কিতাবুল ফিতানের পাঠকদের সমীপে
কিতাবুল ফিতান অর্থ ফিতনার আলোচনা বিষয়ক গ্রন্থ। এখানে সুনির্দিষ্ট কোনো গ্রন্থ উদ্দেশ্য নয়; বরং বাংলা ভাষায় এ যাবৎ প্রকাশিত যেকোনো গ্রন্থ উদ্দেশ্য। কয়েক বছর ধরে ফিতান বিষয়ে পাঠকদের বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তাই প্রকাশকরাও এ বিষয়ে বিভিন্ন বই প্রকাশ করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত কিতাবুল ফিতানগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন তুলে ধরা সংগত মনে হচ্ছে। আর বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলাও প্রয়োজন।
১. ফিতান বিষয়ক অধিকাংশ হাদিসই অশুদ্ধ, অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রমাণিত। অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় এ বিষয়ে জাল, ভিত্তিহীন ও দুর্বল হাদিসের সংখ্যা অনেক বেশি।
২. ফিতান বিষয়ক হাদিসগুলোকে আমরা দু-ভাগে ভাগ করতে পারি : (ক) যা অতীতে সংঘটিত হয়েছে। (খ) যা বর্তমান বা ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কিত। অতীত ফিতনার সঙ্গে ইতিহাসের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ইতিহাসের বর্ণনাগুলোর মধ্যেও শুদ্ধ এবং অশুদ্ধ দুই ভাগ রয়েছে। হাদিসের তাহকিকের তুলনায় ইতিহাসের বর্ণনার তাহকিক কঠিনই বটে। ইতিহাসের বিশুদ্ধ বর্ণনার আলোকেই কেবল অতীত ফিতনাগুলোর আলোচনা বোঝা সম্ভব। অন্যথায় হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণেই দেখা যায়, অনেক মানুষ ফিতনার হাদিস প্রয়োগ করতে গিয়ে আকিদাই নষ্ট করে ফেলে। সাহাবি মুয়াবিয়া রা. থেকে শুরু করে মুশাজারাতে সাহাবার ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহর মানহাজবিরোধী আচরণ করে। দলিল হিসেবে ফিতনার কিছু হাদিস সামনে আনে। আমাদের মনে পড়ে, সহিহ বুখারির 'ফিয়াতে বাগিয়া'র হাদিসের আলোকে এক প্রবীণ কওমি আলিম দারসে ছাত্রদের সামনে মুয়াবিয়া রা.-এর শানে চরম গোস্তাখিমূলক আচরণ করেছিল।
আর বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোর সাথে আকিদাও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ কারণে আকিদার কিতাবে ফিতনার আলোচনা থাকে। আমরা জানি, আকিদা সাব্যস্ত হওয়ার জন্য যেনতেন বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। দুর্বল হাদিস শর্তসাপেক্ষে ফাজায়িলের ক্ষেত্রে চলনসই হলেও এগুলোর দ্বারা কখনোই আকিদা প্রমাণিত হয় না। আকিদা সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এমন দলিলের প্রয়োজন হয়, যা সাব্যস্ত হওয়ার দিক থেকেও অকাট্য, অর্থ নির্দেশের ক্ষেত্রেও অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন। যেসব ভাই ইমাম মাহমুদ, হাবিবুল্লাহ সাহিবে কিরান, কাহতানি খলিফা ইত্যাদির আলোচনা দ্বারা অনলাইন জগত পুরো কাঁপিয়ে রাখছে; তাদেরকে বলুন তো, পারলে তারা মাত্র একটা দলিল পেশ করুক, যা উপরিউক্ত মানদণ্ডে উত্তীর্ণ। সমস্যা হলো, উসুল সম্পর্কে বিলকুল অজ্ঞ হওয়ায় তারা কোনটা অকাট্য আর কোনটা অকাট্য নয়, এর আগামাথা কিছুই বোঝে না।
৩. ফিতান বিষয়ক অধিকাংশ হাদিসই যেহেতু অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রমাণিত, তাই এক্ষেত্রে হাদিসের যথার্থ তাহকিক সামনে আসা সবচে বেশি প্রয়োজন। যেমন একটা উদাহরণ দিই। নুয়াইম বিন হাম্মাদের কিতাবুল ফিতান বেশ প্রসিদ্ধ; বরং বলা যায়, এই অঞ্চলে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। কিন্তু এ গ্রন্থের অধিকাংশ হাদিসই শাস্ত্রীয় নীতি অনুসারে গ্রহণীয় নয়। কিন্তু এ গ্রন্থের প্রতিই পাঠকের আগ্রহ দেখবেন সবচে বেশি। ইদানীং এর তাহকিককৃত সংস্করণ প্রকাশ করা হয়েছে। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, এমন ব্যক্তিদের হাতে এর তাহকিক হয়েছে, যারা হাদিসশাস্ত্রের কোনো ব্যক্তিত্ব নয়। আমার নিজের কথাই বলি। হাদিসশাস্ত্র সম্পর্কে আমি নিতান্ত অজ্ঞ। আমি যদি কোনো বইয়ের হাদিসসমূহের তাহকিক করতে বসি, তাহলে তা কখনোই যথাযথ হবে না। বইটার প্রথম খণ্ড আমি পড়েছি। মুনির ভাই এর অনেক তাহকিকই নিয়েছেন মূল বইয়ের টীকা থেকে। যার কারণে মূল বইয়ের টীকায় তাহকিক যেসব ভুল ছিল, তার অনেকগুলোই হুবহু উঠে এসেছে অনূদিত বইয়ের টীকায়। মুনির ভাই বা মানজুর ভাই, তাদের যোগ্যতা আপন জায়গায় স্বীকার্য। কিন্তু তারা যদি হাদিসশাস্ত্রের তাহকিক উপস্থাপন করেন, তাহলে এর ওপর আস্থা ও নির্ভরতা রাখার কোনো যুক্তি নেই। পুরো হিন্দুস্তানে শাইখুল হাদিস হিসেবে একবাক্যে স্বীকৃত জাকারিয়া কান্ধলবি রহ.-এর ফাজায়িলে আমাল তো আমাদের চোখের সামনেই আছে। ইবনে খালদুনের মতো এত বড় ব্যক্তিত্ব মাহদি বিষয়ক সব হাদিসকেই অসহিহ বলেছিলেন। গাজালি তার জীবনে যত হাদিস উল্লেখ করেছেন, তার বড় অংশই ছিল অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রমাণিত। উল্লেখিত ভাইয়েরা হাদিসগুলোর মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ যেটা করতে পারবেন, তা হলো বিভিন্ন টীকা থেকে বা অনলাইন থেকে কপিপেস্ট। কিন্তু এটাকে কখনোই হাদিসের তাহকিক বলা যায় না। অন্যথায় শায়খ গুগলকেই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাক্কিক বলতে হতো।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, তাদের তাহকিকের ধরন ছিল, মারফু/মাওকুফ/মাকতু; সহিহ/হাসান/জয়িফ etc। এখন মনে করেন, একটা হাদিসের টীকায় আপনি দেখলেন, সহিহ মাওকুফ, এখন আপনার কী করণীয়? অথবা দেখলেন, হাসান মারফু, এবার এই হাদিসের আলোকে আপনি কী সিদ্ধান্ত নেবেন? কখনো দেখলেন, স্ববিরোধী দুটো কথার উভয়টি মারফু কিংবা উভয়টি সহিহ বা হাসান, এখন আপনি কী পদক্ষেপ নেবেন? স্ববিরোধী বক্তব্যের মধ্যে সমন্বয়ই বা কীভাবে করবেন? মাহদির পরে জাহজাহ আসবে, কাহতানি আসবে, মানসুর আসবে, মাখজুমি আসবে, মুকআদ আসবে; এরকম আরও কয়েকটা নাম পড়লেন। এরপর কী সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন? সমন্বয়ই বা কীভাবে দেবেন? অনেক কষ্ট করে বৃহৎ একটা বই এভাবে আদ্যোপান্ত পড়ে ফেললেন। এখন আপনাকে কি ফিতান সম্পর্কে জ্ঞানী বলা যাবে? নাকি আপনি শুধুই পড়েছেন, আগামাথা কিছুই বোঝেননি? ফিতানের গ্রন্থগুলো যারা পড়ে শেষ করেছে, তাদের কারও রিভিউ পড়েই মনে হয়নি, এই শাস্ত্র সম্পর্কে তারা প্রাথমিক জ্ঞানও অর্জন করতে পেরেছে।
আর অনেক বইয়ে তো হাদিসের তাহকিকেরই ধার ধারা হয় না। সব ধরনের হাদিস থেকেই আকিদা ও ফিকহ উদঘাটন করা হয়। মাওলানা আসিম উমর বা মুফতি আবু লুবাবা শাহ মানসুর হাফি.-এর ফিতান বিষয়ক আলোচনায় এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। প্রায়শই তারা এমনসব হাদিসের আলোকে সমীকরণ টানেন, যা এক্ষেত্রে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু পাঠক তো আর তা জানছে না। ওহির মতো করে অবলীলায় সব গিলে যাচ্ছে। এমন এমন আকিদা পোষণ করতে শুরু করছে, যা একেবারেই ভিত্তিহীন।
৪. ফিতানের ক্ষেত্রে শুধু হাদিসের তাহকিকই যথেষ্ট নয়; বরং এরচেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো, হাদিসের সঠিক তত্ত্ব ও মর্ম বের করতে পারা। এ যুগে ফিতান বিষয়ে যেসব প্রসিদ্ধমুখ আলোচনা করেন, এই জায়গায় এসে তাদের অধিকাংশের পদস্খলন ঘটে। কোনো একটা হাদিসকে সহিহ বলার অর্থ কিন্তু এ নয় যে, প্রামাণিকতার বিচারে তা অকাট্য। কারণ, সহিহ হলো 'খবরে ওয়াহিদ'র প্রকার। আর 'খবরে ওয়াহিদ' জন্নি। অর্থাৎ এর দ্বারা প্রবল ধারণা তৈরি হয়; এটা সুনিশ্চিত বা অকাট্য নয়। অকাট্য হওয়ার অর্থ হলো মুতাওয়াতির বা মাশহুর হওয়া। এছাড়াও কোনো হাদিস সহিহই শুধু নয়, মাশহুর হলেও তার অর্থ ও মর্ম যে অকাট্য হবে, এটা জরুরি নয়। কুরআনের সব আয়াতই তো প্রামাণিকতার বিচারে অকাট্য। কিন্তু এর সবগুলোর অর্থ অকাট্য নয়। তাই বিভিন্ন আয়াতের অর্থ নিয়ে ইখতিলাফও হয়েছে। যেমন, তালাকপ্রাপ্তা নারী তিন 'কুরু' ইদ্দত পালন করবে। এখন এই 'কুরু'র অর্থ কী? হানাফিদের মতে ঋতুস্রাব, আর শাফিয়িদের মতে পবিত্রতা। আয়াত একটাই; কিন্তু এর ব্যাখ্যায় পুরোই বিপরীত দুই মত। একইভাবে সুরা কাউসারের দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, 'তোমার রবের জন্য নামাজ পড়ো এবং উট নহর করো'। এই আয়াতের তাফসির অনেকেই করেছেন, এখানে কুরবানি করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কুরবানির বিষয়টি যেহেতু আয়াতের অকাট্য বক্তব্য নয়, বরং একটা তাফসির মাত্র, তাই কুরবানিকে ফরজ বলা হয়নি। অন্যথায় কুরআনের স্পষ্ট আদেশ হলে তা ফরজই বলা হতো।
আপনি কিতাবুল ফিতান পড়ে, ৩০০ সহিহ হাদিস জানলেন। দেখা যাবে, এর বড় একটা অংশই অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে অকাট্য নয়। কিন্তু আপনি তো আর এ বিষয়ে কিছু জানেন না। তাই আপনি নিজের বিবেক দ্বারা যে অর্থ বুঝলেন, সেটাকেই ধরে নিলেন হাদিসের অকাট্য বাণী। এখন কেউ যদি আপনার এই বুঝের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে, আপনি তাকে বানিয়ে দিলেন হাদিসবিরোধী। নামাজের একটা হাদিস দ্বারা এর জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। কিয়ামুল লাইলের রাকাতসংখ্যা বিষয়ক আয়িশা রা.-এর হাদিস থেকে একদল বুঝেছে তারাবিহ ৮ রাকাআত। এখন তাদের সঙ্গে কেউ দ্বিমত করলেই তাকে বানিয়ে দিচ্ছে সহিহ হাদিসবিরোধী। অথচ সহিহ কোনটা ছিল? হাদিসের প্রামাণিকতা তো সহিহ; কিন্তু তা থেকে এই ভাইয়েরা যে অর্থ বুঝল, তা কি অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন? উপরন্তু যারা তাদের সঙ্গে দ্বিমত করছে, তাদের দলিল হলো তাআমুল ও তাওয়ারুস, যা মুতাওয়াতিরের প্রকার। তো একদিকে মুতাওয়াতির; আরেকদিকে সহিহ, যা কিনা খবরে ওয়াহিদের প্রকার। মুতাওয়াতির অকাট্য আর খবরে ওয়াহিদ প্রবল ধারণানির্ভর। দুটোর মধ্যে সংঘর্ষ হলে শক্তির বিচারে মুতাওয়াতিরই এগিয়ে থাকে। আর এই সংঘর্ষও তখন হবে, যখন সহিহ হাদিসের ভাষ্য অকাট্য হবে। যেখানে হাদিসের অর্থই মুহাদ্দিসগণ বুঝেছেন কিয়ামুল লাইলের রাকাতসংখ্যা; কিয়ামু রামাজান বা তারাবিহের রাকাতসংখ্যা নয়, সেখানে মুতাওয়াতির আর খবরে ওয়াহিদের মধ্যে কোনো সংঘর্ষই নেই। বেচারা নিজের ভুল বুঝের দায় চাপাচ্ছে হাদিসের ওপর, বিষয়টা এ ছাড়া আর কিছু নয়। যাহোক, এগুলো তো উসুল। কিন্তু আজকালকার হাইব্রিড জ্ঞানীদের উসুল দেখার সময় কোথায়!
বলছিলাম, ফিতান বিষয়ে হাদিস সহিহ হলেই তো কাজ শেষ নয়। বরং হাদিসের সহিহ অর্থ ও মর্ম সামনে না আসলে অনেক সময় ঝুঁকি বেড়ে যায়। যেহেতু বিষয়টা আকিদা রিলেটেড, তাই এক্ষেত্রে বিচ্যুতি ঘটার অর্থ হলো আকিদার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির শিকার হওয়া। এই এক ফিতানের পেছনে পড়ে কত মানুষ উন্মাদনার শিকার হয়েছে। ড. কাজি ইবরাহিম যার জলজ্যান্ত নমুনা। যুগে যুগে এ ধরনের অসংখ্য মানুষ বিগত হয়েছে, যারা ফিতানের হাদিসগুলো বুঝতে গিয়ে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে। প্রকাশকরা কিতাবুল ফিতানগুলো ছাপতে গিয়ে সর্বোচ্চ যা করতে পারবেন, তা হলো হাদিসের সহিহ তাহকিক জুড়ে দেওয়া। কিন্তু এই তাহকিক সামনে আসার দ্বারাই যে সব হয়ে গেছে, বিষয়টা এমন নয়; বরং আদতে কিছুই হয়নি। যা হয়েছে তা হলো, আপনার আকিদার ঝুঁকি বেড়েছে। এখন হতে পারে, আপনি তেমন কিছুই বুঝবেন না অথবা হতে পারে, আপনি বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয়ে যাবেন। বড় বড় মুহাক্কিকরাও প্রায়শই ফিতানের হাদিসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভুল করে ফেলেন; সেখানে আমি আর আপনি তো নস্যি। আবার তাদের সব ব্যাখ্যাও যে সব পাঠক গ্রহণ করে, বিষয়টা এমনও নয়। ইমাম ইবনু কাসির তার ফিতানে হিন্দের গাজওয়ার ব্যাপারে লিখেছেন, তা সংঘটিত হয়ে গেছে। আপনি কি তার সাথে এ ব্যাপারে একমত হবেন? এ কারণে কিতাবুল ফিতান থেকে শুধু হাদিসের পাঠ গ্রহণ করার ফলাফল সবক্ষেত্রে সবার জন্য ইতিবাচক হয় না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন