মজলুম অবস্থায় সাবাঈদের হাতে উসমান রা. এর শাহাদাত
আবু বকর(রা) ও উমর(রা) এর সময়ে ইসলামের শত্রুরা গা ঢাকা দিয়ে থাকে। সাহাবী হুযাইফা(রা)-যাকে রাসূল(ﷺ) বিভিন্ন গোপন বিষয় জানিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি ফিতনার হাদিস সম্পর্কে বলেন যে, ফিতনা আসার মাঝে যেই দরজা তা উমর(রা), এবং তা ভেঙ্গে ফেলা হবে। বাস্তবেই, উমর(রা)কে হত্যা করে শিয়া জাতির অন্যতম আদর্শ আবু লুলু ওরফে ফিরোজ।
এরপরে উসমান(রা) এর সময়ে অতটা কড়াকড়ি না থাকার কারণে ইহুদি ও পারসিকরা ষড়যন্ত্র করার সুযোগ পায়। ৩৪ হিজরির শেষে ছুপা ইহুদি আবদুল্লাহ ইবনে সাবা মিশর ও ইরাক থেকে তার বিদ্রোহী বাহিনী নিয়ে মদিনায় উসমান(রা)কে অবরোধ করে।
সাহাবীরা এসময় বেশিরভাগ হজ্জের জন্য মদিনার বাইরে থাকায় তালহা(রা),আলী(রা) এর মত অল্পকিছু প্রথম শ্রেণির সাহাবী উসমান(রা)এর সাথে সাবাঈ বিদ্রোহীদের মীমাংসা করাতে চেষ্টা করেন।
কিন্তু ক্রমেই বিদ্রোহীরা দলে ভারী হয়ে আক্রমণাত্নক হতে থাকে এবং প্রায় ১ মাস অবরোধ করে রাখার পরে অবশেষে একদিন ফজরের সময়ে কিছু বিদ্রোহী হঠাত ঘরে ঢুকে উসমান(রা)কে হত্যা করে।
নিজের উপরে আপতিত বিপদ এবং জান্নাতের সুসংবাদের ব্যাপারে রাসূল(ﷺ) আগেই তাঁকে আভাস দিয়ে রেখেছিলেন। তাই তিনি সবর করে যান এবং বিদ্রোহীদের সাথে পাল্টা যুদ্ধে যেতে আলী(রা) ও অন্য সাহাবীদের নিষেধ করেন। হাদিসে দেখি-
আয়িশা(রা) থেকে বর্ণিতঃ নবী(ﷺ) বললেনঃ হে 'উসমান! আল্লাহ তা’আলা হয়ত তোমাকে একটি জামা পরিধান করাবেন (খিলাফত দান করবেন)। তোমার হতে লোকেরা তা খুলে নিতে চাইলে তুমি তাদের দাবিতে তা ত্যাগ করবে না।
[সুনানে তিরমিযী ৩৭০৫; ইবন মাজাহ ১১২; মুসনাদ আহমদ ২৩৯৪৫; সহি ইবন হিব্বান ৬৯১৫]
ইবন উমর(রা) বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) একটি ফিতনার কথা উল্লেখ করে বললেনঃ সেদিন এই মস্তকাবৃত ব্যক্তি ফিত্নায় অন্যায়ভাবে নিহত হবে। আমি তাকিয়ে দেখি তিনি হলেন উসমান ইবন আফফান(রা)।
[মিশকাত ৬০৭৮; তিরমীযি ৩৭০৮; মুসনাদ আহমদ ৫৬৮৯; তাহযিবুল কামাল ১২৫৭]
আয়িশা (রা)থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) তাঁর রোগশয্যায় বললেনঃ আমি আশা করি যে, এ সময় আমার কোন সাহাবী আমার নিকট উপস্থিত থাকুক। আমরা বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমরা কি আপনার কাছে আবু বক্রকে ডেকে আনবো? তিনি নীরব থাকলেন। আমরা বললাম, আমরা কি আপনার কাছে উমরকে ডেকে আনবো? তিনি এবারও নীরব থাকলেন। আমরা বললাম, আমরা কি আপনার নিকট উসমানকে ডেকে আনবো? তিনি বলেন, হ্যাঁ। অতঃপর উসমান(রা)এলেন। তিনি তার সাথে একান্তে আলাপ-আলোচনা করেন। উসমান(রা)-এর চেহারায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। কায়স(র) বলেন, আমার নিকট উসমানের মুক্ত দাস আবু সাহলাহ (র) বর্ণনা করেন যে, উসমান বিন আফফান (রা)নিজ বাড়িতে অবরুদ্ধ থাকাকালে বললেন, রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) আমার থেকে একটি অঙ্গীকার নিয়েছেন, আমি তাতে ধৈর্য ধারণ করবো। আলী বিন মুহাম্মাদ(র) তার বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন, উসমান (রা)বলেছেন, আমি তাতে ধৈর্য ধারণ করবো। কায়স(র) বলেন, সাহাবীদের মতে, রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) -এর সঙ্গে এটাই ছিল তাঁর একান্ত আলাপ।
[ইবন মাজাহ ১১৩; মুসতাদরাকে হাকিম ৪৫৯৯; মুসনাদ আহমদ ২৩৭৩২]
আবু মূসা আশআরী(রা) বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসে, মদিনার বাগানে নবী(ﷺ) বসে ছিলেন; সেখানে আবু বকর(রা) এবং তারপরে উমর(রা) প্রবেশ করতে চাইলে নবী(ﷺ) তাঁদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়ে অনুমতি দিলেন। উসমান(রা) প্রবেশ করতে চাইলে তাঁকেও অনুমতি দিলেন এবং বললেন- সে মহাবিপদে আপতিত হবে, এরপর জান্নাতে প্রবেশ করবে।
বাগানে প্রবেশ করে তিনি রাসূল(ﷺ), আবু বকর(রা) ও উমর(রা) থেকে দূরে জায়গা পেয়ে বসলেন। রাবী বলেন, এর থেকে অর্থ করি যে, তাঁর কবর দূরে হবে।
[সহি বুখারী ৬৬১৬; তিরমীযি ৩৭১০; মুসনাদ আহমদ ১৪৯৫০]
অবরুদ্ধ অবস্থায় উসমান(রা)কে ঠিকমত পানিও পান করতে দেয়নি শিয়াদের জাতির পিতা আবদুল্লাহ ইবনে সাবা’র বাহিনী। এই শিয়ারাই পরে হুসাইন(রা) এর সাথে বেঈমানি করেছিল কারবালার প্রান্তরে!
অব্রুদ্ধ অবস্থায়ও উসমান(রা) সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন নবী(ﷺ) এর পবিত্র মুখে উচ্চারিত তার ফযিলাতের কথাঃ-
আমর ইব্ন জাওয়ান (রা) থেকে বর্ণিতঃ আমি তাকে বললামঃ আপনি আহনাফ্ ইব্ন কায়স (রা)- এর (সাহাবিগণের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব) পৃথক থাকা সম্পর্কে আপনার অভিমত বর্ণনা করুন। তিনি বললেনঃ আমি আহনাফ্কে বলতে শুনেছি। আমি হজ্জ উপলক্ষে মদীনায় আসলাম। আমরা আমাদের মনযিলে ছিলাম, এমন সময় এক ব্যক্তি এসে বললোঃ লোক মসজিদে একত্রিত হচ্ছে।
আমি গিয়ে দেখলাম, লোক মসজিদে একত্রিত রয়েছে। তাঁদের মাঝে রয়েছেন- আলী ইব্ন আবূ তালিব, যুবায়র, তালহা এবং সা‘দ ইব্ন আবী ওয়াক্কাস(রা)। আমি যখন তাদের নিকট দাঁড়ালাম তখন বলা হলোঃ এই যে, উসমান ইব্ন আফ্ফান এসে গেছেন। তাঁর গায়ে ছিল একখানা হলুদ বর্ণের চাদর।
রাবী বলেনঃ আমি আমার সাথীকে বললাম, তুমি এখানে অবস্থান কর, দেখি উসমান(রা) কি বলেন।
উসমান(রা) বললেনঃ এখানে কি আলী(রা) আছেন? এখানে কি যুবায়র (রা) আছেন? এখানে কি তালহা (রা) আছেন? এবং এখানে কি সা‘দ (রা) আছেন? তারা বললেনঃ হাঁ (আমরা এখানে আছি)।
তিনি বললেনঃ আমি তোমাদেরকে আল্লাহ্ তা‘আলার কসম দিয়ে বলছি, যিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ্ নেই, তোমরা কি অবগত আছ যে, রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) বললেনঃ যে ব্যক্তি অমুক অমুক গোত্রের (উটের) বাথান ক্রয় করবে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমি তা ক্রয় করে রাসূলুল্লাহ্(ﷺ)- এর নিকট এসে বললামঃ আমি অমুক (উটের) বাথান খরিদ করেছি।
তিনি বললেনঃ এখন তুমি তা আমাদের মসজিদের জন্য (ওয়াক্ফ করে) দিয়ে দাও, তাহলে এর সওয়াব তুমি পাবে।
তাঁরা বললেনঃ হ্যাঁ।
তিনি আবার বললেনঃ আমি তোমাদেরকে আল্লাহ্র কসম দিয়ে বলছি। যিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। তোমরা কি অবগত আছ যে, রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) বলেনঃ যে ব্যক্তি ‘রূমা’ কূপ ক্রয় করবে আল্লাহ্ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমি (তা ক্রয় করে) রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) - এর নিকট এসে বললামঃ আমি ‘রূমা’ কূপ ক্রয় করেছি। তখন তিনি বললেনঃ এখন তা তুমি মুসলমানদের পানি পান করার জন্য (ওয়াক্ফ করে) দিয়ে দাও, আর এর সওয়াব তুমি পাবে।
তাঁরা বললেনঃ হ্যাঁ। তিনি আবার বললেনঃ আমি তোমাদেরকে আল্লাহ্র শপথ দিয়ে বলছি। যিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই।
তোমরা কি জান, রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) বললেনঃ যে ব্যক্তি অনটনগ্রস্ত (তাবুক) যুদ্ধের বাহিনীর যুদ্ধোপকরণের ব্যবস্থা করে দেবে, আল্লাহ্ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। এরপর আমি তাদের জন্য এমন যুদ্ধোপকরণের ব্যবস্থা করে দেই যে, ঐ বাহিনীর কোন লোকের একটি রশির বা একটি লাগামেরও অভাব হয়নি? তারা বললেনঃ হ্যাঁ। উসমান (রা) এরপর বলেনঃ হে আল্লাহ্! আপনি সাক্ষী থাকুন! হে আল্লাহ্! আপনি সাক্ষী থাকুন! হে আল্লাহ্! আপনি সাক্ষী থাকুন!
[সুনানে নাসাঈ ৩৬০৭; সুনানে তিরমীযি ৩৭০৩; মুসনাদ আহমদ ৫১৩; সুনানে দারাকুতনী ৪৩৫৬/১]
আব্দুর রহমান ইবন সামুরা(রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ নবী(ﷺ) যখন জায়শুল উসরা তাবুকের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন উসমান(রা) কাপড়ের আচলে এক হাজার দিনার নিয়ে নবী(ﷺ) এর কাছ এসে সেগুলা তাঁর কোলে ছাড়িয়ে দিলেন।
আব্দুর রহমান(রা) বললেন, আমি দেখতে পেলাম যে, নবী(ﷺ) সেগুলা তাঁর কোলে নিয়ে উলট-পালট করছেন আর বলছেনঃ আজকের দিনের পর উসমান যাই(আমল) করুক না কেন, তাতে তার কোন ক্ষতি হবে না। তিনি এই কথা দুই বার বললেন।
[সুনানে তিরমীযি ৩৭০১; মুসতাদরাক হাকিম ৪৬০৯; মুসনাদ আহমদ ২০১০৭; সিয়ার আ’লামিন নুবালা ৪৫১/২; মিশকাত ৬০৭৩;]
উসমান(রা)কে ঘেরাওকারী বিদ্রোহিরা মুসলিম বেশে দাবিদাওয়া নিয়ে এসেছিল, তাদের মধ্যে অনেকে ছিল ভুল তথ্যের দ্বারা বিভ্রান্ত আর বেশিরভাগই ছিল ইহুদি ইবনে সাবা’র মতাদর্শী। কিন্তু উসমান(রা) চাননি যে তাঁর কারণে উম্মতের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হোক।
যিলক্কদ মাসের শেষ দিক থেকে জিলহজ্জের ১৮ তারিখ পর্যন্ত অবরোধ ছিল।সেদিন ছিল জুমআর দিন, উসমান(রা)এর ঘরে প্রায় ২৭ জন আনসার-মুহাজির সাহাবী ছিলেন, যার মধ্যে হাসান-হুসাইন(রা)ও ছিলেন।বড় বড় সাহাবীদের সন্তান এবং প্রচুর দাসও ছিল, যাদের দিয়ে চাইলে সাবাঈ বিদ্রোহীদের সামাল দিয়ে রাখা যেত। কিন্তু তাঁদের উদ্দেশ্যে উসমান(রা) বলেন যে- যার উপরে আমার অধিকার আছে, আমি কসম দিয়ে বলছি সে যেন হাত গুটিয়ে নিজ গৃহে ফিরে যায়। দাসদের বললেন- যে তরবারি কোষবদ্ধ রাখবে, সে মুক্ত। এরুপ বলার ফলে লড়াইয়ে ভাটা পরে গেল। সবাইকে গৃহত্যাগ করতে বলার পরে সর্বশেষ চলে যাওয়া ব্যক্তি ছিলেন হাসান ইবন আলী(রা)। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩২৭/৭]
সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন সালাম(রা) বর্ণনা করেন- অবরোধকালে আমি উসমান(রা)কে সালাম জানাবার জন্য তার নিকট উপস্থিত হই। গৃহে প্রবেশ করলে তিনি বলেনঃ ‘মারহাবা প্রিয় ভাই আমার, আজ রাত্রে আমি এ জানালা দিয়ে রাসূলুল্লাহ্(ﷺ)কে দেখেছি।[কায়স বিন সালাত সূত্রে- স্বপ্নে দেখি আবু বকর এবং উমরকেও] বর্ণনাকারী বলেন, গৃহে জানালা ছিল। রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) বললেন- উসমান! তারা তোমাকে অবরুদ্ধ করেছে?’ আমি বললাম- জী। তিনি বললেন- তারা তোমাকে পিপাসার্ত রেখেছে? আমি বললাম, জী হ্যাঁ!
তখন তিনি একটি বালতি কাত করেছিলেন,যাতে পানি ছিল। আমি তা থেকে পানি পান করি, এমনকি পরিতৃপ্ত হই। তিনি আমাকে আরো বলেন- তুমি ইচ্ছা করলে তাদের বিরুদ্ধে আমি তোমাকে সাহায্য করি। আবার তুমি ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে ইফতার করতে পার।’ উসমান(রা) বলেছেন- আমি তাঁর সঙ্গে ইফতার করাকেই পছন্দ করেছি। সেদিন রাতেই তিনি নিহত হন।
[আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩২৯/৭; আনসাব ওয়াল আশরাফ ৫৭৩/৫; আল হাওইয়ি লিল ফাতওয়া-সুয়ূতি ৩১৫/২; তারিখে দামিশক ৩৮৬/৩৯]
উসমান(রা)কে শহীদ করার পরে সাবাঈ বিদ্রোহীরা নিজেদের মধ্যে থাকা হত্যাকারীদের বাঁচাবার জন্য আলী(রা)কে ঘিরে ধরে, বাইয়্যাত করায় এবং ধীরে ধীরে শিয়া ধর্মের মূলনীতিসমূহ রচনা করতে থাকে। যেমন শুরুতেই আলি(রা)এর ১ম খলিফা হওয়াকে ফরজ দাবি করে, ইমামত-অসিয়্যাত আকিদার জন্ম দেয়, প্রথম ৩ খলিফাকে অপবাদ দেয়ার রীতি চালু করে ইত্যাদি।
উসমান(রা)এর হত্যার ঘটনা থেকে আলী(রা) সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। তিনি উসমান(রা)এর হত্যার খবর শুনে বলেন- ধ্বংস হোক তারা চিরকালের জন্য।
তিনি আরো বলেন- লোকেরা চাইলে আমি মাকামে ইব্রাহিমের সামনে আল্লাহ্র নামে শপথ করে বলব যে, আমি উসমান(রা)কে হত্যা করিনি, হত্যার নির্দেশও দেইনি বরং আমি তাদের মানা করেছিলাম কিন্তু তারা আমার কথা শুনেনি।
সাহাবী হুযাইফা ইবন ইয়ামান(রা) বলেন যে- উসমান(রা) এর হত্যাই ইসলামের প্রথম ফিতনা।
[আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩৪৫-৩৪৭/৭ম খণ্ড]
~ The Rafidologist
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন