নারী: উত্তরাধিকার এবং অধিকার প্রসঙ্গ
নারী: বঞ্চনা যার সর্বত্র সঙ্গী
আমার রক্তসম্পর্কীয় এক আত্মীয়া, যিনি বয়সের ভারে প্রায় ন্যুব্জ, আমার দেখা পেয়ে কথার ডালি খুলে বসলেন। এই কথা সেই কথার পর জিজ্ঞেস করলেন,
'আচ্ছা বলো তো, আমি যদি আমার বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে প্রাপ্য ওয়ারেসি সম্পত্তি নিয়ে নেই তাহলে ভাইদের সাথে আমার সব ধরনের সম্পর্ক চিরজীবনের জন্য শেষ হয়ে যাবে কথাটা কতোটুকু সত্য?'
আমি আগে থেকে জানতাম ভাইদের সাথে উত্তরাধিকার সম্পত্তি নিয়ে তার কিছুটা মনোমালিন্য চলছে। তার ছেলেদের কথা হলো, 'মা তুমি তোমার পাওনা অংশ নিয়ে নাও। আমাদের সংসারের টানাটানির গ্লানি কিছু হলেও তো কমবে। যেখানে নিজেদেরই চলে না, সেখানে তোমার এতো বদান্যতা দেখানোর তো কোন মানে হয় না। তাছাড়া তুমি তো কারো থেকে করুণা ভিক্ষা করছো না। নিজের পাওনা সম্পদ উসুল করে নিতে চাচ্ছো। এতে এতো সংকোচ আর লজ্জার কী আছে!'
আমি বুঝে নিলাম তিনি কেন প্রশ্নটা করলেন। আগে থেকেও কিছুকিছু জানতাম ব্যাপারটা। অনেক জায়গাতেই এমন ধারনা প্রচলিত আছে যে, বোনরা তাদের ওয়ারেসি সম্পত্তির ভাগ বুঝে নিয়ে গেলে বাপের বাড়ির সাথে তার সব ধরনের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। ভাইদের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। এসব ভেবে অনেক নারীই নিজের পাওনা সম্পদ নেন না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভাইদের দিয়ে দেন। দেওয়ার সময় আবার মুখে হাসিহাসি ভাব ফুটিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। ভাবটা এমন দেখান যে, এটি তিনি সন্তুষ্টচিত্তেই দিচ্ছেন। তার মুখে রাশিরাশি হাসির ঢেউ খেলা করলেও এর অপর পিঠেই লুকিয়ে থাকে একবুক মনোবেদনা আর পাহাড়সম কষ্টের ছড়াছড়ি।
অনেক ভাইয়েরাও ভাবটা এমন দেখান যে, বোনেরা তাদের ওয়ারেসি সম্পত্তি বুঝে নিয়েছে মানে হলো, এখন থেকে তাদের সাথে আর কোন সম্পর্ক রইলো না। যেহেতু বোনেরা নিজেদের পাওনা বুঝে নিয়ে নিয়েছে সুতরাং তারা এখন আর বাপের বাড়ি বেড়াতেও আসতে পারবে না বা আসলেও আগের মতো তাদের সমাদর করা ভাইদের কর্তব্যের মধ্যে ধর্তব্য হবে না। তো এসব কারণে দেখা যায় বোনরা মুখ বুঝে সব সয়ে নেয়। বাপের বাড়ির টানে আর ভাইদের সাথে সম্পর্ক রক্ষার্থের শানে তারা নিজেদের প্রাপ্য হকের দাবি পরিত্যাগ করে 'মহানুভবতা'র পরিচয় দেয়।
আমি উনাকে বললাম, 'শুনেন, এগুলো সব হলো ভাওতাবাজিমার্কা কথাবার্তা। বোনদের ঠকিয়ে তাদের পাওনা মেরে খাওয়ার উদ্দেশ্যে সমাজের কিছু অসৎ লোকেরা এসব অসত্য কথা প্রচার করে বেড়ায়। যাতে করে বোনেরা মানসিক চাপে পড়ে কিংবা ভয় পেয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের হক ছেড়ে দেন এবং সেটা ভাইদের পেটে যায়। শরীয়ত বোনদের যতোটুকু সম্পদ পাওয়ার বিধান দিয়েছে আপনি অবশ্যই তার হকদার। নিজের পাওনা বুঝে নিতে আপনি স্বাধীন। এর মাধ্যমে কখনোই বাপের বাড়ির সাথে আপনার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হবে না। যারা এমন বলে তারা ভুল বলে।'
উনার চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখি তখনও তার চেহারায় কেমন একটা সংশয়পূর্ণ ভাব। অসহায়ত্বের ছাপও সেখানে ফুটে উঠছে। কোনদিকে যাবেন ঠিক স্থির করে উঠতে পারছেন না। একদিকে সন্তানদের চাপ অন্যদিকে নিজের ভেতরে ভুলতথ্যের মিশ্রণে তৈরি হওয়া ভাবনা তাকে বিচলিত করে তুলছিলো। আমার খুব মায়া হচ্ছিলো তার চেহারার দিকে তাকিয়ে। বয়সের নির্মম কষাঘাত তার কালো চুলগুলোকে সাদা করে দিয়েছে। মুখাবয়বে নিয়ে এসেছে একরাশ ক্লান্তির ছাপ।
আমি আবার বলতে শুরু করলাম, 'ধরুন, আপনি আমার কাছে দশ হাজার টাকা পান। তো এই টাকা চাইতে কি আপনার মধ্যে কোন সংকোচবোধ হবে? না। টাকাটা আমার কাছ থেকে নিয়ে গেলে কি আপনার সাথে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক নিঃশেষ হয়ে যাবে? না। কারণ আপনি আমার থেকে জোর করে কিছু নিচ্ছেন না। বরং নিজের পাওনা টাকাটা নিচ্ছেন। এটাও ঠিক সেরকমই। সুতরাং এটা নিয়ে আপনার এতো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনই কারণ নেই। তাছাড়া এমনও তো নয় যে আপনি যথেষ্ট সচ্ছল আর আপনার ভাইয়েরা অসচ্ছল। সুতরাং আপনি যদি পাওনাটা না নিয়ে তাদের দিয়ে দেন তবে তাদের অনেক উপকার হবে। যদি সত্যি সত্যি এমন হতো তাহলে এই অবস্থাতেও তো শরীয়ত আপনাকে এই অধিকার দেয় যে, আপনি নির্বিঘ্নে আপনার প্রাপ্য অংশটুকু নিয়ে নিতে পারেন। যদি না নেন তবে সেটা আপনার দয়া ও মহানুভবতা বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু এখানে তো চিত্রটা বরং পুরোই উল্টো। তারা সকলেই আল্লাহর রহমতে সচ্ছল। তাদের যথেষ্ট অর্থসম্পদ আছে। এর বিপরীতে আপনার পরিবারে প্রতিনিয়ত চলছে টানাপোড়ন। অভাবের কষাঘাত দৈনন্দিন জীবনকে করে তুলছে বিষাক্ত আর বিষাদময়।'
আমার কথায় মনে হলো তিনি কিছু সস্থি পেয়েছেন। তারপর কি হয়েছিলো সেটা আর জানা নাই। তবে যাইহোক বা না হোক, কথা হলো, এমন সমস্যার সম্মুখীন যে তিনি শুধু একা তা কিন্তু নয়। বরং সমাজের পরতে পরতে এমন নারীর সংখ্যা অগণিত, যারা এভাবে বঞ্চনার শিকার হয়ে নিজেদের অধিকার হারাচ্ছেন। শতো কষ্টের মুখেও নিজেদের দুর্দশার কথা বলতে পারছেন না। মুখ বুজে সব সয়ে যাচ্ছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এ অনেক বড়ো ব্যর্থতা। যুগে যুগে ধান্ধাবাজ পুরুষেরা নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে বেছে নিয়েছে এমন সব কুট-কৌশলের। তৈরি করেছে ভয়ের জুজু। যা দিয়ে সহজে নারীকে ঘায়েল করা যায়।
------------------
লিখেছেনঃ Abdullah Al Masud
আমার রক্তসম্পর্কীয় এক আত্মীয়া, যিনি বয়সের ভারে প্রায় ন্যুব্জ, আমার দেখা পেয়ে কথার ডালি খুলে বসলেন। এই কথা সেই কথার পর জিজ্ঞেস করলেন,
'আচ্ছা বলো তো, আমি যদি আমার বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে প্রাপ্য ওয়ারেসি সম্পত্তি নিয়ে নেই তাহলে ভাইদের সাথে আমার সব ধরনের সম্পর্ক চিরজীবনের জন্য শেষ হয়ে যাবে কথাটা কতোটুকু সত্য?'
আমি আগে থেকে জানতাম ভাইদের সাথে উত্তরাধিকার সম্পত্তি নিয়ে তার কিছুটা মনোমালিন্য চলছে। তার ছেলেদের কথা হলো, 'মা তুমি তোমার পাওনা অংশ নিয়ে নাও। আমাদের সংসারের টানাটানির গ্লানি কিছু হলেও তো কমবে। যেখানে নিজেদেরই চলে না, সেখানে তোমার এতো বদান্যতা দেখানোর তো কোন মানে হয় না। তাছাড়া তুমি তো কারো থেকে করুণা ভিক্ষা করছো না। নিজের পাওনা সম্পদ উসুল করে নিতে চাচ্ছো। এতে এতো সংকোচ আর লজ্জার কী আছে!'
আমি বুঝে নিলাম তিনি কেন প্রশ্নটা করলেন। আগে থেকেও কিছুকিছু জানতাম ব্যাপারটা। অনেক জায়গাতেই এমন ধারনা প্রচলিত আছে যে, বোনরা তাদের ওয়ারেসি সম্পত্তির ভাগ বুঝে নিয়ে গেলে বাপের বাড়ির সাথে তার সব ধরনের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। ভাইদের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। এসব ভেবে অনেক নারীই নিজের পাওনা সম্পদ নেন না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভাইদের দিয়ে দেন। দেওয়ার সময় আবার মুখে হাসিহাসি ভাব ফুটিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। ভাবটা এমন দেখান যে, এটি তিনি সন্তুষ্টচিত্তেই দিচ্ছেন। তার মুখে রাশিরাশি হাসির ঢেউ খেলা করলেও এর অপর পিঠেই লুকিয়ে থাকে একবুক মনোবেদনা আর পাহাড়সম কষ্টের ছড়াছড়ি।
অনেক ভাইয়েরাও ভাবটা এমন দেখান যে, বোনেরা তাদের ওয়ারেসি সম্পত্তি বুঝে নিয়েছে মানে হলো, এখন থেকে তাদের সাথে আর কোন সম্পর্ক রইলো না। যেহেতু বোনেরা নিজেদের পাওনা বুঝে নিয়ে নিয়েছে সুতরাং তারা এখন আর বাপের বাড়ি বেড়াতেও আসতে পারবে না বা আসলেও আগের মতো তাদের সমাদর করা ভাইদের কর্তব্যের মধ্যে ধর্তব্য হবে না। তো এসব কারণে দেখা যায় বোনরা মুখ বুঝে সব সয়ে নেয়। বাপের বাড়ির টানে আর ভাইদের সাথে সম্পর্ক রক্ষার্থের শানে তারা নিজেদের প্রাপ্য হকের দাবি পরিত্যাগ করে 'মহানুভবতা'র পরিচয় দেয়।
আমি উনাকে বললাম, 'শুনেন, এগুলো সব হলো ভাওতাবাজিমার্কা কথাবার্তা। বোনদের ঠকিয়ে তাদের পাওনা মেরে খাওয়ার উদ্দেশ্যে সমাজের কিছু অসৎ লোকেরা এসব অসত্য কথা প্রচার করে বেড়ায়। যাতে করে বোনেরা মানসিক চাপে পড়ে কিংবা ভয় পেয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের হক ছেড়ে দেন এবং সেটা ভাইদের পেটে যায়। শরীয়ত বোনদের যতোটুকু সম্পদ পাওয়ার বিধান দিয়েছে আপনি অবশ্যই তার হকদার। নিজের পাওনা বুঝে নিতে আপনি স্বাধীন। এর মাধ্যমে কখনোই বাপের বাড়ির সাথে আপনার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হবে না। যারা এমন বলে তারা ভুল বলে।'
উনার চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখি তখনও তার চেহারায় কেমন একটা সংশয়পূর্ণ ভাব। অসহায়ত্বের ছাপও সেখানে ফুটে উঠছে। কোনদিকে যাবেন ঠিক স্থির করে উঠতে পারছেন না। একদিকে সন্তানদের চাপ অন্যদিকে নিজের ভেতরে ভুলতথ্যের মিশ্রণে তৈরি হওয়া ভাবনা তাকে বিচলিত করে তুলছিলো। আমার খুব মায়া হচ্ছিলো তার চেহারার দিকে তাকিয়ে। বয়সের নির্মম কষাঘাত তার কালো চুলগুলোকে সাদা করে দিয়েছে। মুখাবয়বে নিয়ে এসেছে একরাশ ক্লান্তির ছাপ।
আমি আবার বলতে শুরু করলাম, 'ধরুন, আপনি আমার কাছে দশ হাজার টাকা পান। তো এই টাকা চাইতে কি আপনার মধ্যে কোন সংকোচবোধ হবে? না। টাকাটা আমার কাছ থেকে নিয়ে গেলে কি আপনার সাথে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক নিঃশেষ হয়ে যাবে? না। কারণ আপনি আমার থেকে জোর করে কিছু নিচ্ছেন না। বরং নিজের পাওনা টাকাটা নিচ্ছেন। এটাও ঠিক সেরকমই। সুতরাং এটা নিয়ে আপনার এতো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনই কারণ নেই। তাছাড়া এমনও তো নয় যে আপনি যথেষ্ট সচ্ছল আর আপনার ভাইয়েরা অসচ্ছল। সুতরাং আপনি যদি পাওনাটা না নিয়ে তাদের দিয়ে দেন তবে তাদের অনেক উপকার হবে। যদি সত্যি সত্যি এমন হতো তাহলে এই অবস্থাতেও তো শরীয়ত আপনাকে এই অধিকার দেয় যে, আপনি নির্বিঘ্নে আপনার প্রাপ্য অংশটুকু নিয়ে নিতে পারেন। যদি না নেন তবে সেটা আপনার দয়া ও মহানুভবতা বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু এখানে তো চিত্রটা বরং পুরোই উল্টো। তারা সকলেই আল্লাহর রহমতে সচ্ছল। তাদের যথেষ্ট অর্থসম্পদ আছে। এর বিপরীতে আপনার পরিবারে প্রতিনিয়ত চলছে টানাপোড়ন। অভাবের কষাঘাত দৈনন্দিন জীবনকে করে তুলছে বিষাক্ত আর বিষাদময়।'
আমার কথায় মনে হলো তিনি কিছু সস্থি পেয়েছেন। তারপর কি হয়েছিলো সেটা আর জানা নাই। তবে যাইহোক বা না হোক, কথা হলো, এমন সমস্যার সম্মুখীন যে তিনি শুধু একা তা কিন্তু নয়। বরং সমাজের পরতে পরতে এমন নারীর সংখ্যা অগণিত, যারা এভাবে বঞ্চনার শিকার হয়ে নিজেদের অধিকার হারাচ্ছেন। শতো কষ্টের মুখেও নিজেদের দুর্দশার কথা বলতে পারছেন না। মুখ বুজে সব সয়ে যাচ্ছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এ অনেক বড়ো ব্যর্থতা। যুগে যুগে ধান্ধাবাজ পুরুষেরা নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে বেছে নিয়েছে এমন সব কুট-কৌশলের। তৈরি করেছে ভয়ের জুজু। যা দিয়ে সহজে নারীকে ঘায়েল করা যায়।
------------------
লিখেছেনঃ Abdullah Al Masud
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন