্থ হল, ‘আল্লাহ তাআলা আমার ভাষা ফিরিয়ে দেন’। আর আল্লামা তীবি রাহ. বলেনÑ ‘আল্লাহ তাআলা আমার ধ্যান ফিরিয়ে দেন’। সুতরাং এ হাদীস দিয়ে একথা প্রমাণ হয় না যে, সালামের জবাব দেওয়ার আগে ও পরে নবী মৃত ছিলেন।
(খ) আসলে যারা পূর্বোল্লিখিত হাদীসগুলোকে সহীহ মেনে নিয়েছেন তারা কখনোই আলোচ্য হাদীসটির এ অর্থ গ্রহণ করতে পারেন না। যদি করেন তাহলে তিনি এক অমীমাংসাযোগ্য স্ববিরোধিতার শিকার হয়ে যাবেন।
(গ) আরো সহজ কথা হলো ‘কেউ সালাম করলে রূহ ফিরিয়ে দেন’ অর্থ করলেও পূর্বে মৃত ছিলেন একথা প্রমাণ করা যায় না। কারণ, মৃত বা মায়্যিত বলে ঐ ব্যক্তিকে যার রূহ দেহ থেকে বের হয়ে গেছে এবং রূহের সাথে দেহের কোন সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে না। আর যদি রূহ দেহ থেকে বের হয়ে যায় কিন্তু দেহের সাথে রূহের সম্পর্ক থাকে তাহলে তাকে মৃত বলা হয় না। বরং সে জীবিত। যেমন ঘুমন্ত ব্যক্তি। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন, মৃত ব্যক্তির মত ঘুমন্ত ব্যক্তির রূহও তিনি দেহ থেকে নিয়ে নেন। অতপর জাগার সময় তা আবার তার দেহে ফিরিয়ে দেয়া হয়। সুতরাং রূহ ফিরিয়ে দেয়া হয় কথা দ্বারা বুঝা যায় তিনি হয়ত ঘুমন্ত ব্যক্তির ন্যায় জীবিত ছিলেন। তবুও তো জীবিত। এ থেকে মৃত একথা প্রমাণ হয় না।
(ঘ) তাছাড়া কোনো সময় কি এমন আছে যখন নবীজীর উপর পৃথিবীর কোনো না কোনো স্থান থেকে কেউ না কেউ ছালাত ও সালাম পাঠায় না, বা রওজায়ে আতহারে কেউ না কেউ সালাম পেশ করতে থাকে না?! তাহলে সব সময়ই ছালাত ও সালাম জারি থাকে আর সব সময়ই তার দেহ মুবারকের সাথে রূহের সম্পর্ক থাকে। সুতরাং এ হাদীসের বাহানা দিয়ে ‘হায়াতুন্নবী’ অস্বীকার করার কোন সুযোগ থাকে কি করে?
৫. হায়াতুল আম্বিয়া বিষয়ে দেওবন্দীদের উপরে আরোপিত আকীদা ভিত্তিহীন
ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে ‘হায়াতুল আম্বিয়া’ আকীদা শিরোনামে কিছু ঘটনা উদ্ধৃত করে উলামায়ে দেওবন্দ সম্পর্কে বলা হয়Ñ তাঁরা বিশ্বাস করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুবরণ করেননি, কবর থেকে যে কারো সাথে জাগ্রত ও ঘুমন্ত অবস্থায় সাক্ষাৎ করেন, তাঁর সাথে কথাবার্তা বলা যায়, তিনি বিভিন্ন স্থানে যখন ইচ্ছা গমনাগমন করতে পারেন ইত্যাদি। এর প্রমাণ স্বরূপÑ দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার সময়ে নবীজীকে স্বপ্নে দেখার ঘটনা, শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর রওজা মোবারক থেকে সরাসরি সালামের জবাব শুনতে পাওয়ার কথা, একদিন নবীজীকে কবরে সরাসরি দেখতে পাওয়ার ঘটনা, আহমদ রিফাঈ রাহ. (মৃত.৫৭৮ হি.)-এর নবীজীর সাথে মোসাফাহা করার ঘটনা ও শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রাহ. রচিত ফাযায়েলে হজ্ব ও ফাযায়েলে ছাদাকাত গ্রন্থে উদ্ধৃত কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করা হয়। আর একমুখী অধ্যয়নে অভ্যস্ত অনেক সাধারণ শিক্ষিত ভাই এগুলো পড়ে উলামায়ে দেওবন্দ ও তাঁদের ধারার আলেমদের সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে পড়ে যান। অনেকে তো দ্বীনী কাজ মনে করে দেওবন্দীদের বিরোধিতা ও তাঁদের প্রতিরোধ করার কাজে কোমর বেঁধে লেগে যান। আর এভাবেই দ্বীন ইসলামের ধারক-বাহক একটি বিশাল দলের দ্বীনি কর্মের উপর তারা পানি ঢালতে শুরু করেন।
দেওবন্দীদের নামে প্রচারিত এ আকীদা মিথ্যা
বস্তুত দেওবন্দীদের নামে প্রচারিত এ আকীদা ভিত্তিহীন। প্রবন্ধের শুরুতে ‘হায়াতুন্নবী আকীদা’ শিরোনামে দলিল-প্রমাণসহ উলামায়ে দেওবন্দের আকীদা তুলে ধরা হয়েছে। এ বিষয়টিও পরিষ্কার করে দেয়া হয়েছে যে, উলামায়ে দেওবন্দ নবীগণের মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে তাই বিশ্বাস করেন, যা শরীয়তের দলিলের আলোকে প্রমাণিত। তাঁরা এর থেকে এক চুল পরিমাণও বিচ্যুত নন। তবে স্বপ্ন, কাশফ ও কারামাত-এর মাধ্যমে কোন কিছু ঘটে যাওয়া প্রমাণিত হলে তা স্বতন্ত্র বিষয়। তাহায়াতুল আম্বিয়া’ বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কযুক্ত কোন বিষয় নয়। বরং যে স্বপ্ন দেখে, যার কাশ্ফ হয় ও যার সাথে কারামাতের ঘটনা ঘটে এবং যা ঘটে সে বিষয়ে শরীয়তের স্বতন্ত্র বিধান রয়েছে। এটি সেই বিধানের আলোকেই বিচারিত হবে।
স্বপ্ন, কারামাত ও কাশফের পরিচয়
স্বপ্ন সত্যও হয়, মিথ্যাও হয়। ভাল স্বপ্ন মুমিনের জন্য সুসংবাদ, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদান করা হয়। হাদীসে রয়েছে ‘সত্য স্বপ্ন নবুওতের ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ’। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৫৮৬) আর আল্লাহর ওলীদের মাধ্যমে বা তাঁদেরকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো সময় কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটে। একে কারামত বলে। তদ্রƒপ কখনো প্রিয় বান্দাদের অন্তরে আল্লাহ তাআলা কোনো অজানা বা অদৃশ্য বিষয় উন্মোচিত করে দেন। একে পরিভাষায় কাশ্ফ ও ইলহাম বলে। অনেকে একেই ফিরাসাত বলেন। মূলত কাশফ ও ইলহামও কারামতেরই একটি প্রকার।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আকীদাহ
আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আকীদা হল, আলিমুল গাইব আল্লাহ তাআলার একক বৈশিষ্ট্য। তিনি ছাড়া কেউ গাইব জানেন না। তদ্রƒপ তিনিই একমাত্র সব কিছু করতে সক্ষম। তিনি এর জন্য কোনো আসবাব তথা কার্য-কারণের মুখাপেক্ষী নন।
কিন্তু আল্লাহ তাআলা ওহীর মাধ্যমে অনেক গায়েবের সংবাদ ও অদৃশ্য বিষয় নবীদেরকে জানিয়েছেন। তদ্রƒপ নবীদের দ্বারা অনেক অলৌকিক কাজ করিয়েছেন, যাকে পরিভাষায় বলা হয় মু‘জিযা। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর বিশ্বাস হল, রাসূলের প্রকৃত অনুসারী, পূর্ণ শরীয়তের পাবন্দ, নেককার বান্দাদেরকেও তিনি কোনো কোনো সময় সত্য স্বপ্ন, কাশফ ও ইলহামের মাধ্যমে অনেক অদৃশ্য বিষয়ে অবগত করেন। অনুরূপ তাঁদের দ্বারাও কখনো কখনো কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন, যাকে পরিভাষায় কারামত বলা হয়।
নবীর উপর অবতীর্ণ ওহীর সংবাদ ও আওলিয়ায়ে কেরামের সত্য স্বপ্ন, কাশ্ফ ও ইলহামের সংবাদের মধ্যে বড় বড় পার্থক্য রয়েছে। যেমনÑ (১) ওহী হল নিশ্চিত জ্ঞান ও অকাট্য বিষয়। তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হওয়া নিশ্চিত, তাই এতে কোনোরূপ সন্দেহ করার অবকাশ থাকে না। এর বিপরীতে স্বপ্ন, কাশ্ফ ও ইল্হামের সংবাদ কোনোটিই আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হওয়া নিশ্চিত নয়। তাই এসব কিছুই সন্দেহযুক্ত বিষয়। (২) ওহী কখনো ভুল হয় না। কিন্তু কাশ্ফ ও ইলহাম ভুলও হতে পারে। (৩) নবীর দ্বারা ওহী বুঝতে পারা ও সংরক্ষণ করে রাখার বিষয়েও কোনোরূপ সন্দেহ নেই। আল্লাহ নিজেই সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। বিপরীতে স্বপ্ন, কাশফ ও ইলহাম বান্দার জন্য বুঝতেও অনেক সময় ভুল হয়, আবার অনেক সময় তা স্মরণও রাখা যায় না। (৪) সবচে’ বড় কথা হল, নবীর প্রতি অবতীর্ণ ওহী (যার মধ্যে নবীর প্রতি হওয়া ইলহাম ও নবীর নিজে দেখা স্বপ্নও শামীল) শরীয়তের দলীল। এর বিপরীতে নবী ছাড়া অন্য কারো কাশ্ফ, ইলহাম ও স্বপ্ন শরীয়তের দলীল নয়।
স্বপ্ন, কাশফ ও ইলহামের শরয়ী বিধান
১. আলিমুল গাইব একমাত্র আল্লাহ তাআলা। স্বপ্ন, কাশফ-ইলহাম ও কারামতের মাধ্যমে কোনো বিষয় জানতে পারাকে ইলমুল গায়ব বলে না। কেননা এটা ব্যক্তির ইচ্ছাধীন নয়। বরং আল্লাহ যখন জানান তখনি জানতে পারেন। আবার এ জানাটাও নিশ্চিত জ্ঞান নয়। তাই এ ধারণা রাখার কোনো অবকাশ নেই যে, আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দাগণ গায়েব জানেন।
২. ওহী শরীয়তের দলিল। আর নবী ছাড়া অন্য কারো স্বপ্ন, কাশ্ফ ও এলহাম শরীয়তের দলিল নয়। এর দ্বারা কোন বিধি-বিধান সাব্যস্ত হবে না। আকীদা-বিশ্বাস প্রমাণ হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। Ñআত-তাশাররুফ বিমারিফাতি আহাদীসিত তাসাওউফ, মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রাহ. পৃ. ২৬২
৩. এগুলো বিশ্বাস করা যাবে, যদি তাতে কুরআন-সুন্নাহ ও শরীয়ত বিরোধী কিছু না থাকে। বরং শরীয়তের বিধানের অধীন থেকে এর দ্বারা কোনোভাবে উপকৃত হতে পারলে তাও করা যাবে। যেমন, স্বপ্নে দেখল অমুক কাজটা করলে তার ব্যবসায় বরকত হবে। আর এ কাজটা শরীয়তে নিষিদ্ধ নয় বরং ভাল। তাহলে তার জন্য এ কাজ করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু স্বপ্নে দেখা এই নির্দেশকে শরীয়তের হুকুম মনে করা যাবে না।
কারামত এর বিধান
নবী ছাড়া অন্য কারো দ্বারা যে অলৌকিক কর্ম-কাণ্ড প্রকাশ পায় তা সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। এক. কিছু অলৌকিক কাজ আছে যা যাদু-মন্ত্র ও শয়তানের সাহয্যে করা হয়। দুই. কিছু অলৌকিক ঘটনা আছে যা প্রকৃত আল্লাহর ওলীদের বেলায় ঘটে থাকে। আর তৃতীয় আরেকটি প্রকার আছে যা মূলত অলৌকিক নয় বরং নিজের চেষ্টা ও কৌশলে অনুশীলনের মাধ্যমে আয়ত্ব করতে হয়। আর এর মাধ্যমে বাহ্যত অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখানো যায়। দেখতে মনে হয় এটাও অলৌকিক, আসলে তা অলৌকিক কোনো কাজ নয়। তাই কোন অলৌকিক ঘটনা ঘটতে দেখলে প্রথম করণীয় হলÑ
১. যার দ্বারা বা যাকে কেন্দ্র করে এমন অলৌকিক ঘটনাটি ঘটল তিনি কেমন লোক। তিনি যদি প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ওয়ালা ও কুরআন-সুন্নাহ এবং পরিপূর্ণরূপে শরীয়তের অনুসারী হন তাহলে বুঝা যাবে ঘটনাটি আল্লাহ তাআলা তাঁর সম্মানার্থে করিয়েছেন। এটাকেই কারামত বলে। আর যদি ব্যক্তি বেদ্বীন হয়। কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী না হয়, বা শরীয়তের বিধি-বিধান পালন না করে, অথবা প্রকৃত আল্লাহ ওয়ালা নয় বরং ওলীদের বেশধারী ধোঁকাবাজ হয়, তাহলে বুঝতে হবে ঘটনাটি কারামত নয়। বরং পরিভাষায় একে বলা হয় ‘ইস্তিদরাজ্’।
২. কারামত সম্পর্কে এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, এ অলৌকিক ঘটনাটি ঘটানোর নিজস্ব কোনো ক্ষমতা ওলীর হাতে নেই। তাই ওলী যখন ইচ্ছা তখন কারামত দেখাতে পারেন না। অনেক সময় ওলী নিজেও জানতে পারেন না যে, তাঁর দ্বারা একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেছে। বরং আল্লাহ তাআলাই নিজ কুদরতে যখন ইচ্ছা তাঁর প্রিয় বান্দাদের মাধ্যমে এমন অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন। তাই কারামত প্রকাশ পাওয়ার ক্ষেত্রে ওলীর নিজস্ব কোনো কৃতিত্ব নেই। অনেক সময় মৃত্যুর পরও কারো কারামত প্রকাশ পায়, যাতে ওলীর কোনোই হাত থাকে না।
৩. তবে কারামত থেকে কেবল এ শিক্ষাটুকুই নেওয়ার আছে যে, আল্লাহ তাআলা কেন এ বান্দাকে দিয়ে এমন অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে সম্মানিত করেছেন? নিশ্চয় তিনি আল্লাহ তাআলার এত বেশি সন্তুষ্টি অর্জন করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা এর বদলে তাঁকে পুরস্কৃত করেছেন। সুতরাং শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয় বিষয় হল, আল্লাহর ওলী দ্বীন ও শরীয়তের অনুসরণের মাধ্যমে কীভাবে আল্লাহর এত প্রিয় হলেন।
৪. সহীহ বিশ্বাসের সাথে কারামতের ঘটনা বর্ণনা করতে কোন দোষ নাই। তবে এতটুকু যাচাই তাকে করতে হবে যে, যে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে, এটি কি আসলেই ঘটেছে কি না। দ্বিতীয়ত কারামাতের ঘটনায় যদি এমন কোনো বিষয় থাকে যা শুনলে বা পড়লে সাধারণ মানুষের আকীদা-বিশ্বাসে প্রভাব পড়তে পারে, বা তারা বিভ্রান্তিতে পড়তে পারে তাহলে তা যথাসম্ভব চর্চা না করা।
৫. আল্লাহর প্রিয় বা ওলী হওয়ার জন্য কারামত প্রকাশ পাওয়া কোনো শর্ত নয়। বরং এর কোনোই প্রয়োজন নেই। এমনকি কারামত প্রকাশ পাওয়াটা বিশেষ কোনো কামাল তথা পূর্ণতাও নয়। তাই কারামত প্রকাশ পাওয়াটাকেই আল্লাহর ওলী হওয়ার দলিল মনে করা, এবং কারমত প্রকাশ না পেলে ওলী হওয়া যায় নাÑ এমন বিশ্বাস নিতান্তই ভুল। এর প্রভাবেই মূলত অনেক জীবনীকারকেও দেখা যায় কোনো আল্লাহ ওয়ালার জীবনী রচনাকালে কারামত উল্লেখ করাটাকে জরুরি মনে করেন। আর এ কারণে বাস্তবে ঘটেছে কি ঘটেনি চিন্তা না করে লোকমুখে চর্চিত সব ঘটনাই সংকলন করতে থাকেন। বিশেষ করে যে সকল বিষয় সাধারণ পাঠকের বোধগম্য নয়, এমন বিষয়ও অনেকেই উল্লেখ করেন যা মোটেও উচিত নয়। তাই এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।
৬. কারামতের মাধ্যমে কিছু অলৌকিক ঘটনা পাওয়া গেলে এটাকে স্বাভাবিক নিয়ম বা আক্বীদা-বিশ্বাস বানিয়ে নেওয়া যাবে না। যেমন কোনো কবরস্থ ব্যক্তির সাথে সরাসরি মুসাফাহা করার ঘটনা যদি ঘটে, তাহলে মনে করতে হবে এটি স্বাভাবিক নিয়মে নয় বরং কারামত হিসেবে ঘটেছে। তাই এখান থেকে এ আকীদা পোষণ করা যাবে না যে, কবরস্থ ব্যক্তি ইচ্ছা করলেই তার হাত কবর থেকে বের করতে পারে। তদ্রƒপ কারামতের মাধ্যমে কোনো ঘটনা ঘটলে আর এর রহস্য বুঝে না আসলে এ কারণে ওলীদেরকে দোষারোপও করা যাবে না।
মিথ্যা স্বপ্ন, জাদু ও ভেল্কিবাজী থেকে সতর্ক থাকতে হবে
উপরিউক্ত বিষয়গুলো সামনে রেখেই স্বপ্ন কাশফ ও কারামাতকে মূল্যায়ন করতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে যে, এক্ষেত্রে যেন মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি না হয়ে যায়। কারণ, এগুলোর মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির দ্বারা ও এর সঠিক মূল্যায়ন না করার কারণে নানারকম রসম-রেওয়াজ ও শিরক-বিদআতের জন্ম হয়ে থাকে। বিশেষ করে মিথ্যা স্বপ্ন ও মিথ্যা কারামত এবং জাদু ও ভেল্কিবাজীর মাধ্যমে সব বাতিলপন্থীরাই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে থাকে। (বিস্তারিত দেখুনÑ তাসাওউফ তত্ত¡ ও বিশ্লেষণ, মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক পৃ. ১৩৬-১৪৮, প্রকাশক, মাকতাবাতুল আশরাফ বাংলাবাজার, ঢাকা)
কারামত নিয়ে দুই ধরনের বিভ্রান্তি
কারামত নিয়ে আমাদের সমাজে দুই ধরনের প্রান্তিকতা লক্ষ্য করা যায়। একদিকে কেউ কেউ কারামত প্রকাশ পাওয়াটাকে ওলী তথা বান্দার কর্ম ধরে নেন। আর এভাবেই ওলীকেও অলৌকিক কর্ম সাধনকরার ক্ষমতায় বিশ্বাস করে শিরকে লিপ্ত হন। অনেকে এর দ্বারা ওলীরা ‘গায়েব জানেন’ এমন ভ্রান্ত বিশ্বাসেও নিপতিত হন। ফলশ্রæতিতে জীবিত ও মৃত ওলীদের কাছে এমন সব বিষয় কামনা করে থাকে যা দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন একমাত্র আল্লাহ তাআলা। অপরদিকে অন্য আরেক শ্রেণী কারামত সত্য হওয়াকেই অস্বীকার করে বসেন। কারামতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওলীগণকেও দোষারোপ করেন। তাঁদের আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে নানা রকম আপত্তি তোলেন। এমনকি কেউ কেউ তাদেরকে কাফের মুশরিক পর্যন্ত বলতেও দ্বিধাবোধ করেন না।
কারামত বিষয়ে এ উভয় শ্রেণীর কর্মপন্থাই প্রান্তিকতাপূর্ণ ও ভারসাম্যহীন। কারণ কারামত যেহেতু ঘটে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় তাঁরই কুদরতে, এখানে ওলী তথা বান্দার ক্ষমতার কোনো দখল নেই; তাই এটিকে ওলীর ক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্য মনে করা যেমন অন্যায়। তদ্রƒপ কারামতকে অস্বীকার করাটাও ন্যায়সঙ্গত নয়। কারণ কারামতকে ওলীর ক্ষমতার অধীন মনে করলে যেমন আল্লাহর ক্ষমতা ওলীকে প্রদান করার দোষ পাওয়া যায়, তেমনি কারামতকে অস্বীকার করলেও আল্লাহর কর্মকে অস্বীকার করার দোষ হয়। আর কারামতের কারণে আল্লাহর ওলীদের দোষারোপ করা, এবং তাদের আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে আপত্তি করা তো মহা অন্যায়। (বিস্তারিত দেখুন, যাল্যালা কা পোস্ট মরটেম, বেরলভী ফেতনা কা নায়া রূপ)
কাশফ-কারামত বিষয়ক উপরোক্ত কথাগুলো আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামাআর কাছে স্বীকৃত বিষয়। তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত দলিল প্রমাণের কোনো প্রয়োজন আপাতত নেই। আমার উপরিউক্ত কথাগুলোর সমর্থনে কেবল কাশফ ও কারামতের কারণে যারা আল্লাহ ওয়ালাদের উপর দোষারোপ করেন, তাদের উদ্দেশ্যে তাদেরই আস্থাভাজন কয়েকজন আলেমের উদ্ধৃতি এখানে পেশ করছি।
ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর বক্তব্য
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. কাশফ, ইলহাম ও কারামাতের উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, “নবী ব্যতিত অন্যদের থেকে যেসব অলৌকিক ঘটনা ঘটে তার মধ্যে কিছু আছে যেগুলো (আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে) কাশফ ও ইলম সংশ্লিষ্ট (অর্থাৎ অদৃশ্য বিষয়ক জ্ঞান সংশ্লিষ্ট), যেমন সারিয়ার ঘটনায় উমরের বক্তব্য, স্ত্রীর গর্ভস্থিত সন্তান মেয়ে হওয়ার বিষয়ে আবু বকরের অগ্রিম সংবাদ দেয়া, নিজ সন্তান ন্যায়পরায়ণ হওয়ার বিষয়ে উমরের অগ্রিম সংবাদ প্রদান, শিশুর ভবিষ্যত জীবন সম্পর্কে খাজির (আ.)-এর সংবাদ প্রদান করা। আর কিছু আছে অসাধারণ ক্ষমতা সংক্রান্ত। যেমন সুলাইমান আলাইহিস সালামের হুকুমে বিলক্বীসের সিংহাসন নিয়ে আসার ঘটনা, আসহাবে কাহফের ঘটনা, মারইয়াম আলাইহাস সালামের ঘটনা। তদ্রƒপ হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ, সাফীনা ও আবু মুসলিম খাওলানীর ঘটনাসহ আরো অনেক ঘটনা যা অনেক দীর্ঘ আলোচনার দাবি রাখে। কারণ এমন ঘটনা বৃষ্টির ফোটার ন্যায় অসংখ্য। এখানে শুধু উদাহরণ পেশ করাই ছিল উদ্দেশ্য।”
অতঃপর তিনি আরো বলেন, “অলৌকিক ঘটনা কাশ্ফের মাধ্যমে হোক বা অন্য কোনো প্রভাবে হোক, এর দ্বারা যদি দ্বীনের মধ্যে কাম্য কোনো উপকার পাওয়া যায়, তাহলে এটি নেক কাজের অন্তর্ভুক্ত ধরা হবে। দ্বীনের কাজটা ওয়াজিব হোক বা মুস্তাহাব। আর যদি দুনিয়ার কোন বৈধ উপকার পাওয়া যায় তাহলে এটি আল্লাহ তা‘আলার একটি দুনিয়াবী নিয়ামতরূপে গণ্য হবে, যার শুকরিয়া আদায় করা উচিত। কিন্তু যদি এর দ্বারা শরীয়তে নিষিদ্ধ কোনো কাজ করা হয় তাহলে তা আযাব ও গজবের কারণ হবে। যেমন বাল‘আমে বাঊরার ক্ষেত্রে হয়েছে। তবে যার দ্বারা এটি ঘটে কোনো কোনো সময় বিভিন্ন কারণে তিনি নির্দোষ সাব্যস্ত হন।...” Ñমাজমুউল ফাতাওয়া ১১/৩১৮
তিনি আরো বলেন, “... তবে কখনো কখনো আমাদের যামানার অনেকের কাছে কবরের অনেক কিছু প্রকাশ পেয়ে যায়। ঘুমন্ত বা জাগ্রত অবস্থায়ও তারা এ বিষয়ে অবগত হন এবং নিশ্চিত হয়ে যান। এমন অনেক বিষয় আমাদের কাছে রয়েছে। ... এ সকল বিষয় যদি নবুওতের শিক্ষার অনুকূলে হয় তাহলে তা সত্য। আর যদি এর বিরোধী হয় তাহলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে। এজন্য জ্ঞানীরা দ্বীনের মাসআলার ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমার উপরই আমল করেন...।” Ñমাজমুউল ফাতাওয়া ২৪/৩৭৬
তিনি আরো বলেন, “অনেকের কাছেই কবরের বিভিন্ন বিষয় প্রকাশ পেয়েছে, এমনকি তারা কবরে শাস্তিতে নিপতিত ব্যক্তিদের আওয়াজও শুনতে পেয়েছেন। স্বচক্ষে তাদের কবরের শাস্তি প্রত্যক্ষ করেছেন, যা বিভিন্ন প্রসিদ্ধ বর্ণনায় পাওয়া যায়।” Ñমাজমুউল ফাতাওয়া ৪/২৯৬, আরো দেখুন, মাজমুউল ফাতাওয়া ১১/৩১৩, ১১/৩৭৯, ১১/৩৩৮
ইবনুল কায়্যিম রাহ.-এর বক্তব্য
ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন, “জীবিত ও মৃতের রূহের পরষ্পর সাক্ষাতের একটি আলামত হল, জীবিত ব্যক্তি মৃত ব্যক্তিকে স্বপ্নে দেখতে পেয়ে বিভিন্ন সংবাদ জিজ্ঞেস করে, আর মৃত ব্যক্তি তাকে এমন বিষয় বলে, যা পূর্বে জীবিত ব্যক্তির জানা ছিল না। অতপর জীবিত ব্যক্তি স্বপ্ন থেকে জেগে অতীত ও ভবিষ্যত সংক্রান্ত বিষয়ের সংবাদটি হুবহু সঠিক পেয়ে যায়। কখনো মৃত ব্যক্তি মাটির নিচে প্রোথিত সম্পদের সন্ধানের কথা (স্বপ্নে জীবিত ব্যক্তিকে) বলে, যা সে ছাড়া কেউ জানত না, কখনো তার ঋণ সম্পর্কে অবহিত করে এবং এর প্রমাণাদিও বলে দেয়। এরচে আশ্চর্য হল, মৃত ব্যক্তি তার এমন কাজের কথা বলে, যা বিশ্ববাসীর কেউ জানে না। আরো অবাক করার বিষয়, মৃত ব্যক্তি জীবিতকে বলে তুমি আমাদের কাছে আসবে (অর্থাৎ মৃত্যুবরণ করবে), পরে তাই বাস্তব হয়। কখনো মৃতব্যক্তি এমন বিষয়ের সংবাদ দেয়, যে বিষয়ে জীবিত ব্যক্তি নিশ্চিত যে এটি আর কেউ জানত না। পূর্বে হযরত ছা‘ব ইবনে জাস্সামা ও আওফ ইবনে মালেকের ঘটনা এবং সাবেত ইবনে কায়স ইবনে শাম্মাসের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে।” Ñকিতাবুর রূহ পৃ.২১, (বাংলা) পৃ. ২৬
কখনো কখনো কারো বেলায় এ ধরনের ঘটনা প্রকাশ পাওয়া একটি বাস্তবতা। প্রমাণিত হলে এ ধরনের ঘটনা অস্বীকার করা উচিত নয়। এবং এগুলো থেকে গলত আকীদা বের করারও অবকাশ নেই। যেমন, মৃত ব্যক্তি গায়েব জানে বা মৃত ব্যক্তি কারো উপকার করার ক্ষমতা রাখেÑ এ ধরনের চিন্তার কোনো সুযোগ নেই। প্রকৃতপক্ষে মানুষ যা দেখে, তাতে না তার নিজের কোনো দখল থাকে, আর না যাকে সে দেখেছে তার কোনো প্রভাব। এতো সরাসরি আল্লাহর কুদরতের মুআমালা।
শায়খ আলবানী রাহ.-এর বক্তব্য
শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী রাহ. বলেন, “হযরত উমর রা. কর্তৃক খুৎবারত অবস্থায় সারিয়াকে পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়ার কথা বলা, যখন সারিয়া তাঁর থেকে বহু দূরে ছিলেন, বিষয়টি ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘ইলহাম’।” অতপর বলেন, “যদি তাকে কাশ্ফ নাম দেওয়া সহীহ হয় তবুও এটি হল একটি অলৌকিক ঘটনা। এমন অলৌকিক ঘটনা অমুসলিম থেকেও প্রকাশ পায়। তাই উলামায়ে কেরাম বলেন, এমন অলৌকিক ঘটনা যদি মুসলমান থেকে সংঘটিত হয় তবেই তাকে কারামত বলে। নয়তো এর নাম হল ‘ইসতিদরাজ’।” সবশেষে বলেন, “সুতরাং উমর রা.-এর ঘটনাটি সত্য ও প্রমাণিত। আর এটি ছিল উমর রা.-এর কারামত, এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা তাঁকে সম্মানিত করেছেন। এর দ্বারা তিনি মুসলিম বাহিনীকে বন্দী হওয়া বা নিহত হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন। এতে গায়রুল্লাহর গায়ব জানতে পারার কোনো বিষয় নেই যা তথাকথিত সূফীরা মনে করে থাকে।” Ñসিলসিলাতুস সহীহা, হাদীস ১১১০
আরো দেখুন, আল-আকীদাতিল ওয়াসিতিয়্যাহ, ইবনে তাইমিয়্যাহ পৃ. ১৩ এবং মুহাম্মদ বিন সালিহ আল-উসাইমিন রচিত শারহুল আক্বীদাতিল ওয়াসিতিয়্যাহ পৃ. ৪৯০ (দারু ইবনিল জাওযী) ও শরহুল আকীদাতিস্ সাফারীনিয়্যাহ, পৃ. ৬৪০
উলামায়ে দেওবন্দের ঘটনাগুলো আকীদা নয়, অলৌকিক
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল উলামায়ে দেওবন্দের আকীদা-বিশ্বাস প্রমাণের জন্য যেসকল ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয় তাতে তাঁদের আকীদা প্রমাণ হয় না। কারণ,
এক. দেওবন্দ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে নবীজীকে দেওবন্দে আসতে দেখার ঘটনাটি ছিল স্বপ্ন। আর পরবর্তীতে নির্দিষ্ট স্থানে লাঠির দাগ পাওয়া যাওয়াটা ছিল কারামত। দেওবন্দীগণ কখনোই এ বিশ্বাস রাখে না যে, নবীজী স্বশরীরে দেওবন্দে এসেছেন এবং লাঠি দিয়ে দাগ দিয়েছেন, বা নবীজী কবর থেকে যথা ইচ্ছা যাওয়া আসা করতে পারেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর-জীবন সম্পর্কে উলামায়ে দেওবন্দের আকীদ সুস্পষ্ট।
দুই. হযরত মাদানী রাহ.-এর রওজা শরীফ থেকে সালামের জবাব শুনতে পাওয়া ও নবীজিকে দেখতে পাওয়া উভয়টিই কারামত সংশ্লিষ্ট তথা অলৌকিক ঘটনা। এ ধরনের অসংখ্য কারামত প্রমাণিত থাকার কথা ইবনে তাইমিয়া রাহ.ও বলেছেন। এ ঘটনা উল্লেখ করলে বা বললে যদি আকীদা নষ্ট হয়ে যায় তাহলে ইবনে তাইমিয়ার রাহ.-এর আকীদার কী হবে?
তিন. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আহমদ রিফাইর মুসাফাহা করার ঘটনাটিও ছিল একটি কারামত। কেউ যদি নিশ্চিতভাবে একথা প্রমাণ করতে পারেন যে, আহমদ রিফাইর নামে যে ঘটনা প্রচলিত তা বাতিল ও অবাস্তব তাহলে তা বর্ণনা করা যেত না। কিন্তু আমাদের জানামতে এমন কিছু প্রমাণিত হয়নি। মনে রাখতে হবে, এটি হাদীস নয়, বরং একটা ঘটনামাত্র যা ঘটা অসম্ভব কিছু নয়। তাই এটি যাচাই করার জন্য হাদীস যাচাইয়ের মানদন্ড দিয়ে পরখ করার কোনো প্রয়োজন নেই। কোনো কোনো ঐতিহাসিক ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। ‘মুত্তাসিল সনদ’ না থাকার কারণে যদি কেউ এ ঘটনা অস্বীকার করে, তাহলে এটা তার ব্যক্তিগত রায়। আমরা তার কোনো প্রতিবাদ করতে যাব না। কিন্তু যেহেতু শরীয়তে এ ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে কোনো দলীল নেই, তাই কেউ কারামতের দৃষ্টান্ত দিতে এটিকে শুধু একটি ঘটনা হিসাবে উল্লেখ করলে তার উপর নিন্দাবাদ নিক্ষেপেরও কোনো সুযোগ নেই। আসল কথা হল, এ ধরনের ঘটনা থেকে কোনো গলত আকীদা বা গলত মাসআলা বের করা থেকে বিরত থাকা জরুরি।
এ প্রসঙ্গে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন, “এ বিষয়ের মধ্যে এ ধরনের বর্ণনাগুলো অন্তর্ভুক্ত হবে না যেমন, অনেক নেককার লোক নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর থেকে বা অন্য কোনো সালিহীনদের কবর থেকে সালামের জবাব শুনতে পেয়েছেন। মদীনায় র্হারার ঘটনার সময়কালে সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব রাহ. নবীর কবর থেকে আযান শুনতে পেয়েছেন ইত্যাদি। বরং এ সবই সত্য ঘটনা। তবে তা আমাদের এখানের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়। এ বিষয়গুলো এর উর্ধ্বের। অনুরূপ অনাবৃষ্টির কারণে এক ব্যক্তি নবীজীর কবরে এসে অনাবৃষ্টির কথা জানিয়েছিল। সে দেখতে পেল নবী তাঁকে খলীফা উমরের কাছে যেতে আদেশ করেছেন। এবং তাঁকে একথা বলতে বলেছেন যে, তিনি যেন মানুষদের নিয়ে ‘ইসতিসকার’ মাধ্যমে বৃষ্টির জন্য দু‘আ করেন। এ ঘটনা আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং এমন ঘটনা নবী ছাড়া অন্যদের বেলায়ও অনেক ঘটে থাকে। এমন অনেক ঘটনা আমি জানি। অনুরূপ কোনো ব্যক্তি নবীকে বা তাঁর উম্মতের অন্য কারো কাছে তার কোনো প্রয়োজনের কথা বলেছে, অতপর তার প্রয়োজন পূরণ হয়ে গেছে এমন বিষয়ও অনেক ঘটেছে। এটিও আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। ... বরং এমন কিছু যদি ঘটে যায় (অর্থাৎ কোনো প্রয়োজন পুরণ হয়ে গেল) তাহলে তা হবে কবরবাসীর কারামাত। কবরের কাছে সুওয়ালকারীর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব এতে প্রমাণিত হয় না। ...তদ্রƒপ নবী ও আওলিয়ায়ে কেরামের কবরে যত কারামাত ও অলৌকিক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় যেমন, ...ওগুলোও আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। এ সমস্ত বিষয় কবরের কাছে নামায পড়া বা কবরের কাছে দুআ করা মুস্তাহাব হওয়ার দাবি রাখে না।” Ñইকতিযাউস্ ছিরাতিল মুসতাকীম, দারুল হাদীস, কায়রো পৃ. ৩৩৮ (৩)
ইনসাফ করুন, বাড়াবাড়ি বর্জন করুন
কারামত বিশ্বাস করা কোনো দোষণীয় বিষয় নয়। এটা আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামাআর সর্বসম্মত আকীদা। কিন্তু অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণে অনেকেই এ সত্যটি উপলব্ধি করতে অক্ষম হয়ে যান। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একটি দারুল ইফতায় শায়খ জাকারিয়া রাহ. রচিত ফাজায়েলে আমল গ্রন্থে উল্লিখিত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মুসাফাহা করা সংক্রান্ত আহমদ রিফাইর ঘটনাটি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তারা উত্তরে লেখেন, ঘটনাটি ভিত্তিহীন। যে বইয়ে এ ধরনের ঘটনা আছে তা পড়া জায়েয নেই। যে ইমাম এ ধরনের ঘটনা বিশ্বাস করে তার পিছনে নামায পড়া যাবে না ইত্যাদি। তদ্রƒপ অনেকে ফাজায়েলে হজ্ব ও ফাজায়েলে সাদাকাত গ্রন্থ থেকে কিছু অলৌকিক ঘটনা উল্লেখ করে তাকে আকীদা বানিয়ে পুরো উলামায়ে দেওবন্দকে দোষী সাব্যস্ত করতে চেষ্টা করেন। ঘটনাগুলো থেকে এমনসব আকীদা-বিশ্বাস বের করে নিয়ে আসেন যেগুলো ভ্রান্ত হওয়ার বিষয়ে সমস্ত আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ একমত এবং উলামায়ে দেওবন্দও স্পষ্টভাবেই এর সাথে একমত। কিন্তু তারা সুস্পষ্ট বক্তব্য না দেখে বর্ণিত অলৌকিক ঘটনাকে আকীদা বানিয়ে উলামায়ে দেওবন্দের উপর চাপিয়ে দেন।
আলোচ্য দারুল ইফতার ফতোয়ার কথাই ধরুন, তাতে আহমদ রেফাইর ঘটনাটি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত কি না এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। যদি তা ইতিহাস হিসেবে প্রমাণিত হয় তাহলে এটি কারামত হিসেবে বিশ্বাস করতে দোষের কী আছে? এমন অলৌকিক ঘটনা ঘটা অসম্ভবÑ এমন কোনো শরয়ী দলিল কি আছে কোথাও? ‘হযরত উমর রা. মসজিদে নববী থেকে বসে এক মাসের পথের দূরত্বে যুদ্ধরত সারিয়ার বাহিনীর অবস্থা জানলেন, সারিয়াকে ডাক দিলেন এবং তাঁরাও তাঁর ডাক শুনতে পেয়ে কথা মত আমল করে উপকার পেলেন’। বর্ণনাটিকে সমস্ত মুহাদ্দিস সহীহ বলেছেন এবং তাদের কিতাবেও উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে ইবনু তাইমিয়া ও শায়খ আলবানী সাহেবও রয়েছেন। এ ঘটনা বিশ্বাস ও বর্ণনা করাতে কি উমর রা.-কে আলিমুল গায়ব সাব্যস্ত করা হয়ে যায়? তাঁকে কি অদৃশ্যের জ্ঞানী বা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বিশ্বাস করা হয়ে যায়? যারা এত দূর থেকে তার কথা শুনতে পেরেছেন, তাদেরকে আলিমুল গায়েব মানা হয়ে গেলো? আহমদ রিফাইর ঘটনা বর্ণনা করলে আর বিশ্বাস করলে যদি সে বই পড়া ও সে ইমামের পিছনে নামায আদায় করা না-জায়েয হয়ে যায়, তাহলে হযরত উমরের ঘটনা যারা যারা উল্লেখ করেছেন তাদেরকে ঐ মুফতী সাহেবগণ কী বলবেন!
মূলত কারামত সম্পর্কে আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আকীদার উপর মজবুত থেকে এ ধরনের ঘটনাবলী উল্লেখ করা ও বর্ণনা করাতে শরীয়তে কোনো নিষেধ নেই। কেননা এ ধরনের ঘটনা বিশ্বাস ও বর্ণনা করলেই যদি কাউকে পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত বলতে হয়, তাহলে এ বিভ্রান্তি থেকে কেউ বাদ পড়বে বলে মনে হয় না। যারা উলামায়ে দেওবন্দের বই থেকে এ ধরনের ঘটনা খুঁজে খুঁজে বের করে তাদেরকে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট সাব্যস্ত করেন, তাদের প্রতি আমার একটা বিনীত অনুরোধ রয়েছে। আপনারা ইনছাফ করুন। উলামায়ে দেওবন্দের পূর্বেই যারা শত শত বছর ধরে এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করে রেখেছেন, যাদের কিতাব-পত্র বিশ্বব্যাপী প্রচারিত তাদের ব্যাপারে আপনারা যে ধারণা পোষণ করেন, দেওবন্দীদের উপরও কি সে ধারণা পোষণ করা যায় না? তা না হলে তো ইমাম ইবনু আবিদ-দুন্য়া, হিবাতুল্লাহ লালিকায়ী, ইবনে তাইমিয়া, ইবনুল কায়্যিম, আল্লামা সামহুদী, শায়খ ছালেহ ফাওযান, শায়খ উসাইমিনসহ অসংখ্য ইমাম, মুহাদ্দিস, ফকীহ ও ঐতিহাসিক সকলকে গোমরাহ বলতে হবে। কারণ সকলের কিতাবেই এ ধরনের ঘটনা পাওয়া যায়, যা স্বপ্ন, কাশফ-ইলহাম ও কারামাত সংশ্লিষ্ট। (দেখুন, মান ‘আশা বা‘দাল মাওত, ইবনু আবিদ্দুন্য়া; শরহু উসূলি এ’তেকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামাআহ লিল-লালিকায়ী, মাজমুউল ফাতাওয়া ও আল-আকীদাতুল ওয়াসিতিয়্যাহ, ইবনে তাইমিয়া পৃ.১৩; কিতাবুর রূহ, ইবনুল কায়্যিম; ওয়াফাউল ওয়াফা বি আখাবারি দারিল মুছতাফা, সামহুদী; জামিউদ্ দুরূস ফি শারহিল আকীদাতিল ওয়াসিতিয়্যাহ, দারু ইবনে হাযম থেকে প্রকাশিত (পৃ. ৮১০-৮১১), শারহুল আকীদাতিল ওয়াসিতিয়্যাহ (পৃ. ৪৯০) ও শরহুল আকীদাতিস-সাফারাইনিয়্যাহ (পৃ. ৬৪০), শায়খ উসাইমীন) বিশেষ করে ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর শিষ্য ইবনুল কায়্যিম রাহ.-এর কিতাবুর রূহে এ ধরনের ঘটনা ভরপুর যা তিনি বর্ণনাও করেছেন এবং সত্যায়িতও করেছেন। (দেখুন, কিতাবুর রূহ পৃ. ৮, ১৪-১৫, ১০৩, ১৮৮)
১. তাবলীগ জামাত ও দেওবন্দীগণ পৃ. ১০২-১০৫
২. হাদীসটির মারাত্মক ও হাস্যকর ভুল তরজমা করা হয়েছেÑ তাবলীগ জামাত ও দেওবন্দীগণ বইয়ে পৃ. ৯১। এর সঠিক তরজমা দেখুন পূর্বোক্ত (প্রথম কিস্তির) সাত নম্বর হাদীসের আলোচনায়।
৩. ولا يدخل في هذا الباب : ما يروى من أن قوما سمعوا رد السلام من قبر النبي صلى الله عليه وسلم ، أو قبور غيره من الصالحين . وأن سعيد بن المسيب كان يسمع الأذان من القبر ليالي الحرة . ونحو ذلك . فهذا كله حق ليس مما نحن فيه ، والأمر أجل من ذلك وأعظم .وكذلك أيضا ما يروى : " أن رجلا جاء إلى قبر النبي صلى الله عليه وسلم ، فشكا إليه الجدب عام الرمادة فرآه وهو يأمره أن يأتي عمر، فيأمره أن يخرج يستسقي بالناس " فإن هذا ليس من هذا الباب . ومثل هذا يقع كثيرا لمن هو دون النبي صلى الله عليه وسلم ، وأعرف من هذا وقائع . وكذلك سؤال بعضهم للنبي صلى الله عليه وسلم، أو لغيره من أمته حاجة فتقضى له ، فإن هذا قد وقع كثيرا، وليس هو مما نحن فيه ... فهذا القدر (১) إذا وقع يكون كرامة لصاحب القبر ، أما أن يدل على حسن حال السائل، فلا فرق بين هذا وهذا . فإن الخلق لم ينهوا عن الصلاة عند القبور، واتخاذها مساجد استهانة بأهلها، بل لما يخاف عليهم من الفتنة، وإنما تكون الفتنة إذا انعقد سببها، فلولا أنه قد يحصل عند القبور ما يخاف الافتتان به لما نهي الناس عن ذلك.
وكذلك ما يذكر من الكرامات، وخوارق العادات، التي توجد عند قبور الأنبياء والصالحين مثل نزول الأنوار والملائكة عندها وتوقي الشياطين والبهائم لها، واندفاع النار عنها وعمن جاورها، وشفاعة بعضهم في جيرانه من الموتى، واستحباب الاندفان عند بعضهم، وحصول الأنس والسكينة عندها، ونزول العذاب بمن استهانها- فجنس هذا حق، ليس مما نحن فيه .
وما في قبور الأنبياء والصالحين، من كرامة الله ورحمته، وما لها عند الله من الحرمة والكرامة فوق ما يتوهمه أكثر الخلق، لكن ليس هذا موضع تفصيل ذلك. وكل هذا لا يقتضي استحباب الصلاة، أو قصد الدعاء أو النسك عندها، لما في قصد العبادات عندها من المفاسد التي علمها الشارع كما تقدم. فذكرت هذه الأمور لأنها مما يتوهم معارضته لما قدمناه، وليس كذلك.