আট রাকাত তারাবীর দলীলসমূহ পর্যালোচনা এবং কিছু কথা...
হাদীস ১: হযরত আবু সালামা (রাঃ) আয়েশা (রাঃ) -কে
জিজ্ঞেস করলেন যে, রাসূল (সাঃ) রমজান মাসে নামাজ কেমন পড়তেন? আয়েশা (রাঃ)
বললেন, রমজান ও অন্য ১১মাসে ১১রাকাতের চেয়ে বেশী পড়তেন না। প্রথমে
৪রাকাত। যার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে প্রশ্ন কর না। তারপর ৪ রাকাত। যার
সৌন্দর্য ওদীর্ঘতা সম্পর্কে প্রশ্ন কর না। তারপর ৩রাকাত। আমি বললাম ইয়া
রাসূলাল্লাহ! আপনি কি বিতর পড়ার আগে ঘুমুচ্ছেন? তিনি (সাঃ) বললেন
আয়েশা!আমার চোখ ঘুমায় কিন্ত অন্তর সজাগ থাকে। (বুখারী ১/১৫৪)
পর্যালোচনাঃ বর্ণিত হাদীসটিকে আট রাকাত তারাবীর পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী দলীল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু হাদীসটি তাহাজ্জুদ সম্পর্কে। তারাবী সম্পর্কে নয়। আর তারাবী ও তাহাজ্জুদ যে এক নামাজ নয় বরং ভিন্ন ভিন্ন নামাজ সেকথা আহলে হাদীসদের দায়িত্বশীল আলিমগণও স্বীকার করেন।
(দেখুন:আহলে হাদীস কা মাযহাব: পৃঃ ৯২-৯৩;ফাতাওয়া ছানাইয়্যাহ: ১/৬৮২, ৬৫৪) তাই বর্ণিত হাদীস দ্বারা ৮রাকাত তারাবীর দলীল দেয়া অজ্ঞতা ও দলান্ধতা বৈ কিছুই নয়।
২নং দলীল: জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) রমজান মাসে আমাদেরকে নিয়ে ৮রাকাত নামাজ আদায় করলেন এবং বিতর পড়লেন। দ্বিতীয় রাতে আমরা এসে মাসজিদে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু ফজর হয়ে গেল তিনি (সাঃ) বেরিয়ে আসলেন না। যখন ফজরের নামাজ পড়তে আসলেন তখন আমরা জিজ্ঞাসা করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ!আমরা সকলে মাসজিদে একত্রিত হয়েছিলাম আপনি আমাদেরকে নিয়ে নামাজ পড়বেন সে আশায়। রাসূল (সাঃ) বললেন, আমার ভয় হচ্ছিল যে, তোমাদের উপর বিতর ওয়াজিব হয়ে যাবে। (ইবনে হিব্বান ৭১০)
সনদ বিশ্লেষণ: বর্ণিত হাদীসটি নিতান্তই জঈফ ও দলীলযোগ্য নয়। কারণ এতে দুই জন আপত্তিকর রাবী রয়েছে।
১.ইয়াকুব আল-কুম্মী। তার সম্পর্কে ইমাম দারাকুতনী বলেন 'তিনি শক্তিশালী নন' (মীযানুল ই'তিদাল ৭/ ২৭৮)
২.ঈসা ইবনে জারিয়া। তার সম্পর্কে ইমাম নাসাঈ ওআবু দাউদ বলেন 'মুনকারুল হাদীস'। ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন বলেন, তার নিকট আপত্তিকর বর্ণনা আছে। ইমাম নাসাঈ তাকে মাতরুকও বলেছেন (মীযানুল ই'তিদাল ৭/২৭৮) ইবনে আদী বলেন, তার সব হাদীস সংরক্ষিত নয় (তাহযীবুত তাহযীব ৮/২০৭;আল কামেল ৬/৪৩৬)
৩য় দলীল: সায়েব ইবনে ইয়াজিদ হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ওমর (রাঃ) উবাই ইবনে কা'আব ও তামিম দারীকে ১১রাকাত পড়ানোর নির্দেশ দিলেন। (মুয়াত্তা মালেক ৪০) ।
পর্যালোচনা: ৮রাকাত তারাবীর দাবিদাররা বর্ণিত হাদীস দ্বারা ৮রাকাতের দলীল পেশ করে থাকে। কিন্ত, এটা দ্বারা ৮রাকাত সাবিত হয় না। কারণ-
১. ইমাম মালেক (রহঃ) সায়েব ইবনে ইয়াজিদ থেকে ২০রাকাতের পক্ষে ২টি রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন। বর্ণিত হাদীসটি সে দুই রেওয়ায়েতের খেলাফ।
২. হাদীসটি মুজতারিব।
৩. মুহাদ্দিসিনের মতে হাদীসটিতে ২০এর স্হলে ১১ উল্লেখ করা বর্ণনাকারীর ভুল। (আল-ইস্তিযকার ৫/১৫৬; শরহে জুরকানী ১/৩৩৫; রাকাতে তারাবী ১২, ২০) ।
৪.সায়েব ইবনে ইয়াজিদের শাগরিদ ইয়াজিদ ইবনে খুসায়ফা। তার বর্ণনায় ইজতিরাব নেই। তার সকল ছাত্র বর্ণিত হাদীসটিকে এভাবে বর্ণনা করেন যে, সায়েব ইবনে ইয়াজিদ (রহঃ) বলেন, আমরা ওমর (রাঃ) এর যুগে তারাবীর নামাজ ২০রাকাত পড়তাম। অতএব এবর্ণনা আগের বর্ণনার উপর প্রাধান্য পাবে। (রাকাতে তারাবী ২১)
মোটকথা: এই হাদীস দ্বারা ২০রাকাত তারাবীই প্রমাণিত হয়। ৮রাকাত নয়।
৪নং দলিল: হযরত জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন, উবাই ইবনে কা'আব (রাঃ) রাসূল (সাঃ) এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ!রমজান মাসে রাতে একটি ঘটনা ঘটেছে। রাসূল (সাঃ) বললেন কী ঘটনা?তিনি বলেন, আমার বাড়ির মহিলারা বললো আমরা কোরআন পড়তে জানিনা তাই আপনার পিছনে নামাজ পড়ব। আমি তাদেরকে নিয়ে আট রাকাত তারাবী পড়লাম। অতঃপর বিতর পড়লাম। রাসূল (সাঃ) শুনে কিছু বললেন না। আর এটা সমর্থন করার মত। (মুসনাদে আবু ইয়ালা ২/৩২৬)
পর্যালোচনা: এ হাদীসটি জঈফ ও দুর্বল। কারণ এতে দুইজন রাবী আছেন। একজন জঈফ। আরেকজন পরিত্যাজ্য। এদের আলোচনা দ্বিতীয় পর্বে গত হয়েছে।
৫ম দলিল: সায়েব ইবনে ইয়াজিদ বলেন, ওমর (রাঃ) সকল মানুষকে উবাই ইবনে কা'আব ও তামিম দারীর (রাঃ) পিছনে একত্রিত করলেন। আর তাঁরা উভয়ে ১১রাকাত পড়তেন।
পর্যালোচনা: এহাদীসে ইজতিরাব রয়েছে। তাই তারজীহ বা তাতবীকের পদ্ধতিতে আমল করতে হবে। আর এপদ্ধতিতে আমল করলে ২০রাকাত তারাবীই সাব্যস্ত হয়। যার আলোচনা তৃতীয় পর্বে গত হয়েছে।
'তারাবীহ'শব্দটিই প্রমাণ করে তারাবীর নামাজ আট রাকাতের বেশী
বিগত ৯টি পোস্টে ২০রাকাত তারাবীর দলিল আলোচনা ও ৮রাকাত তারাবীর দলিল পর্যালোচনা করা হয়েছে। এবং একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়েছে যে আট রাকাত তারাবীর পক্ষে কোনই সহীহ হাদীস নেই। যে সত্য গ্রহণ করতে চায় তার জন্য ঐপোস্ট গুলিই যথেষ্ট। আর যে সত্য গ্রহণ করতে চায় না তার জন্য হাজার হাজার দলিল পেশ করলেও কোন ফায়দা হবে না। এখন আসুন দেখি তারাবীর রাকাত সংখ্যার ব্যাপারে 'তারাবীহ' শব্দটির ভূমিকা কী?
'তারাবীহ'আরবী শব্দ, এবং তা 'তারবীহাতুন' শব্দের বহুবচন। তারবীহাতুন অর্থ একবার বিশ্রাম করা। আর 'তারাবীহ' অর্থ হচ্ছে অনেকবার বিশ্রাম করা। এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে,আরবী ভাষায় বচন তিনটি ১.একবচন ২. দ্বীবচন ৩.বহুবচন। আর এখানে বহুবচনই ব্যবহার হয়েছে। যদি তারাবী আট রাকাতই হত তবে এখানে দ্বীবচন 'তারবীহাতানে'ব্যবহার হত। কেননা প্রতি চার রাকাত পর একবার বিশ্রাম নেয়ার কারণেই এ নামাজকে 'তারাবীহ'নামকরণ করা হয়েছে।আর যদি আট রাকাত হত তখন দুই বিশ্রাম তথা 'তারবীহাতানে'হত। তারাবীহ হওয়ার জন্য কমপক্ষে ৪ রাকাতের পর ৩ বার বিশ্রাম (= ১২ রাকাত + এরপর আরো ৪ রাকাত = ১৬ রাকাত) লাগবে।
মোটকথা, নামেই প্রমাণ করে তারাবী নামাজ আট রাকাতের অধিক। কিন্তু বেদআতীরা তা বোঝেনা।
স্বয়ং ইমাম বুখারী (রহঃ) ২০ রাকাত তারাবীহ পড়তেন
ইমাম তিরমিযী রহঃ বলেন, তারাবীর ব্যাপারে আলেমগণ মতানৈক্য করেছেন। এক দলের মতামত ছিল তারাবী নামাজ বিতর সহ ৪১ রাকাত। এটা মদিনার আলেমগণের মত। আর মদিনাবাসীগণ এর উপরই আমল করতেন। আর অধিকাংশ আলেমের মতামত হল তারাবী ২০ রাকাত। যেটা উমর, আলী এবং অন্যান্য সাহাবীগণ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। (তিরমিযী, ১ম খন্ড, ১৬৬পৃষ্ঠা) ।
এখানে ইমাম তিরমিযী রহঃ তাঁর যুগে তারাবী কত রাকাত পড়া হত সে আলোচনা করেন। এবং তিনি বলেন যে, এক্ষেত্রে আলেমগণের মধ্যে ২টি দল। ১ম দল: মদিনাবাসী আলেমগণ। তাঁদের মত হল তারাবী বিতর সহ ৪১রাকাত। ২য় দল: (মদিনাবাসী ছাড়া) বেশীরভাগ আলেমগণ। তাঁদের মত হল তারাবী ২০রাকাত।
সুতরাং একথা দ্বারা বোঝা যায় সেই যুগে ৮রাকাতের ফিতনা ছিল না। থাকলে ইমাম তিরমিযী রহঃ তা উল্লেখ করতেন।
আর ইমাম বুখারী রহঃ হলেন তিরমিযী রহঃ এর উস্তাদ। তিনিও ৮রাকাত তারাবী পড়েন নি। পড়লে তিরমিযী রহঃ উল্লেখ করতেন। অপরদিকে বুখারী রহঃ ছিলেন বুখারার আলেম। মাদানী আলেম ছিলেন না। তাই নির্দ্বিধায় একথা বলা যেতে পারে যে, তিনিও ২০ রাকাত তারাবীই পড়তেন।
এখন ৮রাকাতীদের কাছে আমার প্রশ্ন: ইমাম বুখারী রহঃ কি বিদাতী ছিলেন নাকি তিনি আয়েশা রাঃ এর হাদীস বুঝেন নি???
বিশ রাকাত বনাম আট রাকাত কারা সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী ??
তারাবীর রাকাত সংখ্যা নিয়ে মতানৈক্যে বেশি প্রাচীন নয়। এ মতানৈক্যের সূচনা মাত্র দেড় থেকে দুইশত বছরের মধ্যে। অপরদিকে বিশ রাকাতের আমল নবীযুগ থেকেই ধারাবাহিকভাবে উম্মাতের মাঝে চলে আসছে। অপরদিকে আট রাকাতের পক্ষে শ্লোগান বাটালবীর যুগ থেকে। এখানে আমার মূল উদ্দেশ্য রাকাত সংখ্যা নিয়ে আলোচনা নয়। আমার উদ্দেশ্য হল সুস্থ বুদ্ধির বিবেচনায় ও সুন্নাহ অনুসরণের দিক থেকে কোনটি বেশি নিকটবর্তী। দলিলের বিবেচনায় তো বিশ রাকাতই। সুস্থ বুদ্ধি বা সুস্থ জ্ঞাণের বিবেচনায় ও বিশ রাকাতই সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী। কারণ যারা আট রাকাতের দাবীদার তাদের কথা হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আট রাকাতই পড়েছেন বিশ রাকাত পড়েননি। বিশ রাকাত হযরত উমরের রাঃ আমল। আর কোন সাহাবীর আমল দ্বারা রাসূলের আমলকে বাদ দেয়া যাবেনা। এক্ষেত্রে তো আমাদের প্রথম উত্তর হল স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই বিশ রাকাত পড়েছেন। দ্বিতীয়ত যদি ধরেও নেয়া হয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল ছিল আট রাকাত আর উমর রাঃ এর আমল ছিল বিশ রাকাত তবুও সুন্নাহ অনুসরণে বিশ রাকাতের উপর আমলকারীরাই অধিক নিকটবর্তী। কারণ আট রাকাতের উপর আমল করলে শুধু একটি সুন্নাতের উপর আমল হল। পক্ষান্তরে বিশ রাকাতের উপর আমল করলে দুটি সুন্নাতের উপর আমল হল। একটি হল রাসূলের সুন্নাত অপরটি হল সাহাবীর সুন্নাত। কারণ বিশের মধ্যে তো আট আছেই। সুতরাং যারা বিশ রাকাত তারাবীহ পড়েন তারাই অধিক সুন্নাহর নিকটবর্তী বা অনুসারী।
---------
পর্যালোচনাঃ বর্ণিত হাদীসটিকে আট রাকাত তারাবীর পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী দলীল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু হাদীসটি তাহাজ্জুদ সম্পর্কে। তারাবী সম্পর্কে নয়। আর তারাবী ও তাহাজ্জুদ যে এক নামাজ নয় বরং ভিন্ন ভিন্ন নামাজ সেকথা আহলে হাদীসদের দায়িত্বশীল আলিমগণও স্বীকার করেন।
(দেখুন:আহলে হাদীস কা মাযহাব: পৃঃ ৯২-৯৩;ফাতাওয়া ছানাইয়্যাহ: ১/৬৮২, ৬৫৪) তাই বর্ণিত হাদীস দ্বারা ৮রাকাত তারাবীর দলীল দেয়া অজ্ঞতা ও দলান্ধতা বৈ কিছুই নয়।
২নং দলীল: জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) রমজান মাসে আমাদেরকে নিয়ে ৮রাকাত নামাজ আদায় করলেন এবং বিতর পড়লেন। দ্বিতীয় রাতে আমরা এসে মাসজিদে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু ফজর হয়ে গেল তিনি (সাঃ) বেরিয়ে আসলেন না। যখন ফজরের নামাজ পড়তে আসলেন তখন আমরা জিজ্ঞাসা করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ!আমরা সকলে মাসজিদে একত্রিত হয়েছিলাম আপনি আমাদেরকে নিয়ে নামাজ পড়বেন সে আশায়। রাসূল (সাঃ) বললেন, আমার ভয় হচ্ছিল যে, তোমাদের উপর বিতর ওয়াজিব হয়ে যাবে। (ইবনে হিব্বান ৭১০)
সনদ বিশ্লেষণ: বর্ণিত হাদীসটি নিতান্তই জঈফ ও দলীলযোগ্য নয়। কারণ এতে দুই জন আপত্তিকর রাবী রয়েছে।
১.ইয়াকুব আল-কুম্মী। তার সম্পর্কে ইমাম দারাকুতনী বলেন 'তিনি শক্তিশালী নন' (মীযানুল ই'তিদাল ৭/ ২৭৮)
২.ঈসা ইবনে জারিয়া। তার সম্পর্কে ইমাম নাসাঈ ওআবু দাউদ বলেন 'মুনকারুল হাদীস'। ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন বলেন, তার নিকট আপত্তিকর বর্ণনা আছে। ইমাম নাসাঈ তাকে মাতরুকও বলেছেন (মীযানুল ই'তিদাল ৭/২৭৮) ইবনে আদী বলেন, তার সব হাদীস সংরক্ষিত নয় (তাহযীবুত তাহযীব ৮/২০৭;আল কামেল ৬/৪৩৬)
৩য় দলীল: সায়েব ইবনে ইয়াজিদ হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ওমর (রাঃ) উবাই ইবনে কা'আব ও তামিম দারীকে ১১রাকাত পড়ানোর নির্দেশ দিলেন। (মুয়াত্তা মালেক ৪০) ।
পর্যালোচনা: ৮রাকাত তারাবীর দাবিদাররা বর্ণিত হাদীস দ্বারা ৮রাকাতের দলীল পেশ করে থাকে। কিন্ত, এটা দ্বারা ৮রাকাত সাবিত হয় না। কারণ-
১. ইমাম মালেক (রহঃ) সায়েব ইবনে ইয়াজিদ থেকে ২০রাকাতের পক্ষে ২টি রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন। বর্ণিত হাদীসটি সে দুই রেওয়ায়েতের খেলাফ।
২. হাদীসটি মুজতারিব।
৩. মুহাদ্দিসিনের মতে হাদীসটিতে ২০এর স্হলে ১১ উল্লেখ করা বর্ণনাকারীর ভুল। (আল-ইস্তিযকার ৫/১৫৬; শরহে জুরকানী ১/৩৩৫; রাকাতে তারাবী ১২, ২০) ।
৪.সায়েব ইবনে ইয়াজিদের শাগরিদ ইয়াজিদ ইবনে খুসায়ফা। তার বর্ণনায় ইজতিরাব নেই। তার সকল ছাত্র বর্ণিত হাদীসটিকে এভাবে বর্ণনা করেন যে, সায়েব ইবনে ইয়াজিদ (রহঃ) বলেন, আমরা ওমর (রাঃ) এর যুগে তারাবীর নামাজ ২০রাকাত পড়তাম। অতএব এবর্ণনা আগের বর্ণনার উপর প্রাধান্য পাবে। (রাকাতে তারাবী ২১)
মোটকথা: এই হাদীস দ্বারা ২০রাকাত তারাবীই প্রমাণিত হয়। ৮রাকাত নয়।
৪নং দলিল: হযরত জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন, উবাই ইবনে কা'আব (রাঃ) রাসূল (সাঃ) এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ!রমজান মাসে রাতে একটি ঘটনা ঘটেছে। রাসূল (সাঃ) বললেন কী ঘটনা?তিনি বলেন, আমার বাড়ির মহিলারা বললো আমরা কোরআন পড়তে জানিনা তাই আপনার পিছনে নামাজ পড়ব। আমি তাদেরকে নিয়ে আট রাকাত তারাবী পড়লাম। অতঃপর বিতর পড়লাম। রাসূল (সাঃ) শুনে কিছু বললেন না। আর এটা সমর্থন করার মত। (মুসনাদে আবু ইয়ালা ২/৩২৬)
পর্যালোচনা: এ হাদীসটি জঈফ ও দুর্বল। কারণ এতে দুইজন রাবী আছেন। একজন জঈফ। আরেকজন পরিত্যাজ্য। এদের আলোচনা দ্বিতীয় পর্বে গত হয়েছে।
৫ম দলিল: সায়েব ইবনে ইয়াজিদ বলেন, ওমর (রাঃ) সকল মানুষকে উবাই ইবনে কা'আব ও তামিম দারীর (রাঃ) পিছনে একত্রিত করলেন। আর তাঁরা উভয়ে ১১রাকাত পড়তেন।
পর্যালোচনা: এহাদীসে ইজতিরাব রয়েছে। তাই তারজীহ বা তাতবীকের পদ্ধতিতে আমল করতে হবে। আর এপদ্ধতিতে আমল করলে ২০রাকাত তারাবীই সাব্যস্ত হয়। যার আলোচনা তৃতীয় পর্বে গত হয়েছে।
-পরিশিষ্ট-
'তারাবীহ'শব্দটিই প্রমাণ করে তারাবীর নামাজ আট রাকাতের বেশী
বিগত ৯টি পোস্টে ২০রাকাত তারাবীর দলিল আলোচনা ও ৮রাকাত তারাবীর দলিল পর্যালোচনা করা হয়েছে। এবং একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়েছে যে আট রাকাত তারাবীর পক্ষে কোনই সহীহ হাদীস নেই। যে সত্য গ্রহণ করতে চায় তার জন্য ঐপোস্ট গুলিই যথেষ্ট। আর যে সত্য গ্রহণ করতে চায় না তার জন্য হাজার হাজার দলিল পেশ করলেও কোন ফায়দা হবে না। এখন আসুন দেখি তারাবীর রাকাত সংখ্যার ব্যাপারে 'তারাবীহ' শব্দটির ভূমিকা কী?
'তারাবীহ'আরবী শব্দ, এবং তা 'তারবীহাতুন' শব্দের বহুবচন। তারবীহাতুন অর্থ একবার বিশ্রাম করা। আর 'তারাবীহ' অর্থ হচ্ছে অনেকবার বিশ্রাম করা। এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে,আরবী ভাষায় বচন তিনটি ১.একবচন ২. দ্বীবচন ৩.বহুবচন। আর এখানে বহুবচনই ব্যবহার হয়েছে। যদি তারাবী আট রাকাতই হত তবে এখানে দ্বীবচন 'তারবীহাতানে'ব্যবহার হত। কেননা প্রতি চার রাকাত পর একবার বিশ্রাম নেয়ার কারণেই এ নামাজকে 'তারাবীহ'নামকরণ করা হয়েছে।আর যদি আট রাকাত হত তখন দুই বিশ্রাম তথা 'তারবীহাতানে'হত। তারাবীহ হওয়ার জন্য কমপক্ষে ৪ রাকাতের পর ৩ বার বিশ্রাম (= ১২ রাকাত + এরপর আরো ৪ রাকাত = ১৬ রাকাত) লাগবে।
মোটকথা, নামেই প্রমাণ করে তারাবী নামাজ আট রাকাতের অধিক। কিন্তু বেদআতীরা তা বোঝেনা।
স্বয়ং ইমাম বুখারী (রহঃ) ২০ রাকাত তারাবীহ পড়তেন
ইমাম তিরমিযী রহঃ বলেন, তারাবীর ব্যাপারে আলেমগণ মতানৈক্য করেছেন। এক দলের মতামত ছিল তারাবী নামাজ বিতর সহ ৪১ রাকাত। এটা মদিনার আলেমগণের মত। আর মদিনাবাসীগণ এর উপরই আমল করতেন। আর অধিকাংশ আলেমের মতামত হল তারাবী ২০ রাকাত। যেটা উমর, আলী এবং অন্যান্য সাহাবীগণ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। (তিরমিযী, ১ম খন্ড, ১৬৬পৃষ্ঠা) ।
এখানে ইমাম তিরমিযী রহঃ তাঁর যুগে তারাবী কত রাকাত পড়া হত সে আলোচনা করেন। এবং তিনি বলেন যে, এক্ষেত্রে আলেমগণের মধ্যে ২টি দল। ১ম দল: মদিনাবাসী আলেমগণ। তাঁদের মত হল তারাবী বিতর সহ ৪১রাকাত। ২য় দল: (মদিনাবাসী ছাড়া) বেশীরভাগ আলেমগণ। তাঁদের মত হল তারাবী ২০রাকাত।
সুতরাং একথা দ্বারা বোঝা যায় সেই যুগে ৮রাকাতের ফিতনা ছিল না। থাকলে ইমাম তিরমিযী রহঃ তা উল্লেখ করতেন।
আর ইমাম বুখারী রহঃ হলেন তিরমিযী রহঃ এর উস্তাদ। তিনিও ৮রাকাত তারাবী পড়েন নি। পড়লে তিরমিযী রহঃ উল্লেখ করতেন। অপরদিকে বুখারী রহঃ ছিলেন বুখারার আলেম। মাদানী আলেম ছিলেন না। তাই নির্দ্বিধায় একথা বলা যেতে পারে যে, তিনিও ২০ রাকাত তারাবীই পড়তেন।
এখন ৮রাকাতীদের কাছে আমার প্রশ্ন: ইমাম বুখারী রহঃ কি বিদাতী ছিলেন নাকি তিনি আয়েশা রাঃ এর হাদীস বুঝেন নি???
বিশ রাকাত বনাম আট রাকাত কারা সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী ??
তারাবীর রাকাত সংখ্যা নিয়ে মতানৈক্যে বেশি প্রাচীন নয়। এ মতানৈক্যের সূচনা মাত্র দেড় থেকে দুইশত বছরের মধ্যে। অপরদিকে বিশ রাকাতের আমল নবীযুগ থেকেই ধারাবাহিকভাবে উম্মাতের মাঝে চলে আসছে। অপরদিকে আট রাকাতের পক্ষে শ্লোগান বাটালবীর যুগ থেকে। এখানে আমার মূল উদ্দেশ্য রাকাত সংখ্যা নিয়ে আলোচনা নয়। আমার উদ্দেশ্য হল সুস্থ বুদ্ধির বিবেচনায় ও সুন্নাহ অনুসরণের দিক থেকে কোনটি বেশি নিকটবর্তী। দলিলের বিবেচনায় তো বিশ রাকাতই। সুস্থ বুদ্ধি বা সুস্থ জ্ঞাণের বিবেচনায় ও বিশ রাকাতই সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী। কারণ যারা আট রাকাতের দাবীদার তাদের কথা হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আট রাকাতই পড়েছেন বিশ রাকাত পড়েননি। বিশ রাকাত হযরত উমরের রাঃ আমল। আর কোন সাহাবীর আমল দ্বারা রাসূলের আমলকে বাদ দেয়া যাবেনা। এক্ষেত্রে তো আমাদের প্রথম উত্তর হল স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই বিশ রাকাত পড়েছেন। দ্বিতীয়ত যদি ধরেও নেয়া হয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল ছিল আট রাকাত আর উমর রাঃ এর আমল ছিল বিশ রাকাত তবুও সুন্নাহ অনুসরণে বিশ রাকাতের উপর আমলকারীরাই অধিক নিকটবর্তী। কারণ আট রাকাতের উপর আমল করলে শুধু একটি সুন্নাতের উপর আমল হল। পক্ষান্তরে বিশ রাকাতের উপর আমল করলে দুটি সুন্নাতের উপর আমল হল। একটি হল রাসূলের সুন্নাত অপরটি হল সাহাবীর সুন্নাত। কারণ বিশের মধ্যে তো আট আছেই। সুতরাং যারা বিশ রাকাত তারাবীহ পড়েন তারাই অধিক সুন্নাহর নিকটবর্তী বা অনুসারী।
---------
লিখেছেনঃ শাইখ যুবায়ের আল মাহমুদ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন