সালাতের সময় রিংটোন ও ফোনকল
মসজিদের পিনপতন নিরবতা ভেদ করে একটা হিন্দি গান বেজে উঠলো বিকট শব্দে। নামাজরত মুসুল্লিদের সবার কান এখন শব্দটার উৎসমুখের দিকে। নামাজের মনোযোগ ভেঙ্গে তারা ভাবছে, এমন বেক্কলমার্কা কাজটা কে করলো! মসজিদে এসে মোবাইলটা অফ করে রাখা যায় না? আর রিংটোন কি এমন গানই দিতে হবে? গান ছাড়া কি অন্যকোন রিংটোনের অভাব পড়েছে? এমন বিভিন্ন প্রশ্ন এসে ভিড় জমাচ্ছে প্রতিজন মুসুল্লির মাথায়। এর ভেতর দিয়েই আগের উৎসমূল থেকে আবার সেই গানটা বেজে উঠলো। যার মোবাইলে এমন কাণ্ড ঘটছে তিনি নিজেও বিব্রত। এমন পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়েন নি। কেন যে রিংটোন বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলেন! আর রিংটোন বন্ধ করতে ভুলে গেছেন ভালো কথা কিন্তু এই গানটা রিংটোনে দিয়েছেন কোন দুঃখে কে জানে! নামাজ শেষ হবার পর নিশ্চয়ই আশপাশের মুসুল্লিরা তাকে এটাওটা বলবে। তা না হলেও অন্তত চোখ বড় বড় করে বিরক্তি-দৃষ্টি যে হানবে তা তো নিশ্চিত। এসব নিয়ে টেনশন করতে করতেই তার পুরো নামাজটা লেজেগোবরে হয়ে গেলো।
এমন দৃশ্যের অবতারণা অহরহ হচ্ছে আমাদের চারপাশে। আমরা ভাবি, রিংটোনটা কী হবে কেমন হবে এটা কি আলাদা করে ভাবার মতো কিছু হলো? অথচ যখন উপরের ব্যক্তির মতো সমস্যায় পড়ে যাই তখন ঠিকই দুইহাতে মাথা চাপড়াই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন প্রচুর বিষয় আছে, যেগুলোকে আমরা হালকা বলে এড়িয়ে যাই, গুরুত্ব দিতে চাই না। অথচ সেগুলো মোটেই গুরুত্বহীন কিছু না। বরং ক্ষেত্রবিশেষ এসব ছোট ছোট বিষয়ের কারণেই আমাদেরকে প্রচণ্ড রকমের লজ্জিত হতে হয়।
মোবাইলে রিংটোন দেওয়ার জন্য গান সিলেক্ট করা কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এটাতে একটা নয়, বহুবিদ সমস্যা আছে। প্রথমত গান শোনা একটা গুনাহ। আল্লাহর অবাধ্যতা মিশে আছে এর সাথে। যখনই কেউ আপনাকে ফোন করছে তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার পকেটে অনর্থক কিছু গুনাহ ঢুকে পড়ছে। অনর্থক বললাম এই কারণে, অনেক সময় মানুষ গান শোনে খাহেশাতকে পরিতৃপ্ত করার জন্য। অথবা মন ভালো নেই বা কিছুই ভালো লাগছে না অবস্থাটা পার করতেও অনেকে গান শোনে। এই শোনাটা গুনাহের কারণ হলেও এর সাথে একটা শয়তানী উপকার থাকে। কিন্তু মোবাইলের রিংটোনে এর কোনটাই পাওয়া যায় না। আবার সেই রিংটোনের গান আশাপাশের লোকদের কানে যাবার কারণে তাদের গুনাহের ভারটাও মোবাইলওয়ালার উপর এসে বর্তায়। এভাবে সামান্য একটা কলের হাত ধরে পাপে পাপে সয়লাব হতে হয়। তাছাড়া এমন ব্যক্তি যদি নামাজী হন এবং মাঝেমাঝে মসজিদে যাওয়ারও টুকটাক অভ্যাস থাকে তবে তো সমস্যাগুলো আরো প্রকট হয়। যেমনটা উপরের চিত্রে দেখে আসলাম আমরা।
অনেকে আবার ঠিক এর পুরোপুরি উল্টো। তারা অতিধার্মিকতা দেখাতে গিয়ে গানের বদলে মোবাইলের রিংটোনে কুরআনের তিলাওয়াত দিয়ে রাখে। অনেক সময় দেখা যায় তিনি যখন টয়লেটে অবস্থান করছেন তখন কেউ ফোন করলো। আর টয়লেটের ভেতরেই বাজতে থাকে সুমধুর কণ্ঠের কোন তিলাওয়াত। এ যেন ভিক্ষা চাই না মা কুত্তা সামলা অবস্থা। নেকির বদলে এবার কুরআনের সম্মানহানির গুনাহ এসে পড়ছে ঘাড়ের উপর। তাছাড়া কুরআনের আয়াত রিংটোনে দেওয়ার আরেকটা বড়ো সমস্যা হলো, রিসিভ করার সময় তো আর কেউ অর্থের দিকে লক্ষ্য করে রিসিভ করে না। ফলে অর্থের ও মর্মের বিকৃতি ঘটে। যেমন ধরুন রিংটোনে দেওয়া তিলাওয়াত 'লা তাকরাবুস সালাতা' পর্যন্ত আসতেই আপনি রিসিভ করে ফেললেন। ওয়া আনতুম সুকারাটা আর বলা হলো না। ফলে 'তোমরা মাতাল অবস্থায় নামাজের ধারেকাছে যেও না' এর পরিবর্তে বলা হয়ে গেলো শুধু 'তোমরা নামাজের ধারেকাছেও যেও না'। নাউযুবিল্লাহ! কুরআনের অর্থের স্পষ্ট বিকৃতি। এটা কেবল উদাহরণ হিসেবে বললাম। এভাবে বিকৃতি আরো বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্নভাবে হতে পারে।
কুরআনুল কারীমকে আমাদের কাছে পাঠানোর মূল লক্ষ্য হলো, একে তিলাওয়াত করা এবং এর থেকে বিধিবিধান আহরণ করা ও এতে বর্ণিত উপদেশাবলী থেকে শিক্ষার্জন করা। সেসব বাদ দিয়ে একে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম বানানো যে অনৈতিক কাজ তা তো বলাই বাহুল্য।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয় তখন তোমরা কান পেতে শোন। আয়াতে সাধারণভাবে শোনার কথা বলা হয় নি। বলা হয়েছে একেবারে কান পেতে শোনার কথা। যা পূর্ণ মনোযোগের প্রতি নির্দেশ করছে। কিন্তু তিলাওয়াতকে যদি রিংটোনে দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে এই নির্দেশ রক্ষিত হয় না। কারণ রিংটোনে কেউ তিলাওয়াতটা শোনার উদ্দেশ্যে স্থাপন করে না।
এটা তো গেলো যিনি রিংটোনে গান বা তেলায়াত সেট করেছিলেন তার কথা। কিন্তু যিনি নামাজ চলাকালীন কল দিয়েছিলেন তারও তো বোঝা উচিত ছিলো যে এখন নামাজের সময়। আমরা মানুষকে কল করার সময় সময়ের উপযুক্ততার প্রতি খুব বেশি একটা ভ্রুক্ষেপ করি না। যখনতখন কল দিয়ে দেই। ভাবি, আমি যেমন অবসর যাপন করছি, যাকে ফোন দিয়েছি তিনিও হয়তো আমার মতোই অবসর যাপন করছেন। যিনি নামাজ পড়েন না তার তো নামাজের সময় সম্পর্কেও খবর থাকে না। ফলে কখন মসজিদে জামাত শুরু হয় তার প্রতি লক্ষ্য রেখে কল দেন না। প্রয়োজন পড়লেই ডায়াল বাটনে চাপ দিয়ে বসেন।
ফোন করার সময় যাকে ফোন দিচ্ছেন তার প্রতিও লক্ষ্য রাখা উচিত আমাদের। সময়টা কি বিশ্রামের নাকি কাজের নাকি অন্য কিছুর তার প্রতি লক্ষ্য না করলে অনেক সময় ফোন করাটা বিরক্তি উৎপাদনের কারণ হয়ে থাকে। দেখা যায় এমন বিরক্তি থেকে যে উদ্দেশ্যে ফোন করা তা ভেস্তে যায়। ধরুন, আপনি একজনের কাছে টাকা ধার চাইতে ফোন দিলেন। তখন ছিলো নামাজের সময়। ওই বেচারা নামাজী হওয়ায় মসজিদে অবস্থান করছিলেন। রিংটোন বন্ধ করতে ভুলে যাওয়ায় আপনার করা কলের কারণে নামাজের ভেতরেই সশব্দে ফোনটা বেজে উঠলো। তিনি নামাজের ভেতরই তড়িঘড়ি কোন মতে ফোনটা কেটে দিলেন। ভেতরে ভেতরে তিনি বেজায় বিরক্ত হয়ে কলকারীর চৌদ্দ গোষ্ঠীও হয়তো উদ্ধার করে ফেলছেন। নামাজ শেষ হওয়ার পর মসজিদ থেকে বের হয়ে তিনি কলব্যাক করলেন। আপনি হাসিহাসি মুখে কাচুমাচু হয়ে কিছু টাকা ধার চাইলেন। তিনি পটাপট না করে দিলেন। অথচ তার কাছে টাকা ছিলো। তিনি ইচ্ছা করলে ধারটা দিতে পারতেন। ধার দেবার অভ্যাসও তার আছে। কিন্তু ওই যে নামাজের ভেতর কল করার কারণে আপনার উপর তার যে একটা বিরক্তি ও বিরাগভাব জন্মেছিলো এর ফলেই তিনি এমন আগপিছ চিন্তা না করে সরাসরি নিষেধ করে দিলেন।
অনেকে তো আরো এক কাঠি সরস। তারা ফোনের পর ফোন দিয়েই যেতে থাকে। ফোনকল কেটে দেবার পরও অনবরত কল দিতেই থাকে। অথচ আল্লাহর বান্দার বোঝা উচিত ছিলো যে, ওপাশ থেকে যেহেতু কলটা কেটে দেওয়া হয়েছে তারমানে নিশ্চয়ই তিনি ব্যস্ত আছেন। কল রিসিভ করার মতো অবস্থায় তিনি নাই। আমার একবার এমন হয়েছিলো। আমি দরসে বসে আছি। একেবারেই উস্তাদের গা ঘেঁষে বসেছি সামনের টেবিলে। কেউ একজন কল দিলো। মোবাইলে ব্রাইব্রেশন চালু থাকায় শশব্দে রিংটোন না বাজলেও কম্পনের একটা মৃদু শব্দ তো ঠিকই হচ্ছিলো। একবার দুবার করে বেশ কয়েকবারই এমন হলো। আমি এ পাশ থেকে কেটে দেই আর অন্যজন ওপাশ থেকে কল দিতেই থাকেন। আমি ভেতরে ভেতরে কিছুটা ঘাবড়েও যাই। কোন দুঃসংবাদ নাই তো! নয়তো এতো বার কেটে দেওয়ার পরও পুনরায় কল করার মতো প্রয়োজন আর কী হতে পারে! দরস শেষে পেকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখি অপরিচিত নাম্বার। ব্যাক করার পর ওপাশ থেকে সালামকালাম বিনিময় শেষে তিনি আমাকে বললেন, এক জায়গা থেকে আপনার নাম্বারটা নিয়েছি। আপনার কাছে কি ভালো কোন শিক্ষক আছে? তার কথা শুনে আমার মেজায এতোটা খারাপ হয়েছিলো যে অতি শোকে পাথর হবার মতো পাথর হয়ে গেলাম। অতিরিক্ত কিছু না বলে 'নাই' কথাটা শুনিয়েই ফোনটা রেখে দিলাম। এমন বিবেকহীন মানুষকে আসলে কি বলে বিবেকবোধ জাগ্রত করা যায় আমার ঠিক জানা নাই।
হাদীসের মধ্যে পাওয়া যায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'তোমাদের কেউ তিনবার অনুমতি চাওয়ার পর যদি অনুমতি না পায় তাহলে যেন ফিরে যায়।' (সহীহ মুসলিম) তো কারো দরজায় এসে ভেতরে যাবার অনুমতি প্রার্থণার ব্যাপারটি যেমন কল করার ব্যাপারটিও তেমন। কল করার মানে হলো আমি আপনার সাথে কথা বলার অনুমতি চাচ্ছি। যদি আপনি রিসিভ করেন তাহলে বুঝবো অনুমতি দিয়েছেন। আর যদি রিসিভ না করেন তাহলে বুঝবো অনুমতি দেন নি। সুতরাং তিনবার কল করার পরও যদি রিসিভ না করে তাহলে অনবরত কল না করে ক্ষ্যান্ত থাকা উচিত। প্রয়োজনে কিছু সময় পর পুনরায় যোগাযোগের চেষ্টা করা যেতে পারে। আর যদি কেউ কল কেটে দেয় তাহলে এটা তো সরাসরি অনুমতি প্রত্যাখ্যান করারই নামান্তর। তাই সেক্ষেত্রে অতি প্রয়োজন না হলে পুনরায় আবার কল করাটা অনুচিত।
ইসলাম এমন একটা ধর্ম, যা আমাদেরকে সব ধরনের আদব কায়দা শেখায়। ফোন ব্যবহার করা থেকে রিংটোন সেট করা সর্ববিষয়ে আমাদের নির্দেশনা প্রদান করে। কুরআন-সুন্নাহ আমাদের সামনে যে আলোর ফোয়ারা বিছিয়ে দিয়েছে তার আলোকে আমরা ঠিক করে নিতে পারি আমাদের কোনটা করা উচিত আর কোনটা করা অনুচিত। এমনিভাবে কোনটা কীভাবে কতোটুকু করতে হবে সেটাও আমরা সেখান থেকে জেনে নিতে পারি। কোন বিষয়কেই আসলে ছোট হিসেবে অবহেলা করা ঠিক নয়। বরং ছোটছোট বিষয়গুলো দিয়েই অন্যদের সাথে আপনার আমার পার্থক্য রচিত হয়। কারণ বড়ো বড়ো ব্যাপারগুলো তো সবাই মানে বা মানার চেষ্টা করে। ফলে এতে আলাদা কোন বিশেষত্ব থাকে না।
------------------
লিখেছেনঃ Abdullah Al Masud
এমন দৃশ্যের অবতারণা অহরহ হচ্ছে আমাদের চারপাশে। আমরা ভাবি, রিংটোনটা কী হবে কেমন হবে এটা কি আলাদা করে ভাবার মতো কিছু হলো? অথচ যখন উপরের ব্যক্তির মতো সমস্যায় পড়ে যাই তখন ঠিকই দুইহাতে মাথা চাপড়াই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন প্রচুর বিষয় আছে, যেগুলোকে আমরা হালকা বলে এড়িয়ে যাই, গুরুত্ব দিতে চাই না। অথচ সেগুলো মোটেই গুরুত্বহীন কিছু না। বরং ক্ষেত্রবিশেষ এসব ছোট ছোট বিষয়ের কারণেই আমাদেরকে প্রচণ্ড রকমের লজ্জিত হতে হয়।
মোবাইলে রিংটোন দেওয়ার জন্য গান সিলেক্ট করা কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এটাতে একটা নয়, বহুবিদ সমস্যা আছে। প্রথমত গান শোনা একটা গুনাহ। আল্লাহর অবাধ্যতা মিশে আছে এর সাথে। যখনই কেউ আপনাকে ফোন করছে তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার পকেটে অনর্থক কিছু গুনাহ ঢুকে পড়ছে। অনর্থক বললাম এই কারণে, অনেক সময় মানুষ গান শোনে খাহেশাতকে পরিতৃপ্ত করার জন্য। অথবা মন ভালো নেই বা কিছুই ভালো লাগছে না অবস্থাটা পার করতেও অনেকে গান শোনে। এই শোনাটা গুনাহের কারণ হলেও এর সাথে একটা শয়তানী উপকার থাকে। কিন্তু মোবাইলের রিংটোনে এর কোনটাই পাওয়া যায় না। আবার সেই রিংটোনের গান আশাপাশের লোকদের কানে যাবার কারণে তাদের গুনাহের ভারটাও মোবাইলওয়ালার উপর এসে বর্তায়। এভাবে সামান্য একটা কলের হাত ধরে পাপে পাপে সয়লাব হতে হয়। তাছাড়া এমন ব্যক্তি যদি নামাজী হন এবং মাঝেমাঝে মসজিদে যাওয়ারও টুকটাক অভ্যাস থাকে তবে তো সমস্যাগুলো আরো প্রকট হয়। যেমনটা উপরের চিত্রে দেখে আসলাম আমরা।
অনেকে আবার ঠিক এর পুরোপুরি উল্টো। তারা অতিধার্মিকতা দেখাতে গিয়ে গানের বদলে মোবাইলের রিংটোনে কুরআনের তিলাওয়াত দিয়ে রাখে। অনেক সময় দেখা যায় তিনি যখন টয়লেটে অবস্থান করছেন তখন কেউ ফোন করলো। আর টয়লেটের ভেতরেই বাজতে থাকে সুমধুর কণ্ঠের কোন তিলাওয়াত। এ যেন ভিক্ষা চাই না মা কুত্তা সামলা অবস্থা। নেকির বদলে এবার কুরআনের সম্মানহানির গুনাহ এসে পড়ছে ঘাড়ের উপর। তাছাড়া কুরআনের আয়াত রিংটোনে দেওয়ার আরেকটা বড়ো সমস্যা হলো, রিসিভ করার সময় তো আর কেউ অর্থের দিকে লক্ষ্য করে রিসিভ করে না। ফলে অর্থের ও মর্মের বিকৃতি ঘটে। যেমন ধরুন রিংটোনে দেওয়া তিলাওয়াত 'লা তাকরাবুস সালাতা' পর্যন্ত আসতেই আপনি রিসিভ করে ফেললেন। ওয়া আনতুম সুকারাটা আর বলা হলো না। ফলে 'তোমরা মাতাল অবস্থায় নামাজের ধারেকাছে যেও না' এর পরিবর্তে বলা হয়ে গেলো শুধু 'তোমরা নামাজের ধারেকাছেও যেও না'। নাউযুবিল্লাহ! কুরআনের অর্থের স্পষ্ট বিকৃতি। এটা কেবল উদাহরণ হিসেবে বললাম। এভাবে বিকৃতি আরো বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্নভাবে হতে পারে।
কুরআনুল কারীমকে আমাদের কাছে পাঠানোর মূল লক্ষ্য হলো, একে তিলাওয়াত করা এবং এর থেকে বিধিবিধান আহরণ করা ও এতে বর্ণিত উপদেশাবলী থেকে শিক্ষার্জন করা। সেসব বাদ দিয়ে একে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম বানানো যে অনৈতিক কাজ তা তো বলাই বাহুল্য।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয় তখন তোমরা কান পেতে শোন। আয়াতে সাধারণভাবে শোনার কথা বলা হয় নি। বলা হয়েছে একেবারে কান পেতে শোনার কথা। যা পূর্ণ মনোযোগের প্রতি নির্দেশ করছে। কিন্তু তিলাওয়াতকে যদি রিংটোনে দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে এই নির্দেশ রক্ষিত হয় না। কারণ রিংটোনে কেউ তিলাওয়াতটা শোনার উদ্দেশ্যে স্থাপন করে না।
এটা তো গেলো যিনি রিংটোনে গান বা তেলায়াত সেট করেছিলেন তার কথা। কিন্তু যিনি নামাজ চলাকালীন কল দিয়েছিলেন তারও তো বোঝা উচিত ছিলো যে এখন নামাজের সময়। আমরা মানুষকে কল করার সময় সময়ের উপযুক্ততার প্রতি খুব বেশি একটা ভ্রুক্ষেপ করি না। যখনতখন কল দিয়ে দেই। ভাবি, আমি যেমন অবসর যাপন করছি, যাকে ফোন দিয়েছি তিনিও হয়তো আমার মতোই অবসর যাপন করছেন। যিনি নামাজ পড়েন না তার তো নামাজের সময় সম্পর্কেও খবর থাকে না। ফলে কখন মসজিদে জামাত শুরু হয় তার প্রতি লক্ষ্য রেখে কল দেন না। প্রয়োজন পড়লেই ডায়াল বাটনে চাপ দিয়ে বসেন।
ফোন করার সময় যাকে ফোন দিচ্ছেন তার প্রতিও লক্ষ্য রাখা উচিত আমাদের। সময়টা কি বিশ্রামের নাকি কাজের নাকি অন্য কিছুর তার প্রতি লক্ষ্য না করলে অনেক সময় ফোন করাটা বিরক্তি উৎপাদনের কারণ হয়ে থাকে। দেখা যায় এমন বিরক্তি থেকে যে উদ্দেশ্যে ফোন করা তা ভেস্তে যায়। ধরুন, আপনি একজনের কাছে টাকা ধার চাইতে ফোন দিলেন। তখন ছিলো নামাজের সময়। ওই বেচারা নামাজী হওয়ায় মসজিদে অবস্থান করছিলেন। রিংটোন বন্ধ করতে ভুলে যাওয়ায় আপনার করা কলের কারণে নামাজের ভেতরেই সশব্দে ফোনটা বেজে উঠলো। তিনি নামাজের ভেতরই তড়িঘড়ি কোন মতে ফোনটা কেটে দিলেন। ভেতরে ভেতরে তিনি বেজায় বিরক্ত হয়ে কলকারীর চৌদ্দ গোষ্ঠীও হয়তো উদ্ধার করে ফেলছেন। নামাজ শেষ হওয়ার পর মসজিদ থেকে বের হয়ে তিনি কলব্যাক করলেন। আপনি হাসিহাসি মুখে কাচুমাচু হয়ে কিছু টাকা ধার চাইলেন। তিনি পটাপট না করে দিলেন। অথচ তার কাছে টাকা ছিলো। তিনি ইচ্ছা করলে ধারটা দিতে পারতেন। ধার দেবার অভ্যাসও তার আছে। কিন্তু ওই যে নামাজের ভেতর কল করার কারণে আপনার উপর তার যে একটা বিরক্তি ও বিরাগভাব জন্মেছিলো এর ফলেই তিনি এমন আগপিছ চিন্তা না করে সরাসরি নিষেধ করে দিলেন।
অনেকে তো আরো এক কাঠি সরস। তারা ফোনের পর ফোন দিয়েই যেতে থাকে। ফোনকল কেটে দেবার পরও অনবরত কল দিতেই থাকে। অথচ আল্লাহর বান্দার বোঝা উচিত ছিলো যে, ওপাশ থেকে যেহেতু কলটা কেটে দেওয়া হয়েছে তারমানে নিশ্চয়ই তিনি ব্যস্ত আছেন। কল রিসিভ করার মতো অবস্থায় তিনি নাই। আমার একবার এমন হয়েছিলো। আমি দরসে বসে আছি। একেবারেই উস্তাদের গা ঘেঁষে বসেছি সামনের টেবিলে। কেউ একজন কল দিলো। মোবাইলে ব্রাইব্রেশন চালু থাকায় শশব্দে রিংটোন না বাজলেও কম্পনের একটা মৃদু শব্দ তো ঠিকই হচ্ছিলো। একবার দুবার করে বেশ কয়েকবারই এমন হলো। আমি এ পাশ থেকে কেটে দেই আর অন্যজন ওপাশ থেকে কল দিতেই থাকেন। আমি ভেতরে ভেতরে কিছুটা ঘাবড়েও যাই। কোন দুঃসংবাদ নাই তো! নয়তো এতো বার কেটে দেওয়ার পরও পুনরায় কল করার মতো প্রয়োজন আর কী হতে পারে! দরস শেষে পেকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখি অপরিচিত নাম্বার। ব্যাক করার পর ওপাশ থেকে সালামকালাম বিনিময় শেষে তিনি আমাকে বললেন, এক জায়গা থেকে আপনার নাম্বারটা নিয়েছি। আপনার কাছে কি ভালো কোন শিক্ষক আছে? তার কথা শুনে আমার মেজায এতোটা খারাপ হয়েছিলো যে অতি শোকে পাথর হবার মতো পাথর হয়ে গেলাম। অতিরিক্ত কিছু না বলে 'নাই' কথাটা শুনিয়েই ফোনটা রেখে দিলাম। এমন বিবেকহীন মানুষকে আসলে কি বলে বিবেকবোধ জাগ্রত করা যায় আমার ঠিক জানা নাই।
হাদীসের মধ্যে পাওয়া যায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'তোমাদের কেউ তিনবার অনুমতি চাওয়ার পর যদি অনুমতি না পায় তাহলে যেন ফিরে যায়।' (সহীহ মুসলিম) তো কারো দরজায় এসে ভেতরে যাবার অনুমতি প্রার্থণার ব্যাপারটি যেমন কল করার ব্যাপারটিও তেমন। কল করার মানে হলো আমি আপনার সাথে কথা বলার অনুমতি চাচ্ছি। যদি আপনি রিসিভ করেন তাহলে বুঝবো অনুমতি দিয়েছেন। আর যদি রিসিভ না করেন তাহলে বুঝবো অনুমতি দেন নি। সুতরাং তিনবার কল করার পরও যদি রিসিভ না করে তাহলে অনবরত কল না করে ক্ষ্যান্ত থাকা উচিত। প্রয়োজনে কিছু সময় পর পুনরায় যোগাযোগের চেষ্টা করা যেতে পারে। আর যদি কেউ কল কেটে দেয় তাহলে এটা তো সরাসরি অনুমতি প্রত্যাখ্যান করারই নামান্তর। তাই সেক্ষেত্রে অতি প্রয়োজন না হলে পুনরায় আবার কল করাটা অনুচিত।
ইসলাম এমন একটা ধর্ম, যা আমাদেরকে সব ধরনের আদব কায়দা শেখায়। ফোন ব্যবহার করা থেকে রিংটোন সেট করা সর্ববিষয়ে আমাদের নির্দেশনা প্রদান করে। কুরআন-সুন্নাহ আমাদের সামনে যে আলোর ফোয়ারা বিছিয়ে দিয়েছে তার আলোকে আমরা ঠিক করে নিতে পারি আমাদের কোনটা করা উচিত আর কোনটা করা অনুচিত। এমনিভাবে কোনটা কীভাবে কতোটুকু করতে হবে সেটাও আমরা সেখান থেকে জেনে নিতে পারি। কোন বিষয়কেই আসলে ছোট হিসেবে অবহেলা করা ঠিক নয়। বরং ছোটছোট বিষয়গুলো দিয়েই অন্যদের সাথে আপনার আমার পার্থক্য রচিত হয়। কারণ বড়ো বড়ো ব্যাপারগুলো তো সবাই মানে বা মানার চেষ্টা করে। ফলে এতে আলাদা কোন বিশেষত্ব থাকে না।
------------------
লিখেছেনঃ Abdullah Al Masud
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন