সাবাঈ শিয়া-রাফেযী ধর্মের বিবর্তন ও শাখাপ্রশাখাসমূহ
ইসলামের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়ার সাহস না থাকায়,ইসলামের ভিতরে ছদ্মবেশ নিয়ে অবস্থান করে ভাঙন,দল-উপদল সৃষ্টি ও ইসলামের মৌলিক বিষয়কে বিকৃত করে বিনষ্ট করার অভিযান শুরু হয় উসমান(রা)এর শাসনামলে সাবাঈ ছুপা ইহুদিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহের মাধ্যমে। তাঁকে হত্যার পরে বিদ্রোহীদের এক বড় অংশ আলী(রা)এর হাতে বাইয়্যাত দিয়ে নিজেদেরকে আলী-প্রেমী দাবি করতে থাকে, কিন্তু তখনো “আহলে বাইতের শিয়া” ইত্যাদি নামে দল খোলা হয়নি সেরকমভাবে, অথবা আহলে বাইতের নামে মিথ্যা হাদিস রচনার জালিয়াতি অতটা গতি পায়নি।
আলী(রা)এর খিলাফতকালে মুয়াবিয়া(রা)এর সাথে বিরোধের সময়ে, সাহাবাদের কেউ আলী(রা)এর পক্ষে আবার অনেকে মুয়াবিয়া(রা)এর পক্ষে অবস্থান নেন। এই পরিস্থিতিকে সাবাঈরা বিভেদ সৃষ্টির মোক্ষম সময় বিবেচনা করে। তারা মুয়াবিয়া(রা)কে নয়, সেই পিছনে ফিরে আবু বকর(রা),উমর(রা) এর খিলাফতকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, আলী(রা) এর ইমামত,অসিয়্যাত-ইত্যাদি নানাবিধ মিথ্যা দাবি তুলে এবং তাদের অনেকে আলী(রা)কে রব দাবি করে। সাবাঈরা এই সময়ে বিশেষভাবে নিজেদের ‘আলীর শিয়া’ পরিচয় দিতে শুরু করে এবং আলী(রা)কে সকলের শ্রেষ্ঠ দাবি করে। যে ক’জন সাহাবা জীবিত ছিলেন তারা অনেকে ইজতিহাদ করে যুদ্ধে জড়ালেও ঘৃণা,বিদ্বেষ থেকে দূরে ছিলেন,স্বয়ং মুয়াবিয়া(রা)ও স্বীকার করতেন যে আলী(রা) তাঁর থেকে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ। বেশিরভাগই বিরত থাকেন, তালহা(রা) ও যুবায়র(রা)এর মত অনেকে যুদ্ধের ময়দান পর্যন্ত গিয়েও যুদ্ধ ছেড়ে দেন।
ন্যায়পরায়ণ তাবেঈরাও ফিতনার সময়ে ঐক্যের পক্ষে ছিলেন। এমনকি আলী(রা)এর পুত্র মুহাম্মদ ইবন হানাফিয়্যা(র) স্বয়ং গৃহযুদ্ধ থেকে বিরত থাকেন। যার উদ্দেশ্যে আলী(রা) বলেন- ‘হায়! তুমি বসে আছ, আর তোমার পিতা তোমাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে!’ [তারিখে তাবারী ৪৪/৩]
তাফযিলী শিয়াঃ
তাবেঈ ও বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের কেউ কেউ তৎকালীন হালত বিবেচনায় রাজনৈতিকভাবে আলী(রা)এর প্রতি ঝুঁকে যান,যেটা আমল-আকিদাগত ছিল না; যেমনটা ইহুদিজাত শিয়ারা বলে থাকে যে-আহলে বাইতের খিলাফত ছিনিয়ে ইসলামের আমল বদলে দেয়া হয়েছে! এর সাথে প্রথম ৩ খলিফার খিলাফত অস্বীকার,সাহাবা বিদ্বেষ,ইমামত-তত্ব ইত্যাদি অথবা সুন্নাহর উল্টা আমলের কোন সম্পর্ক ছিলনা!
যেমন- আবু তুফায়ল আমির(রা),তিনি আলী(রা)কে সর্বাগ্রে স্থান দিলেও আবু বকর(রা),উমর(রা) এর মর্যাদা স্বীকার করতেন। [ইকমাল তাহযিবুল কামাল ১৫৩/৭] এবং তাঁদের সূত্রে হাদিস বর্ণনা করতেন[আল ইসাবা ২৩০/৭]
আলি(রা)এর সাথী আরবী নাহুর আবিষ্কারক আবুল আসওয়াদ আদ-দুওয়ালি(র); তিনি উমর(রা)’র শিক্ষকতাও গ্রহণ করেছেন এবং প্রচুর পরিমাণে আইশা(রা)এর হাদিস বর্ণনা করেছেন তাঁর ভাগ্নে উরওয়া ইবন যুবায়র(র) সূত্রে।
মোটকথা, শুরুর দিকে যারা শুধু মুয়াবিয়া(রা)এর সঙ্গে দ্বন্দকালীন রাজনৈতিক কারণে {ও পরে ইয়াযিদের বিরোধিতার কারণেও} আলী(রা)এর পক্ষে মত দেন,অনেকে আলী(রা)এর প্রতি অন্য সাহাবীদের থেকে বেশি ভক্তি,মর্যাদা প্রদর্শন করেন তাদেরকেও আ’মভাবে শিয়া ডাকা হত। ফযীলাত/মর্যাদা সংক্রান্ত হওয়ায় এদেরকে তাফযিলী(الشيعة التفضيلية) বলা হয়।
ইমাম যাহাবী(র)এর কিতাবে আহমদ বিন সিয়ার সূত্রে বর্ণিত আছে, প্রাথমিক যুগে তাশায়্যু/শিয়া মতবাদগ্রস্থরা আবু বকর ও উমর(রা) এর উপরে আলী(রা)কে স্থান দিলেও সাহাবাদের ব্যাপারে সুন্দর কথা বলত। মিযানুল ই’তিদাল(৬১২/২)
হাফিয ইবনে হাজার আস্কালানী(র) ও বলেন- পূর্বের সময়ে শিয়া বলতে তাদের বুঝানো হত যারা আলী(রা) এর সাথে লড়াইকারীদের দোষ দেয় ও শায়খাইন(আবু বকর,উমর রা.),উসমান(রা) এর উপরে আলী(রা) কে প্রাধান্য দেয়।কিন্তু পরের যুগে শিয়া বলতে যাদের বুঝিয়েছে তারা খাটি রাফেযী, এই গা’লী(বাড়াবাড়িকারী)দের ও কারামাতীদের থেকে কোন বর্ণনা গ্রহণ করা যাবেনা {তাহযীবুত তাহযীব ৯৪/১}।
সাবাঈ শিয়াঃ
আলী(রা)এর খিলাফতের শেষভাগ থেকেই ইহুদি আবদুল্লাহ ইবনে সাবা’র অনুসারীরা আলী(রা)কে রাসূল(ﷺ)এর পরে খিলাফতের উত্তরাধিকারী দাবি করে,তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে করতে রব, ইলাহ দাবি করে! আলী(রা) এঅবস্থা দেখে তাদের বিতাড়িত করে রাখলেও তাঁর শাহাদাতের পরে এরা আরো নিকৃষ্ট আকিদা নিয়ে দল পাকাতে থাকে, প্রথম ৩ খলিফার নামে জঘন্য কথাবার্তা-অপবাদ চালু করে। দ্বীনে ক্রমাগত উদ্ভাবন(বিদ’আত) ঢুকিয়ে বিনষ্ট করা ছিল তাদের লক্ষ্য। এদেরি এক অংশ আবার সিফফিনের যুদ্ধে মুয়াবিয়া(রা)এর সাথে আলী(রা)’র সন্ধি-সালিশের প্রতিবাদের খারেজী-দল হিসেবে বেরিয়ে যায় ও তাদের একজন ইবন মুলজিম আলী(রা)কে শহীদ করে।
শিয়া ধর্মের রিজালাল কাশি রিঃ ১৭৫, ফিরাকুশ শিয়া- পৃষ্ঠা ১৯-২০,শরহে নাহজুল বালাগা ৫/৫, তাহযিবুল আহকাম ২৮২পৃ/২য় খণ্ড- ইত্যাদি প্রধান প্রধান কিতাবে ইবনে সাবা’র আলোচনা এসেছে, যারা ফলে একে “সুন্নিদের বানানো” দাবি করে দুষ্কর হয় শিয়া-মালাঊনদের জন্য।
৪০ হিজরি ও তৎসংলগ্ন সময়ে এই সাবাঈদের ওয়ালী-ওয়াসি আকিদা,সাহাবাদের অপবাদ, রাজাআত, শিরক-বিদ’আত ইত্যাদি শিয়া ধর্মের শিকড় থেকে বিস্তৃত হতে থাকে।
এই সময়ে নির্দিষ্ট ইমাম/ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিভিন্ন শিয়া-উপদলের পরিচয়-
● হাসানিয়াঃ
তারা দাবি করে আলী(র)’র পরে হাসান(রা) ও হুসাইন(রা)’র ইমামত। এর পরে ইমাম হাসান(রা)’র পুত্র আবদুল্লাহ বিন হাসান(র),তারপরে তার পুত্র মুহাম্মদ নাফস-যাকিয়া,এরপরে তার ভাই ইবরাহীম বিন আবদুল্লাহ ইমাম। [তাহযিবুত তাহযিব ২২৪/৯, সিয়াল আ’লামিন নুবালা ২১০,২১৮/৬] । হাসানিয়্যাদের এক দল দাবি করে বসে মুহাম্মদ নাফসে-যাকি(র) মরেন নাই, গায়েব হয়ে লুকিয়ে আছেন। তাদের থেকে কট্টর শিয়া-হুকমিয়্যা,শয়তানিয়া,যাররাইয়্যা দলও বের হয়।
● কায়সানিয়াঃ
হুসাইন(রা)এর শাহাদাতের পরে কাকে ইমাম বানানো হবে এ নিয়ে বিভিন্ন শিয়া উপদলে কোন্দল চলে। একদল শিয়া দাবি করে যে, <আলী(আ)এর পরে ইমাম ছিলেন হাসান,তারপরে হুসাইন এবং এরপরে মুহাম্মদ ইবন হানাফিয়্যা> এদেরকেই কায়সানিয়া বলা হয়। কোনমতে এই নামটি আলী(রা)এর গোলাম কায়সান মাওলা আলীর থেকে নেয়া,কোনমতে-তিনি ইবন হানাফিয়্যা(র)এর ছাত্র ছিলেন।
কায়সানিয়্যাদের কেউ কেউ বলে- মুহাম্মদ ইবন হানাফিয়্যা(র)এর ইমামতের বিরোধিতা করলে সে কাফির-মুশরিক,এছাড়া তাঁকে মাহদিও দাবি করা হয় [ফিরাকুশ শিয়া ২৬পৃ]
পরবর্তীতে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ(মূলত ১২ ইমামি) যারা দাবি করে হুসাইন(রা)এর পরে তাঁর এক পুত্র আলী বিন হুসাইন ওরফে যাইনুল আবিদিন(র)কে ইমামত দেয়া হবে! তারা পাল্টা হাদিস/গল্প রচনা করে- “আলী বিন হুসাইন, ইবন হানাফিয়্যাকে নিয়ে তাঁর ইমামতের ব্যাপারে পাথরকে জিজ্ঞাসা করলে পাথর পরিষ্কার আরবী ভাষায় জানিয়ে দেয় হুসাইন এর পরে আলী বিন হুসাইন হবেন ইমাম,ওয়াসি..” !! [আল কাফি, রিঃ৫,বাব ১৩৮; মুখতাসার বাসাইর১৪-১৫পৃ ] কালের বিবর্তনে ১২ ইমামি মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হলে ইবন হানাফিয়্যা(র) এটিই টিকে যায় যে তিনি ইমাম দাবি ছেড়ে দেন।
মুখতার ইবন আবু উবায়দ শুরুতে এই ইমাম-দলের হয়ে কাজ করলেও পরে নিজে আলাদা দল খুলে নেয়। কায়সানিয়া দল পরে প্রায় ১০টির মত উপদলে বিভক্ত হয়। যেমনঃ- রাযামিয়া দল দাবি করে মুহাম্মদ ইবন হানাফিয়্যা(র)এর পরে তাঁর পুত্র আবু হিশাম আবদুল্লাহ ইমাম হবেন। বায়ান বিন সাম’আন আত-তামিমীর বায়ানিয়্যা দল দাবি করে – আল্লাহ্ তায়ালা মানুষের সুরত স্বরূপ; আলী তারপর মুহাম্মদ ইবন হানাফিয়্যা ও তারপরে আবু হিশাম এর রুহে মিশে যান {নাঊযুবিল্লাহ} [আল-মিলাল ওয়ান নিহাল ১৫২/১]
হুলুল ছাড়া, শিয়া ধর্মের মৌলিক- ইমামত,বাদাআ(আল্লাহ্র নতুন ইচ্ছা হওয়া) ইত্যাদি এদের মধ্যে প্রকাশ পায়।
● মুখতারিয়াঃ
ভণ্ড নবী-দাবিকারী মুখতার ইবন উবায়দ আস-সাকাফী এর শিয়া-উপদল। হুসাইন(রা)এর শাহাদাতের পরে সে শিয়াদেরকে উদ্বুদ্ধ করে প্রতিশোধের জন্য বাহিনী গঠনে। শিয়ারা কারবালায় বেঈমানির জন্য যখন তাওবা করে সুলায়মান বিন সুরাদ(রা)এর অধীনে জাইশুত-তাওয়্যাবীন এ যাচ্ছিল, তখন মিথ্যাবাদী মুখতার এসে মুহাম্মদ বিন হানাফিয়্যা(র)এর নাম ভাঙ্গিয়ে শিয়াদের নিজের দলে টানে। সে নিজের কাছে অহী আসার দাবি করত। [আল বিদায়া,৪৫-৪৫৪/৮]
শিয়া ধর্মের কিতাবে ও শিয়া যাজকদের মুখে সে ব্যাপক শ্রদ্ধাভাজন; যেমন- ‘ইমাম সাজ্জাদ(আ) বলেন- আল্লাহ্ মুখতারকে উত্তম প্রতিদান দিন’[রিজাল আল-কাশি ১২৭; তানকিহুল মাকাল ২০৪/৩] , তুসি,বাকের মাজলিসী প্রভৃতি শিয়া যাজক তাকে বিশ্বস্ত গণ্য করে।
আমরা মুসলিমরা মানি- রাসূল(ﷺ) বলেছেন, “বনী ছাকিফা থেকে একজন মিথ্যাবাদী ও একজন ধ্বংসকারী বের হবে”[তিরমীযি ৪৩২৪] এই হাদিসে উল্লিখিত মিথ্যাবাদী হল মুখতার, আর ধ্বংসকারী হাজ্জাজ বিন ইউসুফ।
● মুহাম্মাদিয়াঃ
এই দলের শিয়ারা বিশ্বাস করে যে, হাসান(রা)এর নাতি মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ বিন হাসান হলেন ইমাম মাহদি! আব্বাসিয় খলিফা মানসুরের বাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়।
এই শিয়া দলের অন্যতম কর্তাব্যক্তি ছিল মুগীরা বিন সাঈদ আল-আজলী,যে পরবর্তীতে প্রভাবশালী হলে তার নামেই ফেরকা হয় হয়-মুগিরীয়্যা।[আল মাজরুহিন, ইবন হিব্বান ৭/৩]। শিয়া ধর্মাবলম্বীরা যে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত আহলে বাইতের নামে চালিয়ে দেয় এবং খারাবির আয়াত আবু বকর,উমর(রা)এর নামে শিয়া তাফসিরে চালানো হয়েছে- তা এই ব্যক্তির মতবাদ থেকেই চালু হয়েছিল।
এছারা আরো অনেক ছোটবড় শিয়া-দল সৃষ্টি হয় ২০০ হিজরির আগ পর্যন্ত। যেমন- আবদুল্লাহ বিন মুয়াবিয়া বিন আব্দুলাহ বিন জাফর-এর দল জানাহিয়্যা;তারা আহলে বাইতের বংশানুক্রমিক রুহের গমন বিশ্বাস করে,মদ হালাল করে ইত্যাদি[তালবিস আল ইবলিস,পৃ১১৬]; আল মানসুরিয়া-যারা ইমাম বাকিরের পরে মানসুর আল-আজলির ইমামত দাবি করে[আল মিলাল ১৭৮/১]; গুরাবিয়্যা-যারা জিবরাঈল(আ) ভুল করে আলী(রা)কে নবুয়্যাত দেন নি-এই দাবি করে; খাত্তাবিয়্যা-যারা দাবি করে ইমামরা নবীর স্তরে,আর আবুল খাত্তাব আল আসআদীও নবী [মিনহাজুস সুন্নাহ ৫০২/২]
ক্ষুদ্র দল বিলুপ্ত হলেও বিভিন্ন কুফরি আকিদা শিয়া ধর্মে পালক হিসাবে যুক্ত হয়।
●● রাফেজী শিয়াঃ
এটিই সাবাঈ শিয়া দলের গোছালো রূপ যাদের থেকে ১২ ইমামি প্রভৃতি স্থায়ী শিয়া দল গঠিত হয়। ইমামি-শিয়াদের দাবিকৃত ৫ম ইমাম এর পুত্র যায়দ বিন আলী(র) এর উক্তির মাধ্যমে সর্বপ্রথম “রাফেযী” শব্দের ব্যবহার হয়।দুই ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে আবু বকর,উমর(রা) এর থেকে দায়মুক্ত হতে ও যালিম,খারাপ ইত্যাদি বললে তিনি তাদের তাড়িয়ে দিয়ে বলেন তোমরা রাফেযী। [মুসনাদ যায়দ বিন আলী, পৃ ১১,৪৬(শিয়া কিতাব); তারীখে তাবারী ৪৯৮/৫]। সাবাঈ শিয়াদের মধ্যে রাফেজী-উপাধি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অনেকে এই নাম অস্বীকার করতে চায়; অপরদিকে শিয়া ধর্মের কিতাবে রাফেজী শব্দের মাহাত্ন্য নিয়ে বর্ণনা রচিত হয়েছে- ‘রাফেজী নিয়ে আপত্তি তুলা হলে আবু জাফর(আ) বলেন-আমি রাফেজীদের থেকে ও রাফেজীরা আমার থেকে।’{বিহারুল আনওয়ার ৯৭পৃ/৬৫}, যদিও এজাতীয় বর্ণনা আসে আবু জারুদ এর মত প্রতিষ্ঠিত জালিয়াত,মিথ্যবাদীর সূত্র থেকে[আল মাজরুহিন,৩০৬পৃ/১, আল কামিল ১৩২/৪], এমনকি শিয়া রিজাল কিতাবেও অভিশপ্ত মিথ্যাবাদী হিসাবে তার নাম উল্লিখিত[রিজাল আল কাশি ৪১৫-৪১৭]
চলমান সময়ে শিয়া ধর্মের ১২ ইমামি,জাফরি- মাজহাব মূলত এই সাবাঈ রাফেজীদের মতবাদ।তবে তাকিয়া(মতলব লুকানো)’র কারণে সব সময়ে নিজেদের আকিদা প্রকাশ করে না। রাফেজীদের বৈশিষ্ট্য ইমামত ফরয দাবি,সাহাবাদের তাকফির,মু’তা হালাল করা+ফযিলাত দাবি,কবরপূজায়,কুরআনের তাহরিফ(বিকৃতি) বিশ্বাস,রাজাআত,বাদাআ’, দ্বীনে প্রচুর উদ্ভাবন/বিদাত(আযানে,অযুতে, মাতম, অগ্নিপূজকদের থেকে ধার করা অনুষ্ঠান) ইত্যাদি করবে। এছাড়া পরবর্তী যুগের অনেক ইমামি-রাফেজী তাদের কিতাবে স্বীকার করেছে যে তাদের মূল উদ্দেশ্য সুন্নাহের অনুসারীদের ঘৃণা করে তাদের বিপরীত কাজ করা!
● ১২ ইমামিঃ
এদের ইমামি ধারা এরূপ- আলী>হাসান>হুসাইন>বাকির>জাফর সাদিক>মুসা কাযিম>রেযা>তাকী>নকী>হাসান আসকারী>মাহদি(কল্পিত)। সময়ের বিবর্তনে হুসাইন(রা)এর বংশ থেকে এই ১২ জন ঠিক করা হয়,এই ধারার বাইরে কাউকে ইমাম দাবি করা হলে সৃষ্টি হয়েছে নতুন শিয়া দলের। প্রত্যেক ইমাম মারা যাবার পরেই কেউ না কেউ বলেছে ‘তিনি মরেন নাই,মাহদী-রূপে আবির্ভূত হবেন’। যেমন -
*বাকিরিয়্যা-ইমাম বাকিরের মৃত্যু অস্বীকার করে ও বলে তিনি অপেক্ষমান মাহদি[আত তাবসির ফিদ-দ্বীন পৃ৩৫]
*হাসিরিয়্যা- ইমাম বাকিরের পরে তাঁর পুত্র যাকারিয়্যাকে ইমাম দাবি করে ও বলে তিনিই মাহদি, আলহাসির পর্বতে লুকিয়ে আছেন[আল মাওয়াকিফ, ৬৮০পৃ]। এছারা আবদুল্লাহ বিন নাঊস বসরীর দল- নাঊসিয়া দাবি করে ইমাম জাফর সাদিক গায়েব হয়েছেন; তিনিই মাহদি। আম্মারিয়া- দল দাবি করে জাফর সাদিকের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র মুহাম্মদ ইমাম।
পরবর্তী যুগের মুফাদ্দালিয়া,খলিফিয়্যা,জানাবিয়্যা,বুরকাইয়্যা, ইউনুসিয়া, শায়খ আহমদ যাইনুদ্দিন আল-ইহসায়ী’র দল শায়খিয়্যা/আহমদিয়্যা, তার ছাত্র কাযিমুদ্দিন রাশ্তায়ীর দল রাশতিয়া উল্লেখযোগ্য।
১৫শ’ শতাব্দীতে ইসমাইল সাফাভীর পারস্য আগ্রাসনের পরেই ইরান ও ইরাকের পূর্বাংশে ১২- ইমামি রাফেজী ধর্ম চেপে বসে।পরবর্তীতে নাদির শাহ নাজাফ সম্মেলনে সেই মত থেকে ফিরলেও, ৭৯’ খোমেনীর বিপ্লবের পরে তা আবার জেকে বসে এবং মুসলিম উম্মাহর কর্তৃত্ব দখলের শপথ নেয়।
১২-ইমামিদের মধ্যে বর্তমানে বড় দু’টি ফারাক হল, উসুলি ও আখবারি-দের মধ্যে। উসুলিরা শিয়া-হাওজা(কোম,নাজাফ)র মারাজা/আয়াতুল্লাহদের ইজতিহাদ গ্রহণ করে এবং অনুসরণ করে। পক্ষান্তরে আখবারিরা ১২ ইমামের পরে আর কারো অনুসরণ করার বিরোধী।
ভারতীয় উপমহাদেশে ১২ ইমামিরা জাফরি শিয়া হিসেবে পরিচিত,নিজেদেরকে বিশেষত জাফর সাদিকের ফিকহের অনুসারী দাবি করার ভিত্তিতে।
এছারা হযরত মুহাম্মদ-আলী-আল্লাহ্ এভাবে খ্রিস্টানদের ন্যায় ত্রিত্ববাদ বানিয়ে(নাঊযুবিল্লাহ) আলাভি-শিয়া মতবাদ সৃষ্ট হয় ১২ ইমামিদের থেকে, তুরস্কে এদের ব্যাপক বসবাস।
● যায়দিয়াঃ
১২ ইমামিদের দাবিকৃত ৬ষ্ঠ ইমাম জাফর সাদিক(র)এর স্থানে যায়দ বিন আলী(র)কে যেই দল ইমাম হিসেবে নিয়ে দল গঠন করে এবং মূলত আব্বাসিয় আমলে বিদ্রোহের জন্য পরিচিতি লাভ করে তাদের থেকেই যায়দি দল শুরু হয়। যায়দ বিন আলী(র)এর পূর্বে ১২-ইমামি,জাফরিদের ন্যায় ইমাম বাকির(র)কে ৫ম ইমাম দাবি না করে তারা হাসান(রা)এর পুত্র হাসান বিন হাসান(র) সূত্রে আলী(রা)পর্যন্ত যায়; এবং যায়দ(র)এর পরে তারা ১২ ইমামি,জাফরিদের ন্যায় ইমামতের সিলসিলা না টেনে নেতৃস্থানীয় হিসাবে ইমাম বানায়, মূলত হাসান(রা)এর বংশধরদের। তাদের ফেরকা ইয়েমেনভিত্তিক, ৮শ’শতাব্দীতে আল-হাদি ইলাল হাক্ক কে ইমাম/নেতা মেনে ১৯৬২তে আন মানসুর পর্যন্ত যাইদি-ইমামধারা চলে।
যাইদিদের প্রথম উপদল বের হয়-জারুদিয়্যা, আবু জারুদ এর দল,আবু জারুদ আসলে রাফেজী-শিয়াই ছিল।
সুলায়মানিয়্যা-সুলায়মান বিন জারীর এর দলঃ শূরার মাধ্যমে ইমাম নির্ধারণ,ইজতিহাদ মানলেও উসমান(রা)এর খিলাফত বাতিল বলে। সালিহিয়্যা/বাতরিয়া নামে অপর দল বের হয় হাসান বিন সালিহ এর অনুসারীদের মাধ্যমে। ইয়াহিয়া বিন যায়দ এর ইমামত নিয়েও দল হয়।
যাইদিদের বেশির ভাগ- আবু বকর,উমর(রা)এর উপরে আলী(রা)কে প্রাধান্য দিলেও, দুইজনের খিলাফত বাদ বলে- তাঁদের সম্বন্ধে খারাপ বলা থেকে বিরত থাকে।অন্য দুই সাহাবী তালহা(রা),যুবায়র(রা)কে দোষারোপ করে আলী(রা)এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার জন্য।
তারা ইমামতকে নস/আল্লাহ্র নির্ধারিত না দাবি করে বরং বাইয়্যাত-ভিত্তিক মানে; ইমামকে মা’সুম,যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ হবার শর্ত দাবি করেনা, প্রয়োজনে একই সময়ে একাধিক ইমাম জায়েয মানে। যাইদিরা মু’তা হালাল করে না,অন্য শিয়াদের ন্যায় রাজাআত(কিয়ামতের আগে কিছু ব্যক্তির পুনরায় আবিরভাব)এ বিশ্বাস করে না,দীর্ঘসময় ধরে গায়েব-মেহদির বিশ্বাস করে না।
সর্বোপরি, যাইদিরা বাতিল ফেরকা হলেও রাফেজী নয় এবং জাতিগত কাফের বলা যাবে না এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। প্রচলিত ইমামত ধারা না মানায় ১২ইমামি রাফেজী শিয়াদের হিসাবে তারা নাসিবী,তাদের সদকা দান এমনকি পানি দেয়াও নিষেধ![রিজাল আল কাশি,হা-৪০৯ পৃষ্ঠা ১৯৮]
● ইসমাঈলিয়্যাঃ
৭ম ইমামের পজিসন নিয়ে ভেজাল লাগলে বিভক্তি ঘটে বিকাশমান শিয়া ধর্মে। ১২ ইমামিরা মুসা কাযিমকে ইমাম দাবি করে, আর যারা জাফর সাদিক(র)এর অপর পুত্র ইসমাইলকে ইমাম দাবি করে তারা ইসমাইলিয়্যা দল নিয়ে আলাদা হয়ে যায়! সাবাঈ শিয়া ধর্মের নিকৃষ্টতম শাখা। শুরুতে তাদের মধ্যে থেকে ৭ ইমামি ইসমাঈলি শিয়া দল হয়; তাদের শক্তিশালী উপদল হয় কারামাতি, হামাদান কারামাতির ইমামি-গ্রুপ। এরা একসময়ে কাবার হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত লুট করে! তাদের ইমাম- আল মাহদি বিল্লাহ ফাতিমি সাম্রাজ্য কায়েম করে,যা শিয়া ধর্মাবলম্বীদের প্রথম সাম্রাজ্য, সালাহউদ্দিন আইয়্যুবী(র) এদের পতন ঘটান।
জাফর সাদিক(র)এর খাদেম দাবিকারী আবদুল্লাহ বিন মায়মূন নামক জিন্দিক এর দল হয় মায়মুনিয়া। হামযা বিন আলী নামক মালাঊনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় দ্রুজ-ইসমাঈলি উপদল। যারা এখনো সিরিয়া-লেবাননে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আছে।
ইসমাইলিদের ইমাম ধারা এখনো চলমান আছে। এদের সবচেয়ে বড় বিদ্যমান দল নিযারি-ইসমাঈলি; এদের ৪৯ তম ইমাম আগা খান(৪র্থ)। ফাতিমিদের ৮ম খলিফা/ইমাম মুনতাসির বিল্লাহ তার পুত্র নিযারকে ইমাম বানালেও, পরবর্তীতে অপর পুত্র মুস্তাআলি’র হয়ে সেনাপতি আফদাল বিদ্রোহ ঘটালে নিযার পালিয়ে যায়,পরে ধৃত হয়ে মারা যায়। তার ছেলে হাদি বিন নিযারকে ইমাম মেনে পরবর্তীতে সর্ববৃহৎ ইসমাঈলি উপদল নিযারিরা ইরান,সিরিয়ায় বিস্তার লাভ করে। মুস্তাআলি’র দুই পুরুষ পরে ফাতিমি সাম্রাজ্য ধ্বংস হলেও তার মাধ্যমে যে ইমামত ধারা চলে তাকে তায়্যিবি ইসমাইলি ধারা হিসাবে চালু রাখা হয়। এরা ২১ ইমামে বিশ্বাসী। ফাতিমিদের পতনের পরে এরা সুলায়মানি বোহরা(মূলত বর্তমান সৌদি আরবে স্থায়ী) ও ভারতীয় উপমহাদেশভিত্তিক দাঊদি বোহরা- দলে বিভক্ত হয়।
শেষকথা হচ্ছে, কোনো কোনো ইতিহাসবিদ এর মতে শিয়াদের মাঝে মোট ৩০০টিরও অধিক ফিরকা রয়েছে।
~ The Rafidologist
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন