পাঠ পর্যালোচনা: আররফউ ওয়াত তাকমীল ফিল জারহি ওয়াত তা'দীল + pdf
পাঠ_পর্যালোচনা_৩৫
বইয়ের নাম: আররফউ ওয়াত তাকমীল ফিল জারহি ওয়াত তা'দীল
লেখক: আবদুল হাই লাখনৌবি
টীকাকার: আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ
প্রকাশক: দারুল বাশাইর আল-ইসলামিইয়া, বৈরুত, লেবানন।
বাঙলাদেশী ছাপা: হরফ প্রকাশন, ইসলামী টাওয়ার, বাঙলাবাজার, ঢাকা-১১০০
-------------------------- --------
জরাহ মানে হল কারো দোষত্রুটির কারণে তাকে অভিযুক্ত করা। আর তাদিল হল ভালোগুণের কারণে কারো প্রশংসা করা। হাদিস গ্রহণ-বর্জনের বিষয়টি পুরোটাই এই শাস্ত্রের উপর নির্ভরশীল।
এই শাস্ত্র নিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই উলামায়ে কেরাম কাজ করে আসছেন। তবে সেটা ছিল বিচ্ছিন্নভাবে। এই শাস্ত্রের নিয়মকানুনগুলো একমলাটের ভেতর নিয়ে এসে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনার কাজটা প্রথম করা হয়েছে আমাদের আলোচিত গ্রন্থটিতে।
লেখক আবদুল হাই লাখনৌবি একজন অনারব তথা ভারতীয় আলেম। তার জন্ম হয়েছিল ১২৬৪ হিজরীতে। আর মৃত্যু ১৩০৪ হিজরীতে। মাত্র চল্লিশ বছরের জীবদ্দশায় তিনি যে পরিমান রচনা লিখে যান তা সত্যিই বিস্ময়কর আমাদের জন্য। তার রচনাবলির প্রায় সবই শাস্ত্রগত নানান বিষয়ে।
ভারতীয় আলেম হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তার নাম ও রচনাবলির সাথে আরবদের তেমন পরিচয় ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে বিখ্যাত আরব মুহাক্কিক ও মুহাদ্দিস আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ তার কিছু রচনাতে টীকা সংযোজন করে আরব থেকে প্রকাশ করায় তিনি সহজেই ভারতের বাইরের দেশগুলোতে পরিচিতি পান। আলোচ্চ গ্রন্থটিও সেরকমই একটি টীকাযুক্ত গ্রন্থ।
জরাহ-তাদিল শাস্ত্রে এই গ্রন্থটিকে একটি আকরগ্রন্থ হিসেবে বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। এই শাস্ত্রের বহু দুর্লভ বিষয়ের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন তিনি বইটিতে। আসুন, পুরোটা সম্ভব না হলেও এর সামান্য কিছুর উপর আমরা খানিকটা নজর বুলিয়ে আসি।
শুরুতে তিনি গ্রন্থটি রচনা করার কারণ উল্লেখ করেছেন। তা হল, তিনি দেখলেন তার যুগে অনেক মানুষ জরাহ-তাদিলের কিতাবাদি থেকে ইমামদের বিভিন্ন মন্তব্য উদ্ধৃত করে যাকে ইচ্ছা তাকে প্রত্যাখ্যাত সাব্যস্ত করতেন। আবার যাকে ইচ্ছা তাকে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ করতেন। কেমন যেন এটা একটা ছেলেখেলা। এর কারণ ছিল, জরাহ-তাদিলে তাদের বুৎপত্তি না থাকা ও এই শাস্ত্রের জটিলতার সাথে পরিচয় না ঘটা। তাই তিনি এই অবস্থার সংশোধনকল্পে এই বিষয়ে একটা প্রমাণ্য ও স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নই হল আলোচ্চ গ্রন্থটি।
পুরো বইটিতে তিনি মোট পঁচিশটি 'ইকায' বা সতর্কবার্তা শিরোনাম দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হল,
১/জরাহ মানে যেহেতু হাদিস বর্ণনাকারীর ব্যক্তিদের দোষত্রুটি তালাশ করে বর্ণনা করা তাই কারো মনে সন্দেহ হতে পারে এটি গীবত হবে। আর গীবত তো হারাম। তিনি তাই প্রথম সতর্কবার্তায় দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে এই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন যে, জরাহ সেসব গীবতের অন্তর্ভুক্ত হবে যেগুলো শরীয়ত জায়েয বলে সাব্যস্ত করেছে। সুতরাং এর কারণে মুহাদ্দিসদেরকে দোষারোপ বা নিন্দনীয় কিছু বলা যাবে না।
২/ মন চাইলেই যে কেউ যে কারো জরাহ করতে পারবে না। এর জন্য পূর্বশর্ত হল, জরাহকারীকে অবশ্যই মুত্তাকী, সত্যবাদী, গোঁড়ামীমুক্ত এবং জরাহের কারণসমূহ সম্পর্কে সম্যক অবগত হতে হবে।
৩/ জরহে মুবহাম বা কারণ উল্লেখ করা ছাড়াই যদি কেউ কারো জরাহ করে তবে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে কি না এই বিষয়ে বেশ লম্বা ও বিস্তারীত আলোচনা করেছেন। টীকাকার এখানে লেখকের সাথে কিছু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন টীকাতে।
৪/যদি একই ব্যক্তিকে কেউ ভালো বলে আর কেউ খারাপ তবে সেক্ষেত্রে হুকুম কি হবে? এটা নিয়েও তিনি চমৎকার ও গোছালো আলোচনা করেছেন।
৫/অনেক ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসরা বলেন, হাদিসটি সহিহ নয়। এরদ্বারা অনেকে মনে করে যে হাদিসটি যইফ বা মওযু। লেখক এর প্রতিবাদ করে বলেন, এটা হল তাদের পরিভাষা সম্পর্কে অজ্ঞতার ফল। বরং অনেক সময় হাদিসটি সহিহ নয় বলে মুহাদ্দিস বুঝাতে চান হাদিসটি হাসান। কিন্তু টীকাকার এখানে চমৎকার একটি বিষয় সংযোজন করেছেন। তিনি বলেন, এই জাতীয় কথা যদি হুকুম সংক্রান্ত হাদিসের কিতাবের বেলায় পাওয়া যায় তবে তো লেখকের কথা ঠিকই আছে। আ যদি জালহাদিস নিয়ে রচিত গ্রন্থে মুহাদ্দিস এমন কথা বলেন তবে 'হাদিসটি সহিহ নয়' এর দ্বারা উদ্দেশ্য হয় হাদিসটি মওযু। সেখানে 'সহিহ নয়, বরং হাসান' এমনটা বুঝানো উদ্দেশ্য হয় না। এই পার্থক্যটা বহু বড় বড় লেখকও ধরতে সক্ষম হন নি।
৬/ কোন হাদিসর মান নির্ণয় করতে গিয়ে 'সহিহ' বলা আর 'সহিহুল ইসনাদ' বলার মধ্যে যে পার্থক্য তাও তিনি তুলে ধরেছেন। প্রথমটা সেই হাদিসের সনদ-মতন সব সহিহ হওয়া বুঝায়। কিন্তু দ্বিতীয়টা শুধু সনদ সহিহ হওয়া বুঝায়। মতন নয়।
৭/অনেক মুহাদ্দিসের নিজস্ব কিছু পরিভাষা আছে। যা জানা না থাকলে আপনি এর উদ্দেশ্য বুঝতে কখনোই সক্ষম হবেন না। যেমন, ইবনে মাইন যদি বলেন, 'হুয়া লাইসা বি-শাই' আর আপনি এর সাধারণ তরজমা 'সে কিছুই নয়' দিয়ে কথাটার অর্থ বুঝতে যান তবে ভুল করবেন। বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, তার হাদিস খুবই কম। ফলে কেমন যেন তিনি হাদিস শাস্ত্রে তেমন কিছু না। এই অর্থে কথাটা জরাহ হয় না। অবশ্য কোন রাবির ব্যাপারে যদি তিনি উক্ত মন্তব্য করার পাশাপাশি তাকে যইফও বলেন তখন আবার 'লাইসা বি-শাই' কথাটা জরাহ বলে বিবেচিত হবে। এমনিভাবে ইমাম বুখারি 'ফিহি নযর' বললে কি উদ্দেশ্য আর অন্যরা এটি বললে কি উদ্দেশ্য সেটাসহ আরো কয়েকজন ইমামের এমন সুনির্দিষ্ট পরিভাষা ও এর মর্মার্থ তুলে ধরেছেন। যেগুলো জানা না থাকলে আপনি জরাহ-তাদিলের ক্ষেত্রে নিশ্চিত ভুলের মুখে পতিত হবেন। যেমনটা বর্তমানে অনেক অদক্ষ ব্যক্তির দ্বারা ঘটে চলেছে।
৮/ একজন ব্যক্তির ব্যাপারে কারো থেকে জরাহ পেলেই লাফ দিয়ে সেটা গ্রহণ না করে অন্যান্য ইমামরা কি বলেছেন সেসবগুলো কথা সামনে রেখে পরে সিদ্ধান্তে যাওয়া।
৯/ইমাম আবু হানিফা সহ আরো বহু ফকিহকে অনেকে মুরজিয়া বলেছেন। এই শব্দটির ব্যাপকতা ও অর্থগত বৈচিত্রের সাথে পরিচিত না থাকায় অনেকে একে জরাহ মনে করে থাকেন। তারা একে বেদআতি ফেরকা মুরজিয়াদের সাথে গুলিয়ে ফেলেন। তিনি বিষয়টা নিয়ে খুব লম্বা আলোচনা করেছেন। যার সারাংশ হল, মুরজিয়া দুই ধরনের। একটা হল, মুরজিয়াতুস সুন্নাহ আরেকটা মুরজিয়াতুল বিদআহ। আবু হানীফাসহ আরো অনেককে যে মুরজিয়া বলা হয় এটা হল মুরজিয়াতুস সুন্নাহ। যার মানে হল, আমলকে ইমান থেকে পৃথক মনে করা। এখানে এই বিষয়ে তিনি আরো অনেকগুলো অর্থ বর্ণনা করেছেন। যেমন, যারা আলী রা, ও মুআবিয়া রা, এর মধ্যকার যুদ্ধের কোন পক্ষকে সঠিক না বলে নিরবতা অবলম্বন করেন তাদেরকেও মুরজিয়া বলা হয়। সুতরাং যারা এই বিষয়ে বিস্তারিত জানে না তারা মুরজিয়া শব্দটি দেখেই একে জরাহ বলে জ্ঞান করে বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়।
১০/ইবনে আদি, উকাইলি প্রমুখ মুহাদ্দিস তাদের কিতাবে যেসব বাড়াবাড়িমূলক কাজ করেছেন সেগুলো নিয়েও লেখক চমৎকার আলোচনা করেছেন। যেমন, যেসব রাবির বিষয়ে কোন না কোন জরাহ পাওয়া যায় ইবনে আদি তার গ্রন্থ 'কামেল' এর মধ্যে তাদের সকলের আলোচনা এনেছেন। ফলে বহু নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের আলোচনাও তাতে এসেছে। তার অনুসরনে ইমাম যাহাবি 'মিযানুল ইতেদাল' রচনা করেছেন। ফলে এর মধ্যেও বহু নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের আলোচনা এসেছে। তো যেহেতু এসব কিতাব রচিত হয়েছে মূলত দুর্বল রবিদের জরাহ করার জন্য তাই এসব গ্রন্থে নাম থাকায় অনেক গ্রহণযোগ্য রাবকেও অনেকে দুর্বল মনে করে বসে থাকে। অথচ ব্যাপারটি মোটেই তা নয়।
এগুলো ছাড়াও আরো অনেক বিষয়ে লেখক দারুন সব আলোচনা করেছেন। যা পড়তে পড়তে ইলমের গভীর তলদেশে হারিয়ে যেতে হয়।
টীকাকার আবদুল ফাত্তাহ সাহেব এসব আলোচনার সাথে প্রচুর পরিমানে দৃষ্টান্ত ও উদাহরণ পেশ করেছেন টীকাতে। ফলে প্রত্যেকটা বিষয় পাঠকের সামনে আরো বেশি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।
কিছু কিছু বিষয় টীকাকার বহু খাটাখাটনি করে গভীর থেকে তুলে এনেছেন টীকাতে। যেমন, কোন কোন মিযানুল এতেদালে আবু হানীফার জীবনী পাওয়া যায়। অথচ এই কিতাবটি যাহাবি রচনা করেছিলেন ব্যক্তিদের দোষ পর্যালোচনার জন্য। সুতরাং এই কিতাবে ইমাম আবু হানীফার মতো মহামতি ইমামের উল্লেখ থাকাটাও তো নিন্দনীয়। টীকাকার বহু খোঁজাখুজি করে, বিভিন্ন লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত মিযানুল ইতেদালের প্রচীন পান্ডুলিপি যাচাই করে নিশ্চিত করেছেন যে, আবু হানিফার জীবনী এই গ্রন্থে ছিল না। পরবর্তীতে কেউ তা তাতে যুক্ত করেছে। কীভাবে এটা যুক্ত হল সে রহস্যও তিনি উদ্ঘাটন করেছেন সেখানে। খুবই প্রয়োজনীয় ও চিত্তাকর্ষক বিশ্লেষন ছিল সেটি। এরচে মজার কথা হল, খোদ ইমাম যাহাবিও তার উক্ত গ্রন্থের ভূমিকাতে স্পষ্ট করে বলেছেন, আমি আবু হানিফার জীবনী উক্ত গ্রন্থে আনি নি। এটাই সবচে বড় প্রমাণ যে, এই গ্রন্থে মূলত তার জীবনী পরবর্তীতে কেউ অনুপ্রবেশ করিয়েছে।
কয়েক জায়গায় অবশ্য টীকাকার মূল লেখকের বক্তব্যের সাথে দ্বিমতও পোষণ করেছেন। যদিও তা খুবই অল্প। অত্যন্ত আদবের সাথে তিনি নিজের মত পেশ করেছেন সেসব জায়গায়।
টীকাকারের অধ্যয়নের পরিধি দেখে বিস্ময়াবিষ্ট না হয়ে পারা যায় না। প্রতিটি আলোচনাতে তিনি যে পরিমাণ দৃষ্টান্ত রিজাল শাস্ত্রের বিভিন্ন কিতাব থেকে খুঁজে খুঁজে যুক্ত করেছেন তা থেকে তার অধ্যয়নের পরিধির মোটামুটি একটা পরিচয় পাওয়া যায়।
টীকাকার আরেকটি দারুন কাজ করেছেন। সেটা হল, গ্রন্থের শেষে তিনি গ্রন্থে উল্লেখিত আয়াত, হাদিস ও মনীষীদের নির্ঘণ্ট তৈরি করেছেন। কোথায় কোথায় সেটা আলোচিত হয়েছে তার পৃষ্ঠা নং নির্দেশ করা আছে। কাজটা খুবই পরিশ্রমসাধ্য ছিল দেখলেই বুঝা যায়। এর দ্বারা খুব সহজেই কাঙ্খিত জায়গা খুঁজে বের করা সম্ভব।
বইটির ভাষা খুবই উন্নত ও চমকপ্রদ। সহজতার ভেতর দিয়েই লেখক সহিত্যনৈপুণ্য সুন্দরভাবে বজায় রেখেছেন। এমনিতেও লেখকের আরবি খুবই চমৎকার হিসেবে সুবিদিত।
জরাহ-তাদিল শাস্ত্র তার পাঠকের চিন্তাকে পরিশীলিত করে। ভাবনাকে উন্নত করে। দৃষ্টিকে পরিশোধন করে। ব্যক্তি বিচারের ক্ষেত্রে ন্যায় ও ইনসাফ শেখায়। মানবচরিত্রের সাথে পরিচয় ঘটায়। সে বিবেচনায় আহলে ইলমদের জন্য, বিশেষকরে যারা ইলমে হাদিসের প্রতি আগ্রহ রাখেন তাদের জন্য, বইটি অধ্যয়ন করা শুধু উপকারীই নয় বরং জরুরি বলা যায়।
লেখক: আবদুল হাই লাখনৌবি
টীকাকার: আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ
প্রকাশক: দারুল বাশাইর আল-ইসলামিইয়া, বৈরুত, লেবানন।
বাঙলাদেশী ছাপা: হরফ প্রকাশন, ইসলামী টাওয়ার, বাঙলাবাজার, ঢাকা-১১০০
--------------------------
জরাহ মানে হল কারো দোষত্রুটির কারণে তাকে অভিযুক্ত করা। আর তাদিল হল ভালোগুণের কারণে কারো প্রশংসা করা। হাদিস গ্রহণ-বর্জনের বিষয়টি পুরোটাই এই শাস্ত্রের উপর নির্ভরশীল।
এই শাস্ত্র নিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই উলামায়ে কেরাম কাজ করে আসছেন। তবে সেটা ছিল বিচ্ছিন্নভাবে। এই শাস্ত্রের নিয়মকানুনগুলো একমলাটের ভেতর নিয়ে এসে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনার কাজটা প্রথম করা হয়েছে আমাদের আলোচিত গ্রন্থটিতে।
লেখক আবদুল হাই লাখনৌবি একজন অনারব তথা ভারতীয় আলেম। তার জন্ম হয়েছিল ১২৬৪ হিজরীতে। আর মৃত্যু ১৩০৪ হিজরীতে। মাত্র চল্লিশ বছরের জীবদ্দশায় তিনি যে পরিমান রচনা লিখে যান তা সত্যিই বিস্ময়কর আমাদের জন্য। তার রচনাবলির প্রায় সবই শাস্ত্রগত নানান বিষয়ে।
ভারতীয় আলেম হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তার নাম ও রচনাবলির সাথে আরবদের তেমন পরিচয় ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে বিখ্যাত আরব মুহাক্কিক ও মুহাদ্দিস আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ তার কিছু রচনাতে টীকা সংযোজন করে আরব থেকে প্রকাশ করায় তিনি সহজেই ভারতের বাইরের দেশগুলোতে পরিচিতি পান। আলোচ্চ গ্রন্থটিও সেরকমই একটি টীকাযুক্ত গ্রন্থ।
জরাহ-তাদিল শাস্ত্রে এই গ্রন্থটিকে একটি আকরগ্রন্থ হিসেবে বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। এই শাস্ত্রের বহু দুর্লভ বিষয়ের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন তিনি বইটিতে। আসুন, পুরোটা সম্ভব না হলেও এর সামান্য কিছুর উপর আমরা খানিকটা নজর বুলিয়ে আসি।
শুরুতে তিনি গ্রন্থটি রচনা করার কারণ উল্লেখ করেছেন। তা হল, তিনি দেখলেন তার যুগে অনেক মানুষ জরাহ-তাদিলের কিতাবাদি থেকে ইমামদের বিভিন্ন মন্তব্য উদ্ধৃত করে যাকে ইচ্ছা তাকে প্রত্যাখ্যাত সাব্যস্ত করতেন। আবার যাকে ইচ্ছা তাকে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ করতেন। কেমন যেন এটা একটা ছেলেখেলা। এর কারণ ছিল, জরাহ-তাদিলে তাদের বুৎপত্তি না থাকা ও এই শাস্ত্রের জটিলতার সাথে পরিচয় না ঘটা। তাই তিনি এই অবস্থার সংশোধনকল্পে এই বিষয়ে একটা প্রমাণ্য ও স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নই হল আলোচ্চ গ্রন্থটি।
পুরো বইটিতে তিনি মোট পঁচিশটি 'ইকায' বা সতর্কবার্তা শিরোনাম দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হল,
১/জরাহ মানে যেহেতু হাদিস বর্ণনাকারীর ব্যক্তিদের দোষত্রুটি তালাশ করে বর্ণনা করা তাই কারো মনে সন্দেহ হতে পারে এটি গীবত হবে। আর গীবত তো হারাম। তিনি তাই প্রথম সতর্কবার্তায় দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে এই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন যে, জরাহ সেসব গীবতের অন্তর্ভুক্ত হবে যেগুলো শরীয়ত জায়েয বলে সাব্যস্ত করেছে। সুতরাং এর কারণে মুহাদ্দিসদেরকে দোষারোপ বা নিন্দনীয় কিছু বলা যাবে না।
২/ মন চাইলেই যে কেউ যে কারো জরাহ করতে পারবে না। এর জন্য পূর্বশর্ত হল, জরাহকারীকে অবশ্যই মুত্তাকী, সত্যবাদী, গোঁড়ামীমুক্ত এবং জরাহের কারণসমূহ সম্পর্কে সম্যক অবগত হতে হবে।
৩/ জরহে মুবহাম বা কারণ উল্লেখ করা ছাড়াই যদি কেউ কারো জরাহ করে তবে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে কি না এই বিষয়ে বেশ লম্বা ও বিস্তারীত আলোচনা করেছেন। টীকাকার এখানে লেখকের সাথে কিছু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন টীকাতে।
৪/যদি একই ব্যক্তিকে কেউ ভালো বলে আর কেউ খারাপ তবে সেক্ষেত্রে হুকুম কি হবে? এটা নিয়েও তিনি চমৎকার ও গোছালো আলোচনা করেছেন।
৫/অনেক ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসরা বলেন, হাদিসটি সহিহ নয়। এরদ্বারা অনেকে মনে করে যে হাদিসটি যইফ বা মওযু। লেখক এর প্রতিবাদ করে বলেন, এটা হল তাদের পরিভাষা সম্পর্কে অজ্ঞতার ফল। বরং অনেক সময় হাদিসটি সহিহ নয় বলে মুহাদ্দিস বুঝাতে চান হাদিসটি হাসান। কিন্তু টীকাকার এখানে চমৎকার একটি বিষয় সংযোজন করেছেন। তিনি বলেন, এই জাতীয় কথা যদি হুকুম সংক্রান্ত হাদিসের কিতাবের বেলায় পাওয়া যায় তবে তো লেখকের কথা ঠিকই আছে। আ যদি জালহাদিস নিয়ে রচিত গ্রন্থে মুহাদ্দিস এমন কথা বলেন তবে 'হাদিসটি সহিহ নয়' এর দ্বারা উদ্দেশ্য হয় হাদিসটি মওযু। সেখানে 'সহিহ নয়, বরং হাসান' এমনটা বুঝানো উদ্দেশ্য হয় না। এই পার্থক্যটা বহু বড় বড় লেখকও ধরতে সক্ষম হন নি।
৬/ কোন হাদিসর মান নির্ণয় করতে গিয়ে 'সহিহ' বলা আর 'সহিহুল ইসনাদ' বলার মধ্যে যে পার্থক্য তাও তিনি তুলে ধরেছেন। প্রথমটা সেই হাদিসের সনদ-মতন সব সহিহ হওয়া বুঝায়। কিন্তু দ্বিতীয়টা শুধু সনদ সহিহ হওয়া বুঝায়। মতন নয়।
৭/অনেক মুহাদ্দিসের নিজস্ব কিছু পরিভাষা আছে। যা জানা না থাকলে আপনি এর উদ্দেশ্য বুঝতে কখনোই সক্ষম হবেন না। যেমন, ইবনে মাইন যদি বলেন, 'হুয়া লাইসা বি-শাই' আর আপনি এর সাধারণ তরজমা 'সে কিছুই নয়' দিয়ে কথাটার অর্থ বুঝতে যান তবে ভুল করবেন। বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, তার হাদিস খুবই কম। ফলে কেমন যেন তিনি হাদিস শাস্ত্রে তেমন কিছু না। এই অর্থে কথাটা জরাহ হয় না। অবশ্য কোন রাবির ব্যাপারে যদি তিনি উক্ত মন্তব্য করার পাশাপাশি তাকে যইফও বলেন তখন আবার 'লাইসা বি-শাই' কথাটা জরাহ বলে বিবেচিত হবে। এমনিভাবে ইমাম বুখারি 'ফিহি নযর' বললে কি উদ্দেশ্য আর অন্যরা এটি বললে কি উদ্দেশ্য সেটাসহ আরো কয়েকজন ইমামের এমন সুনির্দিষ্ট পরিভাষা ও এর মর্মার্থ তুলে ধরেছেন। যেগুলো জানা না থাকলে আপনি জরাহ-তাদিলের ক্ষেত্রে নিশ্চিত ভুলের মুখে পতিত হবেন। যেমনটা বর্তমানে অনেক অদক্ষ ব্যক্তির দ্বারা ঘটে চলেছে।
৮/ একজন ব্যক্তির ব্যাপারে কারো থেকে জরাহ পেলেই লাফ দিয়ে সেটা গ্রহণ না করে অন্যান্য ইমামরা কি বলেছেন সেসবগুলো কথা সামনে রেখে পরে সিদ্ধান্তে যাওয়া।
৯/ইমাম আবু হানিফা সহ আরো বহু ফকিহকে অনেকে মুরজিয়া বলেছেন। এই শব্দটির ব্যাপকতা ও অর্থগত বৈচিত্রের সাথে পরিচিত না থাকায় অনেকে একে জরাহ মনে করে থাকেন। তারা একে বেদআতি ফেরকা মুরজিয়াদের সাথে গুলিয়ে ফেলেন। তিনি বিষয়টা নিয়ে খুব লম্বা আলোচনা করেছেন। যার সারাংশ হল, মুরজিয়া দুই ধরনের। একটা হল, মুরজিয়াতুস সুন্নাহ আরেকটা মুরজিয়াতুল বিদআহ। আবু হানীফাসহ আরো অনেককে যে মুরজিয়া বলা হয় এটা হল মুরজিয়াতুস সুন্নাহ। যার মানে হল, আমলকে ইমান থেকে পৃথক মনে করা। এখানে এই বিষয়ে তিনি আরো অনেকগুলো অর্থ বর্ণনা করেছেন। যেমন, যারা আলী রা, ও মুআবিয়া রা, এর মধ্যকার যুদ্ধের কোন পক্ষকে সঠিক না বলে নিরবতা অবলম্বন করেন তাদেরকেও মুরজিয়া বলা হয়। সুতরাং যারা এই বিষয়ে বিস্তারিত জানে না তারা মুরজিয়া শব্দটি দেখেই একে জরাহ বলে জ্ঞান করে বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়।
১০/ইবনে আদি, উকাইলি প্রমুখ মুহাদ্দিস তাদের কিতাবে যেসব বাড়াবাড়িমূলক কাজ করেছেন সেগুলো নিয়েও লেখক চমৎকার আলোচনা করেছেন। যেমন, যেসব রাবির বিষয়ে কোন না কোন জরাহ পাওয়া যায় ইবনে আদি তার গ্রন্থ 'কামেল' এর মধ্যে তাদের সকলের আলোচনা এনেছেন। ফলে বহু নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের আলোচনাও তাতে এসেছে। তার অনুসরনে ইমাম যাহাবি 'মিযানুল ইতেদাল' রচনা করেছেন। ফলে এর মধ্যেও বহু নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের আলোচনা এসেছে। তো যেহেতু এসব কিতাব রচিত হয়েছে মূলত দুর্বল রবিদের জরাহ করার জন্য তাই এসব গ্রন্থে নাম থাকায় অনেক গ্রহণযোগ্য রাবকেও অনেকে দুর্বল মনে করে বসে থাকে। অথচ ব্যাপারটি মোটেই তা নয়।
এগুলো ছাড়াও আরো অনেক বিষয়ে লেখক দারুন সব আলোচনা করেছেন। যা পড়তে পড়তে ইলমের গভীর তলদেশে হারিয়ে যেতে হয়।
টীকাকার আবদুল ফাত্তাহ সাহেব এসব আলোচনার সাথে প্রচুর পরিমানে দৃষ্টান্ত ও উদাহরণ পেশ করেছেন টীকাতে। ফলে প্রত্যেকটা বিষয় পাঠকের সামনে আরো বেশি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।
কিছু কিছু বিষয় টীকাকার বহু খাটাখাটনি করে গভীর থেকে তুলে এনেছেন টীকাতে। যেমন, কোন কোন মিযানুল এতেদালে আবু হানীফার জীবনী পাওয়া যায়। অথচ এই কিতাবটি যাহাবি রচনা করেছিলেন ব্যক্তিদের দোষ পর্যালোচনার জন্য। সুতরাং এই কিতাবে ইমাম আবু হানীফার মতো মহামতি ইমামের উল্লেখ থাকাটাও তো নিন্দনীয়। টীকাকার বহু খোঁজাখুজি করে, বিভিন্ন লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত মিযানুল ইতেদালের প্রচীন পান্ডুলিপি যাচাই করে নিশ্চিত করেছেন যে, আবু হানিফার জীবনী এই গ্রন্থে ছিল না। পরবর্তীতে কেউ তা তাতে যুক্ত করেছে। কীভাবে এটা যুক্ত হল সে রহস্যও তিনি উদ্ঘাটন করেছেন সেখানে। খুবই প্রয়োজনীয় ও চিত্তাকর্ষক বিশ্লেষন ছিল সেটি। এরচে মজার কথা হল, খোদ ইমাম যাহাবিও তার উক্ত গ্রন্থের ভূমিকাতে স্পষ্ট করে বলেছেন, আমি আবু হানিফার জীবনী উক্ত গ্রন্থে আনি নি। এটাই সবচে বড় প্রমাণ যে, এই গ্রন্থে মূলত তার জীবনী পরবর্তীতে কেউ অনুপ্রবেশ করিয়েছে।
কয়েক জায়গায় অবশ্য টীকাকার মূল লেখকের বক্তব্যের সাথে দ্বিমতও পোষণ করেছেন। যদিও তা খুবই অল্প। অত্যন্ত আদবের সাথে তিনি নিজের মত পেশ করেছেন সেসব জায়গায়।
টীকাকারের অধ্যয়নের পরিধি দেখে বিস্ময়াবিষ্ট না হয়ে পারা যায় না। প্রতিটি আলোচনাতে তিনি যে পরিমাণ দৃষ্টান্ত রিজাল শাস্ত্রের বিভিন্ন কিতাব থেকে খুঁজে খুঁজে যুক্ত করেছেন তা থেকে তার অধ্যয়নের পরিধির মোটামুটি একটা পরিচয় পাওয়া যায়।
টীকাকার আরেকটি দারুন কাজ করেছেন। সেটা হল, গ্রন্থের শেষে তিনি গ্রন্থে উল্লেখিত আয়াত, হাদিস ও মনীষীদের নির্ঘণ্ট তৈরি করেছেন। কোথায় কোথায় সেটা আলোচিত হয়েছে তার পৃষ্ঠা নং নির্দেশ করা আছে। কাজটা খুবই পরিশ্রমসাধ্য ছিল দেখলেই বুঝা যায়। এর দ্বারা খুব সহজেই কাঙ্খিত জায়গা খুঁজে বের করা সম্ভব।
বইটির ভাষা খুবই উন্নত ও চমকপ্রদ। সহজতার ভেতর দিয়েই লেখক সহিত্যনৈপুণ্য সুন্দরভাবে বজায় রেখেছেন। এমনিতেও লেখকের আরবি খুবই চমৎকার হিসেবে সুবিদিত।
জরাহ-তাদিল শাস্ত্র তার পাঠকের চিন্তাকে পরিশীলিত করে। ভাবনাকে উন্নত করে। দৃষ্টিকে পরিশোধন করে। ব্যক্তি বিচারের ক্ষেত্রে ন্যায় ও ইনসাফ শেখায়। মানবচরিত্রের সাথে পরিচয় ঘটায়। সে বিবেচনায় আহলে ইলমদের জন্য, বিশেষকরে যারা ইলমে হাদিসের প্রতি আগ্রহ রাখেন তাদের জন্য, বইটি অধ্যয়ন করা শুধু উপকারীই নয় বরং জরুরি বলা যায়।
পিডিএফ লিংকঃ https://archive.org/details/raftakmil8
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন