তাহক্বীকঃ আমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের দিকে ফিরে এলাম

ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের দিকে ফিরে এলাম
رجعنا من الجهاد الاصغر الى الجهاد الاكبر

এখানে বড় জিহাদ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে নফসের সাথে জিহাদ আর ছোট জিহাদ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে কাফেরদের সাথে জিহাদ।

জিহাদের প্রসঙ্গ আসলেই অনেক ভাইকে উক্ত কথাটি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস হিসেবে পেশ করতে শুনা যায়।

কারো কারো কথা থেকে অনুমিত হয়, জিহাদ ছেড়ে শুধু তাসাওউফে লেগে থাকাই শ্রেয়। ‌এটাই যেন হাদীসটির উদ্দেশ্য। অথচ কথাটি বাস্তবে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস কি না, আর হাদিস হলেও এর উদ্দেশ্যটা কি? এর ব্যাখ্যা কি? আমরা এগুলো তাহকিক করি না। এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করার জন্যই এই লেখার আয়োজন।

প্রথম কথা হলো, হাদিসের প্রসিদ্ধ কোনো গ্রন্থে উক্ত হাদিসটি পাওয়া যায় না। তবে ইমাম বাইহাকি রহ. তার ‌‘আয- যুহদুল কাবির’ গ্রন্থে (পৃ. ১৬৫) উল্লেখ করেন যে, হযরত জাবির রাহ. থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে একদল মুজাহিদ আসলে তিনি বললেন, তোমাদের আগমন শুভ হয়েছে। তোমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের দিকে ফিরে এসেছে। জিজ্ঞাসা করা হলো বড় জিহাদ কোনটি? উত্তরে বললেন, কুপ্রবৃত্তির সাথে জিহাদ করা।

একই সূত্রে খতিব বাগদাদি রহ. ‘তারিখে বাগদাদ’ ১৫/৬৮৫-এ এবং ইবনুল জাওযি রহ. তাঁর ‌‘‌জাম্মুল হাওয়া’ পৃ.৬৩-৬৪-এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।

সনদে ইয়াহইয়া ইবনে ইয়া‌‘লা নেহায়াত দুর্বল রাবি। কেউ কেউ তো তার ব্যাপারে মিথ্যা বলার অভিযোগও করেছেন।

ইবনে তাইমিয়া রহ. তাঁর ‘মাজমুউল ফাতাওয়া’ গ্রন্থে (১১/১১১) বলেন, হাদিসটির কোন ভিত্তি নেই, কোন আলেমই এটাকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা হিসাবে উল্লেখ করেন নি।

মাহমুদ আলুসি রহ. তাফসিরে রূহুল মাআনি এর সূরা নিসা, আয়াত-৯৬-এর বলেন, মুহাদ্দিসিনে কেরামের ভাষ্য অনুযায়ী হাদিসটি ভিত্তিহীন।

আর 'ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন' গ্রন্থে (৬/৩৯৭ মাআ ইতহাফিস সাদাহ) কথাটি সাহাবাদের বক্তব্য হিসেবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

হাফেজ ইবনে হাজার রহ. তাঁর ‘তাসদীদুল কাওস’ গ্রন্থে (نقله السيوطي في الدرر المنتثره 125 ) এটাকে ইবরাহিম ইবনে আবলা তাবেয়ির বক্তব্য বলেছেন।

একইভাবে নাসায়ি রহ.ও তাঁর ‘আল কুনা’ গ্রন্থে ইবরাহিম ইবনে আবলা’র বক্তব্য হিসেবে কথাটি উল্লেখ করেছেন যা মিজ্জি রহ. তার ‘তাহযীবুল কামাল’-এ (২/১৪৪) উদ্ধৃত করেছেন।

যাইলা‘ঈ রহ. তাখরিজুল কাশশাফ (২/৩৯৫) এ বলেন-غريب جدا হাদীসটি খুবই বিরল। তিনি বলেন, ছা‌লবী এটাকে সনদবিহীন উল্লেখ করেছেন।

এছাড়াও অনেক মুহাদ্দিস উক্ত হাদীসকে নিতান্তই দুর্বল বলেছেন, আর কেউ কেউ তো সুস্পষ্ট ভিত্তিহীন বলেছেন।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেল-

হাদিসটি মুহাদ্দিসিনে কেরামের মতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বক্তব্য হিসেবে কোন ভিত্তি নেই। বরং কারো কারো মতে এটি ইবরাহিম বিন আবলা নামক শামের এক তাবেয়ির বক্তব্য।

যদি এটাকে বাস্তবে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বক্তব্য হিসেবেই ধরে নেয়া হয় তবুও যে অর্থে এটাকে পেশ করা হয় সেটি কখনোই হাদিসের উদ্দেশ্য হতে পারে না।কারণ-

ক.
কুরআনে কারিমে সূরায়ে নিসার ৯৫ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট বলেছেন, যারা জিহাদ করে আর যারা ঘরে বসে থাকে উভয়ে সমান হতে পারে না। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীদের 'দারাজাহ' অনেক উঁচু।

ইবনে তাইমিয়া রহ. ‘মাজমূউল ফাতাওয়া’ গ্রন্থে (১১/১১১) উক্ত হাদিসকে ভিত্তিহীন উল্লেখ করে বলেন-জিহাদ হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম আমল। এরপর অন্যান্য ইবাদতের চেয়ে জিহাদের ফযিলত বেশি হওয়া সংক্রান্ত আয়াত ও হাদিস পেশ করেন।

খ.
এখানে লক্ষণীয় আরেকটি বিষয় হচ্ছে, নফসের সাথে মুজাহাদা করার প্রয়োজন সাধারণত নফসের অপছন্দ বস্তুর ক্ষেত্রেই হয়; নফস চায় এগুলো করতে তখন খুবই কষ্ট করে নফসকে বারণ করতে হয়। আর জিহাদ হচ্ছে নফসের কাছে খুবই অপছন্দনীয় এবং অপ্রিয়। আল্লাহ তাআলা সূরা বাকারার ২১৬ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ ‘ তোমাদের উপর জিহাদ ফরজ করা হয়েছে অথচ এটি তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়।

তাই যারা জিহাদ করবে একই সাথে তাদের নফসের সাথেও জিহাদ হচ্ছে আবার কাফেরদের সাথে শারীরিক জিহাদ হচ্ছে। সুতরাং যারা কাফেরদের সাথে জিহাদে যায় নি তাদের একথা বলার সুযোগ নেই, যারা জিহাদে রয়েছে তাদের তুলনায় আমরা বড় জিহাদ নিয়ে বসে আছি।

হ্যাঁ, যারা জিহাদও করে আবার জিহাদ শেষে বাড়িতে এসেও নিজের নফসের সাথে মুজাহাদায় মগ্ন থাকে, কখনো নফসের ইচ্ছাকে পূরণ করে না, এমন ব্যক্তি তার দুই অবস্থার মাঝে তুলনা করে বলতে পারে, ময়দানে গিয়ে জীহাদের চেয়ে সবসময় নফসকে কুপ্রবৃত্তি থেকে বারণ করাই বেশি কষ্ট দায়ক, বেশি বড়।

প্রতিদানের দিক দিয়ে নয়; বরং কষ্টের দিক দিয়ে বেশি বড়। কেননা জিহাদ তো হয় অল্প সময়ের জন্য।আর নির্ধারিত একটি সময়ে কোনো কাজ সম্পাদন করার তুলনায় সর্বদা কোনো কাজে লেগে থাকা অনেক কঠিন। তাছাড়া জীহাদ যদিও আল্লাহর বিধান হিসেবে নফসের কাছে অপছন্দনীয় তথাপি দুশমকে পরাজিত করার জন্য নফসের একটি আগ্রহ থাকে যা সব সময় নামায রোযা ইত্যাদি আদায়ের ক্ষেত্রে থাকে না।

গ.
হাদিসটি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐসকল সাহাবীদেরকে বলেছেন যারা জিহাদ থেকে সবেমাত্র ফিরে এসেছেন; যারা একই সাথে কাফেরদের সাথেও জিহাদ করেছেন আবার নফসের সাথেও জিহাদ করেছেন। আমরা যারা জিহাদে না গিয়ে শুধুই নফসের জিহাদে বসে আছি আমাদের জন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসটি প্রযোজ্য নয়।

ঘ.
এই ব্যাখ্যার প্রয়োজন তখনই পড়বে যদি এটাকে বাস্তবে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস হিসেবে ধরে নেয়া হয়। ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে মুহাদ্দিসিনে কেরাম এটাকে ভিত্তিহীন বলেছেন। সুতরাং এসব ব্যাখ্যারও প্রয়োজন নেই।

------------------
লিখেছেনঃ Mahbubul Hasan Arife

মন্তব্যসমূহ

এই সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

ডাউনলোড করুন মাকতাবায়ে শামেলা লেটেস্ট ভার্শন (মোবাইল এবং পিসির জন্য)

রুকইয়াহ আশ-শারইয়্যাহ (ডাউনলোড)

ইসতিখারার সুন্নত তরিকা + pdf