ইয়াজুজ-মাজুজ সম্পর্কে ইমরান নজর হোসেনের ভ্রান্ত আক্বিদা পর্যালোচনা
(ফুটনোট সহ পূর্ণ লেখাটি পড়ুন)
.
প্রশ্নঃ
আমি শায়খ ইমরান নজরের এমন লেকচার শুনেছি যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইসরাঈলের সাদা ইহুদিদেরকে ইয়াজুজ-মাজুজ হিসেবে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে এবং তারা ইতোমধ্যে সুপেয় পানির দখল নিতে শুরু করেছে- ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি জানতে চাই তাদের এই বক্তব্য কতটুকু সঠিক? এমন সম্ভবনা কি আদতেই আছে যে, ইয়াজুজ-মাজুজ আমাদের মধ্যেই বিদ্যমান?
উত্তরঃ
পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্।
ইয়াজুজ-মাজুজ কারা এবং তারা কোথায় আছে এই ব্যাপারে পূর্ব থেকেই অনেক আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক চলে আসছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখা দরকার যে, বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, কুরআন-হাদীসে যেসব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত নেই সেসব বিষয়ের খুটিনাটি অন্বেষণ করা উচিত নয় এবং বাহ্যিকভাবে যা বোঝা যাচ্ছে তাই বুঝে নিতে হবে। [১]
কিন্তু শায়েখ ইমরান নজর এই বিষয়গুলোতে (সালাফের বিপরীতে) নিজস্ব যুক্তি ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পছন্দ করেন। তিনি এও বিশ্বাস করেন সুরা কাহাফে (আয়াত ৯৩-৯৬) বর্ণিত যুলকারনাইন ও ইয়াজুজ-মাজুজ দ্বারা ককেসাস পর্বতমালা বেষ্টিত Darial Gorge কে বোঝায়। [২]
.
তিনি তার An Islamic View of Gog and Magog in the Modern World বইতে ইয়াজুজ-মাজুজ সম্পর্কে লিখেন, ""ককেশাস পর্বতমালার উত্তর ভু-খণ্ডে বসবাসকারী Khazar গোত্রের লোকেরা ইহুদিবাদ গ্রহণ করে এবং ইসলামের প্রথম যুগে যখন বিশ্বের বিভিন্ন স্থান একের পর এক ইসলামের ছায়াতলে আসছিল তখন তারা তাদের ভু-খণ্ডে প্রবেশের সমস্ত পথ বন্ধ করে দিতে সমর্থ হয়। আমরা এমন লোকের সন্ধান পেয়েছি যারা যুলকারনাইনের বন্দিশালা থেকে নিজেদের মুক্ত করে তাদের পবিত্র ভূমির (may be israel) দিকে ছুটে চলেছে। এরা হল ককেশিয়ান বা ইউরোপিয়ান ইহুদিরা যারা সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে (বিশেষত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায়) বসবাসরত ইহুদিদের পবিত্র ভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যাপারে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে।
তাই আমরা বলতে পারি পূর্ব ইউরোপের khazars রাই আসলে ইয়াজুজ-মাজুজ যাদের বেশিরভাগ এখন ইউরোপে বসবাসরত ইহুদি সম্প্রদায় হলেও অনেকেই খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে ইউরোপে বসবাস করছে।"" [৩]
.
তিনি অভিযোগ করেন যে, ইয়াজুজ-মাজুজ সম্পর্কে যারা অন্যকথা বলে তারা কেবল এই কারনেই বলে যে, তারা নিজেরা কোনদিন যুলকারনাইনের প্রাচীর খুজে দেখেনি।[৪]
ইয়াজুজ-মাজুজের বিষয়ে তিনি কুরআনুল কারিমের আয়াত ও হাদিসের যে ব্যাখ্যা নিজস্ব যুক্তির মাধ্যমে দেন তা পূর্বের আর কোন মুফাফসির এবং মুদাদ্দিস করেন নি। [৫]
.
হাদিসে পরিষ্কার ভাষায় এসেছে, ইসা আ. পৃথিবিতে অবতরণের পরেই ইয়াজুজ-মাজুজের আগমন ঘটবে।
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
"...অবশেষে দাজ্জালকে লুদুদ নামক আরণ্যের কাছে পেয়ে যাবেন এবং তাকে হত্যা করবেন। অতঃপর ঈসা (আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঐ সম্প্রদায়ের নিকট যাবেন, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা দাজ্জালের ফিতনা থেকে হিফাযত করেছেন। তাদের নিকট গিয়ে তিনি তাদের চেহারায় হাত বুলিয়ে জান্নাতে তাদের স্থানসমূহ সম্পর্কে সংবাদ দিবেন।
এমতাবস্থায় আল্লাহ তাআলা ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর প্রতি এ মর্মে অহী নাযিল করবেন যে, আমি আমার এমন কিছু বিশেষ বান্দা আবির্ভূত করেছি, যাদের সাথে কারোই যুদ্ধ করার ক্ষমতা নেই। সুতরাং তুমি আমার বান্দাদের তূর পর্বতে সমবেত কর। তখন আল্লাহ তাআলা ইয়াজুয-মাযুয সম্প্রদায়কে প্রেরণ করবেন। তারা প্রতি উঁচু ভূমি হতে ছুটে আসবে। তাদের প্রথম দলটি তাবারিয়া উপসাগরের নিকট এসে এর সমুদয় পানি পান করে নিঃশেষ করে দিবে। অতঃপর তাদের সর্বশেষ দলটি এ স্থান দিয়ে যাত্রাকালে বলবে, এ সমুদ্রে এক সময় অবশ্যই পানি ছিল। (সহিহ মুসলিম, ৮/৫০১, হাদিস নং ৭০১৬)
.
তিনি উক্ত হাদিসের শেষাংশের সাথে ভূমধ্যসাগরের তুলনা করে ইয়াজুজ-মাজুজের প্রসঙ্গে উল্লেখ করে। [৬] তিনি তার বইয়ে বলেন,
"এই হাদিসে বলা হয়েছে ইয়াজুজ-মাজুজকে বের করে দেবার পর তারা জেরুজালেম যাবার পথে ভুমধ্যসাগরের পানি পান করতে করতে শুকিয়ে ফেলবে। বর্তমানে ভূমধ্যসাগরের পানি এতটাই কমে গিয়েছে যে একে প্রায় মৃতই বলা যায়... ভূমধ্যসাগরের পানি শুকিয়ে যাবার বিষয়টা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র... পানি কমতে কমতে এমন সময় আসবে যখন ইসরায়েলের পানির সাপ্লাইয়ের পাম্পগুলোর চেয়ে নিচে আসবে... এছাড়াও বলা যায়, বিশ্বের বড় বড় হৃদসমূহের পানি ক্রমাগত শুকিয়ে যাচ্ছে যা পৃথিবীতে ইয়াজুজ-মাজুজের ছড়িয়ে পড়া প্রমাণ করে।" [৭]
.
উপরোক্ত ব্যাখ্যাগুলো ছাড়াও শায়খের কিয়ামত দিবস সম্পর্কে এমন সব মতামত/ব্যাখ্যা রয়েছে যা পূর্ববর্তী অধিকাংশ কুরআন-হাদীস বিশেষজ্ঞদের সাথে মিলে না। যেমনঃ
১. দাজ্জাল (Antichrist) পৃথিবীতে তার মিশণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং সে তার মিশনের তৃতীয় স্তরে আছে।
২. বর্ণীত "ধোয়া" (the smoke) হল বর্তমানের পরিবেশ দূষণ।
৩. "দাব্বাতুল আরদ" (the beast) বলতে বর্তমান ইসরাঈলকে বোঝানো হয়েছে।
.
এসকল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তার একান্ত নিজস্ব চিন্তাপ্রসূত এবং এর সাথে সোনালী যুগের কোন মুফাস্সির বা মুহাদ্দিসের মতের কোন মিল নেই।
.
আগেই বলা হয়েছে, মুসলিম হিসেবে এধরনের কোন হাদিসের ব্যাখ্যায় নিজস্ব যুক্তি, চিন্তা প্রয়োগের কোন সুযোগ আমাদের নেই। (এসব গায়েবের বিষয়, যা ওহীর মাধ্যমে রাসূল স.কে জানানো হয়েছে) আমরা বরং হাদিসের বাহ্যিক বিষয়বস্তু নিয়েই থাকব। সেখানে গভীর বিশ্লেষণে যাব না যেখানে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবীগন (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) যাননি।
আল্লাহ তায়ালাই সর্বজ্ঞ..
উত্তর লিখন-
বিলাল মুহাম্মাদ
দারুল ইফতা, নিউজার্সি, ইউএসএ
যাচাই ও অনুমোদন-
মুফতি ইব্রাহিম দেশাই
তথ্যসূত্র এবং পাদটীকাঃ-
[১] Bawadir An-Nawadir, pg. 374-375, Idaratul Islamiyyaat Lahore
[২] Hosein, Imran. “An Islamic View of Gog and Magog in the Modern World”, pg. 170
[৩] Ibid., pg. 177-178
[৪] Ibid., pg. 184
[৫] উনি উনার বইয়ের ১৯৯পৃষ্ঠায় বলেছেন- সুরা আম্বিয়া ৯৬ আয়াতে "ইহুদিদের জেরুজালেমে ফিরে আসার কথা বলা হয়েছে।"
এই আয়াতের ক্ষেত্রে উনার ব্যাখ্যা কোনো সালাফের তাফসীরের সাথেই মিলেনা। যেমনঃ ইমাম কুরতুবি রহ: সাফ ভাষায় বলেছেন এখানে আল্লাহর গজব পড়া শহরের বাসিন্দাদের কিয়ামত পর্যন্ত তওবা নসিব না হওয়া বিষয়ে বলা হয়েছে। (তাফসিরের কুরতুবি, সুরা আম্বিয়া ৯৫-৯৭ আয়াতের তাফসির দ্রষ্টব্য) আর কমন সেন্সও সেটাই বলছে, আয়াতগুলো খেয়াল করুন-
وَحَرَامٌ عَلَىٰ قَرْيَةٍ أَهْلَكْنَاهَا أَنَّهُمْ لَا يَرْجِعُونَ -
حَتَّىٰ إِذَا فُتِحَتْ يَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَهُم مِّن كُلِّ حَدَبٍ يَنسِلُونَ - وَاقْتَرَبَ الْوَعْدُ الْحَقُّ فَإِذَا هِيَ شَاخِصَةٌ أَبْصَارُ الَّذِينَ كَفَرُوا يَا وَيْلَنَا قَدْ كُنَّا فِي غَفْلَةٍ مِّنْ هَٰذَا بَلْ كُنَّا ظَالِمِينَ -
.
""যেসব জনপদকে আমি ধ্বংস করে দিয়েছি, তার অধিবাসীদের ফিরে না আসাটা অবধারিত। যে পর্যন্ত না ইয়াজুজ ও মাজুজকে বন্ধন মুক্ত করে দেয়া হবে এবং তারা প্রত্যেক উচ্চভুমি থেকে দ্রুত ছুটে আসবে। আমোঘ প্রতিশ্রুত সময় নিকটবর্তী হলে কাফেরদের চক্ষু উচ্চে স্থির হয়ে যাবে; হায় আমাদের দূর্ভাগ্য, আমরা এ বিষয়ে বেখবর ছিলাম; বরং আমরা গোনাহগরই ছিলাম।"" (21:95-97)
.
[অনুবাদকের টিকা-
প্রথমত: উনার তাফসির(!) এই আয়াতের অর্থের সাথেই মিলেনা। আয়াত দুটি জাতির কথা বলা হয়েছে, ১. কোনো ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের বাসিন্দাদের কথা, ২. ইয়াজুজ মাজুজের কথা। দুটি ভিন্ন ভিন্ন জাতি।
২য় দল বের হওয়ার পর ১ম দল শহরের ফিরবে/ফিরতে পারে। ইমরান সাহেব দুইটারে কেম্নে কিভাবে মিলালেন, আর কিভাবে ইহুদীদের ইয়াজুজ মাজুজ বানালেন কে জানন!! নাকি উনি কোরআনের আয়াতের তরজমাও বুঝেন না? আল্লাহ মালুম।
দ্বিতীয়ত: উনি যে কাটছাঁট করে দলিল দেয়ায় অভ্যস্ত, তা এখান থেকেই বুঝা যায়, আগের - পরের আয়াত দেখলে উনার অপব্যাখ্যা ধরা খেয়ে যাবে, এজন্য ওই দুইটাকে কাটছাঁট করে মাঝের এক আয়াতের তাহরিফ(বিকৃতি) করেছেন। কি জিনিয়াস!]
.
[৬] “Sea of Galilee”, Wikipedia , accessed on November, 26, 2013
[৭] Hosein, Imran. “An Islamic View of Gog and Magog in the Modern World”, pg. 197-198
[৮] Hosein, Imran. ” Ten Major Signs of the Last Day – Has One Just Occurred”,
-------
[৯] অনুবাদকের টিকা:
প্রথমত: হাদিসের সাফ ভাষ্য খেয়াল করুন, দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেই ইজাজুজ মাজুজদের উচু ভূমি থেকে নেমে আসার ঘটনা 'মিন কুল্লি হাদাবিই ইয়ানসিলুন' ঘটবে, আর তাদের আবির্ভাবের সময় আল্লাহ নিজেই ঈসা আ.কে ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিবেন।
.
দ্বিতীয়ত: আপনারা হাদীসে দেখলেন কিয়ামতের পূর্বে ইয়াজুজ মাজুজরা ঈসা আ. ও মুসলমানদের অবরোধ করবে। পক্ষান্তরের এর আগে ইহুদীদেরকে মুসলমানরা কচুকাটা করবে। "এমনকি তারা পাথর বা গাছের পিছনে লুকিয়ে থাকবে। তখন পাথর বা গাছ বলবে, হে মুসলিম! হে আল্লাহর বান্দা! এই তো ইয়াহুদী আমার পিছনে লুকিয়ে আছে। এসো, তাকে হত্যা কর।" (মুসলিম ৭০৭৫, আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ) এর দ্বারা ইহুদীরা ইয়াজুজ মাজুজ এই থিওরি খণ্ডন হয়ে যাচ্ছে।
.
তৃতীয়ত: ঈসা আ. ওপর পাঠানো আল্লাহর ওহী "আমার এমন কিছু বিশেষ বান্দা আবির্ভূত করেছি, যাদের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষমতা কারো নেই" এর দ্বারা আমেরিকান - ইউরোপিয়ান - রাশিয়ানদের মাঝে ইমরান সাহেবের ইয়াজুজ মাজুজ আবিষ্কারের থিওরীও ছাই হয়ে যায়।
কেননা, আল-কায়েদার মুজাহিদরা এসব কথিত সুপারপাওয়ারদেরকে প্রতিটি যায়গাতেই নাকানিচোবানি খাইয়েছে, এখনো খাওয়াচ্ছে..। (আলহামদুলিল্লাহ)
....
অবশেষে, ইমরান নজর হোসেনের অনুসারীদের আমি তওবাহ করার আহবান জানাচ্ছি...
ওয়াসসালামু আলা মানিত্তাবা'আল হুদা!
.
----------
// ইমরান নজর হোসেন ফিতনা - ৬
#imranNexposed
কপি-পেস্ট এবং শেয়ার করে দ্বীন প্রচারে সহযোগী হোন..
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন