তারাবীহ সালাত নিয়ে শিয়া কাফেরদের বিভ্রান্তির জবাব
রমজান মাসে আমরা মুসলিমরা রাত্রিতে নামাজে দাঁড়িয়ে কুরআন শুনে থাকি যাকে তারাবীহ বলা হয়। ইহুদি ঔরসজাত সাবাঈ শিয়া ধর্মাবলম্বীরা একে বিদাআত বলে দাবি করে এবং তারাবীহ’র নামাজ জামাআতে আদায় করাকে উমর(রা)’র আবিষ্কৃত বলে দাবি করে।
✤ বিদাআত কি?
বিদাআত হল, নতুন উদ্ভাবিত এমন ইবাদত বা তার পন্থা- যেটার রাসূলুল্লাহ(ﷺ)এর জীবনে,কাজে বা কথায় কোন অস্তিত্ব নেই। তারাবীহ বিদাআত হবার জন্য ২টি জিনিস লাগবে-
১)রাসূল(ﷺ) কখনো তারাবীহ পরেননি,
২)পড়লেও, পরবর্তীতে একে ইসলামে নিষিদ্ধ করে দিয়ে গিয়েছেন।
এই ২ শর্ত না পাওয়া গেলে এটিকে কাফেররা বিদাআত দাবি করতে পারে না।
এখন,আমরা হাদিসে লক্ষ্য করি, রাসূল(ﷺ) এর তারাবীহ আদায়ের দৃষ্টান্তঃ-
❀ যায়দ ইব্ন সাবিত(রা) থেকে বর্ণিতঃ নবী(ﷺ) চাটাই দিয়ে মসজিদে একটি হুজরা বানিয়ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) তার ভিতর কয়েক রাত সালাত পড়লেন। এতে লোকেরা তার সঙ্গে একত্রিত হত। তারপর এক রাতে তারা তাঁর আওয়ায শুনতে পেল না এবং তারা ভাবল, তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাদের কেউ কেউ গলা খাকার দিতে লাগল, যাতে তিনি তাদের নিকট বেরিয়ে আসেন। তখন তিনি [নবী (ﷺ)] বললেনঃ তোমাদের এ ক’ দিনের কর্মকান্ড আমি দেখেছি, এতে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, তোমাদের উপর তা ফরয করে দেওয়া থেকে পারে। কিন্তু যদি তোমাদের উপর ফরয করে দেওয়া হয় তাহলে তোমরা তা প্রতিষ্ঠিত করবে না। কাজেই ওহে লোকেরা! তোমরা নিজ নিজ ঘরে সালাত পড়। কারন, মানুষের সবচেয়ে উত্তম সালাত হল যা সে তার ঘরে আদায় করে ফরয সালাত ছাড়া।
[সহি বুখারী, ৬৭৯২,কুরআন ও সুন্নাহ অধ্যায়]
❀ আয়েশা(রা) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ(ﷺ) এক রাত্রে মাসজিদে নামায (তারাবীহ) আদায় করলেন। তাঁর (ইকতিদা) করে লোকজনও নামায আদায় করলেন। অতঃপর পরবর্তী রাত্রেও নামায আদায় করলেন। (সে রাত্রে) অনেক লোকের সমাগম হল। তারপর তৃতীয় অথবা চতুর্থ রাত্রে তাঁরা একত্র হলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বের হলেন না। যখন প্রভাত হল, তিনি (কারণ) বললেন, তোমাদের কার্যক্রম আমি লক্ষ করেছি , তোমাদের উপর (তারাবীহ) ফরয করে দেওয়া হবে, এটা আমাকে বের হওয়া হতে বারণ করেছে। এটা ছিল রমাযানের ঘটনা।
[মুয়াত্তা মালিক,রমযানের সালাত অধ্যায়,রি-১; বুখারী ১১২৯, মুসলিম ৭৬১]
❀ আবূ যর(রা) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমরা একবার রাসূলুল্লাহ(ﷺ) এর সাথে সিয়াম পালন করেছিলাম। রমযান মাসে তিনি আমাদের নিয়ে তারাবীহ'র সালাত আদায় করলেন না। যখন মাসের মাত সাত রাত্র অবশিষ্ট রয়ে গেল, তিনি আমাদের নিয়ে তারাবীহ'র সালাত আদায় করতে লাগলেন রাত্রের তৃতীয় প্রহর অতিবাহিত হওয়া পর্যন্ত। যখন মাসের ছয় রাত্র অবশিষ্ট রয়ে গেল তিনি আমাদের নিয়ে তারাবীহ্'র সালাত আদায় করলেন না। যখন পাঁচ রাত্র অবশিষ্ট রয়ে গেল তিনি আমাদের নিয়ে তারাবীহ'র সালাত আদায় করলেন অর্ধ রাত্রি অতিবাহিত হওয়া পর্যন্ত। আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ্! যদি আপনি আমাদের নিয়ে অত্র রাত্রের অবশিষ্ট অংশেও নফল সালাত আদায় করতেন! তিনি বললেন, যে ব্যক্তি ইমামের সাথে তারাবীহ'র সালাত আদায় করে ঘরে ফিরে যায় আল্লাহ তা'আলা তার জন্য পূর্ণ রাত্রি সালাত আদায় করার সওয়াব লিখে রাখেন। অতঃপর তিনি আমাদের নিয়েও তারাবীহ'র সালাত আদায় করলেন না এবং নিজেও আদায় করলেন না। যখন মাসের তিন রাত্রি অবশিষ্ট রয়ে গেল, তিনি আমাদের নিয়ে ঐ রাত্রে তারাবীহ'র সালাত আদায় করলেন (এবং ঐ সালাতে) তাঁর সন্তান-সন্ততি এবং পরিবারবর্গও জড়ো হয়ে গেল। আমরা আশংখা করতে লাগলাম যে, "ফালাহ" না হারিয়ে ফেলি। আমি বললাম, "ফালাহ"-এর অর্থ কি? তিনি বললেন, সাহরি খাওয়ার সময়। [সুনানে নাসাঈ, ১৬০৮,১৬০৯]
❀ নুআয়ম ইব্ন যিয়াদ আবূ তাল্হা থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি নুমান ইব্ন বশীর (রাঃ)-কে হিম্স নামক স্থানের মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছি, আমরা একবার রাসূলুল্লাহ(ﷺ) -এর সাথে রমযান মাসের তেইশতম রাত্রের প্রথম এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত তারাবীহ্'র সালাত আদায় করলাম। অতঃপর পঁচিশতম রাত্রে তাঁর সাথে অর্ধ রাত্রি পর্যন্ত তারাবীহ্'র সালাত আদায় করলাম। আবার তাঁর সাথে সাতাইশতম রাত্রেও তারাবীহ্'র সালাত আদায় করতে লাগলাম। এমন কি আমরা আশংকা করলাম যে, "ফালাহ" পাব না। সাহাবীগণ সাহরীকে ফালাহ বলতেন।[সুনানে নাসাঈ,১৬০৯]
❀ আবূ হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ(ﷺ) রমাযানের তারাবীহর জন্য ওয়াজিব নামাযের মত নির্দেশ দান করতেন না বটে, কিন্তু এটার জন্য অধিক উৎসাহ প্রদান করতেন এবং ফরমাইতেন যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাব-এর (অর্থাৎ আল্লাহর উপর ঈমানসহ ও সওয়াবের আশায়) সাথে রমাযানের তারাবীহ আদায় করবে তার বিগত সমুদয় (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করা হবে।
[মুয়াত্তা মালিক,রমযানের সালাত অধ্যায় রি-১;বুখারী ২০০৮, মুসলিম ৭৫৯]
❀ ছালাবা বিন আবি মালিক(রা) ও আবু হুরায়রা(রা) বর্ণিতঃ রমযানের এক রাতে রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বের হলেন এবং লোকেদেরকে মসজিদের এক কোণায় সালাত আদায় করতে দেখলেন। এরপরে তিনি বললেন-“এরা কারা।”? কেউ একজন বলল- হে রাসূলুল্লাহ! এরা এমন লোক যাদের সাথে কুরআন নেই(মুখস্থ নেই) আর উবাই ইবন কা’ব তাদেরকে তা তিলাওয়াত করে শুনাচ্ছে এবং তাদের সাথে সালাত আদায় করছে। রাসূল(ﷺ) বললেন-“ভাল করেছে”। তিনি এটিকে অপছন্দ করেননি।
[সুনানুল কুবরা-বায়হাকী ৪২১১,৪২১২; আত-তামহিদ ১১১/৮]
সুতরাং, এখানে প্রমাণিত যে,
➀ নবী(ﷺ) রমজানের রাতে তারাবীহের সালাত আদায় করেছেন,
➁ রাসূল(ﷺ)এর পিছে লোকেরা জামাআত ধরে তারাবীহ পরেছে,
➂ ৩ দিনের পরে আর তা আদায় করেননি সবার সাথে, কারণ হিসাবে তিনি তারাবীহকে বাতিল হয়ে গেছে এমন বলেন নাই, বলেছেন- নবী(ﷺ) এর নিয়মিত আমলের ফলে তা উম্মতের জন্য ফরজ হয়ে যেতে পারে।যেমন, তিনি প্রতিবেশীর হক্ক নিয়ে জিবরাঈল(আ)এর বার বার তাকিদা দেয়ার কারণে ভেবেছিলেন যে, প্রতিবেশীদেরকে উত্তরাধিকারী করার হুকুম আসে কিনা! নবী(ﷺ) কখনো অনেক বেশি নফল রোযা রাখতেন যাতে সাহাবাদের মনে হত যে তিনি সারা জীবন রেখে যাবেন, আবার কখনো রোযা রাখা এমন করে বন্ধ রাখতেন যেন মনে হত আর রোযা রাখবেন না। এসবই ছিল উম্মাহর প্রতি বোঝা বেড়ে যাবার ভয়ে। এছাড়া যেহেতু তিনি ছিলেন নবী,তাঁর যেকোন আমলের জরুরিভাবে পালন করাকেই সাহাবারা ওহী হিসাবে জেনে নিতেন,অথবা ওহী কিনা তা জিজ্ঞাসা করতেন।
➃ নবী(ﷺ) তারাবীহ’র ফযিলাত বর্ণনা করেছেন।
এসব থেকে পরিষ্কার সাব্যস্ত হয় যে- তারাবীহ’র নামাজ স্বয়ং রাসূল(ﷺ) আদায় করেছেন,লোকেরাও তাঁর পিছে আদায় করেছে , সুতরাং এটি সুন্নাহ প্রমাণিত। পরবর্তীতে তা ওইভাবে মসজিদে আদায় বন্ধ করে দেন কারণ, তাঁর ভয় ছিল উম্মতের উপরে এটি ফরজ হয়ে যাবে, কষ্টকর হবে এবং উম্মতের অনেকেই তা আদায় করতে পারবে না। মোটকথা, তারাবীহ বাতিল ঘোষণা করার কোন প্রমাণ নেই।
❁ উমর(রা)’র এর “উত্তম বিদাআত” বলাঃ-
শিয়া কাফেরদের হাতে শেষমেষ ঐ একটাই সম্বল রয়, তা হল- উমর(রা)এর সময় আবারো জামাআতে শুরু হয় তারাবীহ, আর উমর(রা) সেটাকে উত্তম বিদাআত বলেছেন।
আসুন দেখে নেই, উমর(রা)’এর সেই বর্ণনাটি-
❀ আব্দুর রহমান ইবন আব্দুল ক্কারী(র) থেকে বর্ণিতঃ
আমি মাহে রমযানে উমার ইবনু খাত্তাব (র)-এর সাথে মসজিদের দিকে গিয়েছি, (সেখানে গিয়ে) দেখি লোকজন বিভিন্ন দলে বিভক্ত। কেউ একা নামায আদায় করছেন, আবার কেউ-বা নামায আদায় করতেছেন এবং তাঁর ইমামতিতে একদল লোকও নামায আদায় করছেন। (এই দৃশ্য দেখে) উমার (রাঃ) বললেন, আমি মনে করি যে, (কত ভালই না হত) যদি এই মুসল্লিগণকে একজন কারীর সাথে একত্র করে দেওয়া হত! অতঃপর তিনি উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ)-এর ইমামতিতে একত্র করে দিলেন। (আবদুর রহমান) বলেন, দ্বিতীয় রাত্রেও আমি তাঁর সাথে (মসজিদে) গমন করলাম। তখন লোকজন তাঁদের কারীর ইকতিদায় নামায আদায় করেছিলেন। উমার (রাঃ) (এটা অবলোকন করে) বললেন, نِعْمَتِ الْبِدْعَةُ هَذِهِ ‘ এটা অতি চমৎকার বিদ’আত বা নূতন পদ্ধতি।’ আর যে নামায হতে তারা ঘুমিয়ে থাকে তা উত্তম ঐ নামায হতে, যে নামাযের জন্য তারা জাগ্রত হয়, অর্থাৎ শেষ রাতের নামাযই উত্তম। [উমার (রাঃ)] এটা এজন্যই বলেছিলেন, অনেক লোকের অবস্থা (এই ছিল) রাত্রের শুরু ভাগে তারা নামায আদায় করে নিলেন। কেউ কেউ শেষ রাত্রে তারাবীহ পড়া অধিক উত্তম মনে করতেন।
[মুয়াত্তা মালিক ২৪২; সহীহ বুখারী ২০১০]
✍ আগেই কিছু কথা বলে নেয়া- ইসলামের শরিয়াতে বিদাআত বলা হয় এমন আবিষ্কৃত ইবাদত দাবিকৃত কাজকে, যে ব্যাপারে রাসূল(ﷺ)এর আমলের কোন রেকর্ড বা নির্দেশ নেই। যেমনটা হাদিসে বলা হয়েছে- من أحدث في أمرنا ما ليس منه فهو رد, রাসূল(ﷺ) হতে বৈধতা না থাকলে সেই আমল বাতিল{মুসলিম ৪২৬৬; আবু দাঊদ ৪৬০৬}
উমর(রা)এর “বিদাআত” কথাটি শরিয়াতের পরিভাষায় নয়,যাদের কাছে ঐদিনের ঘটনা নতুন বোধ হয়েছিল, তাদের জন্য ব্যবহারকৃত শব্দ।
তারাবীহ’র সালাত যে রাসূল(ﷺ) স্বয়ং আদায় করেছেন তা একাধিক হাদিস থেকে প্রমাণ করা হয়েছে উপরে। এবং তিনি যে নিজের করা ঐ আমল আবার বাতিল করেছেন সেরকম কোন বক্তব্য বেই, সুতরাং এটির বিদাআত হবার রাস্তা বন্ধ।
শুধুমাত্র ফরজ হবার ভয়ে মসজিদে আদায় বন্ধ হয়েছিল। পরবর্তীতে আবু বকর(রা)এর ২ বছরের সংক্ষিপ্ত খিলাফতের সময়েও মানুষ সেভাবেই আদায় করতে থাকে। ২য় খলিফা উমর(রা)এর সময়ে মসজিদসমূহে লোকসংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায়, তখন তিনি একদিন গিয়ে লোকেদেরকে বিচ্ছিন্নভাবে তারাবীহ আদায় করতে দেখেন।
✿ উল্লেখ্য, তখনো কেউ কেউ জামাতে তারাবীহ আদায় করছিল, উমর(রা) যা করলেন তা হল- একাকী এবং ছোট ছোট জামাআত না করে সবাইকে একজন ক্কারী/ইমামের পিছে নামাজ আদায় করালেন।
✿ নবী(ﷺ) যেভাবে তারাবীহ পড়িয়েছেন সেভাবেই, আবার শুরু হল, কিন্তু এখন যেহেতু তিনি উম্মতের মাঝে নেই, তাই ফরজ হয়ে যাবার সেই ভয় বা সম্ভাবনা বিদ্যমান ছিল না।
কয়েক বছর ধরে মুসল্লিরা একাকী কিংবা বিচ্ছিন্ন ছোট জামাআতে তারাবীহ পরে আসছিল। উমর(রা) তাঁদেরকে একজন ইমামের পিছে এক জামাআতে নিয়ে আসলেন। অনেকের কাছেই তা নতুন ঘটনা হয়েছে, যেহেতু অনেকেই রাসূল(ﷺ)এর সময়ের তারাবীহ’র ঘটনা,কি কারণে তিনি আর মসজিদে পড়াননি-এসব ব্যাপারে অজ্ঞাত ছিল। তাই হয়ত তারা উমর(রা)’র এই কাজকে নতুন উদ্ভাবন(বিদাআত) বলে প্রশ্ন তুলেছিল। আর উমর(রা)ও তাদের প্রশ্নের কথা ধরেই বলেছেন- যদি এটা বিদাআত হয় তাহলে তা উত্তম বিদাআত।
প্রকৃতপক্ষে উমর(রা) একটি সুন্নাহ পুনঃজীবিত করেছেন, শরিয়াতের মাপকাঠিতে তা বিদাআত হয় না। এটিকে “উত্তম বিদাআত” বলা তাদের জন্য যারা এটাকে বিদাআত মনে করেছিল, এবং যাদের কাছে এই ঘটনা নতুন লেগেছিল।
✿ ‘উত্তম বিদাআত’ বিষয়ে বুখারীর হাদিসের বাইরে আরো একটি মতনে রিওয়ায়াত আছে, যেটিকে ইমাম কুরতুবী(র) তাঁর কিতাবুস সিয়াম ১২৮/১ এ এবং ইবনে রজব হাম্বলী(র) তাঁর জামিঊল উলুম ওয়া-হুকুম ২৬৬/১- এ সনদ এর বর্ণনাকারীদের বিশ্বস্ত বলেছেন। ঐ রিওয়ায়াতে শেষে উমর(রা) বলেছেন- إن كانت هذه بدعة فنعمت البدعة هذه , ‘যদি এটি বিদাআত হয়,তাহলে তা কত উত্তম বিদাআত’।[শরহে নুখবাতুল ফিকর ৬/৭; তুহফাতুল আহওয়াযী ৩৬৬/৭; আওনুল মা’বুদ ১৭৩/৪]
এখানে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, কেউ কেউ একজন ইমামের পিছে সবাই জামাআতে তারাবীহ আদায়কে বিদাআত হয়ার প্রশ্ন তোলায় উমর(রা) ঐ ‘উত্তম বিদাআতের’ উক্তি করেছিলেন।
✿ উমর(রা)এর এই ধরণের উক্তি,যা কারো প্রশ্নের কথায় উত্তর দেয়ার ন্যায়- তা দিয়ে ঐ কথার স্বীকৃতি সাব্যস্ত হয় না, বরং শর্তযুক্ত বা নেতিবাচকই থেকে যায়। যেমন, আল্লাহ্ তাআলা কুরআনে বলেছেন- قُلْ إِنْ كَانَ لِلرَّحْمَنِ وَلَدٌ فَأَنَا أَوَّلُ الْعَابِدِينَ (বল, দয়াময় আল্লাহ্র কোন সন্তান থাকলে আমিই হতাম প্রথম উপাসনাকারী)[সূরা যুখরুফঃ আয়াত ৮১]
এখানে সন্তান থাকার বিষয়টি ইতিবাচক নয়, বরং যদি থাকত এমন অর্থে মুশরিকদের কথার জবাব দেয়া হয়েছে। একিভাবে উমর(রা)ও আপত্তিকারীদের কথার জবাবে বলেছিলেন- যে এটা বিদাআত হলে বরং উত্তম বিদাআত।
যেমন, ইমাম শাফিঈ(র) বলেছিলেন, “যদি আহলে বাইতকে ভালবাসলেই রাফিজী হয়,তাহলে আমি রাফিজী”। তারমানে এই না যে, তিনি আসলেই রাফেজী হয়েছেন, তিনি ঐ শর্তকে রদ করে এই কথা বলেছেন!
✿ রাসূলুল্লাহ(ﷺ) এর সময়েও তিনি বিক্ষিপ্তভাবে জামাআত হতে দেখলে একত্রে করে সালাত আদায় করতেন রমযানের রাতে।
আয়শা(রা) থেকে বর্ণিত- রমযান মাসের রাতে মসজিদে নববীতে লোকেরা বিক্ষিপ্ত দলে সালাত আদায় করত। কেউ যদি কুরআনের কিছু মুখস্থ রাখত,সে ৫-৬ জনের দলকে নিয়ে সালাত আদায় করত। এক রাতে নবী(ﷺ) আমাকে নির্দেশ দিলেন আমার ঘরের বাইরে নামাজের জন্য মাদুর বিছাতে। তিনি যাবার পরে মসজিদে লোকেরা জামাআতবদ্ধ হল এবং তিনি তাঁদের নিয়ে দীর্ঘসময় সালাত আদায় করলেন। [মুসনাদ আহমদ ২৬১৭৫; নাইলুল আওতার ৯৪৫]
☬ শিয়া ধর্মগ্রন্থে তারাবীহ’র অস্তিত্বঃ-
তাকিয়ার ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন শিয়া ধর্মে নানারকম বর্ণনার মাঝে কিছু রিওয়ায়াত পাওয়া যায় রমজানে জামাআতে আলাদা সালাত/তারাবীহ আদায় বিষয়ে, তারমধ্যে কিছু,-
◎ আবু আব্দুল্লাহ(আ) বলেন- রাসূলুল্লাহ(সা) রমযান মাসে তাঁর সালাত বৃদ্ধি করতেন। আতমাহ(সন্ধ্যার পরে সালাত)’র পরে তিনি আরো সালাত আদায় করতেন। লোকেরা তাঁর পিছে দাঁড়িয়ে যেত,কিন্তু তিনি তাদের ছেড়ে ভিতরে চলে যেতেন। তিনি বেরিয়ে আসলে লোকেরা আবার তাঁর পিছে সালাতে দাঁড়িয়ে যেত, কিনতি তিনি তাদের ছেড়ে এভাবে একাধিক বার ভিতরে চলে যেতেন। বর্ণনাকারী হতে, (ইমাম) বলেন- রমযান মাস ছাড়া অন্য সময়ে সন্ধ্যার শেষে নামাজের পরে আর নামাজ আদায় করবে না। [আল কাফি ৯৪/৪,বাব ১১২,রি-২; মিরাত আল উক্কুল ৩৭৮/১৬; ওয়াসায়েল আশ-শিয়া রি-১০০২২]
◎ মুহাম্মদ বিন ইয়াহইয়া বর্ণিত, ‘আমি আবু আব্দুল্লাহ(আ) এর কাছে ছিলাম,তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে,রমযানে নফল সালাত বৃদ্ধি করব কিনা? তিনি বললেন- হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ(সা) আতমাহ এর পরে আরো সালাত আদায় করতেন। লোকেরা তাঁর পিছনে জামাআতবদ্ধ হয়ে সালাতে দাঁড়াত। যখন তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তিনি তাদের ছেড়ে ঘরে চলে যেতেন। লোকজন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তিনি আবার এসে মসজিদে আগের মত সালাত আদায় করতেন। আবার লোকসংখ্যা বেড়ে গেলে তিনি ছেড়ে চলে যেতেন।এভাবে তিনি কয়েক বার করতেন। [তাহযিবুল আহকাম রি-২০৫(৩য় খণ্ড); আল ইস্তিবসার রি-১৭৯৫(১ম খণ্ড); মিসবাহুল ফকীহ ৫২/২]
এখানেও আমরা একই চিত্র দেখতে পাই যে, রাসূল(ﷺ) রমযান মাসের রাতে অতিরিক্ত সালাত আদায় করেছেন, কিন্তু লোকজন বেড়ে গেলে তিনি আবার বন্ধ করেছেন, যেমনটা মুসলিমদের কিতাবের হাদিসে জানতে পারি যে তিনি উম্মতের উপরে ফরজ হয়ে যাবার আশংকায় এমন করেছেন।
۞ আলী(রা) ও তারাবীহঃ-
উমর(রা)-এর খিলাফতের পরে উসমান(রা), অতপর আলী(রা)-এর খিলাফতও সাক্ষী হয়েছে তারাবীহ’র। আসুন দেখে নেই এই ব্যাপারে আলী(রা)’র কাজ ও মতঃ-
আলী(রা) কখনো নিজেই তারাবীহ সালাতে ইমামতি করেছেন, অথবা লোকেদের নির্দেশ দিয়েছেন, তিলাওয়াতকারী নিয়োগ দিয়েছেন ইত্যাদি।
۩ আবু আব্দুর রহমান হতে বর্ণিত, আলী(রা) রমযানে(সালাতে) লোকেদের জন্য দাঁড়াতেন(ইমামতি করতে) [মুসান্নাফ ইবন আবি শায়বা ৭৭০০]
۩ আলী(রা) রমযানে ক্কারীদেরকে নিয়োগ করতেন ২০ রাকাআত(তারাবীহ) পড়াবার জন্য; এরপরে তিনি লোকেদেরকে বিতর সালাতে ইমামতি করতেন। [বায়হাকী-সুনানুল কুবরা ৪৬২০]
۩ উরফাজাহ আস-ছাকাফী বলেন- আলী(রা) রমযানে লোকদেরকে কিয়ামে ইমামতি করতেন। তিনি পুরুষদের জন্য ইমাম নিয়োগ করতেন এবং মহিলাদের সালাতের জন্য ইমাম নিয়োগ করতেন, আমি মহিলাদের ইমাম ছিলাম। [বায়হাকী-সুনানুল কুবরা ৪৬০৬]
۩ আবু বকর ইবন আইয়্যাশ বলেন- আমি আতা’কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, আলী(রা) কি রমযানের সালাতে ইমামতি করতেন? সে বলল- যাদান,আবুল বুখতারী’র ন্যায় আলী(রা)এর উত্তম সাথীগণ তাঁদের পরিবারকে ডেকে রমযানের সালাত আদায় করতেন। [মুসান্নাফ ইবন আবি শায়বা ৭৬৯৪]
কুফা শহরে বের হয়ে তারাবীহ আদায় হতে দেখে তিনি উমর(রা)-এর জন্য দুয়া করেছেন-
۩ আবু ইসহাক হামাদানী বলেনঃ আলী বিন আবি তালিব(রা) রমযানের প্রথম রাতে বের হলেন, যখন বাতিগুলো জ্বলছিল এবং মসজিদে কিতাবুল্লাহ(কুরআন) তিলাওয়াত হচ্ছিল। তখন আলী(রা) দুয়া করলেন- আল্লাহ্ আপনার কবরকে নূর দ্বারা পূর্ণ করুন হে উমর বিন খাত্তাব! যেভাবে আপনি আল্লাহ্র ঘরকে কুরআন দ্বারা আলোকিত করেছেন। [জামিউল আহাদিস-সুয়ূতী ৩৩২৪৬; রহুল বায়ান ৪০০/৩; ফাযায়েলে রমযান-ইবনে আবি দুনিয়া]
~ The Rafidologist
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন