পাঠ পর্যালোচনা: মাওলানা মওদুদীর সাথে আমার সাহচর্যের ইতিবৃত্ত + pdf
পাঠ_পর্যালোচনা_৩০
বই: মাওলানা মওদুদীর সাথে আমার সাহচর্যের ইতিবৃত্ত এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ
মূল লেখক: মনযুর নোমানী
অনুবাদক: নুরূল কবির আনছারী
প্রকাশনী: আশরাফি বুক ডিপো
১১,বাংলাবাজার ইসলামী টাওয়ার, ঢাকা।
===================
শুধু বাংলাদেশই নয় বরং উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জামায়েতে ইসলামী নামক রাজনৈতিক দলটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদির একান্ত সহচর এবং সবচে' নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি ও পরামর্শদাতা ছিলেন। তিনি দলটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, প্রথম রুকন ও আহবায়কও ছিলেন। জামাতে ইসলামির প্রতিষ্ঠা, প্রাথমিক কর্মকাণ্ড সবই তার চোখের সামনে ও হাতের উপর দিয়ে হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি জামায়েতে ইসলামী ত্যাগ করেন। এর কারণ ও ধর্মীয় কিছু দৃষ্টিভঙ্গিতে দলটির ত্রুটি-বিচ্যুতি বিশ্লেষণ করে তিনি রচনা করেন আলোচ্চ গ্রন্থটি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বইটি আলোচিত-সমালোচিত এই দলের আদর্শ ও চিন্তাধারা এবং ভ্রান্তি ও বিচ্যুতি বুঝার ক্ষেত্রে অন্য যে কোন বইয়ের তুলনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।
লেখককে আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেবার মতো কিছু নেই। বিদ্বান মাত্রই তাকে চিনেন। তার সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের জন্য 'মারেফুল হাদিস' এর মতো কালজয়ী গ্রন্থের রচয়িতা বলাটাই যথেষ্ট হবার দাবি রাখে। তবুও যেহেতু আমরা বিদ্বান নই আর আমাদের জানাশোনার পরিধিও সীমিত গণ্ডিতে আবদ্ধ, তাই লেখকের পরিচয়ের জন্য আরো কিছু শব্দ ব্যায় করতে হচ্ছে। কারণ লেখকের পরিচয় আলোচ্চ গ্রন্থটির গুরুত্ব নির্ধারণে সহায়ক হবে।
সাম্প্রতিককালে বিশ্বে যে সকল মহামনীষী ইসলামি পুনর্জাগরণ আন্দোলনের অগ্রপথিক ছিলেন তাদের অন্যতম হলেন মনযুর মোনানি রাহ.। তিনি ইসলামি আদর্শের একজন সফল ও সর্বজনস্বীকৃত ব্যাখ্যাকার। সর্বজনমান্য রাজনীতিবিদ। ইসলামি দর্শন, অর্থব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সুচিন্তিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে জীবদ্দশাতেই লাভ করেছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি। ভারতের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন 'আল-ফুরকান' এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদকও তিনি ছিলেন।
আলোচ্চ গ্রন্থটিকে দুইভাগে ভাগ করে আলোচনা সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। প্রথম ভাগে মওদুদি সাহেবের সাথে তার গভীর সম্পর্ক ও সাহচর্যের ইতিবৃত্তের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে তাঁর এমন কিছু চিন্তাধারা ও মতবাদের পর্যালোচনা করা হয়েছে, যেগুলোকে সুস্পষ্টরূপে ভ্রান্তি ও বিচ্যুতি বলা যায়। এবং এর মধ্যে কিছু তো এতো মারাত্মক যে, সেগুলোকে -লেখকের ভাষায়- উপেক্ষা করাটা অবৈধ হবে।
আমরা অনেকে ভাবি, প্রৌঢ়ত্বের সিঁড়িতে পা দেবার পর মনে হয় মওদুদি সাহেব 'মওদুদি' হয়েছিলেন। আসল ব্যাপার মোটেই তা না। খেলাফত আন্দোলন পরবর্তী সময়ে জমিয়াতুল উলামা যখন 'আল-জমিয়ত' নামে পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয় তখন মওদুদি সাহেবকে এর সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়। তখন তিনি সবেমাত্র টগবগে যুবক। এর মানে হল, যৌবনেই তিনি কলমগিরির কারিগর হবার পথে বহুদূর অগ্রসর হয়েছিলেন। নইলে এমন জাতীয় একটি দলের জাতীয়মানের পত্রিকার সম্পাদক তাকে নিযুক্ত করার কথা না। মূলত এই পত্রিকার সূত্র ধরেই মওদুদি সাহেবের নামের সাথে তাঁর প্রথম পরিচয়।
মওদুদি সাহেব বেশ সুকৌশলী মানুষ ছিলেন। সেসময় তিনি 'তরজুমানুল কুরআন' নামেও একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সে পত্রিকায় রাজনৈতিক আন্দোলন বা এতদসংক্রান্ত কোন বিষয়ের আলোচনা থাকতো না। ১৯৩৬ সালের নির্বাচনের পর তিনি দেশীয় রাজনীতির উপর লেখালেখি শুরু করেন। তার সেসব লেখা অত্যন্ত বলিষ্ঠ হওয়ায় হু হু করে বাড়তে থাকে তার ভক্তের সংখ্যা। এর মধ্যে বড় বড় নামকরা আলেমরাও ছিলেন। কারণ তখন ভারতীয় মুসলিমরা এক ধরনের অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়া কালাতিপাত করছিল। এমন ক্রান্তিলগ্নে তার রচনাসমূহ তাদের সামনে হাজির করছিল আশার বাণী । এসব লেখার দ্বারা প্রভাবিত হয়েই আলোচ্চ গ্রন্থের লেখক মওদুদি সাহেবের সাথে পত্রবিনিময়ের মাধ্যমে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাঁর বিভিন্ন লেখা নিজের সম্পাদিত 'আল-ফুরকান' এ প্রকাশ করেন।
প্রথম যেদিন মওদুদি সাহেবের সাথে লেখকের সাক্ষাৎ হয় সেদিন তিনি বড়সড় একটা ধাক্কা খেলেন। এমন ধাক্কা, যা তিনি কল্পনাও করেন নি। দেখলেন, মওদুদি সাহেবের দাড়ি খুব ছোটছোট করে ছাঁটা। যিনি ইসলামের দিকে মানুষকে আহ্বান করছেন তার নিজের জীবনেই ইসলামের এমন অনুপস্থিতি তাকে চরমভাবে ব্যথিত করেছিল। কিন্তু তিনি নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিলেন যে, ভবিষ্যতে হয়তো তার ভেতর পরিবর্তন ঘটবে।
সবচে বড়ো ধাক্কাটি তিনি খেয়েছিলেন এরও কয়েক বছর পর। ততোদিনে মওদুদি সাহেব পর্দা বিষয়ে একটি বই-ও লিখেছেন। কিন্তু তার যুবক বাবুর্চি মহিলাদের সামনেই পাকসাক করতো আর তিনি কিছু বলতেন না। এটা লেখক কোনভাবেই মানতে পারেন নি। ৪১ পৃষ্ঠা থেকে এই বিষয়ে তাঁর মুখ থেকেই শুনি,
"দারুল ইসলামে এসে এক সপ্তাহের মধ্যে এমন কিছু বিষয় সম্পর্কে আমি অবগত হতে শুরু করলাম যে, শরিয়তের আহকামের যে পরিমাণ পাবন্দি অথবা বলতে হয় 'আমলী তাকওয়া' জামাতের প্রত্যেক সদস্যদের জন্য আবশ্যিক শর্তরূপে নির্ধারিত হয়েছে, স্বয়ং মাওলানা মওদুদি সাহেবও নিজেকে সেগুলোর পাবন্দরূপে তৈরি করেন নি। উপরন্তু জামাতের প্রতিষ্ঠার কিছু দিন পূর্বের একান্ত আলোচনায় 'তাকওয়া' ও 'শরিয়তের পাবন্দি' বিষিয়ে মাওলানা সাহেবের যে অবস্থার আমি ধারণা করেছিলাম, বাস্তবে কিন্তু তার সেরকম অবস্থা নয়। বরং এই ব্যাপারে তিনি এতোটাই উদাসীন ও হালকা মনোভাব পোষণ করেন যা তাকওয়ার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এতদসম্পর্কে অবহিত হবার পর আমার অন্তরে বিরাট আঘাত লাগে। বারংবার চিন্তা-ভাবনা করেও আমি এ ব্যাপারে তাকে অপরাগ ধারণা করতে পারি নি। কিংবা তার এরকম চাল-চলনের সঠিক কোন ব্যখ্যাও বের করতে পারি নি।"
দ্বীনের একজন দাঈর যে পরিমাণ মুত্তাকি ও শরিয়েতের পাবন্দ হওয়া উচিত তা মওদুদি সাহেবের ভেতর ছিল না। মূলত এই কারণেই তিনি আস্তে আস্তে জামাত থেকে সরে আসেন। অনেকে ধারণা করেন, হয়তো মওদুদি সাহেবের ধর্মসংক্রান্ত ভ্রান্ত ব্যখ্যা ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মনে হয় তিনি জামাত পরিত্যাগ করেছিলেন। যেমন অন্য অনেক আলেমের ক্ষেত্রে তা হয়েছে। ব্যাপারটি মোটেই তা নয়। কারণ তিনি যখন জামাতে ইসলামী ছেড়ে চলে আসেন তখনও মওদুদি সাহেবের সেসব গোমরাহি প্রকাশ পাওয়া শুরু হয় নি। বরং তারও অনেক পরে তা প্রকাশ হয়। এর জের ধরে অন্যান্য আলেমরাও জামাতে ইসলামী পরিত্যাগ করেন। মজার কথা হল, জামাতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাকালীন অধিকাংশ আলেম সদস্যই শেষ পর্যন্ত দলটি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তার ভ্রান্ত চিন্তা-ভাবনার কারণে।
লেখক যেহেতু প্রচুর মানুষকে দাওয়াত দিয়েছিলেন জামাতে ইসলামের প্রতি এবং তার সাক্ষ্যর ভিত্তিতে অনেকে এই দলে যোগ দিয়েছিলেন তাই তিনি বিষয়গুলো প্রকাশ্যে জানিয়ে দেওয়া জরুরি মনে করলেন। বিশেষত মওদুদি সাহেবের ভ্রান্ত কথাবার্তা প্রকাশ পাবার পর। নইলে এর জন্য তাকে দায়ী থাকতে হবে। সেই চিন্তা থেকেই তিনি বইটি লেখেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি মওদুদি সাহেবের চারটি মারাত্মক ভুল নিয়ে আলোচনা করেন।
এক, কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষার নিজস্ব ব্যখা।
দুই, ধর্মীয় কাজে 'হিকমতে আমলী' এর দর্শন
তিন, গিলাফে কাবার ভ্রাম্যমান প্রদর্শনী
চার, একটি মারাত্মক ও বিভ্রান্তিকর দাবি। তাহল, মাওলানা মওদুদি ও জামাতে ইসলামের দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারী মুসলমানদের পজিশন বা মর্যাদা তা-ই যা ইহুদি জাতির ছিল।
এই চারটা বিষয়ের উপর তিনি বিস্তারিত আলোকপাত করেন। যার সবিস্তার বিবরণ এই ক্ষুদ্র বুকরিভিউতে দেওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য আলাদা আরেকটি বুক রিভিউর দরকার। তার মধ্যে প্রথমটি আমার কাছে সবচে মারাত্মক বলে মনে হয়েছে। সেখানে রব, ইলাহ, দ্বীন ও ইবাদাত এই চারটি পরিভাষা বিষয়ে মওদুদি সাহেবের বক্তব্য ছিল, কুরআন নাযিলের পরবর্তী শতাব্দীতে এসে শব্দগুলোর মৌল অর্থ হারিয়ে যায়। এবং দীর্ঘ সময় পরিক্রমায় এগুলোর আসল অর্থ কেউ-ই অনুধাবন করতে পারেনি। ফলে কুরআনের তিন চতুর্থাংশ বা তারচে বেশি শিক্ষা দৃষ্টি থেকে প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়। এতোদিন পর তিনি এসে সেগুলোর আসল অর্থ বুঝতে পেরেছেন আবার। তার এসব দাবি মানতে গেলে বলা যায়, পুরো দ্বীন ঝুঁকি ও সংশয়ের মুখে পড়ে যায়। এসব বিষয়গুলো লেখক অত্যন্ত চমৎকার ও সহজবোধ্য আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন।
বইটা আমার মতে, সকলের অবশ্যপাঠ্য তালিকায় থাকা উচিত। এবং একবার নয়, বরং কয়েকবার করে পড়া উচিত। এই নিয়ে আমি দুইবার পড়লাম। এবং দ্বিতীয়বার পড়া শেষে এটাই ছিল বইটার বিষয়ে আমার ক্ষুদ্র মূল্যায়ন।
বই: মাওলানা মওদুদীর সাথে আমার সাহচর্যের ইতিবৃত্ত এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ
মূল লেখক: মনযুর নোমানী
অনুবাদক: নুরূল কবির আনছারী
প্রকাশনী: আশরাফি বুক ডিপো
১১,বাংলাবাজার ইসলামী টাওয়ার, ঢাকা।
===================
শুধু বাংলাদেশই নয় বরং উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জামায়েতে ইসলামী নামক রাজনৈতিক দলটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদির একান্ত সহচর এবং সবচে' নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি ও পরামর্শদাতা ছিলেন। তিনি দলটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, প্রথম রুকন ও আহবায়কও ছিলেন। জামাতে ইসলামির প্রতিষ্ঠা, প্রাথমিক কর্মকাণ্ড সবই তার চোখের সামনে ও হাতের উপর দিয়ে হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি জামায়েতে ইসলামী ত্যাগ করেন। এর কারণ ও ধর্মীয় কিছু দৃষ্টিভঙ্গিতে দলটির ত্রুটি-বিচ্যুতি বিশ্লেষণ করে তিনি রচনা করেন আলোচ্চ গ্রন্থটি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বইটি আলোচিত-সমালোচিত এই দলের আদর্শ ও চিন্তাধারা এবং ভ্রান্তি ও বিচ্যুতি বুঝার ক্ষেত্রে অন্য যে কোন বইয়ের তুলনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।
লেখককে আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেবার মতো কিছু নেই। বিদ্বান মাত্রই তাকে চিনেন। তার সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের জন্য 'মারেফুল হাদিস' এর মতো কালজয়ী গ্রন্থের রচয়িতা বলাটাই যথেষ্ট হবার দাবি রাখে। তবুও যেহেতু আমরা বিদ্বান নই আর আমাদের জানাশোনার পরিধিও সীমিত গণ্ডিতে আবদ্ধ, তাই লেখকের পরিচয়ের জন্য আরো কিছু শব্দ ব্যায় করতে হচ্ছে। কারণ লেখকের পরিচয় আলোচ্চ গ্রন্থটির গুরুত্ব নির্ধারণে সহায়ক হবে।
সাম্প্রতিককালে বিশ্বে যে সকল মহামনীষী ইসলামি পুনর্জাগরণ আন্দোলনের অগ্রপথিক ছিলেন তাদের অন্যতম হলেন মনযুর মোনানি রাহ.। তিনি ইসলামি আদর্শের একজন সফল ও সর্বজনস্বীকৃত ব্যাখ্যাকার। সর্বজনমান্য রাজনীতিবিদ। ইসলামি দর্শন, অর্থব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সুচিন্তিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে জীবদ্দশাতেই লাভ করেছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি। ভারতের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন 'আল-ফুরকান' এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদকও তিনি ছিলেন।
আলোচ্চ গ্রন্থটিকে দুইভাগে ভাগ করে আলোচনা সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। প্রথম ভাগে মওদুদি সাহেবের সাথে তার গভীর সম্পর্ক ও সাহচর্যের ইতিবৃত্তের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে তাঁর এমন কিছু চিন্তাধারা ও মতবাদের পর্যালোচনা করা হয়েছে, যেগুলোকে সুস্পষ্টরূপে ভ্রান্তি ও বিচ্যুতি বলা যায়। এবং এর মধ্যে কিছু তো এতো মারাত্মক যে, সেগুলোকে -লেখকের ভাষায়- উপেক্ষা করাটা অবৈধ হবে।
আমরা অনেকে ভাবি, প্রৌঢ়ত্বের সিঁড়িতে পা দেবার পর মনে হয় মওদুদি সাহেব 'মওদুদি' হয়েছিলেন। আসল ব্যাপার মোটেই তা না। খেলাফত আন্দোলন পরবর্তী সময়ে জমিয়াতুল উলামা যখন 'আল-জমিয়ত' নামে পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয় তখন মওদুদি সাহেবকে এর সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়। তখন তিনি সবেমাত্র টগবগে যুবক। এর মানে হল, যৌবনেই তিনি কলমগিরির কারিগর হবার পথে বহুদূর অগ্রসর হয়েছিলেন। নইলে এমন জাতীয় একটি দলের জাতীয়মানের পত্রিকার সম্পাদক তাকে নিযুক্ত করার কথা না। মূলত এই পত্রিকার সূত্র ধরেই মওদুদি সাহেবের নামের সাথে তাঁর প্রথম পরিচয়।
মওদুদি সাহেব বেশ সুকৌশলী মানুষ ছিলেন। সেসময় তিনি 'তরজুমানুল কুরআন' নামেও একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সে পত্রিকায় রাজনৈতিক আন্দোলন বা এতদসংক্রান্ত কোন বিষয়ের আলোচনা থাকতো না। ১৯৩৬ সালের নির্বাচনের পর তিনি দেশীয় রাজনীতির উপর লেখালেখি শুরু করেন। তার সেসব লেখা অত্যন্ত বলিষ্ঠ হওয়ায় হু হু করে বাড়তে থাকে তার ভক্তের সংখ্যা। এর মধ্যে বড় বড় নামকরা আলেমরাও ছিলেন। কারণ তখন ভারতীয় মুসলিমরা এক ধরনের অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়া কালাতিপাত করছিল। এমন ক্রান্তিলগ্নে তার রচনাসমূহ তাদের সামনে হাজির করছিল আশার বাণী । এসব লেখার দ্বারা প্রভাবিত হয়েই আলোচ্চ গ্রন্থের লেখক মওদুদি সাহেবের সাথে পত্রবিনিময়ের মাধ্যমে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাঁর বিভিন্ন লেখা নিজের সম্পাদিত 'আল-ফুরকান' এ প্রকাশ করেন।
প্রথম যেদিন মওদুদি সাহেবের সাথে লেখকের সাক্ষাৎ হয় সেদিন তিনি বড়সড় একটা ধাক্কা খেলেন। এমন ধাক্কা, যা তিনি কল্পনাও করেন নি। দেখলেন, মওদুদি সাহেবের দাড়ি খুব ছোটছোট করে ছাঁটা। যিনি ইসলামের দিকে মানুষকে আহ্বান করছেন তার নিজের জীবনেই ইসলামের এমন অনুপস্থিতি তাকে চরমভাবে ব্যথিত করেছিল। কিন্তু তিনি নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিলেন যে, ভবিষ্যতে হয়তো তার ভেতর পরিবর্তন ঘটবে।
সবচে বড়ো ধাক্কাটি তিনি খেয়েছিলেন এরও কয়েক বছর পর। ততোদিনে মওদুদি সাহেব পর্দা বিষয়ে একটি বই-ও লিখেছেন। কিন্তু তার যুবক বাবুর্চি মহিলাদের সামনেই পাকসাক করতো আর তিনি কিছু বলতেন না। এটা লেখক কোনভাবেই মানতে পারেন নি। ৪১ পৃষ্ঠা থেকে এই বিষয়ে তাঁর মুখ থেকেই শুনি,
"দারুল ইসলামে এসে এক সপ্তাহের মধ্যে এমন কিছু বিষয় সম্পর্কে আমি অবগত হতে শুরু করলাম যে, শরিয়তের আহকামের যে পরিমাণ পাবন্দি অথবা বলতে হয় 'আমলী তাকওয়া' জামাতের প্রত্যেক সদস্যদের জন্য আবশ্যিক শর্তরূপে নির্ধারিত হয়েছে, স্বয়ং মাওলানা মওদুদি সাহেবও নিজেকে সেগুলোর পাবন্দরূপে তৈরি করেন নি। উপরন্তু জামাতের প্রতিষ্ঠার কিছু দিন পূর্বের একান্ত আলোচনায় 'তাকওয়া' ও 'শরিয়তের পাবন্দি' বিষিয়ে মাওলানা সাহেবের যে অবস্থার আমি ধারণা করেছিলাম, বাস্তবে কিন্তু তার সেরকম অবস্থা নয়। বরং এই ব্যাপারে তিনি এতোটাই উদাসীন ও হালকা মনোভাব পোষণ করেন যা তাকওয়ার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এতদসম্পর্কে অবহিত হবার পর আমার অন্তরে বিরাট আঘাত লাগে। বারংবার চিন্তা-ভাবনা করেও আমি এ ব্যাপারে তাকে অপরাগ ধারণা করতে পারি নি। কিংবা তার এরকম চাল-চলনের সঠিক কোন ব্যখ্যাও বের করতে পারি নি।"
দ্বীনের একজন দাঈর যে পরিমাণ মুত্তাকি ও শরিয়েতের পাবন্দ হওয়া উচিত তা মওদুদি সাহেবের ভেতর ছিল না। মূলত এই কারণেই তিনি আস্তে আস্তে জামাত থেকে সরে আসেন। অনেকে ধারণা করেন, হয়তো মওদুদি সাহেবের ধর্মসংক্রান্ত ভ্রান্ত ব্যখ্যা ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মনে হয় তিনি জামাত পরিত্যাগ করেছিলেন। যেমন অন্য অনেক আলেমের ক্ষেত্রে তা হয়েছে। ব্যাপারটি মোটেই তা নয়। কারণ তিনি যখন জামাতে ইসলামী ছেড়ে চলে আসেন তখনও মওদুদি সাহেবের সেসব গোমরাহি প্রকাশ পাওয়া শুরু হয় নি। বরং তারও অনেক পরে তা প্রকাশ হয়। এর জের ধরে অন্যান্য আলেমরাও জামাতে ইসলামী পরিত্যাগ করেন। মজার কথা হল, জামাতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাকালীন অধিকাংশ আলেম সদস্যই শেষ পর্যন্ত দলটি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তার ভ্রান্ত চিন্তা-ভাবনার কারণে।
লেখক যেহেতু প্রচুর মানুষকে দাওয়াত দিয়েছিলেন জামাতে ইসলামের প্রতি এবং তার সাক্ষ্যর ভিত্তিতে অনেকে এই দলে যোগ দিয়েছিলেন তাই তিনি বিষয়গুলো প্রকাশ্যে জানিয়ে দেওয়া জরুরি মনে করলেন। বিশেষত মওদুদি সাহেবের ভ্রান্ত কথাবার্তা প্রকাশ পাবার পর। নইলে এর জন্য তাকে দায়ী থাকতে হবে। সেই চিন্তা থেকেই তিনি বইটি লেখেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি মওদুদি সাহেবের চারটি মারাত্মক ভুল নিয়ে আলোচনা করেন।
এক, কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষার নিজস্ব ব্যখা।
দুই, ধর্মীয় কাজে 'হিকমতে আমলী' এর দর্শন
তিন, গিলাফে কাবার ভ্রাম্যমান প্রদর্শনী
চার, একটি মারাত্মক ও বিভ্রান্তিকর দাবি। তাহল, মাওলানা মওদুদি ও জামাতে ইসলামের দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারী মুসলমানদের পজিশন বা মর্যাদা তা-ই যা ইহুদি জাতির ছিল।
এই চারটা বিষয়ের উপর তিনি বিস্তারিত আলোকপাত করেন। যার সবিস্তার বিবরণ এই ক্ষুদ্র বুকরিভিউতে দেওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য আলাদা আরেকটি বুক রিভিউর দরকার। তার মধ্যে প্রথমটি আমার কাছে সবচে মারাত্মক বলে মনে হয়েছে। সেখানে রব, ইলাহ, দ্বীন ও ইবাদাত এই চারটি পরিভাষা বিষয়ে মওদুদি সাহেবের বক্তব্য ছিল, কুরআন নাযিলের পরবর্তী শতাব্দীতে এসে শব্দগুলোর মৌল অর্থ হারিয়ে যায়। এবং দীর্ঘ সময় পরিক্রমায় এগুলোর আসল অর্থ কেউ-ই অনুধাবন করতে পারেনি। ফলে কুরআনের তিন চতুর্থাংশ বা তারচে বেশি শিক্ষা দৃষ্টি থেকে প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়। এতোদিন পর তিনি এসে সেগুলোর আসল অর্থ বুঝতে পেরেছেন আবার। তার এসব দাবি মানতে গেলে বলা যায়, পুরো দ্বীন ঝুঁকি ও সংশয়ের মুখে পড়ে যায়। এসব বিষয়গুলো লেখক অত্যন্ত চমৎকার ও সহজবোধ্য আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন।
বইটা আমার মতে, সকলের অবশ্যপাঠ্য তালিকায় থাকা উচিত। এবং একবার নয়, বরং কয়েকবার করে পড়া উচিত। এই নিয়ে আমি দুইবার পড়লাম। এবং দ্বিতীয়বার পড়া শেষে এটাই ছিল বইটার বিষয়ে আমার ক্ষুদ্র মূল্যায়ন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন