মেয়েদের জন্য অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিয়ে
প্রসঙ্গ : মেয়েদের জন্য অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিয়ে
মুফতিয়ে আজম বাংলাদেশ মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী (হাফিজাহুল্লাহ)-এর ফতোয়া
ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আবু ইউসুফ এবং ইমাম মুহাম্মাদ রহ. (তার শেষ ফায়সালা অনুসারে) বলেন, স্বাধীন ও সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন কোনো কোনো প্রাপ্তবয়স্কা নারী—চাই সে কুমারী হোক কিংবা বিবাহিত হোক, তালাকপ্রাপ্তা হোক বা বিধবা হোক—অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া সমকক্ষ পরিবারে বিয়ে করতে পারবে। তবে অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে এবং সম্মতিতে বিয়ে হওয়া সুন্নত এবং উত্তম। কিন্তু কোনো কারণবশত যদি অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে বিয়ে সম্ভাবিত না হয় তাহলে জ্ঞানসম্পন্ন ও প্রাপ্তবয়স্কা নারী তাদের অনুমতি ব্যতীত ইহকালীন ও পরকালীন কোনো কল্যাণের বিবেচনায় একাকী বিয়ে করে নিতে পারে। তার এ বিয়ে শরিয়াহর দৃষ্টিতে বৈধ বলে বিবেচিত হবে।
এ ধরনের বিয়ের দুটো দিক রয়েছে।
১. বিয়ে যদি সমকক্ষ কোনো পরিবারে হয় তাহলে এ ক্ষেত্রে অভিভাবকের উচিত, উক্ত বিয়ের বিরোধিতা না করে সম্মতি প্রকাশ করার মাধ্যমে তার অনুমোদন দেওয়া। মেয়ের ভুলের কারণে বিষয়টি ঘোলাটে করা সমীচীন নয়। কারণ, এসব ক্ষেত্রে অভিভাবকের আপত্তি করার কোনো অধিকার নেই। অধিকন্তু এ ক্ষেত্রে আপত্তি করার দ্বারা কোনো উপকার তো নেই-ই, বরং দেখা যায়, বিয়ে বিচ্ছেদ করতে গেলে দুটো পরিবারের মাঝে বৈবাহিক যে আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে, তাতে শরয়ি কোনো কারণ ছাড়াই অহেতুক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়ে নানাবিধ বিপর্যয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। এরপরও কোনো পরিবার যদি এ বিয়ে ভাঙতে চায় তাহলে তার পন্থা হলো তিনটি : স্বামী কর্তৃক তালাক, খোলা কিংবা আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ। এর বাইরে দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদ করার কোনো পন্থা নেই।
২. সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন নারী যদি অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত সমকক্ষ কোনো পরিবারে বিয়ে না করে নিম্নবর্তী কোনো পরিবারে বিয়ে করে তাহলে এ পরিস্থিতিতে হানাফি মাযহাবের স্পষ্ট মতানুসারে তাদের এ বিয়ে শরয়ি দৃষ্টিতে বৈধ এবং সম্পন্ন হয়ে যাবে। তবে অভিভাবক এতে আপত্তি করতে পারবে এবং চাইলে আদালতের মাধ্যমে এ বিয়ে বিচ্ছেদ করাতে পারবে। তবে এ প্রকারের বিয়েতে সেই মেয়ে দুটো অপরাধ করেছে :
এক. বিয়ের জন্য অভিভাবকের মধ্যস্থতা বাদ দেওয়ার মাধ্যমে শরয়ি এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি অপছন্দনীয় পদ্ধতি অবলম্বন করেছে।
দুই. অসমকক্ষ পরিবারে বিয়ে করে অভিভাবকের মানহানি করেছে।
তবে বিশেষ কোনো সমস্যা না মনে হলে অভিভাবকের জন্য এ ধরনের বিয়েকেও বহাল রাখাই উত্তম হবে।
শরিয়াহর পরিভাষায় সমকক্ষতা বলা হয় নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে পাত্র-পাত্রী সমস্তরের হওয়া। উল্লেখ্য, সমকক্ষতার বিষয়টি শুধু পুরুষের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়; নারীর বেলায় সমকক্ষতা বিবেচনা করা হয় না। উল্লেখ্য, সমকক্ষতার বিষয়টি বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার শর্তসমূহের অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং তা বিয়ের কল্যাণ ও মঙ্গলজনক দিকসমূহের একটি দিক। মেয়ে এবং তার অভিভাবকের কল্যাণার্থে এ বিষয়টিকে গ্রহণ করা হয়েছে। তাই তারা যদি কোনো কারণে নিজেদের হক এবং বাহ্যিক কল্যাণকে উপেক্ষা করে, তবে শরিয়াহ এতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। এ কারণে কোনো মেয়ে যদি পাত্রের অসমকক্ষতার বিষয়টি জেনেও ইচ্ছাকৃতভাবে নিজ সম্মতিতে তাকে বিয়ে করে নেয় তাহলে এ বিয়ে নিঃসন্দেহে শুদ্ধ এবং কার্যকর হবে।
যেসব বিষয়ে সমকক্ষতা বিবেচনা করতে হয় :
১. বংশগত সমকক্ষতা। তবে অনারবদের বেলায় বংশগত সমক্ষতার বিষয়টি প্রযোজ্য নয়।
২. সম্ভ্রান্তে সমকক্ষতা। উল্লেখ্য, সম্ভ্রান্তের ভিত্তি হলো ধার্মিকতা, স্বভাব-চরিত্রের মাধুর্য, ন্যায়পরায়ণতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি।
৩. দীনদারির মধ্যে সমকক্ষতা। এ জন্য ফাসিক, বদদীন পুরুষ নেককার নারীর সমকক্ষ নয়। পাত্রীর নিজের মাঝে এবং তার বংশের মাঝে যে পরিমাণ দীনদারি থাকবে, বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলের মাঝে এবং তার বংশের মাঝে সে পরিমাণ দীনদারি লাগবে। অন্যথায় দাম্পত্য জীবনে কলহ সৃষ্টি হবে এবং বিভিন্ন ফিতনা দেখা দেবে।
৪. পেশাগত সমকক্ষতা। নারী যদি উচ্চ পর্যায়ের পেশাজীবী পরিবারের সন্তান হয় তাহলে তার জন্য সে ধরনের বা কাছাকাছি ধরনের উচ্চ পর্যায়ের পেশাজীবী ছেলেকে বিয়ে করাই সংগত। এ ক্ষেত্রে সামাজিক বিবেচনাবোধকে আমলে নেওয়া হবে।
৫. অর্থ-সম্পদে সমকক্ষতা। অর্থাৎ নারী যদি বিত্তশালী পরিবারের হয় তাহলে ছেলেকেও বিত্তশালী পরিবারের হতে হবে। উল্লেখ্য, এ কথার অর্থ হলো, স্বামী এই পরিমাণ সচ্ছল হওয়া, যেন সে স্ত্রীর মর্যাদানুসারে তার ভরণ-পোষণ ও অন্যান্য ব্যয়ভার বহন করতে পারে; যাতে করে উভয়ের সম্প্রীতির বন্ধন অটুট থাকে এবং আর্থিক অসংগতির কারণে যেন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। ছেলের পরিবার যদি অর্থনৈতিকভাবে মেয়ের ভরণ-পোষণ এবং মোহর আদায় করতে সক্ষম না হয় তাহলে সে অসমকক্ষ বলে গণ্য হবে।
এককথায়, ছেলে যদি মেয়ের মোহর এবং তার মর্যাদানুসারে ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করার সক্ষমতা রাখে তাহলেই সে সমকক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবে। মেয়ে যদি কোটিপতি হয় তাহলে ছেলেও কোটিপতি হতে হবে, এমনটা জরুরি নয়; বরং ছেলের এ পরিমাণ শুধু এ পরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকতে হবে, যা দ্বারা সে স্ত্রীর মাপের ভরণ-পোষণ দিতে সমর্থ হয়। তেমনি মেয়ের বাবা যদি কোটিপতি হয় তাহলে ছেলেকেও কোটিপতি হতে হবে, এমনটা জরুরি নয়; বরং শুধু এ পরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকতে হবে, যা দ্বারা সে কোটিপতির মেয়েকে তার অবস্থানুযায়ী ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে পারে এবং তার মোহর আদায়ে সক্ষম হয়; যদিও সে স্ত্রীর মতো কোটিপতি নয়। এই তারতম্য হয়তো স্বামী-স্ত্রীর মাঝে হতে পারে, আবার তাদের পরিবারের মাঝেও হতে পারে। উভয় অবস্থায় যদি স্বামী স্ত্রীর ভরণ-পোষণ এবং তার মোহর আদায় করতে সক্ষম হয় তাহলেই সে উক্ত নারীর সমকক্ষ বলে বিবেচিত হবে।
উল্লেখ্য, এ সক্ষমতা কেবল বিয়ের সময় লক্ষণীয়। বিয়ের পর যে অবস্থা এবং যে ধরনের পরিস্থিতিরই সম্মুখীন হোক না কেন, অভয়ের দাম্পত্যজীবন চালিয়ে যেতে হবে।
6. স্বাধীন হওয়ার মাঝে সমকক্ষতা। অর্থাৎ স্বামী কারও অধিকারভুক্ত দাস না হওয়া।
সমকক্ষতা যাচাইয়ের অর্থ এ নয় যে, যেখানে সমতার দিকগুলো পাওয়া যাবে, একমাত্র সেখানেই বিয়ে শুদ্ধ হবে। আর যেখানে পাওয়া যাবে না, সেখানে বিয়ে শুদ্ধ হবে না। যেমন : সাধারণত অনেকে ধারণা করে যে, নিজ বংশ ও আত্মীয়-স্বজন ব্যতীত অন্য কোথাও বিয়ে করলে তা বোধ হয় শুদ্ধ হয় না। এসব ভ্রান্ত ধারণা আর সংশয়ের কোনো ভিত্তি নেই। এ কারণেই অভিভাবক এবং প্রাপ্তবয়স্কা সুস্থ নারীর সম্মতিতে যদি অসমকক্ষ পরিবারেও বিয়ে হয় তাহলে তা সম্পন্ন হয়ে যায়। সমতা যদি ফরজ বা ওয়াজিব পর্যায়ের বা অন্তত শর্তও হতো তাহলে বিয়ে সংঘটিত হতো না। কমপক্ষে তা অসম্পূর্ণ থাকত। অথচ এমনটি হয় না, বরং এমন বিয়ে শরয়ি দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য। তাই এ বিয়ে মাকরুহও হবে না।
রাসুলুল্লাহ সা.-এর মেয়েদের মধ্যে রুকাইয়া এবং উম্মে কুলসুম রা.-এর বিয়ে হয়েছে পর্যায়ক্রমে উসমান রা.-এর সাথে। অথচ তিনি রাসুলুল্লাহ সা.-এর মেয়েদের সমকক্ষ ছিলেন না। এ ছাড়াও সায়্যিদ পরিবারের মেয়েদের রাসুলুল্লাহ সা. উমাইয়া পরিবারের ছেলেদের কাছে বিয়ে দিয়েছেন।
রাসুলুল্লাহ সা. ফাতিমা বিনতে কায়স রা.-এর জন্য ঋণের ওপর বিয়ে করতে উসামা বিন যায়দ রা.-এর কাছে প্রস্তাব করেছিলেন। অথচ উসামা রা. বংশগত দিক থেকে ফাতিমা বিনতে কায়স কুরাইশি রা.-এর সমকক্ষ ছিলেন না।
সাহাবি আব্দুর রহমান ইবনু আউফ রা. নিজ বোনকে বিলাল রা.-এর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ বংশগতভাবে উভয়ের মাঝে সমতা ছিল না। একইভাবে আবু হুজাইফা রা. নিজ ভাতিজিকে তার আযাদকৃত গোলামের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন।
এ ধরনের অনেক বিয়ে খোদ রাসুলুল্লাহ সা.-এর হাতে, কোনোটি সাহাবিদের হাতে সম্পন্ন হয়েছিল। সমকক্ষতার বিষয়টি যে ফরজ বা ওয়াজিব কিছু নয়, এর পক্ষে আরও প্রমাণ হলো, ইমাম মালিক, ইমাম সুফয়ান সাওরি এবং হানাফি মাযহাবের ইমাম কারখিসহ অনেক ইমাম বিয়েতে সমকক্ষতার বিষয়টিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। তাঁরা বলেন, আরবের অনারবের ওপর কোনো মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্ব নেই। ইসলামে যদি কারও অপ্ন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব থাকত তাহলে কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী তা হতো কেবল তাকওয়া পরহেজগারি ও দীনদারির ভিত্তিতে। আর কে কত বেশি মুত্তাকি-পরহেজগার, তার সঠিক ফায়সালা হবে আখিরাতে।
স্বামী-স্ত্রীর সমতার বিষয়টি সুন্নত (গাইরে মুয়াক্কাদা) এবং মুস্তাহাব পর্যায়ের, যা উম্মতের কল্যাণার্থে শরিয়তে গৃহীত হয়েছে। সুতরাং সমকক্ষতার সবগুলো বিষয় ভাগ্যক্রমে কারও মধ্যে পাওয়া গেলে তো খুবই ভালো। এমন পরিস্থিতিতে বিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আর একান্ত না পাওয়া গেলে, যতটুকু না হলেই নয়, তা শুধু ছেলের মধ্যে পাওয়া যায় এবং সে দীন-ধর্মে মেয়ের সমকক্ষ বা তার চেয়ে উচ্চস্তরের হয় তাহলেও বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—
‘মেয়ে পাত্রস্থ করার জন্য যদি এমন পাত্র পাওয়া যায়, যার দীন-ধর্ম এবং স্বভাব-চরিত্র তোমাদের পছন্দসই হয়, তাহলে তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দাও। যদি তা না করো, তাহলে পৃথিবীতে ফিতনা হবে এবং বড় বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।’
(সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন