অর্থ দিয়ে সদাকাতুল ফিতর আদায়ের হাদীস : একটি সরল পর্যালোচনা
(পরিমার্জিত ও সংযোজিত)
نحمده ونصلي علي رسوله الكريم
সিয়াম সাধনা শেষে সদকাতুল ফিতর আদায় একটি গুরুত্বপূর্ণ আমাল।
এই সদকাহ আদায়ে রয়েছে বিভিন্ন পদ্ধতি যা আমরা সুন্নাহর আলোকে জানতে পাড়ি।
অর্থ দিয়ে সদাকাতুল ফিতর আদায়ের বহুল প্রচলিত যে পদ্ধতি চালু আছে তা সহীহ হাদীস ও সাহাবায়ে কেরাম এর আমল দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু আমাদের লামাযহাবী বন্ধুগন অর্থ দিয়ে আদায় করাকে অস্বীকার করে এবং বিদ'আদ দাবী করে লোকসমাজে বিভ্রান্তি আর সন্দেহ সৃষ্টি করছেন।
তাই অর্থ দিয়ে সদাকাতুল ফিতর আদায়ে সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগনের আমলের প্রামাণ্যতা স্বরূপ বিশিষ্ট তাবেয়ী আবু ইসহাক আস সাবঈ রাহ. এর একটি আসার (হাদীস) নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
যা আলোচ্যবিষয় প্রমাণে সুস্পষ্ট।
(এক)
তাবেয়ী আবু ইসহাক আস সাবঈ রাহ. এর হাদীস (আছার):
حَدَّثَنَا أَبُو أُسَامَةَ، عَنْ زُهَيْرٍ، قَالَ: سَمِعْتُ أَبَا إِسْحَاقَ، يَقُولُ: «أَدْرَكْتُهُمْ وَهُمْ يُعْطُونَ فِي صَدَقَةِ رَمَضَانَ الدَّرَاهِمَ بِقِيمَةِ الطَّعَامِ»
হযরত যুহাইর রাহ. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আবূ ইসহাক রাহ. থেকে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন, আমি সাহাবায়ে কেরাম রাদি. ও তাবেয়ীনদের কে এই অবস্থায় পেয়েছি যে, তারা রমজানে সাদাকায়ে ফিতর খাবারের বিনিময়ে দিরহাম (অর্থ) দ্বারা আদায় করতেন।
[মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, হা/১০৪৭২ , সনদ সহীহ ]
এমনি ভাবে ইমাম আবু আহমাদ ইবনু জানজুইয়া রাহ. বর্ণনা করেন—
- ﺛﻨﺎ ﻣﺤﻤﺪ ﺑﻦ ﻋﻤﺮ اﻟﺮﻭﻣﻲ، ﺃﻧﺎ ﺯﻫﻴﺮ ﺃﺑﻮ ﺧﻴﺜﻤﺔ، ﻋﻦ ﺃﺑﻲ ﺇﺳﺤﺎﻕ اﻟﻬﻤﺪاﻧﻲ ﻗﺎﻝ: ﻛﺎﻧﻮا ﻳﻌﻄﻮﻥ ﻓﻲ ﺻﺪﻗﺔ اﻟﻔﻄﺮ ﺑﺤﺴﺎﺏ ﻣﺎ ﻳﻘﻮﻡ ﻣﻦ اﻟﻮﺭﻕ
আবূ ইসহাক রাহ. বলেন যে, আমি সাহাবায়ে কেরাম রাদি.ও তাবেয়ীনগন সাদাকায়ে ফিতর (খাবারের বিনিময়ে) দ্রব্যমূল্য দ্বারা আদায় করতেন।
[আল আমওয়াল হা/২৪৫৫, সনদ হাসান]
হাদীসের মর্মবাণী বুঝার আগে জানতে হবে; আবু ইসহাক রাহ. মাকাম ও ইলমী অবস্থান।
আবু ইসহাক রাহ. এর নাম আমর বিন আব্দুল্লাহ। তিনি ইরাকের বিশিষ্ট একজন তাবেয়ী ছিলেন।
সাইয়েদুনা আলী, ইবনে উমার,ইবনে আব্বাস,নুমান বিন বাশির,বারা বিন আযিব,আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহুম সহ বিখ্যাত সব সাহাবায়ে কেরামের সানিধ্য পেয়েছেন।
তিনি সাহাবায়ে কেরাম এর দর্শন পেয়েছেন ২৮ থেকে ৩৮ জনের মতো। ইমাম বুখারী ও মুসলিম রাহ. সহ প্রায় সকল হাদিসের ইমামগণ তার থেকে হাদীস সংগ্রহ করেছেন।
এবার উপলব্ধি করুন এমন মহান একজন তাবেয়ী তার যুগের লোকদের সদাকাতুল ফিতর এর বর্ণনা দিচ্ছেন.যদি অর্থ দিয়ে তা আদায় বৈধই না হতো তাহলে এমনটি তিনি বর্ননা দিতেন না...
বিখ্যাত তাবেয়ী খলীফা উমর ইবনু আব্দুল আজীজ রাহ. যিনি ৬১ হিজরী থেকে ১০১ হিজরী সময়কার খলীফা ছিলেন। যার শাসন আমলে সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন। তিনি অর্থের মাধ্যমে সদকাতুল ফিতর আদায়ের রাজফরমান জারী করেন।
[ মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা হা/১০৩৬৯, সনদ সহীহ ]
তাছাড়া অনেক বড় বড় তাবেয়ীগনে ফতোয়া এ মতেই ফতোয়া দিয়েছেন।
তাই তার ادركتهم বলা দ্বারা সাহাবী ও তাবেয়ীগন উদ্দেশ্য এটা সহজেই অনুমেয়।
শাইখ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ হাফি. মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবায় উক্ত হাদীসের টীকায় ادركتهم দ্বারা সাহাবায়ে কেরাম উদ্দেশ্য নিয়েছেন।
এমনকি সালাফী ঘরওয়ানার প্রখ্যাত শাইখ সালিহ হাফি. এর ভাষ্যও অনুরূপ
(দুই)
কিছু অমূলক সংশয় ও তার নিরসন:
আমাদের কিছু দীনি ভাই উক্ত সহীহ হাদীসের উপর আপত্তি করে থাকেন, তারা বলেন উক্ত হাদীসটি চার কারনে প্রমাণযোগ্য নয় -
১-ইমাম আবু ইসহাক তাদলিস করতেন ( তাদলিস বলা হয় বর্ননা সংক্রান্ত একটি সুক্ষ্মত্রুটি যেখানে উস্তাযে নাম গোপন করা হয়)
২-তার ইখতিলাত্ব হয়েছে তথা শেষজীবনে স্মৃতি শক্তি লোপ পায় তাই তার বর্ননায় হেরফের হয়ে যায়.
৩-আর তার ছাত্র ইমাম যুহাইর রাহ. আবু ইসহাক এর শেষ জীবনের ছাত্র তাই তার বর্ননা গ্রহণ যোগ্য নয়.
৪- এছাড়া সনদে আবু উসামা হাম্মাদ বিন উসামাহ রাহ. নামক যইফ (দূর্বল) রাভী আছে।
তাদের উলুমুল হাদীস নিয়ে আরো ভেবে দেখার দরকার আছে বলে মনে করি। তাই পরামর্শ হিসেবে কিছু খন্ডন উল্লেখ করলাম :
১-আগেই বলা হয়েছে ইমাম আবু ইসহাক বুখারী মুসলিম এর রাবী। অতএব তাকে তার তাদলিস নিয়ে
দোষযুক্ত করা নিতান্তই ছেলেখেলা।
আর যেসব ভাই তাকে তাদলিসের দোষ দিয়ে এই সনদকে অগ্রহণযোগ্য বলছেন তারা মনে হয় তাদলিসের নামটাই জানেন, কাজটা আর জানেন না. কেননা যারা উলুমুল হাদীস নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করেন তারা বুঝবেন যে এই সনদে তাদলিসের লেশমাত্র নেই।
ইমাম আবু ইসহাক নিজেই তার সোনালি যুগের সংবাদ দিচ্ছেন এখানে সনদে তাদলিস কি পেলেন আমাদের বোধগম্য নয়।
২- প্রত্যেক ব্যক্তিরই স্মৃতি শক্তি শেষবয়সে কিছুটা লোপ পায় এখানেও ঠিক তেমনই হয়েছে। তবে একারণে তার হাদীস বর্ননায় ইখতিলাত্ব / হেরফের হওয়াটা মুহাদ্দিসগনের নিকট চূড়ান্ত নয়। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মত আছে।
অনেক লম্বা হয়ে যাবে বিধায় মতগুলো উল্লেখ করা হলো না।
তাহকীকমতে আবু ইসহাক রাহ. এর ইখতিলাত্ব/ বর্ণনায় হেরফের হওয়াটা মুহাদ্দিসীনের মতে আমভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। নির্দিষ্ট কোন সনদের ব্যপারে ইখতিলাত্ব এর ধোয়াশা করে তাকে যইফ বলার আগে প্রমান দিতে হবে যে, তিনি এ বর্ণনায় হেরফের করেছেন।
ইমাম হাফিয যাহাবী বলেন -
وهو ثقة حجة بلا نزاع و قد تغير حفظه تغير السن و لم يختلط
তিনি সকলের ঐক্যমতের সিকাহ ও হুজ্জাহ (উচ্চমানের নির্ভরযোগ্য রাবী)
আর বার্ধক্যের কারণে তার স্মৃতি শক্তিতে পরিবর্তন আসে কিন্তু হাদীস বর্ননায় তার ইখতিলাত্ব/ হেরফের হয়নি.
[সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/১২২]
ইমাম হাফিয যাহাবী রাহ. আরও বলেছেন
ﻣﺎ اﺧﺘﻠﻂ ﺃﺑﻮ ﺇﺳﺤﺎﻕ ﺃﺑﺪا
আবু ইসহাক রাহ.-এর বর্ণনায় কখনই হেরফের হয়নি।
[তাযকিরাতুল হুফফায ১/১৭১]
অনুরূপ ইখতিলাত্ব বিশেষজ্ঞ ইমাম হাফিয আলাঈ রাহ. বলেছে
ﻭﻟﻢ ﻳﻌﺘﺒﺮ ﺃﺣﺪ ﻣﻦ اﻷﺋﻤﺔ ﻣﺎ ﺫﻛﺮ ﻣﻦ اﺧﺘﻼﻁ ﺃﺑﻲ ﺇﺳﺤﺎﻕ اﺣﺘﺠﻮا ﺑﻪ ﻣﻄﻠﻘﺎ ﻭﺫﻟﻚ ﻳﺪﻝ ﻋﻠﻰ ﺃﻧﻪ ﻟﻢ ﻳﺨﺘﻠﻂ ﻓﻲ ﺷﻲء ﻣﻦ ﺣﺪﻳﺜﻪ
ইমামগন আবু ইসহাক রাহ. এর বর্ণনায় হেরফের হওয়া নিয়ে যা উল্লেখ করেছেন তা ধর্তব্য হবেনা। কেননা ইমামগন ব্যপকভাবে আবু ইসহাক রাহ. এর বর্ণনা দ্বারা দলিল পেশ করেছেন।
তাদের এহেন কাজ একথাই বুঝায় তার বর্ণনায় হেরফের হয়নি।
[কিতাবুল মুখতালিত্বীন ৯৬পৃ.]
আবার অনেকে বলে থাকেন আবু ইসহাক রাহ. এর ইখতিলাত্ব পূর্বকালে ছাত্রদের বর্ণনা গ্রহনযোগ্য।
তাই আপত্তি করেন যে, যুহাইর কে অনেকে তার শেষকালের ছাত্র বলেছেন। যুহাইর রাহ. থেকে ইমামদের হাদীস বর্ণনা আর সহীহাইনে স্থান দেয়াটা উক্ত আপত্তিকে খণ্ডন করে দেয়।
তাছাড়া পূর্বকাল আর শেষকালে ছাত্র কখন দেখবো?
আল্লামা যফর আহমাদ থানভী রাহ.অনেক তাহকীক করার পর বলেন; একজন রাভী থেকে যখন ইখতিলাত্ব তথা বর্ণনায় হেরফের প্রচুর পরিমানে হয় তখন তার পূর্বকার জমানার ছাত্রদের বর্ণনা দেখতে হয়।
[কাওয়াঈদ ফী উলূমিল হাদীস ২৭৯]
প্রসঙ্গত আবু ইসহাক রাহ. এতো বেশি পরিমাণে ইখতিলাত্ব করেন নাই যে তার ইখতিলাত্ব পূর্বকালের ছাত্র দেখা লাগবে। আর অনেকে তো তার ইখতিলাত্বকে অস্বীকারই করেন। ইমাম সাখাভী রাহ. উল্লেখিত সনদের রাভী যুহাইর রাহ. কে আবু ইসহাক রাহ. এর কাদীম ছাত্র অর্থাৎ ইখতিলাত্ব পূর্বযুগের ছাত্র বলেই গণ্য করেছেন।
ﻭﻗﺪ اﺗﻔﻖ اﻟﺸﻴﺨﺎﻥ ﻋﻠﻰ اﻟﺘﺨﺮﻳﺞ ﻟﻪ، ﻻ ﻣﻦ ﺟﻬﺔ ﻣﺘﺄﺧﺮﻱ ﺃﺻﺤﺎﺑﻪ ; ﻛﺎﺑﻦ ﻋﻴﻴﻨﺔ ﻭﻧﺤﻮﻩ، ﺑﻞ ﻋﻦ ﻗﺪﻣﺎﺋﻬﻢ ﺣﻔﻴﺪﻳﻪ ; ﺇﺳﺮاﺋﻴﻞ ﺑﻦ ﻳﻮﻧﺲ ﻭﻳﻮﺳﻒ ﺑﻦ ﺇﺳﺤﺎﻕ، ﻭﺯﻛﺮﻳﺎ ﻭﻋﻤﺮ اﺑﻨﻲ ﺃﺑﻲ ﺯاﺋﺪﺓ، ﻭﺯﻫﻴﺮ ﺑﻦ ﻣﻌﺎﻭﻳﺔ ﻭاﻟﺜﻮﺭﻱ،
[ফাতহুল মুগীস ৪/৩৭০]
যদিও মেনে নেই যে, আবু ইসহাক রাহ. এর ইখতিলাত্ব/হেরফের হয়েছে। কিন্তু আলোচ্য সনদের রাভী যুহাইর রাহ. আবু ইসহাকের পূর্বকার জমানার ছাত্র। তাই উল্লেখিত আসারকে যইফ বলা নিতান্তই অপরিনামদর্শীতা।
শাইখুল ইসলাম হাফিয আলাঈ রাহ. আবু ইসহাক সাবঈ রাহ. কে ইখতিলাত্বকারীর প্রথম স্তরে উল্লেখ করেছেন।
প্রথম স্তরের রাভীর হাদীস যইফ বলা যায় না।
ﺃﺣﺪﻫﺎ: ﻣﻦ ﻟﻢ ﻳﻮﺟﺐ ﺫﻟﻚ ﻟﻪ ﺿﻌﻔﺎ ﺃﺻﻼ ﻭﻟﻢ ﻳﺤﻂ ﻣﻦ ﻣﺮﺗﺒﺘﻪ ﺇﻣﺎ ﻟﻘﺼﺮ ﻣﺪﺓ اﻻﺧﺘﻼﻁ ﻭﻗﻠﺘﻪ
[কিতাবুল মুখতালিত্বীন-এর ভূমিকা]
হাদিসের ক্ষেত্রে যেহেতু সতর্কতা জরুরী, তাই তার স্মৃতি লোপ পাওয়ার বিষয়ে মুহাদ্দিসগন সর্তক করেছেন।
যদি হেরফের পাওয়া যায়,অন্য হাদীসের সমর্থন না থাকে তাহলে পরিত্যাজ্য হতে পারে।
তাছাড়া উক্ত হাদীসের সমর্থনে খাইরূল কুরুন তথা উমর ইবনু আব্দুল আজীজ রাহ. রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত আছে যাতে সাহাবায়ে কেরাম এর একাত্মতা প্রকাশ আছে বলে বুঝা যায়। আর বড়বড় তাবেয়ীনদের ফতোয়া তো আছেই।
৩-ইমাম বুখারী তার সহীহ বুখারীতে উল্লেখিত সনদের আলোচিত অংশ অর্থাৎ ইমাম যুহাইর এর বর্ননায় তার উস্তায ইমাম আবু ইসহাক থেকে হাদীস উল্লেখ করেছেন .
[সহীহ বুখারী হা/৪০,১৫৬,২৫২, ৩৫৫২,৪১৫১ দ্রষ্টব্য]
এমনিভাবে ইমাম মুসলিম রাহ. এ সনদে একাধিক হাদীস এনেছেন।
সহীহ মুসলিম হা/১২৫৪,২০০৯ ইত্যাদি।
এখন সেসব ভায়েরা কি বলবেন- সহীহ বুখারী আর মুসলিমের হাদীস অগ্রহণযোগ্য?
বর্তমান সালাফী সহ সকলের শ্রদ্ধাভাজন ইমাম ইবনুল কাইয়িম রাহ. তার বিখ্যাত সুনানু আবি দাউদের ব্যাখ্যাগ্রন্থ তাহযিবুস সুনানের ভিতর ইমাম যুহাইর এর সনদে আবু ইসহাকের হাদীসের গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করতঃ ইমাম ইবনে হাযম এর উক্তি উল্লেখ করেন যে, তিনি বলেন -
نقول ان رواية زهير عن ابي إسحاق صحيحة
আমরা বলবো নিশ্চয়ই আবু ইসহাক থেকে যুহাইরের বর্নিত হাদীস সহীহ্
(তাহযিবুস সুনান ১/২৭৯)
৪-উসূলে হাদীসের নীতি বহির্ভূত মনগড়া নীতির প্রভাবে আবু উসামা হাম্মাদ বিন উসামা রাহ. কে বিচ্ছিন্ন কিছু মত দ্বারা তাদলিসের দোষ দিয়ে মু'আন'আন (আন শব্দ দিয়ে বর্ণিত হাদীস) হওয়ার কারণে উক্ত হাদীসকে জাল যইফ সাব্যস্ত করা ফন বা শাস্ত্র সমন্ধে অজ্ঞতার পরিচায়ক।
আবু উসামা হাম্মাদ বিন উসামা হলেন যুগশ্রেষ্ঠ একজন উচুমানের রাবী যার থেকে বুখারী মুসলিম সহ প্রায় সকল কিতাবে হাদীস আনা হয়েছে। ইমাম আহমাদ বলেন;
ﻛﺎﻥ ﺛﺒﺘﺎ ﻻ ﻳﻜﺎﺩ ﻳﺨﻄﻰء ﻣﺎ ﻛﺎﻥ ﺃﺛﺒﺘﻪ.
আবু উসামা হাদীস বর্ণনায় দৃঢ়, আমি তার থেকে যেসব হাদীস লিপিবদ্ধ করেছি তাতে কোন ভুল হতে পারে না।
ﻛﺎﻥ ﺃﺑﻮ ﺃﺳﺎﻣﺔ ﺿﺎﺑﻄﺎ ﻟﻠﺤﺪﻳﺚ ﻛﻴﺴﺎ
আবু উসামা রাহ. হাদীস বর্ণনায় মজবুত ছিলেন।
[আল ইলাল ওয়া মারিফাতুল রিজাল, রেওয়ায়ত নং ৭৪৫,৫৯৮১]
ইমাম ইবনু মাঈন রাহ. তাকে সিক্বাহ/নির্ভরযোগ্য রাভী বলেছেন।
ﺃﺑﻮ ﺃﺳﺎﻣﺔ ﺃﺣﺐ ﺇﻟﻴﻚ ﺃﻭ ﻋﺒﺪﺓ ﺑﻦ ﺳﻠﻴﻤﺎﻥ ﻓﻘﺎﻝ ﻣﺎ ﻣﻨﻬﻤﺎ ﺇﻻ ﺛﻘﺔ
[তারীখু ইবনি মাঈন,দারেমীর বর্ণনা ১/৯২]
এছাড়া তাকে ইয়াহিয়া বিন সাইদ সহ প্রমুখ জারহ তাদীলের ইমাম সিকাহ হাফেয উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
বিস্তারিত জানতে দেখুন-
▪তাহযীবুল কামাল ৭/২১৭
▪তাহযীবুত তাহযীব ১/৪৭৭
▪আল জারহু ওয়াত তাদীল ৩/১৩২
▪আস সিক্বাত লি ইবনি হিব্বান ৬/২২২
▪সিয়ারু আলামিন নুবালা ৯/২৭৭
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা বুঝা গেল যে,তিনি উচ্চমানের রাবী ছিলেন।
এবার আসা যাক তার তাদলিসের কথায়
(১) তাকে যারা মুদাল্লিস বলেছেন তারা জারহ ওয়া তাদীলের মু'আতাবার বা গ্রহণযোগ্য কোন ব্যক্তিত্ব নন।
এর মধ্যে সর্বাগ্রে হলেন দ্বিতীয়- তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর ইতিহাসবিদ আল্লামা ইবনে সা'আদ রাহ.। এরপর সবাই তার উপর ভিত্তি করে মত দিয়েছেন। ইমাম ইবনে হাজার রাহ.তাকে জারহ তাদীলের ব্যপারে অনির্ভরযোগ্য বলেছেন কেননা তিনি জরাহ-তাদীল ইমাম ওয়াকেদী রাহ. কাছ থেকে শিখেছেন। ইমাম ওয়াকেদীর কথা এ শাস্ত্রে গ্রহনযোগ্য নয়।
ﻭﻟﻢ ﻳﻠﺘﻔﺖ ﺃﺣﺪ ﺇﻟﻰ ﺑﻦ ﺳﻌﺪ ﻓﻲ ﻫﺬا ﻓﺈﻥ ﻣﺎﺩﺗﻪ ﻣﻦ اﻟﻮاﻗﺪﻱ ﻓﻲ اﻟﻐﺎﻟﺐ ﻭاﻟﻮاﻗﺪﻱ ﻟﻴﺲ ﺑﻤﻌﺘﻤﺪ
[হাদয়ুস সারী ৪১৭ পৃ.]
(২)যদিও মেনেও নেই তিনি মুদাল্লিস আর এখানে 'আন' শব্দে বর্ণনা করেছেন। এক্ষেত্রে প্রথম কথা হল-
আবু উসামা রাহ. এর মত ব্যক্তিত্বদের তাদলিসের ব্যাপারে ইমাম ইবনে হাজার রাহ. বলেন;
"এসমস্ত ইমামদের তাদলিস তিন ধরনের হয়ে থাকে.
ক. তাদের امامة যোগ্যতা ও নির্ভরশীলতার কারনে হাদীসের গ্রন্থকারেরা তাদের হাদীস গ্রহণ করেছেন.
খ. তাদের অগনিত বর্ননা অপেক্ষা তাদলিস কম হওয়ায়.
গ. তারা সিকাহ ছাড়া তাদলিস করতেন না."
ﻣﻦ ﺃﻛﺜﺮ اﻷﺋﻤﺔ ﻣﻦ ﺇﺧﺮاﺝ ﺣﺪﻳﺜﻪ ﺇﻣﺎ ﻹﻣﺎﻣﺘﻪ ﺃﻭ ﻟﻜﻮﻧﻪ ﻗﻠﻴﻞ اﻟﺘﺪﻟﻴﺲ ﻓﻲ ﺟﻨﺐ ﻣﺎ ﺭﻭﻯ ﻣﻦ اﻟﺤﺪﻳﺚ اﻟﻜﺜﻴﺮ ﺃﻭ ﺃﻧﻪ ﻛﺄﻥ ﻻ ﻳﺪﻟﺲ ﺇﻻ ﻋﻦ ﺛﻘﺔ.
[আন নুকাত লি ইবনিল হাজার ২৩৮ পৃ.]
এবার যোগবিয়োগ করুন, আর বুকে হাত দিয়ে বলুন এর মধ্য কোন কারণটি পাওয়া যাওয়ার কারণে তার বর্ণনা যইফ হয়....?
আর দ্বিতীয় কথা হল-
যারা আজ তাদলিসের দোহাই দিয়ে যইফের দাবী করছে তারা মনে হয় নিজেদের ঘরের লোক সমন্ধে অজ্ঞ...!
কেননা তাদের ঘরওয়ানার মহামান্য শায়খ আলবানী রাহ. তার জামে তিরমিজি হা/৩২২২ নং তাহকিকে আবু উসামার معنعن মুয়ানয়ান হাদীসকে হাসানুন সহীহুন বলেছেন ...!
আজিব ব্যাপার...!
সেসব ভায়েরা ইবনে হাজারের তবকাতুল মুদাল্লিসীন কিতাব থেকে দলিল দেন। আফসোস আপনারা যদি ইবনে হাজারের মূল বক্তব্য জাতির সামনে উপস্থাপন করতেন। আমার মনে হয় তারা কিছু আড়াল করতে চাচ্ছে...! আল্লাহু আলাম
ইবনে হাজার রাহ. তার তাদলিসের হুকুম বর্ণনা দিয়ে বলেন-
متفق على الاحتجاج به
সর্বসম্মতিক্রমে তার হাদীস দ্বারা দলিল দেয়া যায়। [তবকাতুল মুদাল্লিসীন ৩০পৃ.]
স্ক্রীনশট দেখুন..
(তিন)
উসুলে ফিকহ ও ইমাম ইবনু তাইমিয়ার ফতোয়া :
শরীয়াহ এর উসূলমতে দানের মূলনীতি হল انفع للقفراء অর্থাৎ দান খয়রাতের ক্ষেত্রে গরীব অসহায়দের উপকারিতার দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। এ হিসেবে হানাফী মাযহাব মতে বর্তমানে খাদ্য শস্যের বিপরীতে নগদ অর্থ দিয়ে দিলে তা অধিক ফায়দাজনক এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় উত্তম।
যেমনটা আল মাবসূতে ইমাম সারাখসী রাহ. বলেছেন
ﻓﺈﻥ ﺃﻋﻄﻰ ﻗﻴﻤﺔ اﻟﺤﻨﻄﺔ ﺟﺎﺯ ﻋﻨﺪﻧﺎ؛ ﻷﻥ اﻟﻤﻌﺘﺒﺮ ﺣﺼﻮﻝ اﻟﻐﻨﻰ ﻭﺫﻟﻚ ﻳﺤﺼﻞ ﺑﺎﻝﻗﻴﻤﺔ ﻛﻤﺎ ﻳﺤﺼﻞ ﺑاﻟﺤﻨﻄﺔ،........... ﻭﻛﺎﻥ اﻟﻔﻘﻴﻪ ﺃﺑﻮ ﺟﻌﻔﺮ - ﺭﺣﻤﻪ اﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ - ﻳﻘﻮﻝ: ﺃﺩاء اﻝﻗﻴﻤﺔ ﺃﻓﻀﻞ؛ ﻷﻧﻪ ﺃﻗﺮﺏ ﺇﻟﻰ ﻣﻨﻔﻌﺔ اﻟﻔﻘﻴﺮ ﻓﺈﻧﻪ ﻳﺸﺘﺮﻱ ﺑﻪ ﻟﻠﺤﺎﻝ ﻣﺎ ﻳﺤﺘﺎﺝ ﺇﻟﻴﻪ،
[আল মাবসূত ৩/১০৭]
তাই বলে খাদ্যশস্য দিয়ে সদাকাতুল ফিতর আদায় করলে,তা আদায় হবেনা ব্যপারটা কিন্তু এমন নয়। উলামায়ে কেরাম ফায়দার দিকে লক্ষ রেখে অর্থের মাধ্যমে আদায় করার কথা বলে থাকেন।
শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রাহ. মাযহাবী ও লা মাযহাবী উভয় ঘরওয়ানারই অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।
শাইখুল ইসলামকে অর্থ দিয়ে যাকাত ইত্যাদি আদায় করার ব্যপারে ফাতাওয়া জিজ্ঞেস করা হলে উত্তরে তিনি বলেন -
وأما إخراج القيمة في الزكاة والكفارة ونحو ذلك . فالمعروف من مذهب مالك والشافعي أنه لا يجوز وعندأبي حنيفة يجوز وأحمد - رحمه الله - قد منع القيمة في مواضع وجوزها في مواضع فمن أصحابه من أقر النص ومنهم من جعلها على روايتين . والأظهر في هذا : أن إخراج القيمة لغير حاجة ولا مصلحة راجحة ممنوع منه...................... وأما إخراج القيمة للحاجة أو المصلحة أو العدل فلا بأس به.
অর্থ দিয়ে যাকাত. কাফফারা ইত্যাদি (সদকাতুল ফিতর ইত্যাদি অন্তুর্ভুক্ত) আদায় করা মালেকী ও শাফেয়ী মাযহাবে জায়েজ নেই। আর ইমাম আবু হানিফাহ ও ইমাম আহমাদের মতে তা জায়েজ. তবে ইমাম আহমাদের দুধরনের বর্ণনা আছে. এটি তার থেকে দুই রিওয়ায়াত হিসেবে তার ছাত্ররা উল্লেখ করেছেন.
অর্থ দিয়ে যাকাত ইত্যাদি আদায়ের ব্যাপারে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ফাতাওয়া হল - নিষ্প্রয়োজন এবং গরীবদের কল্যান বিবেচনা করা ছাড়া নিছক অর্থ দিয়ে আদায় করা নিষেধ...........(এরপর তিনি সুন্নাহর আলোকে কিছু উদাহরণ দেন)
আর প্রয়োজনে এবং গরীবদের কল্যাণ বিবেচনা করে অর্থের মাধ্যমে আদায় করলে কোন সমস্যা নেই..
[মাজমুউল ফাতাওয়া ২৫/৮২-৮২,]
এছাড়া শাইখুল ইসলাম গরীবদের উপকার বিবেচনায় সাদকাতুল ফিতর অর্থের মাধ্যমে দেয়া কে স্পষ্টভাবে জায়েজ বলেছেন।
وأنه يجوز إخراج القيمة في زكاة المال وزكاة الفطر إذا كان أنفع للمساكين يجوز إخراج القيمة مطلقاً
[ইখতিয়ারাতু শাইখিল ইসলাম লি বুরহানুদ্দীন ইবনিল কাইয়্যিম মাস'আলা/৭০]
এখানে স্পষ্ট যে,গরীবদের কল্যান হলে অর্থের মাধ্যামে দেয়া জায়েয।
তাই সদকাতুল ফিতর দেয়ার আগে গরীবদের খোঁজ খবর নিয়ে তাদের কল্যান হলে অর্থের মাধ্যমে সদকাতুল ফিতর দিতে সমস্যা নেই।
আমি মনে করি আজকের সমাজ ব্যবস্থায় অর্থ দিলে তাদের উপকার ও কল্যানকর হবে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমাদের সহীহ বুঝ দান করুন।
----------------------
লিখেছেনঃ মুফতি শাহেদ আমিন হাফিযাহুল্লাহু
সোর্সঃ [১], [২], [৩], [৪], [৫]লিখেছেনঃ মুফতি শাহেদ আমিন হাফিযাহুল্লাহু
কমেন্ট থেকে
Abu Umar
ঐ সময়ে
বার্লি, খেজুর, লবণ ইত্যাদি দিরহাম /দিনারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হত। মোট
কথা ঐসব পণ্য দিয়ে কেনাকাটা করা যেত। আজকের পৃথিবীতে তা হয় না। ঐ সময়ে
মানূষ খেজুর, বার্লি, লবণ ইত্যাদি পণ্য বিনিময় করে তার অন্যান্য প্রয়োজনীয়
জিনিষ সংগ্রহ করতে পারত। আজকে সেটা সম্ভব নয়।
জনৈক
এজন্যই হাদিসে মুসাররাতে দেখা যায়, রাসুল স. দুধের বদলায় এক কেজি খেজুর দিতে বলছিলেন। সেটাও মুদ্রা হিসেবেই ছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন