শবে বরাত; ফাযায়েল, মাসায়েল, কুসংস্কার এবং কিছু কথা...

শবে বরাত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আমার শাবান ও শবে বরাত গ্রন্থে রয়েছে। ফেসবুকের পাঠকদের সুবিধার্থে বিভিন্ন পর্বে ভাগ করে এ সংক্রান্ত কয়েকটি পোস্ট দিয়েছিলাম। দীর্ঘ একটি নোট দেওয়ার অাবদার করেছিলেন অনেক ভাই। তাদের আবদার রক্ষার্থে এটি দেওয়া হল। বাকি বিস্তারিত অালোচনা পড়ুন 'শাবান ও শবে বরাত' গ্রন্থে।


আল্লাহ তাআলা শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উম্মতকে একটি মধ্যপন্থি উম্মত বানিয়েছেন। কোরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-‘এভাবেই আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি, যাতে তোমরা অন্যান্য লোক সম্পর্কে সাক্ষী হও এবং রাসূল হন তোমাদের পক্ষে সাক্ষী।’ (সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৪২) অর্থাৎ অন্যান্য উম্মতের তুলনায় এই উম্মতকে সর্বাপেক্ষা মধ্যপন্থী ও ভারসাম্যপূর্ণ উম্মত বানিয়েছেন। তাই এ উম্মতকে এমন বাস্তবসম্মত বিধানাবলী দেওয়া হয়েছে, যা কিয়ামত পর্যন্ত মানবতার সঠিক দিক-নির্দেশনা করতে সক্ষম। অন্যান্য উম্মতের মতো মুসলমানদেরকে এমন বিধান দেয়া হয় নি, যা অতি কঠিন কিংবা অতি শিথিল। আবার এই উম্মত বিশ্বাস কিংবা কর্মে অথবা ইবাদতে মোটকথা সর্বক্ষেত্রেই ভারসাম্যপূর্ণ। তারা পূর্ববর্তী উম্মতের মতো আল্লাহর জন্য সন্তান সাব্যস্ত করে নি; নবীদেরকে হত্যা করে নি; আল্লাহর কিতাব পরিবর্তন করে নি। বুঝা গেলো সর্বক্ষেত্রেই ভারসাম্যতার পরিচয় দেয়া এই উম্মতের বৈশিষ্ট্য। সুতরাং ধর্মীয় সকল বিধান পালনের ক্ষেত্রে একথা ভুললে চলবে না যে, আমরা হচ্ছি মধ্যপন্থি জাতি। আমাদের পক্ষ থেকে যাতে কোন ধরণের বাড়াবাড়ি কিংবা শিথিলতা প্রকাশ না হয়, এ বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে। সামনে শবে বরাত। অত্যান্ত দু:খজনক একটি বাস্তবতা হলো, এই শবে বরাতকে কেন্দ্র করে এতদিন কিছু লোক বাড়াবাড়ির শিকার ছিলো; তারা বিশেষ পদ্ধতির নামায আবিস্কার করেছিলো। যেমন দু’রাকাত করে চার রাকাত নামায পড়তে হবে, প্রতি রাকাতে সূরা ফাতেহার পর পঞ্চাশ বার সূরা ইখলাস পড়তে হবে, নামায শেষে একশত বার দরূদ পাঠ করে মুনাজাত করতে হবে। এভাবে করতে পারলে পঞ্চাশ বৎসরের গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে। এরকম বিভিন্ন প্রকারের ভিত্তিহীন নামাযের পাশাপাশি নানান ধরণের কুসংস্কার আমাদের সমাজে প্রচলিত ছিল। এসকল কুসংস্কার তো দূর হয়নি কিন্তু নতুন আরেকটি রোগ দেখা দিয়েছে; ছাড়াছাড়ির রোগ। এই ফিৎনায় পতিত ভাইদের পরিস্কার কথা, শবে বরাতের কোন ফযীলত সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। শবে বরাত সম্পর্কিত ঐসকল কুসংস্কার দূর হওয়া যেমন প্রয়োজন তেমনিভাবে এই বিভ্রান্তির নিরসন হওয়াও প্রয়োজন। এজন্যই এই ক্ষুদ্র লেখাটির আয়োজন। সংক্ষেপে এ বিষয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। বিস্তারিত আলোচনা পাঠকগণ আমার তত্ত্ব সমৃদ্ধ গ্রন্থ ‘শা’বান ও শবে বরাত’ থেকে দেখে নিবেন। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন। আমীন।
বিভ্রান্তির নিরসন: শবে বরাত তথা অর্ধ শাবানের রাত হচ্ছে বছরের অন্যান্য সাধারণ রাতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত। নির্ভরযোগ্য হাদীসে এ রাতের গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের কিছু ভাই এ রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করেন। তাদের সাফ কথা, এ রাতের কোন গুরুত্ব নেই। বছরের অন্যান্য রাতে যাদের ইবাদতের অভ্যাস নেই তারা এ রাতে ইবাদত করলে বিদআত হবে। তারা বিভিন্নভাবে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে থাকেন। তাদের বিভ্রান্তির মধ্যে একটি হচ্ছে যে, অর্ধ শা’বানের রাতের আমল ৪৪৮ হিজরীতে উৎপত্তি হয়, এর আগে অর্ধ শা’বানের রাতে কোন ইবাদত পালন করা হতো না। সুতরাং এ রাতে ইবাদত করা বিদআত। কেননা ‘খাইরুল কুরূনে’র পরবর্তী সৃষ্ট সবকিছুই তো বিদআত। এক্ষেত্রে তারা তারতুশী রহ. এর একটি বক্তব্য উল্লেখ করে থাকেন। তাদের এধরণের বক্তব্য শুনে প্রথমে খুবই কৌতূহলী ছিলাম। যে রাতের ফযীলতের কথা সহীহ হাদীসে এসেছে, যে রাতের ইবাদতের প্রতি যুগশ্রেষ্ট উলামা, ফুকাহা ও মুহাদ্দিসগণ গুরুত্বারূপ করেছেন এবং মুস্তাহাব বলেছেন, সেই রাতের ইবাদত পাঁচশত শতাব্দির উৎপত্তি!! খুবই আশ্চর্যের বিষয়! একসময় পৌঁছে গেলাম তারতুশী রহ. কিতাব ‘মুখতাসারুল হাওয়াদিছি ওয়াল বিদা’ পর্যন্ত। সেখানে তাঁর বক্তব্য পড়ে তো আমি হতবাক! তিনি কী বলেছেন আর তারা কি বলে বিভ্রান্ত করছে! তাদের কথার সাথে তারতুশী রহ. এর বক্তব্যের কোন মিল খোঁজে পেলাম না। দেখুন, তিনি কী বলেছ-‘‘আবু মহাম্মদ মাকদিসী আমাকে জানিয়েছেন যে, এই ‘সালাতুর রাগাইব’ যা রজব এবং শা’বানে পড়া হয় তা ‘বাইতুল মুকাদ্দাসে’ ছিল না। সর্বপ্রথম এটি চালু হয় ৪৪৮ হিজরির শরুর দিকে। ‘ইবনু আবিল হামরা’ নামে পরিচিত ‘নাবুলুস’ এর এক ব্যক্তি বাইতুল মুকাদ্দাসে আমাদের কাছে আসে। সে সুন্দর তেলাওয়াত করতে পারত। অর্ধ শা’বানের রাতে ‘মসজিদে আকসা’য় সে নামায পড়ল। তার পিছনে আরেকজন তাহরিমা বাঁধল এরপর তৃতীয় আরেকজন এরপর চতুর্থ আরেকজন এভাবে নামায শেষ করতে করতে দেখা গেল অনেক লোকের জামাত। পরবর্তী বছর আবার আসল এবং তার সাথে অনেক লোক নামায পড়ল একসময় এই নামাযটি মসজিদে ছড়িয়ে পড়ল। এমনকি মসজিদে আকসাসহ মানুষের ঘর-বাড়িতেও নামাজটি প্রচার লাভ করল। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত এটি এমনভাবে স্থির হয়ে গেল যেন এটিই নিয়ম।! (মুখতাসারুল হাওয়াদিছি ওয়াল বিদা, তারতুশী, পৃ. ৮৬-৮৭) এই হচ্ছে তারতুশী রহ. এর বক্তব্য। দেখুন, কিভাবে তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন! তারতুশী রহ. কথা থেকে একথা কি বুঝা গেল যে অর্ধ শা’বানের রাতের সকল ইবাদত ৪৪৮ হিজরীতে উৎপত্তি লাভ করেছে? কখনো নয়। তিনি শুধু বিশেষ পদ্ধতির ভিত্তিহীন নামাযের ইতিবৃত্ত তুলে ধরেছেন। মুহাদ্দিসীনে কেরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হচ্ছে শবে বরাতে বিশেষ পদ্ধতির নামায যেমন এতো রাকাত পড়তে হবে, প্রতি রাকাতে সূরা এখলাছ এতো বার পড়তে হবে, এধরণের বিশেষ পদ্ধতির কোন নামায নেই। এসংক্রান্ত সকল হাদীস সম্পর্কে তাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, এগুলো জাল, এগুলোর কোন ভিত্তি নেই। তারতুশী রহ. সেই ভিত্তিহীন নামাযের ইতিবৃত্ত তুলে ধরেছেন আর আমাদের ‘লা মাযহাবী’ ভাইয়েরা তাঁর কথাকে পুঁজি করে আমাদেরকে বিভ্রান্ত করছেন এই বলে যে, অর্ধ শা’বানের সকল ইবাদত চারশত শতাব্দির পরের উৎপত্তি! অথচ যেসকল মুহাদ্দিসগণ এই ‘সালাতুর রাগাইব’ নামক বিশেষ পদ্ধতির নামাযকে ভিত্তিহীন বলেছেন তারাই বলেছেন, কোন বিশেষ পদ্ধতি নির্ধারিত না করে নফল নামায পড়া, দুআ-দরূদ, যিকির-আযকার, তেলাওয়াতে কোরআন ইত্যাদি করা এ রাতে মুস্তাহাব। তাদের কথার উদ্দেশ যদি হয়, দলবদ্ধ হয়ে মসজিদে গিয়ে এ রাতের ইবাদত শুরু হয়েছে ৪৪৮ হিজরীতে, তবুও তাদের কথা সঠিক হবে না। কেননা ফাকিহী রহ. (২১৭-২৭৫হি:) ‘আখবারে মাক্বা’ গ্রন্থে (৩/৮৪) আহলে মাক্কার আমল এই বলে উল্লেখ করেছেন- ‘‘অতীত কাল থেকে আজ পর্যন্ত আহলে মক্কার আমল চলে আসছে যে, অর্ধ শা’বানের রাতে সাধারণ নর-নারী মসজিদে বের হতো অতঃপর নামায পড়তো, তাওয়াফ করতো এবং পুরো রাত ইবাদত করে কাটাতো। সকাল পর্যন্ত মসজিদে হারামে কোরআন তেলাওয়াত এবং কোনআন খতম করতো আর নামায পড়তো। যারা নামায পড়তো প্রতি রাকাআতে ‘আল হামদু’ পড়তো এবং দশবার ‘কুল হুয়াল্লাহ’ পড়তো। আর যমযমের পানি পান করতো এবং তা দিয়ে গোসল করত আর অসুস্থদের জন্য তা জমা করে রাখতো। উদ্দেশ্য এ রাতের বরকত অর্জন করা।’’ (আখবারে মাক্বা: ৩/৮৪) বুঝা গেল, অর্ধ শা’বানের রাতে দলবদ্ধ ইবাদতের এই বিদআতের সূচনা ৪৪৮ হিজরীরও আগে হয়েছে। কেননা ফাকিহী রহ. আনুমানিক ২৭৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন সুতরাং বুঝা গেল আহলে মাক্কা ২৭৫ হিজরীর আগেই এই ভিত্তিহীন নামায এবং পুরুষ-মহিলা মসজিদে গিয়ে দলবদ্ধ ইবাদতে অভ্যস্ত ছিল। যাই হোক, আহলে মাক্কা যেভাবে এই রাতটি উদযাপন করত বা বাইতুল মুকাদ্দাসে যেভাবে জড়ো হয়ে বিশেষ পদ্ধতির নামায পড়া হতো এটি তো শরীয়ত-স্বীকৃত অর্ধ শা’বানের আমল নয়। আমরাও এটিকে সঠিক বলছি না। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, অর্ধ শা’বানের রাতে কোন ইবাদতই করা যাবে না; বরং এ রাতে একাকী নামায তেলাওয়াতে কোরআন, দুআ ইত্যাদি করা মুস্তাহাব। কেউ কেউ বলেন, এ রাতে ইবাদতের সূচনা হয়েছে শামের কিছু তাবেয়ীনদের মাধ্যমে। কিন্তু যাচাই করে দেখা যায় তাদের বক্তব্য সঠিক নয়। বরং শামের কিছু আলেম সমজিদে জড়ো হয়ে ইবাদতের পক্ষে মত দিয়েছিলেন এবং নিজেরাও এভাবে ইবাদত করা শুরু করেছিলেন তখন অন্যান্য আলেমগণ তাদের বিরোধিতা করেন এবং জড়ো না হয়ে একাকী ইবাদতের পক্ষে মত দেন। শামের প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিস আওযায়ী রহ. (১৫৭ হি.) মতও তাই ছিল। বিষয়টি ইবনে হাজার হাইতামী রহ. (৯০৯-৯৭৪ হি.) এর বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি শামের ঐ সকল ফুকীহদের শবে বরাত উদযাপনের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ‘‘এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এই বিশেষ পদ্ধতিতে জড়ো হওয়া এমন নবসৃষ্ট বিষয় যা শরীয়তে ছিল না। সুতরাং যেই এমন কাজ করবে তার এই কাজ নবীজীর হাদীস অনুযায়ী প্রত্যাখ্যাত হবে। কেননা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি শরীয়তে এমন জিনিস সৃষ্টি করবে যা এতে ছিল না তা প্রত্যাখ্যাত হবে। তিনি বলেন, সম্ভবত তাদেরকে এই কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষে যে সকল জাল হাদীস বর্ণিত হয়েছে এগুলো। তারা এগুলো জাল মনে করেন নি তাই এগুলোর উপর আমল করেছেন আর অসংখ্য মানুষ তাদের অনুসরণ করেছে। পরবর্তীতে যখন একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, এগুলো (এ সকল হাদীস) নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে মিথ্যারোপ করা হয়েছে তখন উলামাগণ এগুলো পরিত্যাগ করলেন এবং কঠিনভাবে প্রত্যখ্যান করলেন আর নিন্দাজ্ঞাপন করলেন।’’ (আল ঈযাহ ওয়াল বায়ান, ইবনে হাজার হাইতামী [মাখতুত] হাইতামী রহ.এর উপরোক্ত বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয়ের সমাধান পাওয়া গেল: ক. বুঝা গেল, অর্ধ শাবানের রাতে ইবাদতের সূচনা শামের ঐ সকল আলেমদের থেকে হয় নি, বরং তাদের নতুন উদ্ভাবিত বিষয় ছিল মসজিদে বিশেষ পদ্ধতির জড়ো হওয়া। খ. হাইতামী রহ. কথা থেকে আরেকটি বিষয় বুঝা যায় যে, তাদের নবসৃষ্ট বিষয়ের মধ্যে বিশেষ পদ্ধতির ভিত্তিহীন নামায অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ সূরা দিয়ে নির্ধারিত সংখ্যক নামাযও ছিল। কেননা তিনি বলেছেন তাদেরকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষে বর্ণিত হাদীসগুলো। আর দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষে তিনি বিশেষ পদ্ধতির নামায সংক্রান্ত জাল হাদীসগুলো উল্লেখ করেছেন। ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, মুহাদ্দেসীনে কেরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এধরণের নামায সংক্রান্ত হাদীসগুলো ভিত্তিহীন। সুতরাং এধরণের বিশেষ পদ্ধতির নামায মসজিদে জড়ো হয়ে পড়েছেন এজন্যেই উলামাগণ তাদের এ কাজের বিরোধিতা করেছেন। গ. হাইতামী রহ. এর বক্তব্য থেকে আরেকটি বিষয় সুস্পষ্ট হলো, তা হচ্ছে যেসকল আলেমদের ব্যাপারে বলা হয় তারা অর্ধ শাবানের রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করেছেন তাদের এই অস্বীকারের অর্থ হয়তো এ রাতের বিশেষ পদ্ধতির নামযকে অস্বীকার করা অথবা মসজিদে জড়ো হয়ে ইবাদত করা ইত্যাদি। একাকী ইবাদত করার বিষয়টি তারা অস্বীকার করেন নি। ইবনে হাজার হাইতামী রহ. নিজেও এ রাতে দুআ, ইস্তিগফার, কান্নাকাটি করার কথা বলেছেন। সারকথা: অর্ধ শা’বানের রাতে দলবদ্ধ ইবাদত কিংবা ‘সালাতুর রাগাইব’ এর সূচনা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন যায়গায় হয়েছে। উপরের আলোচনা থেকে বিষয়টি সুস্পষ্ট বুঝা গেল। তবে মসজিদে জড়ো না হয়ে একাকী এ রাতে বিশেষ গুরুত্বের সাথে ইবাদত করার নিয়ম নবীজী এবং সাহাবীদের পরবর্তী যুগের সৃষ্ট নয় বরং যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন অর্ধ শা’বানের রাতের ফযীলতের কথা উল্লেখ করেছেন তখন থেকেই এর সূচনা হয়ে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
শবে বরাত ফযীলত প্রসঙ্গে নবীজীর বাণী: শবে বরাতের ফযীলত প্রসঙ্গে হযরত মুআয রা. এর হাদীসটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- يَطْلُعُ اللَّهُ إِلَى خَلْقِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ. ‘‘আল্লাহ তাআলা অর্ধ শা‘বানের রাতে (শা‘বানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’’ সহীহ ইবনে হিব্বান: ১২/৪৮১, হাদীস নং-৫৬৬৫; শুআবুল ঈমান, বাইহাকী: ৫/৩৬০, ৯/২৪; আল মু‘জামুল কাবীর, তাবারানী: ২০/১০৯; আল মু‘জামুল আওসাত, তাবারানী, হাদীস ৬৭৭৬; আস সুন্নাহ, ইবনে আবী আসেম, হাদীস ৫১২) হাদীসটির সনদ সহীহ এজন্যই ইমাম ইবনে হিব্বান রহ. (৩৫৪ হি.) এটিকে তাঁর ‘কিতাবুস সহীহ’ তথা সহীহ ইবনে হিব্বান এ বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ হাদীসটিকে পারিভাষিক দৃষ্টিকোন থেকে ‘হাসান’ বলেছেন কিন্তু ‘হাসান হাদীস’ ‘সহীহ’ তথা নির্ভরযোগ্য হাদীসেরই একটি প্রকার। ইবনে হিব্বান রহ. ছাড়াও হাদীসের অনেক ইমাম যেমন ইমাম বাইহাকী (৪৫৮ হি.) মুনযিরি (৬৫৬ হি.) ইবনে রজব (৭৯৫ হি.) ইরাকী (৮০৬ হি.) নূরুদ্দীন হাইছামী (৮০৭ হি.) ইবনুল ওয়াযীর (৭৭৫-৮৪০ হি.) ইবনে হাজার হাইতামী (৯০৯-৯৭৪ হি:) যুরকানী (১১২২ হি.) এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদ উক্ত হাদীসকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। এমর্মে হযরত মুআয রা. ছাড়াও অসংখ্য সাহাবী থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন সাহাবী ও তাবেয়ী থেকেও এমর্মে অনেক আছার রয়েছে। মুআয রা. এর হাদীস সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনে কেরামের বক্তব্য: • قال البيهقي في الشعب ٥/٣٦۰: أن للحديث أصلا من حديث مكحول. • قال المنذري في الترغيب صـ ١۰٢٧:رواه الطبراني في الأوسط وابن حبان في صحيحه والبيهقي ورواه ابن ماجه بلفظه من حديث أبي موسى الأشعري والبزار والبيهقي من حديث أبي بكر الصديق بنحوه باسناد لا بأس به. • وقال الهيثمي في مجمع الزوائد ٨/١٢٦: رواه الطبراني في الكبير والأوسط ورجالهما ثقات. • وحسنه العراقي كما في ((شرح المواهب)) للزرقاني ٧/٤١٢. (نقله الشيخ محمد عوامة حفظه الله تعالى . انطر المصنف ١٥/٤۰٥) • وحسنه أيضا ابن رجب؛ كما في ((شرح المواهب اللدنية)) للزرقاني ٧/٤٧٣ (انظر حسن البيان لابوعبيدة مشهور صـ١٨( • قال ابن الوزير في إيثار الحق على الخلق صـ٣٨٥ : رجاله ثقات. • قال العلامة ابن حجر الهيتمي في الززاجر: باسناد لا بأس به. نقله الشريف الصبيح في ليلة النصف صـ٧٢ • قال الزرقاني في شرح المواهب ١۰/٥٦١: فإن ابن حبان قد صححه وكفى به اعتمادا. وقال أيضا: فإن حديث معاذ هذا حسن. • قال الشيخ عوامه حفظه الله تعالى بعد ذكر طائفة من أحاديث ليلة النصف من شعبان: قلت: هذه الأحاديث-وغيرها- وإن كان في كل منها مقال إلا أنها تتقوى ببعضها ولا ريب، بل حديث معاذ بمفرده حسنه العراقي كما في ((شرح المواهب)) للزرقاني ٧/٤١٢. ونقل الشيخ جمال الدين القاسمي في ((إصلاح الساجد)) ص ٣۰٧ عن بعضهم أنه لا يصح في فضل ليلة النصف من شعبان حديث: فهو-على غموضه-غير سديد، وما هو إلا منافرة منه رحمه الله لما عليه جمهرة المسلمين من تكريم هذه الليلة. (انظر:المصنف ١٥/٤۰٥) বর্তমান সময়ের প্রসিদ্ধ শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. যিনি আমাদের লা মযাহাবী ভাইদের কাছে খুবই সমাদৃত, তিনি তাঁর ‘সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহা’ গ্রন্থে (৩/১৩৫-১৩৯) উক্ত হাদীসের সমর্থনে আরো সাতটি হাদীস উল্লেখ করে বলেন- جملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلا ريب. والصحة تثبت بأقل منها عددا، ما دامت سالمة من الضعف الشديد، كما هو الشأن في هذا الحديث. ‘এসব রেওয়ায়াতের মাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে এই হাদীসটি নি:সন্দেহে ‘সহীহ’ প্রমাণিত হয়।’ এরপর শায়খ আলবানী রহ. ঐসব লোকের বক্তব্য খন্ডন করেন যারা কোন ধরনের খোঁজখবর ছাড়াই বলে দেন যে, শবে বরাতের ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেই। তিনি বলেন, ‘হাদীস তো এরচেয়ে কম সংখ্যক সনদের দ্বারাই সহীহ প্রমাণিত হয়ে যায়, যদি কঠিন দুর্বল না হয়, যেমন উপরোক্ত হাদীস।’ সমসাময়িক আরেকজন আলেম, অসংখ্য কিতাবের মুহাক্বিক শায়খ শু‘আইব আল আরনাউত, তিনি সহীহ ইবনে হিব্বানে হাদীসটির তাখরীজে বলেন, তার সমর্থক অন্যান্য হাদীসের কারণে এটি ‘সহীহ’। অর্ধ শা‘বানের রাতে আল্লাহপাকের দুনিয়ার আসমানে নাযিল হওয়া সংক্রান্ত হাদীস ঐসকল ভাইদেরও অনেকেই সহীহ বলে থাকেন যারা শবে বরাতের ফযীলতকে অস্বীকার করেন। উক্ত হাদীস এবং প্রতিদিন আল্লাহ পাকের দুনিয়ার আসমানে নাযিল হয়ে বান্দাকে ডাকা সংক্রান্ত হাদীস দু’টিকে সামনে রেখে মুহাদ্দিসগণ বলেছেন যে, প্রতিদিন আল্লাহ পাকের নুযূল (দুনিয়ার আসমানে অবতরণ) হয় এরপরও অর্ধ শা‘বানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন এতে ঐদিনের নুযূলের বিশেষ গুরুত্ব বুঝায়। ‘লা মাযহাবী’ শায়খ আকরামুজ্জামান সাহেব দা. বা. বিষয়টি খুবই সুন্দর করে বুঝিয়েছেন। তিনি তাঁর ‘শবে বরাত সমাধান’ গ্রন্থে (পৃ.৯) বলেন- ‘‘এই রাত্রিতে নাযিল হওয়া অন্যান্য রাত্রিতে নাযিল হওয়ার মতই। কোন দিক দিয়ে রাত্রিটির গুরুত্ব থাকার কারণে বিশেষভাবে এই রাত্রিতে নাযিল হওয়ার কথা পূনরাবৃত্তি করা হয়েছে। যেমন আমরা প্রতিষ্ঠানের কোন সদস্যকে চিঠি লিখার সময় পরিচিত অন্যান্যদেরকে সালাম ও আন্তরিকতা জানানোর জন্য লিখে থাকি ‘আব্দুল্লাহ, সালীম ও আব্দুর রহীমসহ বাড়ির বা প্রতিষ্ঠানের সকলকে আমার সালাম ও আন্তরিকতা জানাবেন। এই সালাম দান ও আন্তরিকতা জানানোর ক্ষেত্রে সকলকে সমান করা হয়েছে কিন্তু ঐ তিনটি নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তার নিকট তাদের গুরুত্ব একটু বেশী হওয়ার কারণে বা ওদেরকে খুশি করতে পারলে কোন স্বার্থ উদ্ধার হবে বলে। তিনি বলেন, হতে পারে বিশেষভাবে এই রাতে আল্লাহর নিম্নের আসমানে অবতীর্ণ হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এই জন্য যে, আমরা যাতে সতর্ক হই, গাফলতী ও আলস্যতার ঘুম থেকে জাগ্রত হই। যেন বলা হয় যে, হে বান্দা বছরের প্রতিটি রাত্রের, শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ নেমে আসেন ক্ষমা দানের জন্য, আবেদন কবুল করার জন্য, আশা পূরণ করার জন্য কিন্তু এ সুযোগ হেলায় হেলায় হারিয়েছো, আর নয়, এবার ব্যাপকহারে পুণ্য অর্জনের মৌসুমটি (রমযান মাস) নিকটবর্তী হয়েছে, শা‘বানের অর্ধাঅর্ধি হয়ে গেল, এবার ফিরে এসো সুযোগের সৎ ব্যবহার কর আর ঠেলে রেখ না, আল্লাহ রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশে নেমে এসে সে সুযোগ সুবিধা বিতরণ করে থাকেন, উহা গ্রহণে ব্যস্ত হও।’’ দেখুন, কি সুন্দর করে তিনি বুঝিয়ে দিলেন এ রাতের গুরুত্বের কথা। আচ্ছা আল্লাহ যখন গাফলতের ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার জন্য ডাকলেন তখন আমাদের কি ইবাদত ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা উচিত? না ইবাদতে আরো বেশি মনোনিবেশ করা উচিত? তাহলে আমি সেই উচিৎ কাজটি করলে বিদ‘আত হয়ে যায় কিভাবে?! বিষয়টি আরেকটি উদাহরণ দিয়ে বুঝা যেতে পারে। মনে করুন, একটি সভার পোষ্টারে কয়েকজন আলোচকের নাম উল্লেখ করা হলো, শেষে বিশেষ আকর্ষণ বলে আরেকজনের নাম উল্লেখ করা হলো। এর উদ্দেশ্য কি এটা যে, সবার আলোচনা শুনলেও বিশেষ আকর্ষণে যার নাম লেখা আছে তাঁর আলোচনা শুনা যাবে না! না এর উদ্দেশ্য এই যে অন্যান্যদের আলোচনা না শোনলেও বিশেষ আকর্ষণ বক্তার আলোচনা যেন অবশ্যই শোনা হয়। অর্ধ শা‘বানের বিষয়টিও এমনি। অর্থাৎ পুরো বছর গাফেল থাকলেও এ রাতে যেন কেউ গাফেল না থাকে। এজন্য প্রতি রাতের কথা উল্লেখ করার পর বিশেষভাবে এ রাতের কথা উল্লেখ করেছেন। বুঝা গেল, এ রাতের ইবাদত বিদ‘আত হবে তো দূরের কথা, ইবাদত না করাটাই দোষণীয়। সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ পাক এ রাতে তাঁর সকল মাখলুককে ক্ষমা করে দেন, মুশরিক এবং বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত। উক্ত হাদীসকে মুহাদ্দিসগণ তো সহীহ বলেছেন আমাদের দেশের বেশিরভাগ ‘লা মাযহাবী’ ভাইয়েরাও এটাকে সহীহ মানেন। তবে সাথে একথা বলেন যে, উক্ত হাদীসে কোন আমলের কথা বলা হয়নি। হাদীসে বলা হয়েছে সবাইকে ক্ষমা করে দেবেন সুতরাং কোন আমল না করে ঘুমিয়ে থাকলেও ক্ষমা করে দেবেন। কেউ কেউ তো আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলেন, যে ব্যক্তি এ রাতে শিরিক এবং বিদ্বেষমুক্ত থেকে ঘুমিয়ে থাকল সে ক্ষমা পেল। ক্ষমা পেল না কে? যে সারারাত ইবাদত করল নামায পড়ল! কারণ সে ইবাদত করে বিদ‘আত করেছে আর বিদ‘আতের কারণে সওয়াব তো পাবেই না উল্টো গোনাহ হবে! নাউযুবিল্লাহ। দেখুন, কিভাবে তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। আল্লাহ পাক যদি এমনিতেই ক্ষমা এবং রহমত বর্ষণ করেন, তাহলে যারা ক্ষমা এবং রহমতের প্রত্যাশা করবে তাদেরকে কি পরিমাণ ক্ষমা এবং রহমত বর্ষণ করা হবে! মনে করুন, কিছু লোককে পুরষ্কার দেয়ার সিদ্ধান্ত হলো। পুরষ্কার পাওয়ার উপযুক্ত লোকদের মধ্যে দু’ধরণের লোক পাওয়া গেল। কিছু লোক পুরষ্কার পাওয়ার জন্য সকল শর্ত পূরণ করে পুরষ্কার প্রাপ্তির অপেক্ষায় আছে এবং এই ভয়ে আছে যে, তাদের কোন ভুলের কারণে যেন তাদেরকে পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত করা না হয়। আরেকদল হলো, যারা মুখে না বললেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে, পুরষ্কারের প্রতি তাদের কোন আগ্রহ নেই। উভয়ই কি সমান? পুরষ্কার-দাতা কি এই দ্বিতীয় দলের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন? এমনও কি হতে পারে না যে, তাদের এই অনিহার কারণে তাদেরকে তিনি বঞ্চিত করে দিলেন? তেমনিভাবে আল্লাহপাক অর্ধ শা‘বানের রাতে সবাইকে ক্ষমা এবং রহমত বর্ষণ করবেন একথা ঠিক, কিন্তু যারা গাফেল হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে তাদের চেয়ে যারা রাত জেগে ইবাদত করে, দু‘আ-দরূদ পড়ে, তওবা ইস্তিগফার করে তার কাছে চাইবে তাদেরকে গাফেল ব্যক্তির চেয়ে বেশি ক্ষমা এবং রহমত বর্ষণ করবেন এতে কোন সন্দেহ নেই। আল্লাহ পাক তো এমন সত্তা যার কাছে না চাইলে তিনি নারাজ হন। সহীহ বুখারীতে (হাদীস নং-৬৩৩৮-৬৩৩৯) বর্ণিত হয়েছে ‘আপনি চাইলে ক্ষমা করে দেন’ এভাবে আল্লাহর কাছে চাওয়া নিষেধ। আল্লাহ পাক তো দু‘আ কবুল করতে বাধ্য নন। সুতরাং আপনি গাফেল হয়ে ঘুমিয়ে থাকলেন আর অন্যজন পুরো রাত ইবাদত করলো আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলো, রহমত বর্ষণের দু‘আ করলো অথচ আপনার অবস্থা এমন যেন আপনি আল্লাহ তাআলাকে বলছেন, ‘ইচ্চা হলে ক্ষমা করে দেন’ এরপরও আপনি ক্ষমা পাবেন। আর অপর জনের গোনাহ হবে!! সে বিদ‘আত করেছে!! আল্লাহ পাক আমাদেরকে এধরণের ভ্রান্তি থেকে হেফাজত করুন। আমীন। বুঝা গেল, শবে বরাতের বিশেষ গুরুত্ব এবং ফযীলত রয়েছে। ঐ রাতে মুশরিক এবং বিদ্বেষপোষণকারী ব্যতীত সকল মানুষই ক্ষমা পাওয়ার উপযুক্ত। উক্ত হাদীসে প্রার্থনা ছাড়াই আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং রহমত বর্ষণের কথা বলা হয়েছে। যদিও আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে ক্ষমা এবং রহমত প্রত্যাশীদেরকে ক্ষমা করার কথা বলা হয়েছে। যাই হোক, ক্ষমা প্রার্থনার শর্ত থাকুক বা নাই থাকুক একথা তো পরিষ্কার যে, প্রত্যাশা ছাড়াই যদি ক্ষমা এবং রহমত বর্ষণ করা হয় তাহলে প্রত্যাশী ব্যক্তি ক্ষমা এবং রহমতের বেশি উপযুক্ত হবে। সুতরাং আমাদের উচিত বিশেষ এই রাতে আল্লাহ তাআলার কাছে কান্নাকাটি করে ক্ষমা এবং রহমত বর্ষণের দুআ করা। আর পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, গোনাহ ক্ষমা করার অর্থ সগীরা গোনাহ ক্ষমা করা হবে। তাই আমাদের উচিত আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করা এবং তওবা ইস্তিগফার করা, যাতে আল্লাহপাক কবীরা গোনাহও ঐ রাতে ক্ষমা করে দেন। মোটকথা এটি যেহেতু ক্ষমা ও রহমত বর্ষণের বিশেষ রাত, তাই উক্ত রাতে তওবা ইসতিগফার, নফল নামায, তিলাওয়াতে কোরআন ইত্যদি ইবাদত বেশি পরিমাণে করা উচিত। তারা আরো বলেন, অর্ধ শা‘বানের রাতে সকল ইবাদত বিদ‘আত। কেননা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন কারো কাছ থেকে এ রাতে বিশেষ গুরুত্বের সাথে ইবাদতের বিষয়টি প্রমাণিত হয় নি। চমৎকার কথা! আচ্ছা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম এ রাতে ইবাদত করেন নাই, বা করতে নিষেধ করেছেন হাদীসে নববীর বিশাল ভান্ডার থেকে এমর্মে একটি হাদীসও কি দেখাতে পারবেন? বরং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন এ রাতে ইবাদত করেছেন এর প্রমাণ রয়েছে। আচ্ছা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি প্রতি রাতে ইবাদত করতেন না সাহাবায়ে কেরাম কি প্রতি রাতে ইবাদত করতেন না দু‘আ-দরূদ করতেন না? না কোন হাদীসে আছে পুরো বছর রাতে তারা নফল নামায রোযা দু‘আ-দরূদ করেছেন শুধু অর্ধ শা‘বানের রাত ছাড়া। আর পূর্ণ বছরের মধ্যে অর্ধ শা‘বানের রাতটিও অন্তর্ভুক্ত কি না। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম রাজিয়াল্লাহু আনহুম প্রতি রাতেই বিভিন্ন ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। বিভিন্ন হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতকেও প্রতি রাতে ইবাদত করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। যেমন হযরত আব্দুল্লাহ বিন সালাম রা. থেকে বর্ণিত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- يَا أَيُّهَا النَّاسُ، أَفْشُوا السَّلَامَ، وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ، وَصَلُّوا بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ، تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ بِسَلَامٍ. ‘হে মানুষগণ! সালামের ব্যাপক প্রচলন ঘটাও, খানা খাওয়াও, এবং মানুষ ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় রাতে নামায পড়। জান্নাতে নিরাপদে প্রবেশ করবে।’ (সুনানে তিরমিযি, হাদীস ২৪৮৫; সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস ১৩৩৪; মুসনাদে আহমদ: ৩৯/২০১; মুসতাদরাকে হাকীম, হাদীস ৪৩৪২) যাই হোক, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম পুরো বছর রাতের ইবাদতে অভ্যস্ত ছিলেন। যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অর্ধ শা‘বানের ফযীলত এবং গুরুত্বের কথা বর্ণনা করলেন, সাহাবায়ে কেরাম রাতটিকে অন্যন্য রাতের চেয়ে একটু বেশি গুরুত্ব দিবেন, এটাই স্বাভাবিক কিন্তু এ রাতের ইবাদত যেহেতু একাকী করতে হয়, মসজিদে জড়ো হয়ে কোন ইবাদত নেই, তাই এ রাতে তাদের ইবাদতের বর্ণনা খুব একটা আলোচনায় আসে নি। যেমন তারাবীর পুরো নামায নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে পড়েন নি বরং কখনো কখনো তিনি কয়েক রাকাত জামাতের সাথে পড়ে হুজরায় চলে গেছেন এবং একাকী নামাযে পড়েছেন। সহীহ মুসলিম (হাদীস ১১০৪, কিতাবুস সিয়াম, বাবুন্নাহয়ী আনিছ সিয়াম)সহ হাদীসের অন্যান্য গ্রন্থে এভাবেই বর্ণিত হয়েছে। তারাবীহ এর পুরো নামায নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে পড়েন নি, একারণে তিনি তারাবীহ-এর নামায কত রাকাত পড়েছেন, এমর্মে সহীহ সনদে হাদীস বর্ণিত হয় নি। যদিও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কত রাকাত পড়েছেন, সাহাবাদের আমল থেকে আমরা জানতে পেরেছি। অবশ্য অর্ধ শা‘বানের রাতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি আমল করতেন, তা একেবারেই যে বর্ণিত হয় নি, এমন নয়। বরং এ রাতে কিছু লোক ব্যতীত সবার জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা পাশাপাশি হযরত আয়েশা রা. এর বর্ণনায় বিষয়টি এসেছে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ রাতে নফল নামায পড়েছেন যাতে সিজদাও দীর্ঘ ছিল। হযরত আয়েশা রা. এর উক্ত হাদীস সম্পর্কে বাইহাকী রহ. (৪৫৮ হি.) ‘শুআবুল ঈমান’ গ্রন্থে (৫/৩৬২) বলেছেন-هذا مرسل جيد| যাই হোক, এভাবেই এ রাতের ইবাদত একাকী-ই চলে আসছিল তাই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আমল সম্পর্কে যদিও আমরা কিছুটা অবগত হতে পেরেছি কিন্তু সাহাবায়ে কেরামদের আমল সম্পর্কে আমরা খুব একটা জানতে পারি নি। কারণ এগুলো নিয়ে মাতামাতির প্রেক্ষাপট তৈরী হয় নি। তাবেয়ীনদের যুগেও এরকম যাচ্ছিল। সর্বপ্রথম বিষয়টি আলোচনায় আসে যখন খালিদ বিন মা‘দান (১০৪ হি.) মকহুল (১১৩ হি.) লুকমান বিন আমির প্রমুখ শামের তাবেয়ীগণ এ রাতে মসজিদে গিয়ে জড়ো হয়ে ইবাদত শুরু করেন। উলামায়ে কেরাম তখন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন একদল তাদের মত অবলম্বন করেন আরেকদল এর বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন, তারা এ রাতে একাকী ইবাদতের পক্ষে মত দেন কারণ এ রাতে মসজিদে গিয়ে জড়ো হয়ে ইবাদত করার নিয়ম নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম এর যুগে ছিল না। বুঝা গেল মসজিদে গিয়ে জড়ো হয়ে ইবাদতের বিষয়ে, অথবা বিশেষ পদ্ধতির নামাযের ক্ষেত্রে মতভেদ থাকতে পারে, একাকী ইবাদতের ক্ষেত্রে নয়। কেউ কেউ বলে থাকেন এ রাতের ইবাদতের সূচনা শামের কিছু তাবেয়ীদের থেকে হয়েছে। তাদের এ বক্তব্য যে সঠিক নয় ইতিপূর্বে আমরা এসম্পর্কেও আলোচনা করেছি।
অর্ধ শা‘বানের রাতে ইবাদত: মনীষীদের মতামত ও আমল: শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কে ইতিপূর্বে একটি পোস্টে উল্লেখিত হযরত মু‘আয রা. থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীসের পাশাপাশি আরো অসংখ্য হাদীস রয়েছে। উক্ত হাদীসগুলোকে সামনে রেখে যুগশ্রেষ্ট আলেমগণ বলেছেন, অর্ধ শা‘বানের রাত একটি ফযীলতপূর্ণ রাত। তাই এ রাতে একাকী নামায, দু‘আ-দুরূদ, ইস্তিগফার ও তিলাওয়াতে কোরআন মোটকথা বিভিন্ন ইবাদত করা শরীয়তে কাম্য। নিচে কতিপয় আলেমের বক্তব্য এবং আমল উল্লেখ করা হল। •তাবেয়ীদের আমল: ইবনে রজব রহ. ‘লাতাইফুল মাআরিফ’ গ্রন্থে, পৃ. ২৬২ বলেন, খালিদ বিন মা‘দান (১০৪ হি.) মকহুল (১১৩ হি.) লুকমান বিন আমের এবং অন্যান্য তাবেয়ীগণ অর্ধ শা‘বানের রাতকে তা‘জীম করতেন এবং এতে স্বাভাবিক অভ্যাসের চেয়ে বেশি ইবাদত করতেন। •অর্ধ শা‘বানের রাতে একাকী নামায মাকরূহ হবে না, এটাই শামের আলেম ও ফক্বীহ আওযায়ী রহ. (১৫৭ হি.) এর অভিমত। (ইবনে রজব, লাতাইফুল মাআরিফ, পৃ. ২৬২) •ইমাম শাফেয়ী রহ. (১৫০-২০৪ হি.) তাঁর ‘কিতাবুল উম্ম’ গ্রন্থে (২/৪৮৫) দুই ঈদের রাতসহ কয়েকটি রাতে ইবাদত সংক্রান্ত আছার উল্লেখ করেন, যাতে অর্ধ শা‘বানের রাতে দুআ কবুলের কথাও রয়েছে। এগুলো উল্লেখ করে বলেন, আমি এসকল রাত সম্পর্কে বর্ণিত এই সবগুলো বিষয়কে ফরয মনে না করে পালন করতে পছন্দ করি। •ইসহাক ইবনে রাহুইয়া রহ.(১৬১-২৩৮ হি.) রহ.ও এ রাতে ইবাদত করা মুস্তাহাব বলেছেন। (লাতাইফুল মাআরিফ, পৃ. ২৬২) •হাফেয ইবনে আসাকীর রহ. (৪৯৯-৫৭১ হি.) এর জীবনীতে এসেছে, তিনি অর্ধ শা‘বান এবং দুই ঈদের রাতে নামায এবং তাসবীহ পড়ে...ইবাদত করতেন। (সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, যাহাবী: ২০/৫৬২) •ইবনুস সালাহ রহ. (৫৭৭-৬৪৩ হি) বলেন, অর্ধ শা‘বানের রাতের ফযীলত রয়েছে। এ রাতে ইবাদত করা মুস্তাহাব। (আল-বাইছ আলা ইনকারিল বিদাই ওয়াল হাওয়াদিছ, আবু শামাহ: পৃ. ৪১-৪২) •ইবনে আব্দুস সালাম (৬৬০ হি.) রহ. ইবনুস সালাহ রহ. অনুরূপ মত পেশ করেছেন। (আল ঈযাহ ওয়াল বায়ান, হাইতামী [মাখতুত] •নভভী রহ. (৬৩১-৬৭৬ হি.) রওযাতুত তালিবীন গ্রন্থে (১/৫৮২) ঈদের রাতের মুস্তাহাব বিষয়ের মধ্যে দু‘আর করার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন সাথে অর্ধ শা‘বানের রাতে দু‘আ করা মুস্তাহাব হওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন। • ইবনে তাইমিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হি.) বলেন, অর্ধ শা‘বানের রাতে কেউ যদি একাকী অথবা বিশেষ কোন জামাতে নামায পড়ে যেমনিভাবে সালাফে সালেহীনের একদল করতেন, সেটি উত্তম হবে। মাজমূউল ফাতাওয়া: ২৩/৮০=২৩/১৩১) •ইবনে তাইমিয়াহ রহ. (৬৬১-৭২৮ হি.) আরো বলেন, অর্ধ শা‘বানের রাতের ফযীলত সম্পর্কে অনেক হাদীস এবং আছার বর্ণিত হয়েছে। সালাফে সালেহীনের একদল সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, তারা এ রাতে নামায পড়তেন। সুতরাং কেউ যদি একাকী এ রাতে নামায পড়ে, তাহলে এমন কাজ তার আগে সালাফরা করেছেনে, আর এতে তার স্বপক্ষে প্রমাণ রয়েছে। তাই তার এমন কাজকে অস্বিকার করা যাবে না। (মাজমূউল ফাতাওয়া: ২৩/৮১=২৩/১৩২) •ইবনুল হাজ্জ রহ. (৭৩৭ হি.) তাঁর আল মাদখাল গ্রন্থে (১/২৯৯) বলেন, অর্ধ শা‘বানের রাত যদিও ক্বদরের রাতের মতো নয় তথাপি এই রাতের অনেক ফযীলত ও বরকত রয়েছে। আমাদের পূর্বসূরি পুণ্যাত্মারা এই রাতের যথেষ্ট মর্যাদা দিতেন; এর যথাযথ হক আদায় করতেন; রাতটি আগমণের পূর্ব থেকেই এর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। •ইবনুল হাজ্জ রহ. (৭৩৭ হি.) আরো বলেন, অর্ধ শা‘বানের রাতের ফযীলত অনেক বেশি। এই বেশি ফযীলতের দাবী হলো, বিভিন্ন প্রকারের নেক কাজ করে এর উপযোগী শুকরিয়া আদায় করা। (আল মাদখাল: ১/৩০৮) •ইবনে রজব রহ. (৭২৬-৭৯৫ হি.) বলেন, সঠিক কথা হচ্ছে এ রাতের ইবাদত ব্যক্তিগতভাবে করা উচিত। একজন মুমিন বান্দার উচিত, এ রাতে যিকির ও দুআর জন্য পুরোপুরি অবসর হওয়া। প্রথমে খাঁটি মনে তওবা করা এরপর মাগফেরাত ও ক্ষমা প্রার্থনা করা; আপদ-বিপদ দূর হওয়ার জন্য দুআ করা এবং নফল নামায পড়া। এ রাতে নফল নামাযের জন্য মসজিদে ভিড় করা বা মাহফিল করা মাকরূহ। অত:পর অর্ধ শা‘বানের ইবাদত সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনার পর বলেন, ‘‘একজন মুমিন বান্দার উচিত, এ রাতে যিকির ও দুআর জন্য পুরোপুরি অবসর হওয়া। প্রথমে খাঁটি মনে তওবা করবে; এরপর মাগফেরাত ও ক্ষমা প্রার্থনা করবে; আপদ-বিপদ দূর হওয়ার জন্য দুআ করবে এবং নফল নামায পড়বে। সবসময় সেসব গোনাহ থেকে বিরত থাকবে যেগুলো ঐ রাতের বিশেষ ফযীলত (ব্যাপক ক্ষমা) থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে। যেমন শিরক, হত্যা, যিনা, হিংসা ইত্যাদি। (ইবনে রজব, লাতাইফুল মাআরিফ: ২৬০-২৬৫) •ইবনে হাজার হাইতামী রহ. বলেন, অর্ধ শা‘বানের রাতে ইবাদতের বিষয়ে সুস্পষ্ট কথা হচ্ছে এটাই যা পূর্বোক্ত হাদীসগুলো থেকে প্রমাণিত। অর্থাৎ এ রাতে বেশি বেশি দু‘আ করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা, কাকুতি মিনতি করা, গোনাহ ও অপরাধ স্বীকার করা আল-ঈযাহ ওয়াল বায়ান [মাখতুত]) • সুয়ুতী রহ. (৮৪৯-৯১১ হি:) ‘হাকীকাতুস সুন্নাহ’ গ্রন্থে (পৃ. ৫৪) ইবনুস সালাহ রহ. এর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, ‘‘অর্ধ শা‘বানের রাতের ফযীলত রয়েছে। এ রাতে ইবাদত করা মুস্তাহাব।’’ •নাজমুদ্দীন গাইতী রহ. (৯১০-৯৮১ হি.) বলেন, সারকথা হলো, অর্ধ শা‘বানের পুরো রাতে ইবাদত করা মুস্তাহাব। কেননা এ সম্পর্কে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। •লা মাযহাবী আলেম মুবারকপুরী রহ. (১২৮৩-১৩৫৩) বলেন, অর্ধ শা‘বানের রাতের ফযীলত সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে, সমষ্টিগতভাবে এগুলো থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, এ রাতের ফযীলতের ভিত্তি রয়েছে। তিনি আরো বলেন, যারা বলে থাকেন অর্ধ শা‘বানের রাতের ফযীলত সম্পর্কে কোন কিছুই প্রমাণিত নয়, সমষ্টিগতভাবে এসকল হাদীস তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ বহন করে। (তুহফাতুল আহওয়াযী: ৩/৪৪১-৪৪২) • লাখনৌভী রহ.এর (১২৬৪-১৩০৪ হি.) বলেন, ‘‘অর্ধ শা‘বানের রাতে ইবাদত করা এবং যেকোনো নফল আমল যাতে আগ্রহ বোধ হয়, তা আদায় করা মুস্তাহাব। এ বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই। এ রাতে মানুষ যত রাকাত ইচ্ছা নামায পড়তে পারে, তবে এ ধারণা ভুল যে, এ রাতের বিশেষ নামায রয়েছে এবং তার বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। যেসব বর্ণনায় এ ধরণের কথা পাওয়া যায় সেগুলো ‘মওযু।’ তবে এ রাত একটি ফযীলতপূর্ণ রজনী এবং এ রজনীতে ইবাদত-বন্দেগী করা মুস্তাহাব-এ বিষয়টি সহীহ হাদীস থেকেও প্রমাণিত।’’ • শায়খ আব্দুল্লাহ আল গুমারী রহ. (১৩২৮-১৪১৩ হি.) ‘হুসনুল বায়ান ফী লাইলাতিন নিসফি মিন শা‘বান’ গ্রন্থে (পৃ. ১৫-১৬) শবে বরাতের ফযীলত এবং এ রাতের আমল সংক্রান্ত অনেক হাদীস ও আছার উল্লেখ করে বলেন, এসকল হাদীস এবং আছার থেকে এ রাতে ইবাদত করা মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়। এবং আল্লাহর রহমত অর্জনের উদ্দেশ্যে এ রাতে তিলাওয়াতে কোরআন যিকির ও দুআ বেশি পরিমাণে করা প্রমাণিত।’’ •নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ. (১৪২০ হি.) বলেন, এ রাতে যথাসাধ্য ইবাদত করা; নামায, যিকির, তিলাওয়াতে কোরআন, দুআয়ে মুছুরা ইত্যাদি করা উত্তম। এতে কোন অসুবিধা নেই। (উলামাউল আযহার কর্তৃক রচিত আস সিরাতিল মুস্তাক্বীম গ্রন্থের টিকা পৃ.৬১)
শবে বরাতে করণীয়: হাদীসে নববীর আলোকে এ রাতের করণীয় হলো, বিশেষ কোন সূরা নির্ধারণ না করে যতটুকু সম্ভব নফল নামায পড়া এবং দু‘আ দরূদ, ইস্তিগফার তথা নিজের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, আল্লাহর কাছে রহমত বর্ষণের দু‘আ করা। মোটকথা ইবাদতের বিশেষ কোন পদ্ধতি নির্ধারণ না করে যে কোন ধরণের ইবাদতে রাতটি কাটানো। বিশেষতঃ রাতটি যেহেতু আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা পাওয়ার উত্তম সুযোগ তাই সগীরা গোনাহের সাথে সাথে যেন কবীরা গোনাহও ক্ষমা হয়ে যায় এজন্য তওবাহ করে নেয়া। পাশাপাশি যে সকল অপরাধ ক্ষমার পথে বাধা হয় সেগুলো থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকা। ইবনে রজব রহ. বলেন, ‘‘একজন মুমিন বান্দার উচিত, এ রাতে যিকির ও দু‘আর জন্য পুরোপুরি অবসর হওয়া। প্রথমে খাঁটি মনে তওবা করবে; এরপর মাগফেরাত ও ক্ষমা প্রার্থনা করবে; আপদ বিপদ দূর হওয়ার জন্য দুআ করবে এবং নফল নামায পড়বে। সবসময় সেসব গুনাহ থেকে বিরত থাকবে যেগুলো ঐ রাতের বিশেষ ফযীলত (ব্যাপক ক্ষমা) থেকে বঞ্চিত করে। যেমন শিরক, হত্যা, যিনা, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি। (লাতাইফুল মাআরিফ, ইবনে রজব, পৃ.২৬৫-২৬৬) শবে বরাতের আমলসমূহ সম্মিলিত নয়, একাকী: পনের শা‘বানের রাতে যেকোন ধরণের ইবাদত যেমন-নামায, তিলাওয়াত, দুআ-জিকির ইত্যাদি শুধু বৈধই নয় বরং করাটাই শরীয়তে কাম্য এবং মুস্তাহাব। যুগশ্রেষ্ট আলেম ও ফকীহদের মতও তাই। হ্যাঁ, এ রাতের ইবাদত মসজিদে জামাতের সাথে হবে, না একাকী হবে, এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। শামের আলেমদের পক্ষ থেকে এবিষয়ে দু’টি মত পাওয়া যায়। ক. মসজিদে জামাতের সাথে ইবাদত করা মুস্তাহাব। খ. এ রাতে ইবাদতের জন্য মসজিদে জড়ো হওয়া মাকরূহ তবে একাকী নামায পড়া মাকরূহ নয়। যদিও কতিপয় আলেম থেকে শবে বরাতে মসজিদে সম্মিলিতভাবে ইবাদত করার কথা বর্ণিত হয়েছে কিন্তু অধিকাংশ আলেমদের মতে এই রাতে দলবদ্ধ কোন ইবাদত নেই, বরং এ রাতে ইবাদতের জন্য মসজিদে জড়ো হওয়া মাকরূহ। শামের ঐ সকল আলেম ছাড়াও অসংখ্য আলেম বলেছেন শবে বরাতে ইবাদতের উদ্দেশ্যে জড়ো হওয়া মাকরূহ। যেমন গাযনাভী (৬০০ হি.) আল্লামা ইবনে সালাহ (৫৭৭-৬৪৩ হি.) ইবনে তাইমিয়া (৬৬১-৭২৮ হি.) মুনলা খসরূ (৮৮৫ হি.) সুয়ূতী (৮৪৯-৯১১ হি.) হাত্তাব (৯৫৪ হি.) ইবনে নুজাইম (৯৭০ হি.) শুরুম্বুলালী (১০৬৯ হি.) যাবীদী (১২০৫ হি.) ইবনে আবেদীন (১২৫২ হি.) প্রমুখ আলেমগণ এ রাতে জড়ো হয়ে ইবাদত করা মাকরূহ বলেছেন। দেখুন, আল-বাইছ আলা ইনকারিল বিদাই ওয়াল হাওয়াদিছ, আবু শামাহ, পৃ. ৪১-৪১; আল বাহরুর রাইক, ইবনে নুজাইম: ২/৫৬; মাজমূউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়া: ২৩/৮০=২৩/১৩২; দুরারুল হুক্কাম শরহু গুরারুল আহকাম, পৃ. ১১৭; হাকীকাতুস সুন্নাহ ওয়াল বিদআহ, সুয়ুতী, ৫৪ পৃ.) উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেল শবে বরাতে ইবাদতের উদ্দেশ্যে জড়ো হওয়া মাকরূহ। একথাটিই আল মাওসূআল ফিকহিয়্যাহ (২/২৩৬) এ বলা হয়েছে এভাবে- جمهور الفقهاء على كراهة الاجتماع لإحياء ليلة النّصف من شعبان উসতাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা আব্দুল মালেক দা. বা. বলেন, ‘‘তবে কোন আহবান ও ঘোষণা ছাড়া এমনিই কিছু লোক যদি মসজিদে এসে যায় তাহলে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলে মশগুল থাকবে, এসে অন্যের আমলের ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণ হবে না। (আল-কাউসার, সেপ্টে’ ০৫)
শবে বরাতে নফল ইবাদত যেন ফরজ আদায়ে অন্তরায় না হয়: অনেক ভাইকে দেখা যায় অর্ধ শা‘বানের রাতে প্রথমদিকে ইবাদত করে শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়েন। কেউ কেউ তো ওয়াক্তের মধ্যে ফজরের নামাযই পড়তে পারেন না, আবার কেউ পড়লেও জামাতে শরীকে হতে পারেন না। অথচ এই নফল নামাযের চেয়ে ফরজ আদায় করা অত্যন্ত জরূরী। একজন পুরো রাত নফল আদায় করল কিন্তু ফজরের নামায জামাতে পড়ল না, আরেকজন এশার নামায জামাতে পড়ে ঘুমিয়ে পড়ল আর ফজরের ওয়াক্ত হলে মসজিদে দিয়ে জামাতে শরীক হলো, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ভাষ্য অনুযায়ী দ্বিতীয় ব্যক্তির ইবাদতই উত্তম। হযরত উসমান রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- مَنْ شَهِدَ الْعِشَاءَ فِي جَمَاعَةٍ كَانَ لَهُ قِيَامُ نِصْفِ لَيْلَةٍ، وَمَنْ صَلَّى الْعِشَاءَ وَالْفَجْرَ فِي جَمَاعَةٍ كَانَ لَهُ كَقِيَامِ لَيْلَةٍ. ‘যে ব্যক্তি এশার জামাতে উপস্থিত হবে সে অর্ধ রাত ইবাদতের সওয়াব পাবে, আর যে এশা এবং ফজরের নামায জামাতে পড়বে সে পুরো রাত ইবাদতের সওয়াব পাবে।‘ (সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫৬; সুনানে তিরমিযি, হাদীস ২২১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫৫১ [উল্লেখিত ইবারত তিরমিযি থেকে গৃহিত]) সুতরাং শবে বরাতে নফল ইবাদতে লেগে ফজর এবং এশার জামাত যেন ছোটে না যায়, এদিকে লক্ষ রাখা খুবই জরুরী। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।
শবে বরাতের রোজা: অর্ধ শা‘বানের রোযা সম্পর্কে হযরত আলী রা. এর সূত্রে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘যখন অর্ধ শা‘বানের রাত আসে তোমরা এ রাত ইবাদত বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোযা রাখ। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। আছে কি কোন রিযিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দিব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদেরকে ডাকতে থাকেন।’’ (সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস নং-১৩৮৮) হাদীসটি বিস্তারিত পর্যালোচনার দাবী রাখে তবে ফেসবুকের ছোট পরিসরে এতো দীর্ঘ আলোচনা সম্ভব নয় তাই এখানে শুধু উসতাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব দামাত বারাকাতুহুম এর কয়েকটি কথা উল্লেখ করেই আলোচনা শেষ করব। তিনি বলেন, ইবনে মাজার উপরোক্ত হাদীসটি ‘মওজূ’ তো কখনোই নয়। তবে সনদের দিক থেকে ‘জয়ীফ’। যেহেতু ফাযাইলের ক্ষেত্রে জয়ীফ গ্রহণযোগ্য তাই আলিমগণ শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে এ হাদীস বয়ান করে থাকেন। শায়খ আলবানী রহ. তাঁর ‘সিলসিলাতুয যয়ীফা (৫/১৫৪) তে এই বর্ণনাকে ‘মওজূউস সনদ’ লিখেছেন। অর্থাৎ এর সনদ মওজূ। যেহেতু অন্যান্য বর্ণনা উপরোক্ত বর্ণনার বক্তব্যকে সমর্থন করে সম্ভবত এজন্যই শায়খ আলবানী সরাসরি ‘মওজূ’ না বলে ‘মওজূউ সনদ’ বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। তথাপি শায়খ আলবানীর এই ধারণা ঠিক নয়। সঠিক কথা এই যে, এই বর্ণনা ‘মওজূ’ তো নয়, শুধু জয়ীফ। ইবনে রজব রহ. প্রমুখ বিশেষজ্ঞদের এই মতই আলবানী সাহেব নিজেও বর্ণনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে আলবানী সাহেব যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন তা এই যে, এ বর্ণনার সনদে ‘ইবনে আবী ছাবুরা’ নামক একজন রাবী রয়েছেন। তার সম্পর্কে হাদীস জাল করার অভিযোগ রয়েছে। অতএব এই বর্ণনা ‘মওজূ’ হওয়া উচিত। তবে এই ধারণা এ জন্য সঠিক নয় যে, ইবনে আবী সাবুরাহ সম্পর্কে উপরোক্ত অভিযোগ ঠিক নয়। তার সম্পর্কে খুব বেশি হলে এতটুকু বলা যায় যে, জয়ীফ রাবীদের মতো তার স্মৃতিশক্তিতে দুর্বলতা ছিল। রিজাল শাস্ত্রের ইমাম আল্লামা যাহাবী রহ. পরিষ্কার লিখেছেন যে, ‘স্মৃতি শক্তির দুর্বলতার কারণেই তাকে জয়ীফ বলা হয়েছে।’ দেখুন, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৭/২৫০ সারকথা এই যে, উপরোক্ত বর্ণনা ‘মওজূ’ নয়, শুধু জয়ীফ। (মাসিক আল কাউসার, আগস্ট’ ০৮) অন্যত্র তিনি বলেন, এই বর্ণনাটির সনদ যয়ীফ। কিন্তু মুহাদ্দিসীনে কেরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হল, ফযায়েলের ক্ষেত্রে ‘যয়ীফ হাদীস’ গ্রহণযোগ্য। তাছাড়া শা‘বান মাসে বেশি বেশি নফল রোযা রাখার কথা সহীহ হাদীসে এসেছে এবং ‘আইয়্যামে বীয’ অর্থাৎ প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে রোযা রাখার বিষয়টিও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। বলা বাহুল্য, পনের শা‘বানের দিনটি শা‘বান মাসেরই একটি দিন এবং তা আইয়্যামে বীযের অন্তর্ভুক্ত। এজন্য ফিকহের একাধিক কিতাবেই এদিনে রোযা রাখা মুস্তাহাব লেখা হয়েছে। আবার অনেকে বিশেষভাবে এদিনের রোযাকে মুস্তাহাব বা মাসনূন বলতে অস্বীকার করেছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা মুহাম্মদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম তাঁর ইসলাহী খুতুবাতে বলেন, ‘‘আরো একটি বিষয় হচ্ছে শবে বরাতের পরবর্তী দিনে অর্থাৎ শা‘বানের পনেরো তারিখে রোযা রাখা। গভীরভাবে বিষয়টি উপলব্ধি করা প্রয়োজন। হাদীসে রাসূলের বিশাল ভাণ্ডার হতে একটিমাত্র হাদীস এর সমর্থনে পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছে, শবে বরাতের পরবর্তী দিনটিতে রোযা রাখ।’ সনদ ও বর্ণনা সূত্রের দিক থেকে হাদীসটি দুর্বল। তাই এ দিনের রোযাকে এই একটিমাত্র দুর্বল হাদীসের দিকে তাকিয়ে সুন্নত বা মুস্তাহাব বলে দেওয়া অনেক আলেমের দৃষ্টিতেই অনুচিত। তবে হ্যাঁ, শা‘বানের গোটা মাসে রোযা রাখার কথা বহু হাদীসে পাওয়া যায়। অর্থাৎ ১ শা‘বান থেকে ২৭ শা‘বান পর্যন্ত রোযা রাখার যথেষ্ট ফযীলত রয়েছে। কিন্তু ২৮ ও ২৯ তারিখে রোযা রাখতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই বারণ করেছেন। ইরশাদ করেন, ‘রমযানের দু’একদিন পূর্বে রোযা রেখো না।’ যাতে রমযানের জন্য পূর্ণ স্বস্তির সাথে স্বত:স্ফূর্থতার সঙ্গে প্রস্তুতি নেওয়া যায়। কিন্তু ২৭ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিনের রোযাই অত্যন্ত বরকতপূর্ণ। একটি লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে যে, শা‘বানের এই ১৫ তারিখটি তো ‘আইয়ামে বীয’ এর অন্তর্ভুক্ত। আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি মাসের ‘আইয়ামে বীয’ এ রোযা রাখতেন। সুতরাং যদি কোন ব্যক্তি এই দু’টি কারণকে সামনে রেখে শা‘বানের ১৫ তারিখের দিনে রোযা রাখে যা ‘আইয়ামে বীযের’ অন্তর্ভুক্ত, পাশাপাশি শা‘বানেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, তবে ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় সে প্রতিদান লাভ করবে। তবে শুধু ১৫ শা‘বানের কারণে এ রোযাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে সুন্নত বলে দেওয়া অনেক আলেমের মতেই সঠিক নয়। আর সে কারণেই অধিকাংশ ফুকাহায়ে কেরাম মুস্তাহাব রোযার তালিকায় মুহাররামের ১০ তারিখ ও ‘ইয়াউমে আরাফা’ (জিলহজ্বের ৯ তারিখ) এর কথা উল্লেখ করেছেন অথচ শা‘বানের ১৫ তারিখের কথা পৃথকভাবে কেউই উল্লেখ করেননি। বরং তারা বলেছেন, শা‘বানের যেকোন দিনই রোযা রাখা উত্তম। সুতরাং এ সকল বিষয়ের দিকে দৃষ্টি রেখে যদি কেউ রোযা রাখে তবে ইনশাআল্লাহ সে সওয়াব পাবে। তবে মনে রাখতে হবে যে, এ মাসের নির্দিষ্ট কোন দিনের পৃথক কোন বৈশিষ্ট নেই।’’ (মাসিক আল কাউসার, সেপ্টে, ০৫) অন্যত্র একটি প্রশ্নের জবাবে হযরত বলেন, ১৫ শা‘বানের রোযা সম্পর্কে থানভী রহ. যে ‘মাসনূন’ বলেছেন তার অর্থ হল মুস্তাহাব। আর ইসলাহী খুতবাতের আলোচনা মনোযোগ দিয়ে পড়লে দেখা যায় যে, তা এ কথার বিপরীত নয়। ঐ আলোচনায় ‘জয়ীফ’ হাদীসের উপর আমল করার পন্থা বিষয়ে একটি ইলমী আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে। হযরত মাওলানা পনের তারিখের রোযা রাখতে নিষেধ করেন নি। তিনি শুধু এটুকু বলেছেন যে, একে শবে বরাতের রোযা বলবে না। গোটা মাসেই শুধু শেষের দুই দিন ছাড়া, রোযা রাখা মুস্তাহাব। তাছাড়া প্রতিমাসের ‘আইয়্যামে বীয’ (চাঁদের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ) এ রোযা রাখা মুস্তাহাব। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ দিনের রোযা রাখা হলে ইনশাআল্লাহ ছওয়াব পাওয়া যাবে। (মাসিক আল কাউসার, আগস্ট’ ০৮)
শবে বরাতের আপত্তিজনক কাজকর্ম: উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব দামাত বারাকাতুহুম এ রাতের আপত্তিজনক কাজকর্মের আলোচনায় বলেন, ‘‘খিচুরি বা হালুয়া-রুটির প্রথা, মসজিদ, ঘর-বাড়ি বা দোকান-পাটে আলোক-সজ্জা করা, পটকা ফুটানো, আতশবাজি, কবরস্থানে ও মাজারসমূহে ভিড় করা, মহিলাদের ঘরের বাইরে যাওয়া, বিশেষ করে বেপর্দা হয়ে দোকানপাট, মাযার ইত্যাদি স্থানে ভিড় করা, সব কিছুই এ রাতের আপত্তিজনক কাজ। এসব কাজের কোন কোনটা তো অন্য সময়েও হারাম। আর কিছু কাজ সাধারণ অবস্থায় জায়েয থাকলেও (যেমন খিচুরি পাক করে গরীব-মিসকীনদের মধ্যে বন্টন করা) এগুলোকে শবে বরাতে কাজ মনে করা বা জরুরি মনে করা এবং এসবের পেছনে পড়ে এ রাতের মূল কাজ তওবা ইস্তেগফার, নফল ইবাদত ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত থাকার কোন বৈধতা থাকতে পারে কি? এগুলো সবই হচ্ছে শয়তানের ধোঁকা। মানুষকে আসল কাজ থেকে বিরত রাখার জন্যই শয়তান এসব কাজকর্মে মানুষকে লাগিয়ে রাখে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে শা‘বান মাসে সকল গুনাহ ও পাপরাশি থেকে পবিত্র হয়ে যথাযথভাবে রমযানের মাসকে বরণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।’’ (মাসিক আল কাউসার, সেপ্টে, ০৫) শবে বরাতে আলোকসজ্জা ও পটকা ফুটানো: শবে বরাতের গর্হিত কাজগুলোর মধ্যে উক্ত বিষয়টি অন্যতম। এমনিতেই রাতের বেলা আগুন জালিয়ে রাখা নিষেধ। হযরত আবু মুসা রা. বলেন, মদীনার একটি ঘরে একবার আগুন লাগলো। নবীজী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের অবস্থা জানানো হলে তিনি বললেন-‘এই আগুন তোমাদের দুশমন, যখন তোমরা ঘুমাতে যাও তা নিভিয়ে দিবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬২৯৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০১৬) উক্ত হাদীসকে সামনে রেখে মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেছেন বাতি জ্বালিয়ে রাখার বৈধতা দু’টি শর্তের উপর নির্ভরশীল। ক. যদি বাতি জ্বালিয়ে রাখলে ঘরে আগুন লাগার সম্ভাবনা না থাকে। খ. যদি ইসরাফ এবং মাল বিনষ্ট করা না হয়। প্রয়োজন ছাড়া বাতি জ্বালানো যখন এমনিতেই নিষেধ সুতরাং শবে বরাতে এটা বৈধ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কেননা শবে বরাতের আলোকসজ্জার সাথে অনেক কুসংস্কার জড়িত। যেমন এটিকে উৎসবের রাত মনে করা হয়, অথবা ঘরে মৃতদের রূহ আগমন করে এজন্যে তাদের সম্মানে মোমবাতি, আগরবাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়।১ যদি এ ধরণের কোন ধারণা নাও থাকে এমনিতেই এ রাতে বাতি জ্বালানো বৈধ হতে পারে না। কেননা এটি প্রয়োজন ছাড়া মাল বিনষ্ট করার পাশাপাশি বিজাতীয় সংস্কৃতি এবং ‘শিআর’ এর বহিঃপ্রকাশ আর কোন মুসলমান অমুসলিমদের সংস্কৃতি বা ‘শিআর’ গ্রহণ করতে পারে না। নবীজী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি তাদের (বিধর্মীদের) সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪০৩১; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৫১১৪ [শাকের] হাদীসটির সনদ নির্ভরযোগ্য]) যাই হোক, এ বিষয়টি পরিষ্কার যে, অর্ধ শা‘বানের রাতে আলোকসজ্জা, পটকা ফোটানো ইত্যাদি কুসংস্কারে লিপ্ত হওয়া সম্পুর্ণ অবৈধ। ইসলামী শরীয়তে এগুলোর কোন সুযোগ নেই। অসংখ্য আলেম এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। কিভাবে এই বিদ‘আতের সূচনা হলো: এসম্পর্কে ইবনে দিহইয়া রহ. (৬৩৩ হি.) ‘মা ওয়াযাহা ওসতাবানা ফী ফাযাইলি শাহরি শা‘বান’ গ্রন্থে (৪৫-৪৭) বলেন, বিদআতিদের সৃষ্ট বস্তুসমূহের মধ্যে একটি হলো, অর্ধ শা‘বানের রাতে আগুন প্রজ্বলন করা। এ বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোন কিছুই বর্ণিত হয় নি। এটি শরীয়তে মুহাম্মাদীকে নিয়ে তামাশাকারী ‘দ্বীনে মাজুস’ (অগ্নিপূজকদের ধর্ম) এর প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিরই সৃষ্টি। সর্বপ্রথম এটির আবির্ভাব হয় বারামিকাদের (এরাই আগুনের সম্মানার্থে মসজিদ সমূহে ধূপ ব্যবহারের সূচনা করেছে। আল ই’তিসাম, শাতিবী: ২/৪৭১) যুগে। তারা দ্বীনে ইসলামে এমন বস্তু উদ্ভাবন করেছে যা সাধারণ মানুষকে ধোঁকায় ফেলে দেয় অর্থাৎ শা’বানে আগুন প্রজ্বালন, যেন এটি ঈমানেরই একটি অংশ তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে অগ্নিপূজা করা এবং তাদের দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা, অথচ এটি সর্বনিকৃষ্ট একটি ধর্ম। অত:পর মুসলমনরা যখন নামায পড়ল, রুকু সিজদা করলো প্রজ্বলিত আগুনের দিকেই হল। এভাবেই কয়েক যুগ চলে যায় এবং অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসিরাও বাগদাদের অনুসরণ করে। আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (১০৫২ হিঃ) তাঁর ‘মা সাবাতা বিস্‌সুন্নাহ ফী আইয়ামিস সানাহ’ (যার উর্দু অনুবাদ ‘মুমিন কে মাহ ও সাল’ নামে করাচি থেকে আরবীসহ প্রকাশিত হয়েছে)-এ (২১৩) বলেন, ‘‘এই রাতের নিকৃষ্টতম বেদ‘আতসমূহের মাঝে নিচের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত- ঘর-বাড়ি, দোকান-পাটে আলোকসজ্জা করা, খেলা ধুলা ও আতশবাজির উদ্দেশ্যে সমবেত হওয়া ইত্যাদি। এগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং এগুলোর স্বপক্ষে কোন জাল রেওয়ায়াতও কোথাও নেই। প্রবল ধারণা যে, এগুলো হিন্দুদের ‘দেওয়ালী’ প্রথা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।’’ এই বিদ‘আতের আবির্ভাব, যেভাবেই হোক তা সম্পূর্ণ গর্হিত ও বর্জনীয়। আল্লাহপাক আমাদেরকে এধরণের বিদ‘আত থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
শবে বরাত উপলক্ষে হালুয়া রুটি পাকানো: অর্ধ শা‘বানের রাত হচ্ছে দু‘আ-দরূদ, তওবাহ-ইস্তিগফার মোটকথা ইবাদতের রাত। কিন্তু মানুষ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে বিভিন্ন অনর্থক কাজে লিপ্ত হয়ে যায়, যা তাদের ইবাদতে অন্তরায় হয়। ঐ রাতের অনর্থক ভিত্তিহীন কাজের মধ্যে অন্যতম একটি হলো, হালুয়া-রুটি ইত্যাদি বিশেষ খাবারের আয়োজন করা। এই প্রথাটি সর্ব প্রথম কবে, কিভাবে শুরু হলো তালাশ করে কিছুই পাই নি। তবে আসাদুল্লাহ গালিব সাহেব তাঁর ‘শবে বরাত’ গ্রন্থে (পৃ. ৫) বলেন- ‘‘হালুয়া-রুটি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে ঐদিন (অর্ধ শা’বানে) আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দান্দান মুবারক উহুদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল। ব্যথার জন্য তিনি নরম খাদ্য হিসাবে হালুয়া-রুটি খেয়েছিলেন, বিধায় আমাদেরও সেই ব্যথায় সমবেদনা প্রকাশ করার জন্য হালুয়া-রুটি খেতে হয়। অথচ উহুদের যুদ্ধ হয়েছিল ৩য় হিজরীর শাওয়াল মাসের ১১ তারিখ শনিবার সকাল বেলায়।২ আর আমরা ব্যথা অনুভব করছি তার প্রায় দু’মাস পূর্বে শা‘বানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রে!’’ (দালাইলুন নাবুওয়াহ, বাইহাকী: ৩/২০১) যদি বাস্তবেই ঐ তারিখে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দান্দান মুবারক শহীহ হতো, তবুও কি এই অনর্থক কাজ করার সুযোগ থাকতো! আমাদের এই নরম খাদ্য খাওয়ায় কি ফায়দা হচ্ছে? শরীয়তের আলোকে এটা কি সওয়াবের কাজ হিসেবে বিবেচিত হতো? এই সব হচ্ছে মানুষকে আমল থেকে বিরত রাখার জন্য শয়তানের ধোঁকা। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এগুলো থেকে রক্ষা করুন। আমীন। কেউ কেউ এখানেও ‘হাদীসুত তাওসিআহ’ (এই রাতে ভাল খাবারের আয়োজন করলে সারা বছর ভাল খাবে)কে টেনে আনেন। এ প্রসঙ্গে প্রথম কথা হলো, এটি আশুরা সম্পর্কে এসেছে অর্ধ শা‘বানের ক্ষেত্রে নয়। দ্বিতীয় বিষয় হলো আশুরা সংক্রান্ত এই হাদীসটি মুহাদ্দিসীনে কেরামের দৃষ্টিতে আপত্তিজনক। হাফেজ ইবনে হাজার রহ. ‘লীসানুল মীযান’ গ্রন্থে (৬/৩৩৮) খুবই আপত্তিজনক বলেছেন। এছাড়াও অনেক মুহাদ্দিস বলেছেন ‘এটি সহীহ নয় ।’ যাই হোক, যেভাবেই এই প্রথাটি চালু হোক, এটাকে বর্জন করে অর্ধ শা‘বানের রাতে ইবাদতে মগ্ন থাকাই উচিত।
শবে বরাত উপলক্ষে গোসল: এটিও অর্ধ শা‘বানের রাতের ভিত্তিহীন একটি কাজ। গোসল যেকোন সময় করা যায়, কিন্তু এটিকে শবে বরাতের কাজ মনে করে বা ঐ রাতে এটিকে বিশেষ সওয়াবের কাজ মনে করে এর পেছনে পড়ার কোন বৈধতা থাকতে পারে কি? এই প্রথাটি কিভাবে চালু হলো অনেক অনুসন্ধান করেও সঠিক তথ্য পাই নি। আমাদের দেশে সম্ভবত এটি ‘মাকছুদুল মুমিনীন’ জাতীয় বই থেকে এসেছে। তবে যতটুকু মনে হয় গোসলের এই বিদঅ‘াত অনেক পুরোনো। কেননা ফাকিহী রহ. (২১৭-২৭৫হি.) ‘আখবারে মাক্বা’ গ্রন্থে (৩/৮৪) আহলে মক্কার আমল উল্লেখ করেছেন এই বলে- ‘‘অতীত কাল থেকে আজ পর্যন্ত আহলে মক্কার আমল চলে আসছে যে, অর্ধ শা‘বানের রাতে সাধারণ নর-নারী মসজিদে যেতো, অতঃপর নামায পড়ত, তাওয়াফ করত....এবং যমযমের পানি পান করতো আর তা দিয়ে গোসল করত এবং অসুস্থদের জন্য তা জমা করে রাখতো। উদ্দেশ্য এ রাতের বরকত অর্জন করা। হয়ত এখান থেকেই গোসলের এই বিদ‘আতের সূচনা। অন্যরা যমযমের পানি না পেলেও গোসলের কাজটি ধরে রেখেছে। প্রত্যেক বিদ‘আতের সূচনা তো একভাবে হয়, পরবর্তীতে তা বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও শবে বরাতের আরো আপত্তিজনক কাজকর্ম রয়েছে যেমন মহিলাদের ঘরের বাইরে যাওয়া, বিশেষ করে বেপর্দা হয়ে দোকানপাট, মাযার ইত্যাদি স্থানে ভিড় করা১ এসব কিছুই এ রাতের আপত্তিকর কাজ। এসব কাজের কোন কোনটি তো অন্য সময়েও হারাম। আর কিছু কাজ সাধারণ অবস্থায় জায়েজ থাকলেও (যেমন খিচুরী পাক করে গরীব-মিসকীনদের মধ্যে বন্টন করা) এগুলোকে শবে বরাতে কাজ মনে করে বা ঐ দিনে এটিকে বিশেষ সওয়াবের কাজ মনে করে এর পেছনে পড়ার কোন বৈধতা থাকতে পারে না।
শবে বরাত কি ভাগ্য রজনী! অর্ধ শা‘বানের রাতের ফযীলত সম্পর্কে লোকমুখে আরো একটি কথা প্রসিদ্ধ রয়েছে যে এ রাতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ হয় অর্থাৎ আগত বছরে কে জন্ম গ্রহণ করবে? কে মৃত্যু বরণ করবে? কে কি রিযিক পাবে, কতটুকু পাবে? ইত্যাদি এই রাতে নির্ধারণ করা হয়। এই ধারণার মূলে কিছু রেওয়ায়াত এবং কোরআনের একটি আয়াত পাওয়া যায়। কোরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে- إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ # فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ# ‘আমি এটা নাযিল করেছি এক মুবারক রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতেই প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় আমার নির্দেশে স্থির করা হয়।’ (সূরা দুখান, আয়াত: ৩-৪) ইকরিমা রহ.(১০৬ হি.)এবং আরো কিছু উলামায়ে কেরামের মতে আয়াতে উল্লেখিত- لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ দ্বারা উদ্দেশ্য অর্ধ শা‘বানের রাত। (তাফসীরে তাবারী: ২১/৯-১০; তাফসীরে রাযী: ২৭/২৩৮; তাফসীরে ইবনে কাছীর: ১২/৩৩৪; তাফসীরে কুরতুবী: ৯/১০০-১০১; আদ দুররুল মানছুর, সুয়ূতী: ১৩/২৫২-২৫৫; তাফসীরে আলূসী: ২৫/১১০-১১১) আর এই- لَيْلَةٍ مُبَارَكَة-সম্পর্কেই যেহেতু বলা হয়েছে- فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ-অর্থাৎ প্রতি বছর কোন্ ব্যক্তি জন্ম নেবে, তাকে কী পরিমাণ রিযিক দেওয়া হবে, কবে কার মৃত্যু হবে ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থির করা হয় এবং তা কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সুতরাং বুঝা গেল এই রাতেই (অর্ধ শা‘বানের রাতেই) মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ হয়। যদিও ইকরিমা রহ. (১০৬ হি.) সহ অন্যান্য কয়েকজন বলেছেন- لَيْلَةٍ مُبَارَكَةদ্বারা উদ্দেশ্য অর্ধ শা‘বানের রাত, কিন্তু ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (২২৪-৩১০ হি.) যামাখশারী (৫৩৮-৪৬৭ হি.) ইবনুল আরাবী (৪৬৮-৫৪৩ হি.) রাযী (৫৪৪-৬০৪ হি.) কুরতুবী (৬০০-৬৭১ হি.) ইবনে কাছীর (৭০০-৭৭৪ হি.) আলূসী (১২১৭-১২৭০ হি.) প্রমুখ মুফাসসিরীনে কেরামসহ অধিকাংশ মুহাক্কিক আলেমদের মতে ‘লাইলাতুন মুবারাকাহ’ বলে ক্বদরের রাতকে বুঝানো হয়েছে। দেখুন, ‘জামিউল বায়ান’ তাবারী: ২১/১০; তাফসীরে কাশশাফ, যামাখশারী: ৫/৪৬৪) আহকামুল কোরআন, ইবনুল আরাবী: ৪/১১৭; আরিযাতুল আহওয়াযী: ৩/২৭৫; তাফসীরে কাবীর, রাযী: ২৭/২৩৯; আল জামিউ লি আহকামিল কোরআন, কুরতুবী:৯/১০১, ১৯/১০০; তাফসীরে ইবনে কাছীর: ১২/৩৩৪; লাতাইফুল মাআরিফ, ইবনে রজব, পৃ. ২৬৮) তাফসীরে রূহুল মা‘আনী, মাহমূদ আলূসী: ২৫/১১০-১১১) তারা বলেন, উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে কোরআন ‘লাইলাতুল মুবারাকা’য় অবর্তীর্ণ হয়েছে আর সূরা ক্বদরে বলা হয়েছে যে, কোরআন ক্বদরের রাতে অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং বুঝা গেল এই ‘লাইতুল মুবারাকাহ’ই হচ্ছে ক্বদরের রাত। আর ক্বদরের রাত যেহেতু রমযানে হয়, সুতরাং - لَيْلَة مُبَارَكَة দ্বারা কখনো অর্ধ শা‘বানের রাত উদ্দেশ্য হতে পারে না। খোদ ইকরিমা রহ. থেকেও এরকম একটি মত বর্ণিত হয়েছে যে- لَيْلَة مُبَارَكَةদ্বারা ক্বদরের রাতই উদ্দেশ্য। দেখুন, তাফসীরে ইবনে আবী হাতেম: ৬/৩২৮৭; আদ দুররুল মানছূর: ১৩/২৪৯ কোরআনের আয়াতের পাশাপাশি বিশুদ্ধ বর্ণনা থেকেও যা জানা যায় তা হলো প্রতি বছর কোন্‌ ব্যক্তি জন্ম নেবে, তাকে কী পরিমাণ রিযিক দেওয়া হবে, কার মৃত্যু হবে ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থির করা হয় ক্বদরের রাতেই। দেখুন, তাফসীরে ইবনে আবী হাতেম: ১০/৩২৮৭; জামিউল বায়ান, তাবারী ২৪/৫৪৪-৫৪৫; আহকামুল কোরআন, কুরতুবী: ১৯/১০১-১০২; আদ দুররুল মানছুর, সুয়ূতী; ১৩/২৪৮-২৫২; তাফসীরে রূহুল মা‘আনী, আলূসী ২৫/১১৩। আর অর্ধ শা’বানে মানুষের জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি নির্ধারণ হওয়া সংক্রান্ত যেসব হাদীস এবং আছার বর্ণিত হয়েছে মুহাক্কিক আলেমদের দৃষ্টিতে এগুলো দুর্বল কিংবা অতি দুর্বল হওয়ার কারণে এমন পর্যায়ে পৌঁছেনি যে, বিশুদ্ধ বর্ণনার বিপরীত তা গ্রহণযোগ্য হবে। ইবনে কাছীর রহ. তার তাফসীর এ (১২/৩৩৪) এসম্পর্কে (মানুষের জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি অর্ধ শা’বানে নির্ধারণ হয়) উসমান বিন মুহাম্মদ বিন মুগীরাহ রহ. এর একটি রেওয়ায়াত উল্লেখ করে বলেন, ‘এটি মুরসাল। এমন বর্ণনা নুসূসের বিরুধিতা করতে পারে না।’ আব্দুল্লাহ বিন সিদ্দিক আল গুমারী রহ. তার হুসনুল বায়ান গ্রন্থে (পৃ.২০-২৩) এ সংক্রান্ত কয়েকটি রেওয়ায়াত উল্লেখ করে বলেন, ‘এসকল হাদীসগুলোর প্রতি উলামায়ে কেরাম দৃষ্টি দেন নি। কেননা একে তো এগুলো দুর্বল দ্বিতীয়ত এগুলো কোরআনের আয়াতের বিরুধী।’ কেউ কেউ সবগুলো বর্ণনাকে সামনে রেখে এভাবে সমন্বয় করেছেন যে, এখানে তিনটি বিষয়: একটি হচ্ছে বিভিন্ন বিষয়ের মূল তাক্বদীর অর্থাৎ এগুলোর পরিমাণ এবং সংঘটিত হওয়ার সময় নির্ধারণ করা। এটা হয়েছে আযল তথা অনন্তকালে (মানুষ সৃষ্টি হওয়ার অনেক আগে) যেমন সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৬৫২ এবঙ তিরমিযি, হাদীস নং-২১৫৬ এসেছে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা মাখলুক সৃষ্টির পঞ্চশ হাজার বছর আগে তাক্বদীর লিখে রেখেছেন।’ দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে অনন্তকাল আগের নির্ধারিত সেই তাক্বদীর ‘লওহে মাহফুজে’ লিপিবদ্ধ করে ফেরশতাদের কাছে প্রকাশ করা। এটা হয় অর্ধ শা‘বানের রাতে। আর তৃতীয় বিষয় হচ্ছে সেই তাক্বদীরকে বিভিন্ন কপিতে স্থানান্তর করা এবং দায়িত্বশীল ফেরেশতাদের কাছে তা অর্পণ করা; রিযিক, উদ্ভিদ, এবং বৃষ্টি সংক্রান্ত কপিটি মীকাঈল আলাইহিস সালাম এর কাছে। যুদ্ধ বাতাস, সৈন্য, ভূমিকম্প, বজ্র, ধ্বস জিবরীল আলাইহিস সালাম এর কাছে। আমল সংক্রান্ত কপিটি ইসরাফীল আলাইহিস সালাম এর কাছে। আর বিপদ-আপদ সংক্রান্ত বিষয়টি মালাকুল মাওত (আযরাঈল আলাইহিস সালাম) এর কাছে। এই তৃতীয় বিষয়টি সংঘটিত হয় ক্বদরের রাতে। (তাফসীরে রূহুল মাআনী: ৩০/১৯২)২ সারকথা: উপরোক্ত আলোচনা থেকে কয়েকটি বিষয় বুঝা গেল: ক.কোরআনে উল্লেখিত ‘লাইলাতুল মুবারাকাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য ক্বদরের রাত, অর্ধ শা‘বানের রাত নয়। এটাই অধিকাংশ আলেমদের অভিমত। কেননা এতে বলা হয়েছে কোরআন ‘লাইলাতুল মুবারাকা’য় অবর্তীর্ণ হয়েছে আর সূরা ক্বদরে বলা হয়েছে যে, কোরআন ক্বদরের রাতে অবতীর্ণ হয়েছে সুতরাং বুঝা গেল এই ‘লাইতুল মুবারাকাহ’ই হচ্ছে ক্বদরের রাত। আর জানা কথা ক্বদরের রাত রমযান মাসে এসে থাকে সুতরাং অর্ধ শা‘বানের রাত ‘লাইলাতুন মুবারাকাহ’ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। খ.ইকরিমা রহ. (১০৬ হি.)সহ অন্যান্য কয়েকজন থেকে ‘লাইলাতুল মুবারাকাহ’ দ্বারা অর্ধ শা‘বানের রাত উদ্দেশ্য হওয়ার যে মতটি বর্ণিত হয়েছে মুহাক্কিক আলেমদের কাছে এটি প্রত্যাখ্যাত। কেননা এটি কোরআনের আয়াতের বিরোধী। তাই এটি গ্রহণযোগ্য নয়। গ.কিছু কিছু বর্ণনায় যেহেতু এসেছে যে, অর্ধ শা‘বানের রাতে মানুষের জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয় তাই কেউ কেউ উক্ত বর্ণনাসমূহ এবং ক্বদরের রাতে তাকদীর নির্ধারণ সংক্রান্ত বর্ণনাসমূহের মাঝে mgš^q করেছেন যা ইতি উল্লেখ করা হয়েছে। ঘ.অর্ধ শা‘বানের রাতে তাক্বদীর নির্ধারণ হোক বা নাই হোক, কোন ক্রমেই অর্ধ শা‘বানের রাতটি মর্যাদার দিক দিয়ে ক্বদরের রাতের চেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না, সমপর্যায়েরও নয়। কেননা ক্বদরের রাত সম্পর্কে কোরআন হাদীসে যত ফযীলত এসেছে শবে বরাত সম্পর্কে এরূপ আসেনি। বিশেষত: কোরআন নাযিল হওয়ার মতো বরকতময় ঘটনা শবে ক্বদরেই সংঘটিত হয়েছে। তাছাড়া আল্লাহ পাক বলেছেন, এটি হাজার রাতের চেয়ে উত্তম যা অর্ধ শা‘বানের রাতের ক্ষেত্রে বলা হয় নি।
শবে বরাতের ভিত্তিহীন বিশেষ নামায: শবে বরাত ফযীলত উলামা ফুকাহাদের নিকট একটি সমাদৃত বিষয়। এসম্পর্কে নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এবং এই রাতে নফল নামায, দুআ-দরূদ, তিলাওয়াতে কোরআন মোটকথা সবধরণের ইবাদত করা শুধু বৈধই নয় বরং তা শরীয়তে কাম্য এবং মুস্তাহাব। তবে দু’টি বিষয় খুবই লক্ষ রাখতে হবে: ক.এ-রাতের সব ইবাদতই একাকী করতে হবে। ইবাদতের জন্য মসজিদে জড়ো হওয়া মাকরূহ। ইতিপূর্বে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। খ.নফল নামায যা ইচ্ছা পড়তে বাধা নেই কিন্তু এ-রাতের জন্য বিশেষ পদ্ধতির কোন নামায নেই। যেমন দু’রাকাতে এতবার সূরা এখলাছ পড়তে হবে, এতবার সূরা ফাতেহা পড়তে হবে ইত্যাদি। বিভিন্ন কিতাবে ‘সালাতুল আলফিয়্যাহ’ নামে শবে বরাতের বিশেষ পদ্ধতির একটি নামাযের কথা পাওয়া যায়। আবু শামাহ রহ. (৫৯৯-৬৬৫ হি.) তাঁর ‘আল বাইছ আলা ইনকারিল বিদাই ওয়াল হাওয়াদিছ’ গ্রন্থে (পৃ.৩২) বলেন, ‘সালাতুল আলফিয়্যাহ’ হচ্ছে অর্ধ শা‘বানের রাতের নামায এটাকে ‘আলফিয়্যাহ’ (হাজারি) নামকরণের কারণ হচ্ছে এতে একহাজার বার ‘কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ পড়তে হয়। একশত রাকাত পড়তে হয় প্রতি রাকাতে সূরা ফাতেহা একবার এরপর সূরা এখলাছ দশবার পড়তে হয়। (এভাবে এক হাজার বার সূরা ইখলাছ পড়া হয় এজন্য এর নাম হাজারী) এই হচ্ছে ‘সালাতুল আলফিয়্যাহ’ বা হাজারি নামায। শবে বরাত সম্পর্কিত এধরণের বিশেষ পদ্ধতির আরো অনেক নামায বিভিন্ন কিতাবে পাওয়া যায়। মুহাদ্দিসীনে কেরামদের স্বর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হচ্ছে এধরণের বিশেষ পদ্ধতির যত নামায রয়েছে সবগুলো ভিত্তিহীন। এখানে সবগুলো উল্লেখ করার আমার ইচ্ছাও নেই প্রয়োজনও নেই। কেননা ‘সালাতুল আলফিয়্যাহ’ এর প্রচলন বর্তমানে আমাদের এই অঞ্চলে আছে বলে কারো কাছে শুনি নি। ‘সালাতুল আলফিয়্যাহ’ নামের ঐ বিশেষ নামাযের প্রচলন যদিও আমাদের এ অঞ্চলে নেই কিন্তু এর পরিবর্তে আমাদের এখানে ভিত্তিহীন এবং মিথ্যাচারে ভরপুর কিছু বই যেমন ‘মাকসুদুল মু’মিনীন’ বা সহীহ মুকসুদুল মু’মিনীন’ জাতীয় বইয়ে শবে বরাতের জন্য নতুন পদ্ধতির কিছু ভিত্তিহীন নামাযের কথা প্রচার করা হয়েছে যা, সাধারণ মানুষ বিশেষতঃ মহিলাদের কাছে খুবই সমাদৃত। যাই হোক, বিশেষ পদ্ধতির যত নামায আছে সবগুলোই ভিত্তিহীন। মুহাদ্দিসীনে কেরামদের বক্তব্যসহ শা‘বান ও শবে বরাতের বিশেষ পদ্ধতির নামায সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখুন: আল মওযূআত, ইবনুল জাওযী:২/৪৪০-৪৪৩; আল মানারুল মুনীফ, ইবনুল কায়্যিম, পৃ.৯৮-৯৯; আল লাআলিল মাসনূআ, জালালুদ্দীন সুয়ুতী:২/৫৭-৬০; তানযীহুশ শারীআহ, ইবনে আররাক: ২/৯২-৯৪; আল আসরারুল মারফুআহ, মুল্লা আলী ক্বারী, পৃ.৪৩৯-৪৪০; ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন, যাবীদী: ৩/৪২৫-৪২৭; আল ফাওয়াইদুল মাজমূআহ, শাওকানী: ১/৭৫-৭৬; আল আছারুল মারফুআ, লখনোভী:৮০-৮৫; আরো দেখুন-ইকতিযাউস সিরাতিল মুসতাক্বীম, ইবনে তাইমিয়া: ২/৬৩২; মুখতাসারুল হাওয়াদিছি ওয়াল বিদা, তারতুশী, পৃ. ৮৬-৮৭; আল বাইছ আলা ইনকারিল বিদাই ওয়াল হাওয়াদিছ, আবু শামাহ: পৃ.৩২-৩৯; মিরকাতুল মাফাতীহ, মুল্লা আলী কারী: ৩/৩৫০; হুসনুল বায়ান ফী লাইলাতিন নিসফি মিন , আব্দুল্লাহ গুমারী, পৃ.৩০-৩৪; আল মাউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ:২/২৩৬।


--------
লিখেছেন: Mahbubul Hasan Arife
৬/৫/২০১৭ ইং

মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
মহান আললাহ আপনাকে সুস্থতা র সাথে নেক হায়াত দান করুন এবং উওম বিনিময় দান করুন

এই সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

ডাউনলোড করুন মাকতাবায়ে শামেলা লেটেস্ট ভার্শন (মোবাইল এবং পিসির জন্য)

রুকইয়াহ আশ-শারইয়্যাহ (ডাউনলোড)

ইসতিখারার সুন্নত তরিকা + pdf