সহীহ হাদীসের আলোকে ওসিলার মাধ্যমে দু’য়া
ওসিলা আরবি শব্দ। শাব্দিক অর্থ মাধ্যম। কোন কিছু অর্জনের মাধ্যম বা উপায়-উপকরণকে শাব্দিক অর্থে ওসিলা বলে। পরিভাষায়, যেসব জিনিসের দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করা হয়, তাকে ওসিলা বলে। যেমন, নামায, রোজা, নেক আমল। এগুলো আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সবচেয়ে পরিচিত ওসিলা। শাব্দিক অর্থের বিবেচনায় আমাদের প্রয়োজন পূরণে যেসব উপায়-উপকরণ গ্রহণ করা হয়, সেগুলোও ওসিলার অন্তর্ভুক্ত। যেমন, রোগ হলে ওষুধ খাওয়া। ক্ষুধা লাগলে খাবার গ্রহণ করা। ওষুধ, খাবার এগুলো জাগতিক ওসিলা।
ওসিলার আরেকটি শাব্দিক অর্থ মানজিলা। কারও অবস্থানকে মানজিলা বলা হয়। আল্লাহর কাছে রাসূল স. এর একটি বিশেষ অবস্থান রয়েছে। সুতরাং রাসূল স. এর এই অবস্থানের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে দুয়া করাও ওসিলার অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহর কাছে নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম বা উপায় অর্থের চেয়ে মানজিলা অর্থটি ব্যাপক অর্থ বহন করে। কেননা, যেসব মাধ্যম বা উপায়ের দ্বারা আল্লাহর কাছে দুয়া করা হয়, সেগুলোর একটি বিশেষ মানজিলা বা অবস্থান রয়েছে আল্লাহর কাছে। একারণেই মূলত: এগুলো দ্বারা ওসিলা দেয়া হচ্ছে। নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ আল্লাহর কাছে নামাযের বিশেষ মানজিলা বা অবস্থান রয়েছে। একইভাবে রাসূল স. এর ওসিলা দিয়ে দুয়া করা হচ্ছে। কারণ আল্লাহর কাছে রাসূল স. এর বিশেষ মর্যাদা ও অবস্থান রয়েছে। একইভাবে বুজুর্গদের ওসিলায় দুয়া করা হয়, কারণ বুজুর্গদের বিশেষ অবস্থান রয়েছে আল্লাহর কাছে। মোটকথা, যেসব বিষয়ে ওসিলা করা হচ্ছে, সবগুলোর মাঝেই একটা মৌলিক কারণ হচ্ছে, এগুলোর একটি বিশেষ অবস্থান রয়েছে মহান আল্লাহর কাছে। এজন্য ওসিলার শাব্দিক অর্থ থেকে এই মূল কারণটি গ্রহণ করলে সমস্ত ওসিলার ক্ষেত্রে আমাদের মৌলিক বিশ্বাস স্পষ্ট হয়।
আমরা জানি, যে কোন নেক আমলের মাধ্যমে ওসিলা দেয়া জায়েজ, কারণ আমলগুলোর কারণে আল্লাহ খুশি হন। একারণে তিনি কবুল করেন। এটাকে আরেকটু বিস্তারিত বললে এভাবে বলা যায়, যেসব জিনিস আল্লাহ পছন্দ করেন, সেগুলো দিয়ে ওসিলা করলে আল্লাহ কবুল করেন। আল্লাহর প্রিয় হওয়া বা পছন্দের কারণেই মূলত: ওসিলা করা হচ্ছে। নতুবা ওসিলা করার কোন দরকার ছিলো না। সরাসরি দোয়া করলেই হত। বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয়, যখন কোন বুজুর্গের কাছে দুয়া চাওয়া হয়। বুজুর্গের কাছে দুয়া চাওয়ার কারণ হল, তিনি আল্লাহর পছন্দনীয় ও প্রিয় বান্দা। তিনি দুয়া করলে আল্লাহ কবুল করবেন। অন্যের কাছে দুয়ার ক্ষেত্রে মূল যদি তার দুয়া হত, তাহলে মানুষ চোর-ডাকাতের কাছে দুয়া চেতো। কারণ চোর ডাকাত যেই কাজ করবে, বুজুর্গও একই কাজ করবে। কিন্তু চোর ডাকাতের কাছে না গিয়ে ভালো ও নেককার মানুষের কাছে যাওয়ার মূল কারণ হল, সে আল্লাহর পছন্দের। একইভাবে আমলের মাধ্যমে দুয়ার কারণ হল আমলগুলো আল্লাহর পছন্দের। আমাদের অবস্থান এখানে খুবই স্পষ্ট। যেসব বিষয় আল্লাহর প্রিয় ও পছন্দের সেসব বিষয়ের ওসিলা দিয়ে দোয়া করা যাবে। কারণ ওসিলার মূল উদ্দেশ্য হল যে বিষয়ের ওসিলা দেয়া হচ্ছে, সেটি আল্লাহর প্রিয়। সুতরাং যেসকল বিষয় আল্লাহর প্রিয় হবে, সেটা দিয়ে আমরা ওসিলা করবো। আল্লাহর প্রিয় বিষয়টি জীব হোক, জড় হোক, কোন আমল হোক। প্রিয় হওয়ার দিক থেকে সবই সমান। এজন্য আমাদের কাছে জাত ও আমলের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কারণ জাতও আল্লাহর প্রিয়। আমলও আল্লাহর প্রিয়। কেউ যদি কা'বার ওসিলা দিয়ে দোয়া করে, সেটাও আমাদের কাছে পছন্দনীয়। যদিও কাবা আমল বা কোন জীব নয়। কিন্তু কা'বা আল্লাহর প্রিয় ঘর হওয়ার কারণে আমরা এর ওসিলায় দুয়া করি। এক্ষেত্রে আমরা জীবিত, মৃতেরও কোন পার্থক্য করি না। ব্যক্তি জীবিত থাকলেও আল্লাহর প্রিয় থাকে, মারা গেলেও আল্লাহর প্রিয় থাকে।
ওসিলা দিয়ে দু'য়া করার সময় আমাদের অন্তরে এই বিশ্বাস থাকে যে, যেসব বিষয়ের ওসিলা দিচ্ছি, সেটি আল্লাহর প্রিয়, এজন্যই আমরা এর ওসিলা দিচ্ছি। আমরা আমলের ক্ষেত্রে এই বিশ্বাস করি না যে, এসব আমলের নিজস্ব ক্ষমতা আছে, যার কারণে দুয়া কবুল হয়। কোন নেককার ভালো মানুষের কাছে দুয়া চাওয়ার সময় আমরা এটা মনে করি না যে, এই ব্যক্তির নিজস্ব ক্ষমতা কারণে দুযা কবুল হবে। বরং আমাদের অন্তরের বিশ্বাস হল, এই ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয়। প্রিয় হওয়ার কারণে তার দুয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।আরেকটা বিষয় স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন, আমরা যার ওসিলা দিচ্ছি, তাকে আল্লাহ, আল্লাহর সমকক্ষ বা মূর্তি মনে করছি না। নাউযুবিল্লাহ। বরং তাকে আল্লাহর বান্দা মনে করি। তাকে শুধু আল্লাহর প্রিয় বান্দা বিশ্বাস করি। আপনার যদি দিলে আমাদের ব্যাপারে অন্য কোন ধারণা আসে, তাহলে মুমিনের ব্যাপারে অমূলক ধারণা থেকে বেচে থাকুন। আপনার অন্তরে যদি ওসিলা দেয়া ব্যক্তিকে মূর্তি মনে হয়, তাহলে আপনি তৌবা করুন। আমাদের অন্তরে যেহেতু এগুলো আসে না, সুতরাং এজাতীয় কথা আমাদের সামনে না বলে নিজে অন্যায় ধারণা থেকে বাচার চেষ্টা করুন।
আমাদের সালাফী ভাইয়েরা মৌলিকভাবে ওসিলা অস্বীকার করেন, বিষয়টা এমন নয়। বরং তারাও ওসিলা স্বীকার করেন। তবে ওসিলার কয়েকটা পদ্ধতিকে তারা অস্বীকার করেন। বাস্তবতা হল, এগুলো অস্বীকারের পক্ষে তাদের কোন শরয়ী দলিল নেই। নিজেদের কিছু যুক্তির আলোকে এটা করার চেষ্টা করলেও সেসব যুক্তিগুলোও খুবই দুর্বল। আর সহীহ হাদীস ও সাহাবায়ে কেরামের আমলের দ্বারা প্রমাণিত বিষয়কে নিজেদের বানানো মূলনীতির আলোকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ থাকতে পারে না।
১. যে কোন নেক আমলের মাধ্যমে ওসিলা দিয়ে দু’য়া করা।
২. কোন নেককার লোকের কাছে গিয়ে দুয়া চাওয়ার মাধ্যমে ওসিলা করা ।
৩. আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর মাধ্যমে ওসিলা করে দু’য়া করা।
এই তিনটি বিষয়কে তারা ব্যাপকভাবে জায়েজ বলেন। তারা দু’টি বিষয়ের বিরোধিতা করেন,
১. জীবিত কোন ব্যক্তির ওসিলায় দু’য়া করা।
২. মৃত কোন ব্যক্তির ওসিলায় দু’য়া করা।
তবে জীবিত বা মৃত কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে যদি বলা হয়, হে আল্লাহ, আমি রাসূল স.কে মহব্বত করি, এই ওসিলায় আমার দু’য়া কবুল করেন, তাহলে এটা সালাফীদের কাছে জায়েজ। ইবনে তাইমিয়া রহ. এর মতে নীচের ওসিলাগুলো জায়েজ।
১.হে আল্লাহ, আমরা রাসূল স.কে মহব্বত করি, এই মহব্বতের ওসিলায় আমাদেরকে সিরাতে মুসতাকীমের হেদায়াত দান করুন।
২.হে আল্লাহ, আমি বিশ্বাস করি যে, আপনার নবী মুহাম্মাদ স. আপনাকে মহব্বত করেন। রাসূল স. এর এই মহব্বতের ওসিলায় আমাদেরকে সিরাতে মুসতাকীমের হেদায়াত দান করুন।
৩.হে আল্লাহ, আমি বিশ্বাস করি যে, আপনি রাসূল স. কে ভালোবাসেন, আপনার এই ভালোবাসার ওসিলায় আমাদেরকে সিরাতে মুসতাকীমের হেদায়াত দান করুন।
৪.হে আল্লাহ, আমি বিশ্বাস করি যে, আপনার নবী মুহাম্মাদ স. আমাদেরকে মহব্বত করেন এবং আমাদের কল্যাণ কামনা করেন, রাসূল স. এই মহব্বতের ওসিলায় আমাদের সিরাতে মুস্তাকীমের হেদায়াত দান করুন।
ইবনে তাইমিয়া রহ. কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, রাসূল স.কে ওসিলা করে দুয়া করা যাবে কি? তিনি উত্তরে লিখেছেন,
অর্থ: আল-হামদুলিল্লাহ, রাসূল স. এর প্রতি ইমান, তার প্রতি মহব্বত, রাসূল স. এর প্রতি দুরুদ ও সালাম, রাসূল স. আমাদের জন্য যে দুয়া করেছেন বা শাফায়াত করবেন এজাতীয় রাসূল স. এর যেসব কাজ রয়েছে এবং রাসূল স. এর হকের ব্যাপারে বান্দাদেরকে যেসব আমলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, এগুলোর মাধ্যমে ওসিলা করা সমস্ত মুসলিমের ঐকমতে জায়েজ।
- আল-ফাতাওয়াল কুবরা, খ.১, পৃ.১৪০
সালাফীদের মূল দাবী হল, জীবিত ও মৃত ব্যক্তির ওসিলা দিয়ে দু’য়া করা যাবে না। তাদের কেউ কেউ একে শিরকও বলে। যেমন শায়খ ইবনে উসাইমিন এটাকে এক প্রকার শিরক বলেছেন। যেহেতু সালাফীদের সাথে আমাদের মূল বিরোধ ব্যক্তির ওসিলা দিয়ে দুয়া করা। এজন্য আমরা শুধু ব্যক্তির ওসিলা দিয়ে দুয়া করার দলিল আলোচনা করবো। অন্যান্য ওসিলা যেহেতু তারাও স্বীকার করে, এজন্য আমরা সেগুলো আলোচনা করব না ।
আমি যদি বলি,
১. হে আল্লাহ রাসূল স. এর ওসিলায় আমার দুয়া কবুল করুন।
২. হে আল্লাহ আপনার নেককার বান্দা আহমাদ শফী সাহেবের ওসিলায় আমার দুয়া কবুল করুন।
এক্ষেত্রে সালাফীরা কয়েকটা দাবী করে থাকে।
১. ব্যক্তির ওসিলায় দুয়া করার কথা কুরআন -সুন্নাহে নেই।
২. আমলের মাধ্যমে ওসিলা জায়েজ, কারণ আমলের পূজা করা হয় না, কিন্তু ব্যক্তির ওসিলা জায়েজ নয়, কারণ ব্যক্তির পূজা করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এক্ষেত্রে আমরা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলবো, সালাফীদের এই দু’টি দাবী একেবারেই ভিত্তিহীন। দ্বিতীয় দাবী তো তাদের উপরও প্রযোজ্য হয়। কারণ তারা জীবিত ব্যক্তির কাছে গিয়ে দুয়া চাওয়াকে জায়েজ বলেন। অথচ এক্ষেত্রে পূজার সম্ভাবনা থাকার কারণে নাজায়েজ বলা উচিৎ, কিন্তু তারা এটাকে সম্পূর্ণ জায়েজ বলেন। সুতরাং দ্বিতীয় যুক্তিটি একেবারেই ভিত্তিহীন। সালাফীদের প্রথম দাবীও সম্পূর্ণ ভুল। কারণ কুরআন-সুন্নাহে নেই, এই দাবীটি কুরআন-সুন্নাহর সব কিছু অধ্যয়নের উপর নির্ভর করে। যাচাই বা অধ্যয়ন না করে ধারণা করে এধরণের দাবী করার কোন যৌক্তিকতা নেই। আমরা সহীহ হাদিসের আলোকে ব্যক্তির মাধ্যমে ওসিলার দলিলগুলো এখানে উল্লেখ করছি।
দলিল আলোচনার পূর্বে একটা বিষয় স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। ওসিলার ক্ষেত্রে সব-সময় একটা পদ্ধতিতেই ওসিলা করা হবে, এই চিন্তা করা ভুল। আমি যেমন কোন বুজুর্গের কাছে গিয়ে দুয়া চাইতে পারি। আবার সে বুজুর্গের ওসিলা দিয়ে আমি সরাসরি আল্লাহর কাছে দুয়া করতে পারি। আবার আমি নিজের কোন ভালো আমলের মাধ্যমেও ওসিলা করতে পারি। এক্ষেত্রে কোন বাধা নিষেধ নেই। একথা চিন্তা করা অন্যায় যে, আমি ওসিলার শুধু একটি মাধ্যমই সব-সময় আমল করি।
আমি একই দুয়ার মধ্যে বলতে পারি, হে আল্লাহ আপনি আপনার নাম ও গুণাবলীর ওসিলায়, আমার সমস্ত নেক আমলের ওসিলায়, রাসূল স. এর ওসিলায় আমার মুসীবত দূর করেন। আবার আমি উক্ত মুসীবত দূর করার জন্য কোন বুজুর্গকে বলতে পারি, আমার মুসীবত দূর হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দুয়া করুন। এক প্রকার ওসিলা দিয়ে দুয়া করার অর্থ এই নয় যে, অন্য প্রকারকে আমি অ্যাপ্লাই করি না বা করাকে অপছন্দ করি। বুজুর্গের কাছে উক্ত দুয়ার আবেদন এটা কখনও প্রমাণ করে না যে, আমি নিজে একথা কখনও বলতে পারি না যে, হে আল্লাহ, রাসূল স. এর ওসিলায় আমার দুয়া কবুল করেন।
সার কথা হল,
১. ওসিলার যেসকল প্রকার রয়েছে, আমি ইচ্ছা করলে সবগুলো এক সাথে করতে পারি।
২. ইচ্ছা করলে পৃথক পৃথক বা যে কোন একটা করতে পরি।
৩. এক প্রকার ওসিলা ব্যবহার এটা প্রমাণ করে না যে, আমি অন্য প্রকার করি না বা আদৌ করবো না।
এবার আমাদের দলিলগুলোর প্রতি লক্ষ্য করুন। সাহাবায়ে কেরাম অনেক ক্ষেত্রে একই সাথে দু’প্রকার ওসিলা ব্যবহার করেছেন। এর কয়েকটি প্রমাণ আমরা আলোচনা করছি।
বুখারী শরীফে রয়েছে, হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
অর্থ: আমরা যখন অনাবৃষ্টির স্বীকার হতাম, তখন হযরত উমর রা. হযরত আব্বাস রা. এর মাধ্যমে বৃষ্টির দুয়া করতেন। হযরত উমর রা. বলেন, হে আল্লাহ, নিশ্চয় আমরা আমাদের নবী রাসূল স. এর মাধ্যমে আপনার কাছে ওসিলা করতাম, আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করতেন, এখন আমরা আপনার কাছে আমাদের নবীজীর চাচাকে ওসিলা করছি, আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন। হযরত আনাস বলেন, এরপর বৃষ্টি হত।
- বুখারী শরিফ, হাদীস নং ৫১১
এই হাদীস জীবিত ব্যক্তির ওসিলার সুস্পষ্ট প্রমাণ। এই হাদিসে হযরত উমর রা. এর দুয়াটি ব্যক্তির মাধ্যমে ওসিলা প্রমাণ করছে। আর হযরত উমর রা. যখন হযরত আব্বাস রা. কে ওসিলার দুয়া করতে বলছেন, তখন এটি নেককার লোকের কাছে দুয়ার প্রমাণ। মূল কথা হল, হযরত উমর রা. এই দুয়াটিতে স্পষ্ট ওসিলা রয়েছে। আমাদের কাছে হযরত উমর রা. এর নিজের এই দুয়া যেমন ওসিলার প্রমাণ, একইভাবে হযরত আব্বাস রা. কে দুয়া করার জন্য যখন তিনি অনুরোধ করেছেন, সেটাও আরেক প্রকার ওসিলার প্রমাণ। হযরত উমর রা. এর নিজের দুয়াটি লক্ষ্য করুন,
হে আল্লাহ, নিশ্চয় আমরা আমাদের নবী রাসূল স. এর মাধ্যমে আপনার কাছে ওসিলা করতাম, আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করতেন, এখন আমরা আপনার কাছে আমাদের নবীজীর চাচাকে ওসিলা করছি, আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন।
উমর রা. এখানে আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্য দুয়া করেছেন। এই দুয়ার মধ্যে হযরত আব্বাস রা. কে ওসিলা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হযরত উমর রা. দুয়াটি ব্যক্তির মাধ্যমে ওসিলার প্রমাণ। এবং হযরত আব্বাস রা.কে দুয়া করতে বলাটা কোন নেককার ব্যক্তির মাধ্যমে ওসিলার প্রমাণ। এখানে দু’প্রকার ওসিলা এক সাথে হয়েছে। একে এক প্রকার বানাবার চেষ্টার কোন সুযোগ নেই।
এই হাদিসের অন্য বর্ণনা থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় স্পষ্ট হয়। বর্ণনাটি শায়খ নাসিরুদ্দিন আল-বানী তার আত-তাওয়াসসুল কিতাবের ৬২ পৃষ্ঠায় এনেছেন এবং একে সহীহ বলেছেন। হযরত আব্বাস রা দুয়া করেছেন,
অর্থ: হে আল্লাহ, প্রত্যেক বালা মুসীবতই গোনাহের কারণে আসে, আর তৌবা ছাড়া এটি দূর হয় না, হে আল্লাহ, আমার জাতি আমার মাধ্যমে আপনার শরণাপন্ন হয়েছে, কারণ আপনার প্রিয় নবীর সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে (নবীজীর চাচা)। আপনার সামনে আমাদের গোনাহগার হাতগুলো উপস্থিত, আর উপস্থিত আমাদের তৌবার কপাল, আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন।
- আত-তাওয়াসসুল, পৃ.৬২
১. তিনি আল্লাহর কাছে দুয়ার সময় বলেছেন, আমার জাতি আমার মাধ্যমে হে আল্লাহ আপনার কাছে আবেদন করেছে। এখানে স্পষ্টভাবে হযরত আব্বাস রা. এর ওসিলা প্রমাণিত। হযরত আব্বাস রা. এর এই বক্তব্যের দ্বিতীয় কোন ব্যাখ্যার সুযোগ নেই।
২.সাহাবায়ে কেরাম রা. হযরত আব্বাস রা. এর ওসিলা গ্রহণের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, হযরত আব্বাস রা. এর সাথে রাসূল স. এর আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে। কারণ তিনি রাসূল স. এর চাচা ছিলেন। রাসূল স. এর সাথে এই সম্পর্কের কারণে তার ওসিলা গ্রহণ পরোক্ষভাবে রাসুল স. এর ওসিলা গ্রহণ। হযরত উমর রা. তার দুয়ার মধ্যেও এই সম্পর্কের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, হে আল্লাহ, আমাদের নবীজীর চাচার মাধ্যমে আপনার কাছে আবেদন করছি। উমর রা. এর কথা থেকেও সম্পর্কের গুরুত্ব স্পষ্ট। সুতরাং এখানে হযরত আব্বাস রা. ও হযরত উমর রা. এর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, মূলত: এখানে রাসূল স. এর ওসিলা দিয়ে দুয়া করা হয়েছে।
সম্পূর্ণ ঘটনা থেকে যেসকল বিষয় প্রমাণিত হয়,
১. হযরত উমর রা. তার দুয়ার মধ্যে হযরত আব্বাস রা. এর ওসিলা করেছেন। এবং পরোক্ষভাবে হযরত আব্বাস রা. এর ওসিলার কারণ হল, তিনি রাসূল স. এর চাচা।
২.হযরত আব্বাস রা. এর নিজের বক্তব্য থেকে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, সাহাবায়ে কেরাম তার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আবেদন করেছে। হযরত আব্বাস রা. এর স্বীকারোক্তিতে বিষয়টি প্রমাণিত।
৩. হযরত উমর রা. হযরত আব্বাসকে দুয়া করার কথা বলেছেন। এর মাধ্যমে কোন নেককার লোকের কাছে দুয়া চাওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত।
৪. হযরত উমর রা. ও অন্যান্য সাহাবী হযরত আব্বাস রা. এর ওসিলা গ্রহণের মূল কারণ হল, হযরত আব্বাস হলেন রাসূল স. এর আপন চাচা। রাসূল স. এর সাথে তার সম্পর্কের কারণে এই ওসিলা করা হয়েছে। সুতরাং মূল ওসিলা করা হয়েছে রাসূল স. এর মাধ্যমে। হযরত আব্বাস রা. এর স্পষ্ট বক্তব্য থেকে বিষয়টি প্রমাণিত। হযরত আব্বাস বলেছেন, “হে আল্লাহ, আমার জাতি আপনার কাছে আমার মাধ্যমে আবেদন করেছে, কারণ আপনার নবীর সাথে আমার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে”। হযরত আব্বাস রা. এর এই স্পষ্ট বক্তব্য থেকে রাসূল স. এর ইন্তেকালের পরে রাসূল স. এর মাধ্যমে ওসিলা দেয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ।
হযরত উমর রা. এর ঘটনায় মোট তিন প্রকারের ওসিলা প্রমাণিত হয়েছে।
১. কোন ব্যক্তির ওসিলায় দুয়া করা। (বুখারীতে বর্ণিত, হযরত উমর রা. এর নিজের দুয়া)।
২.কোন নেককার লোকের কাছে দুয়ার আবেদন করা। (হযরত আব্বাস রা. কে উমর রা. দুয়ার অনুরোধ করেছেন)।
৩. মৃত ব্যক্তির ওসিলা দেয়া। (হযরত আব্বাস রা. দুয়ার সময় রাসূল স. এর সাথে তার সম্পর্কের কথা বলে দুয়া করেছেন)
এই তিন প্রকারের ওসিলা উক্ত সহীহ বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে। বক্তব্যগুলো সালাফীদের নিজেদের বানানো আকিদার বিরোধী হওয়ার কারণে তারা বিভিন্নভাবে এগুলোর অপব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। সালেহ আল-মুনাজ্জিদ, শায়খ আলবানীসহ অন্যান্যরা ঘটনাকে বিকৃত করার চেষ্টা করলেও বাস্তবতা সকলের কাছে স্পষ্ট। তারা এক্ষেত্রে একটা ভিত্তিহীন দাবী করেছে যে, হযরত উমর রা. হযরত আব্বাস রা.কে বলেছেন, হে আব্বাস, আপনি উঠুন। আল্লাহর কাছে দুয়া করুন। এই বক্তব্যের মাধ্যমে দাবী করেছে যে, এখানে শুধু হযরত আব্বাস রা এর কাছে দুয়া চাওয়া হয়েছে। এছাড়া আর কিছুই নয়। এটা সালেহ আল-মুনাজ্জিদ ও শায়খ আলবানীর স্পষ্ট বিকৃতি। নীচের লিংকে শায়খ মুনাজ্জিদের বিকৃতির নমুনা দেখতে পাবেন, https://islamqa.info/ar/118099
আমরা সহীহ দু’টি হাদিসের আলোকে তাদের এই বিকৃতির জওয়াব উল্লেখ করেছি আল-হামদুলিল্লাহ। হযরত উমর রা. হযরত আব্বাসকে দুয়া করতে বলেছেন। এটা অন্য প্রকারের ওসিলার তো বিরোধী নয়। সুতরাং এটা দিয়ে বাকী দুই প্রকারের ওসিলা অস্বীকারের অপচেষ্টা নিতান্ত হাস্যকর। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন।
.
দ্বিতীয় দলিল:
ওসিলার বিষয়ে হযরত উসমান বিন হানিফ রা. এর বিখ্যাত হাদীস রয়েছে। হাদিসটি সহীহ হওয়ার বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সালাফী আলেমগণও হাদিসটিকে সহীহ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।
হযরত উসমান বিন হানিফ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
অর্থ: ক্ষীণ দৃষ্টির এক ব্যক্তি রাসূল স.কে এর কাছে এসে বললেন, আল্লাহর কাছে আমার চোখের সুস্থতার জন্য দুয়া করুন। রাসূল স. বললেন, তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য দুয়া করবো, আর চাইলে দুয়াকে বিলম্বিত করবো। এটা তোমার জন্য উত্তম। সে বলল, আপনি আল্লাহর কাছে দুয়া করুন। রাসূল স. তাকে ওজু করার নির্দেশ দিলেন। তাকে উত্তম রূপে উজু করে দু’রাকাত নামায পড়ার আদেশ দিলেন এবং এই দুয়া পড়তে বললেন। হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি, আপনার নবী, রহমতের নবীর ওসিলায় আপনার কাছে চাচ্ছি, হে মুহাম্মাদ, আমি আপনার মাধ্যমে আমার প্রভুর কাছে আমার এই প্রয়োজনে আবেদন করেছি যেন এটি পূরণ হয়। হে আল্লাহ, রাসূল স.কে আমার ব্যাপারে সুপারিশকারী হিসেবে গ্রহণ করুন এবং রাসূল স.এর মাধ্যমে আমার এই দুয়াকে কবুল করেন।
হযরত উসমান বিন হানিফ রা. বলেন, লোকটি এই দুয়া করলো। এরপর সে ভালো হয়ে গেলো।
(মুসনাদে আহমাদ, খ.৪, ১৩৮ পৃ, তিরমিযী শরীফ, খ.৫, পৃ.৫৬৯, ইবনে মাজা খ.১, পৃ.৪৪১, সহীহ ইবনে খোজাইমা, খ.২, পৃ.২২৫)
উক্ত সহীহ হাদীস থেকে কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত।
১. রাসূল স. এর কাছে এসে লোকটি দুয়ার আবেদন করেছে। এটি এক ধরণের ওসিলা।
২. রাসূল স. এর ওসিলায় দুয়া করার শিক্ষা দিয়েছেন স্বয়ং রাসূল স.। কারণ উক্ত দুয়াটি রাসূল স. এর শেখানো।
৩. ঐ সাহাবী ব্যক্তি রাসূল স. এর ওসিলা দিয়ে দুয়া করেছে।
এই তিনটি বিষয় মূল হাদিসের বক্তব্য থেকেই প্রমাণিত। এখানে কারও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুযোগ নেই। নাসিরুদ্দিন আলবানী সাহেবে তার আত-তাওয়াসসুল কিতাবে বিভিন্নভাবে দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত বিষয়টাকে অপব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। তার আত-তাওয়াসসুল কিতাবে তিনি যেসব হাস্যকর অপব্যাখ্যা উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর সাথে হাদিসের দূরতম সম্পর্ক নেই। এগুলো শুধু কিতাবের কলেবর বৃদ্ধি করেছে। বাস্তবে কোন দলিল হয়নি। কারণ হাদিসের মূল বক্তব্যে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট ওসিলা রয়েছে।
সাহাবী যখন বলেছেন,
অর্থ: হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি, আপনার কাছে আপনার নবী, রহমতের নবীর ওসিলায় আবেদ করছি।
এধরণের স্পষ্ট ওসিলা থাকার পরে আমাদের আলবানী সাহেবের অপব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন নেই। রাসূল স. এর হাদিসের বিপরীতে তিনি যদি পূর্ণ একটি কিতাবও লিখেন, সেটা কখনও আমাদের কাছে দলিল হবে না।
সত্যকথা হল, শায়খ আলবানী বিভিন্ন অপব্যাখ্যা করে শেষে লিখতে বাধ্য হয়েছেন যে, রাসূল স. এর স্বত্বার ওসিলায় দুয়া প্রমাণিত হলেও সেটা শুধু রাসূল স. এর সাথে খাস। অন্য কারও ক্ষেত্রে নয়।
অথচ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন অপব্যাখ্যা, যুক্তি ও সন্দেহ ঢুকিয়ে এরপরে এটাকে রাসূল স. এর সাথে খাস করার কী উদ্দেশ্য? আর তিনি বিষয়টিকে রাসূল স. এর সাথে খাস করার দলিল কোথায় পেলেন?
শায়খ আলবানী বা সালেহ আল-মুনাজ্জিদসহ অন্যান্য যারা নিজেদের মতের বিরোধী হওয়ার কারণে হাদিসটি অপব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে, তাদেরকে আমরা বলবো, সহীহ হাদিসের মূল বক্তব্য দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পর আপনাদের যুক্তি ও ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন নেই। হাদিসের বক্তব্যকেই আমরা গ্রহণ করবো। আর আপনাদের কোন একটা বক্তব্য যদি গ্রহণযোগ্য হত, তাহলেও সেটা বিবেচনা আসতো। এই হাদিসের স্পষ্ট বক্তব্যের বিপরীতে তারা যা লিখেছেন, সবই অসার ও ভিত্তিহীন যুক্তি। আল্লাহ ক্ষমা করুন।
তৃতীয় দলিল:
অর্থ: হযরত সুলাইম ইবনে আমের আল-খাবাইরী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আকাশে অনাবৃষ্টি দেখা দিলো। হযরত মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান রা. ও দামেশকের লোকেরা বৃষ্টির জন্য দুয়া করতে বের হল। হযরত মুয়াবিয়া রা. যখন মেম্বারে বসলেন, তিনি বললেন, ইয়াজীদ বিন আসওয়াদ জুরাশী কোথায়? লোকেরা তাকে ডাক দিলো। সে লোকদের ভিড় ঠেলে আসতে লাগলো। হযরত মুয়াবিয়া রা. তাকে নির্দেশ দিলেন। তিনি মেম্বারে উঠে হযরত মুয়াবিয়া রা. এর পায়ের কাছে বসলেন। হযরত মুয়াবিয়া রা. বললেন, হে আল্লাহ, আমরা আজ আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ও সবোর্ত্তম ব্যক্তির ওসিলায় আপনার কাছে দুয়া করছি। হে আল্লাহ, আমরা আপনার কাছে আজ ইয়াজীদ বিন আসওয়াদ জুরাশীর ওসিলায় আবেদন করছি।
হে ইয়াজীদ, আল্লাহর উদ্দেশ্যে, তুমি তোমার হাত উত্তোলন করো। ইয়াজীদ ইবনে আসওয়াদ তখন হাত উঠালেন। লোকেরাও তার সাথে হাত উঠালো। কিছুক্ষণের মধ্যে পশ্চিম আকাশে ঢালের মতো মেঘের ঘনঘটা দেখা দিলো। চার দিকে বাতাস বইতে শুরু করল। আমাদের উপর এমন বৃষ্টি হল যে, লোকেরা তাদের বাড়ীতে যেতে পারছিল না।
ইরওয়াউল গালীল, হাদীস নং ৬৭২,
একইভাবে শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী তার আত-তাওয়াসসুল কিতাবে হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।
শায়খ আলবানী তার দু’টি কিতাবে এই বর্ণনাকে সহীহ বলেছেন।
এই বর্ণনায় আমাদের মূল দলিল হল, হযরত মুয়াবিয়া রা. এর দুয়াটি। দুয়াতে তিনি স্পষ্টভাবে হযরত ইয়াজীদ বিন আসওয়াদের ওসিলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুয়া করেছেন। এই হাদিসে দু’প্রকারের ওসিলা প্রমাণিত হয়েছে।
১. হযরত মুয়াবিয়া রা. ইয়াজীদ বিন আসওয়াদ এর সত্ত্বার ওসিলা দিয়ে দুয়া করেছেন।
২. হযরত ইয়াজীদ বিন আসওয়াদকে দুয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন।
এছাড়াও হাদিসে হযরত মুয়াবিয়া রা. এর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, তিনি বলেছেন, হে আল্লাহ, আমাদের মাঝে সবচেয়ে উত্তম ও সবচেয়ে ভালো ব্যক্তির ওসিলা দিয়ে আপনার কাছে আবেদন করছি। এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, ওসিলা দেয়ার ক্ষেত্রে মূল হল, আল্লাহর প্রিয়ভাজন ব্যক্তির ওসিলা দেয়া। ইয়াজীদ ইবনে আসওয়াদকে আল্লাহর প্রিয় পাত্র মনে করেই ওসিলা করা হয়েছে।
আরও অনেক দলিল রয়েছে। সেগুলো আমরা অন্য কোন আলোচনায় লিখবো ইনশা আল্লাহ।
শরীয়তে কোন বিষয়কে হারাম, না-জায়েজ, মাকরুহ বা শিরক বলতে হলে অবশ্যই এর পক্ষে দলিল লাগবে। আমরা এখানে রাসূল স. এর শিক্ষা, হযরত উমর রা. এর মতো খলিফায়ে রাশেদ এর দুয়া, রাসূল স. এর সম্মানিত চাচা হযরত আব্বাসের দুয়া, হযরত মুয়াবিয়া রা. এর দুয়া থেকে দিনের আলোর মতো সহীহ দলিলের মাধ্যমে প্রমাণ দিয়েছি আল-হামদুলিল্লাহ।
সালাফী ভাইয়েরা যখন এটাকে না-জায়েজ বলবেন, তাদেরকে অবশ্যই এধরণের স্পষ্ট দলিল দিতে হবে। আমরা তাদের কাছ থেকে দলিল চাচ্ছি, যেখানে রাসূল স. বলেছেন, তোমরা ওসিলা করো না। কেননা ওসিলা শিরক।
হারাম, না-জায়েজ বা শিরকের মাত্র একটা হাদীস বা আয়াত দেখাতে হবে। আপনাদের নিজস্ব গবেষণা, যুক্তি বা ব্যাখ্যা নয়। আমাদের মতো স্পষ্ট দলীল। মনে রাখবেন, আপনাদের শরীয়তের দলিল ছাড়া আপনাদের গবেষণা, যুক্তি আমাদের কিছু বিন্দুমাত্র কোন মূল্য রাখে না। সুতরাং যখন ওসিলাকে না-জায়েজ বলবেন, তখন ওসিলা নাজায়েজ হওয়ার স্পষ্ট দলিল দিবেন, যখন শিরক বলবেন, তখন শিরক হওয়ার স্পষ্ট দলিল দিবেন। শরীয়তের দলিল ছাড়া কোন ব্যক্তির গবেষণা বা যুক্তি আনবেন না আশা করি। আপনাদের গবেষণাটি ইবনে তাইমিয়া রহ. এর হোক, কিংবা আলবানী সাহেবের, শরীয়তের দলিল ছাড়া শুধু তাদের নিজস্ব বক্তব্য আমাদের কাছে দলিল নয়।
-----
শাইখ মুফতি ইযহারুল ইসলাম আল-কাউসারি
ওসিলার আরেকটি শাব্দিক অর্থ মানজিলা। কারও অবস্থানকে মানজিলা বলা হয়। আল্লাহর কাছে রাসূল স. এর একটি বিশেষ অবস্থান রয়েছে। সুতরাং রাসূল স. এর এই অবস্থানের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে দুয়া করাও ওসিলার অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহর কাছে নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম বা উপায় অর্থের চেয়ে মানজিলা অর্থটি ব্যাপক অর্থ বহন করে। কেননা, যেসব মাধ্যম বা উপায়ের দ্বারা আল্লাহর কাছে দুয়া করা হয়, সেগুলোর একটি বিশেষ মানজিলা বা অবস্থান রয়েছে আল্লাহর কাছে। একারণেই মূলত: এগুলো দ্বারা ওসিলা দেয়া হচ্ছে। নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ আল্লাহর কাছে নামাযের বিশেষ মানজিলা বা অবস্থান রয়েছে। একইভাবে রাসূল স. এর ওসিলা দিয়ে দুয়া করা হচ্ছে। কারণ আল্লাহর কাছে রাসূল স. এর বিশেষ মর্যাদা ও অবস্থান রয়েছে। একইভাবে বুজুর্গদের ওসিলায় দুয়া করা হয়, কারণ বুজুর্গদের বিশেষ অবস্থান রয়েছে আল্লাহর কাছে। মোটকথা, যেসব বিষয়ে ওসিলা করা হচ্ছে, সবগুলোর মাঝেই একটা মৌলিক কারণ হচ্ছে, এগুলোর একটি বিশেষ অবস্থান রয়েছে মহান আল্লাহর কাছে। এজন্য ওসিলার শাব্দিক অর্থ থেকে এই মূল কারণটি গ্রহণ করলে সমস্ত ওসিলার ক্ষেত্রে আমাদের মৌলিক বিশ্বাস স্পষ্ট হয়।
ওসিলার ক্ষেত্রে আমাদের মূল অবস্থান:
আমরা জানি, যে কোন নেক আমলের মাধ্যমে ওসিলা দেয়া জায়েজ, কারণ আমলগুলোর কারণে আল্লাহ খুশি হন। একারণে তিনি কবুল করেন। এটাকে আরেকটু বিস্তারিত বললে এভাবে বলা যায়, যেসব জিনিস আল্লাহ পছন্দ করেন, সেগুলো দিয়ে ওসিলা করলে আল্লাহ কবুল করেন। আল্লাহর প্রিয় হওয়া বা পছন্দের কারণেই মূলত: ওসিলা করা হচ্ছে। নতুবা ওসিলা করার কোন দরকার ছিলো না। সরাসরি দোয়া করলেই হত। বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয়, যখন কোন বুজুর্গের কাছে দুয়া চাওয়া হয়। বুজুর্গের কাছে দুয়া চাওয়ার কারণ হল, তিনি আল্লাহর পছন্দনীয় ও প্রিয় বান্দা। তিনি দুয়া করলে আল্লাহ কবুল করবেন। অন্যের কাছে দুয়ার ক্ষেত্রে মূল যদি তার দুয়া হত, তাহলে মানুষ চোর-ডাকাতের কাছে দুয়া চেতো। কারণ চোর ডাকাত যেই কাজ করবে, বুজুর্গও একই কাজ করবে। কিন্তু চোর ডাকাতের কাছে না গিয়ে ভালো ও নেককার মানুষের কাছে যাওয়ার মূল কারণ হল, সে আল্লাহর পছন্দের। একইভাবে আমলের মাধ্যমে দুয়ার কারণ হল আমলগুলো আল্লাহর পছন্দের। আমাদের অবস্থান এখানে খুবই স্পষ্ট। যেসব বিষয় আল্লাহর প্রিয় ও পছন্দের সেসব বিষয়ের ওসিলা দিয়ে দোয়া করা যাবে। কারণ ওসিলার মূল উদ্দেশ্য হল যে বিষয়ের ওসিলা দেয়া হচ্ছে, সেটি আল্লাহর প্রিয়। সুতরাং যেসকল বিষয় আল্লাহর প্রিয় হবে, সেটা দিয়ে আমরা ওসিলা করবো। আল্লাহর প্রিয় বিষয়টি জীব হোক, জড় হোক, কোন আমল হোক। প্রিয় হওয়ার দিক থেকে সবই সমান। এজন্য আমাদের কাছে জাত ও আমলের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কারণ জাতও আল্লাহর প্রিয়। আমলও আল্লাহর প্রিয়। কেউ যদি কা'বার ওসিলা দিয়ে দোয়া করে, সেটাও আমাদের কাছে পছন্দনীয়। যদিও কাবা আমল বা কোন জীব নয়। কিন্তু কা'বা আল্লাহর প্রিয় ঘর হওয়ার কারণে আমরা এর ওসিলায় দুয়া করি। এক্ষেত্রে আমরা জীবিত, মৃতেরও কোন পার্থক্য করি না। ব্যক্তি জীবিত থাকলেও আল্লাহর প্রিয় থাকে, মারা গেলেও আল্লাহর প্রিয় থাকে।
ওসিলা দিয়ে দু'য়া করার সময় আমাদের অন্তরে এই বিশ্বাস থাকে যে, যেসব বিষয়ের ওসিলা দিচ্ছি, সেটি আল্লাহর প্রিয়, এজন্যই আমরা এর ওসিলা দিচ্ছি। আমরা আমলের ক্ষেত্রে এই বিশ্বাস করি না যে, এসব আমলের নিজস্ব ক্ষমতা আছে, যার কারণে দুয়া কবুল হয়। কোন নেককার ভালো মানুষের কাছে দুয়া চাওয়ার সময় আমরা এটা মনে করি না যে, এই ব্যক্তির নিজস্ব ক্ষমতা কারণে দুযা কবুল হবে। বরং আমাদের অন্তরের বিশ্বাস হল, এই ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয়। প্রিয় হওয়ার কারণে তার দুয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।আরেকটা বিষয় স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন, আমরা যার ওসিলা দিচ্ছি, তাকে আল্লাহ, আল্লাহর সমকক্ষ বা মূর্তি মনে করছি না। নাউযুবিল্লাহ। বরং তাকে আল্লাহর বান্দা মনে করি। তাকে শুধু আল্লাহর প্রিয় বান্দা বিশ্বাস করি। আপনার যদি দিলে আমাদের ব্যাপারে অন্য কোন ধারণা আসে, তাহলে মুমিনের ব্যাপারে অমূলক ধারণা থেকে বেচে থাকুন। আপনার অন্তরে যদি ওসিলা দেয়া ব্যক্তিকে মূর্তি মনে হয়, তাহলে আপনি তৌবা করুন। আমাদের অন্তরে যেহেতু এগুলো আসে না, সুতরাং এজাতীয় কথা আমাদের সামনে না বলে নিজে অন্যায় ধারণা থেকে বাচার চেষ্টা করুন।
ওসিলার ক্ষেত্রে সালাফীদের অবস্থান
আমাদের সালাফী ভাইয়েরা মৌলিকভাবে ওসিলা অস্বীকার করেন, বিষয়টা এমন নয়। বরং তারাও ওসিলা স্বীকার করেন। তবে ওসিলার কয়েকটা পদ্ধতিকে তারা অস্বীকার করেন। বাস্তবতা হল, এগুলো অস্বীকারের পক্ষে তাদের কোন শরয়ী দলিল নেই। নিজেদের কিছু যুক্তির আলোকে এটা করার চেষ্টা করলেও সেসব যুক্তিগুলোও খুবই দুর্বল। আর সহীহ হাদীস ও সাহাবায়ে কেরামের আমলের দ্বারা প্রমাণিত বিষয়কে নিজেদের বানানো মূলনীতির আলোকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ থাকতে পারে না।
সালাফীদের কাছে যেসব ওসিলা জায়েজ
১. যে কোন নেক আমলের মাধ্যমে ওসিলা দিয়ে দু’য়া করা।
২. কোন নেককার লোকের কাছে গিয়ে দুয়া চাওয়ার মাধ্যমে ওসিলা করা ।
৩. আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর মাধ্যমে ওসিলা করে দু’য়া করা।
এই তিনটি বিষয়কে তারা ব্যাপকভাবে জায়েজ বলেন। তারা দু’টি বিষয়ের বিরোধিতা করেন,
১. জীবিত কোন ব্যক্তির ওসিলায় দু’য়া করা।
২. মৃত কোন ব্যক্তির ওসিলায় দু’য়া করা।
তবে জীবিত বা মৃত কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে যদি বলা হয়, হে আল্লাহ, আমি রাসূল স.কে মহব্বত করি, এই ওসিলায় আমার দু’য়া কবুল করেন, তাহলে এটা সালাফীদের কাছে জায়েজ। ইবনে তাইমিয়া রহ. এর মতে নীচের ওসিলাগুলো জায়েজ।
১.হে আল্লাহ, আমরা রাসূল স.কে মহব্বত করি, এই মহব্বতের ওসিলায় আমাদেরকে সিরাতে মুসতাকীমের হেদায়াত দান করুন।
২.হে আল্লাহ, আমি বিশ্বাস করি যে, আপনার নবী মুহাম্মাদ স. আপনাকে মহব্বত করেন। রাসূল স. এর এই মহব্বতের ওসিলায় আমাদেরকে সিরাতে মুসতাকীমের হেদায়াত দান করুন।
৩.হে আল্লাহ, আমি বিশ্বাস করি যে, আপনি রাসূল স. কে ভালোবাসেন, আপনার এই ভালোবাসার ওসিলায় আমাদেরকে সিরাতে মুসতাকীমের হেদায়াত দান করুন।
৪.হে আল্লাহ, আমি বিশ্বাস করি যে, আপনার নবী মুহাম্মাদ স. আমাদেরকে মহব্বত করেন এবং আমাদের কল্যাণ কামনা করেন, রাসূল স. এই মহব্বতের ওসিলায় আমাদের সিরাতে মুস্তাকীমের হেদায়াত দান করুন।
ইবনে তাইমিয়া রহ. কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, রাসূল স.কে ওসিলা করে দুয়া করা যাবে কি? তিনি উত্তরে লিখেছেন,
ﺍﻟﺤﻤﺪ ﻟﻠﻪ، ﺃﻣﺎ ﺍﻟﺘﻮﺳﻞ ﺑﺎﻹﻳﻤﺎﻥ ﺑﻪ، ﻭﻣﺤﺒﺘﻪ ﻭﻃﺎﻋﺘﻪ، ﻭﺍﻟﺼﻼﺓ ﻭﺍﻟﺴﻼﻡ ﻋﻠﻴﻪ، ﻭﺑﺪﻋﺎﺋﻪ ﻭﺷﻔﺎﻋﺘﻪ ﻭﻧﺤﻮ ﺫﻟﻚ، ﻣﻤﺎ ﻫﻮ ﻣﻦ ﺃﻓﻌﺎﻟﻪ، ﻭﺃﻓﻌﺎﻝ ﺍﻟﻌﺒﺎﺩ ﺍﻟﻤﺄﻣﻮﺭ ﺑﻬﺎ ﻓﻰ ﺣﻘﻪ، ﻓﻬﻮ ﻣﺸﺮﻭﻉ ﺑﺎﺗﻔﺎﻕ ﺍﻟﻤﺴﻠﻤﻴﻦ
অর্থ: আল-হামদুলিল্লাহ, রাসূল স. এর প্রতি ইমান, তার প্রতি মহব্বত, রাসূল স. এর প্রতি দুরুদ ও সালাম, রাসূল স. আমাদের জন্য যে দুয়া করেছেন বা শাফায়াত করবেন এজাতীয় রাসূল স. এর যেসব কাজ রয়েছে এবং রাসূল স. এর হকের ব্যাপারে বান্দাদেরকে যেসব আমলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, এগুলোর মাধ্যমে ওসিলা করা সমস্ত মুসলিমের ঐকমতে জায়েজ।
- আল-ফাতাওয়াল কুবরা, খ.১, পৃ.১৪০
সালাফীদের মূল দাবী হল, জীবিত ও মৃত ব্যক্তির ওসিলা দিয়ে দু’য়া করা যাবে না। তাদের কেউ কেউ একে শিরকও বলে। যেমন শায়খ ইবনে উসাইমিন এটাকে এক প্রকার শিরক বলেছেন। যেহেতু সালাফীদের সাথে আমাদের মূল বিরোধ ব্যক্তির ওসিলা দিয়ে দুয়া করা। এজন্য আমরা শুধু ব্যক্তির ওসিলা দিয়ে দুয়া করার দলিল আলোচনা করবো। অন্যান্য ওসিলা যেহেতু তারাও স্বীকার করে, এজন্য আমরা সেগুলো আলোচনা করব না ।
আমি যদি বলি,
১. হে আল্লাহ রাসূল স. এর ওসিলায় আমার দুয়া কবুল করুন।
২. হে আল্লাহ আপনার নেককার বান্দা আহমাদ শফী সাহেবের ওসিলায় আমার দুয়া কবুল করুন।
এক্ষেত্রে সালাফীরা কয়েকটা দাবী করে থাকে।
১. ব্যক্তির ওসিলায় দুয়া করার কথা কুরআন -সুন্নাহে নেই।
২. আমলের মাধ্যমে ওসিলা জায়েজ, কারণ আমলের পূজা করা হয় না, কিন্তু ব্যক্তির ওসিলা জায়েজ নয়, কারণ ব্যক্তির পূজা করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এক্ষেত্রে আমরা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলবো, সালাফীদের এই দু’টি দাবী একেবারেই ভিত্তিহীন। দ্বিতীয় দাবী তো তাদের উপরও প্রযোজ্য হয়। কারণ তারা জীবিত ব্যক্তির কাছে গিয়ে দুয়া চাওয়াকে জায়েজ বলেন। অথচ এক্ষেত্রে পূজার সম্ভাবনা থাকার কারণে নাজায়েজ বলা উচিৎ, কিন্তু তারা এটাকে সম্পূর্ণ জায়েজ বলেন। সুতরাং দ্বিতীয় যুক্তিটি একেবারেই ভিত্তিহীন। সালাফীদের প্রথম দাবীও সম্পূর্ণ ভুল। কারণ কুরআন-সুন্নাহে নেই, এই দাবীটি কুরআন-সুন্নাহর সব কিছু অধ্যয়নের উপর নির্ভর করে। যাচাই বা অধ্যয়ন না করে ধারণা করে এধরণের দাবী করার কোন যৌক্তিকতা নেই। আমরা সহীহ হাদিসের আলোকে ব্যক্তির মাধ্যমে ওসিলার দলিলগুলো এখানে উল্লেখ করছি।
দলিল আলোচনার পূর্বে একটা বিষয় স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। ওসিলার ক্ষেত্রে সব-সময় একটা পদ্ধতিতেই ওসিলা করা হবে, এই চিন্তা করা ভুল। আমি যেমন কোন বুজুর্গের কাছে গিয়ে দুয়া চাইতে পারি। আবার সে বুজুর্গের ওসিলা দিয়ে আমি সরাসরি আল্লাহর কাছে দুয়া করতে পারি। আবার আমি নিজের কোন ভালো আমলের মাধ্যমেও ওসিলা করতে পারি। এক্ষেত্রে কোন বাধা নিষেধ নেই। একথা চিন্তা করা অন্যায় যে, আমি ওসিলার শুধু একটি মাধ্যমই সব-সময় আমল করি।
আমি একই দুয়ার মধ্যে বলতে পারি, হে আল্লাহ আপনি আপনার নাম ও গুণাবলীর ওসিলায়, আমার সমস্ত নেক আমলের ওসিলায়, রাসূল স. এর ওসিলায় আমার মুসীবত দূর করেন। আবার আমি উক্ত মুসীবত দূর করার জন্য কোন বুজুর্গকে বলতে পারি, আমার মুসীবত দূর হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দুয়া করুন। এক প্রকার ওসিলা দিয়ে দুয়া করার অর্থ এই নয় যে, অন্য প্রকারকে আমি অ্যাপ্লাই করি না বা করাকে অপছন্দ করি। বুজুর্গের কাছে উক্ত দুয়ার আবেদন এটা কখনও প্রমাণ করে না যে, আমি নিজে একথা কখনও বলতে পারি না যে, হে আল্লাহ, রাসূল স. এর ওসিলায় আমার দুয়া কবুল করেন।
সার কথা হল,
১. ওসিলার যেসকল প্রকার রয়েছে, আমি ইচ্ছা করলে সবগুলো এক সাথে করতে পারি।
২. ইচ্ছা করলে পৃথক পৃথক বা যে কোন একটা করতে পরি।
৩. এক প্রকার ওসিলা ব্যবহার এটা প্রমাণ করে না যে, আমি অন্য প্রকার করি না বা আদৌ করবো না।
এবার আমাদের দলিলগুলোর প্রতি লক্ষ্য করুন। সাহাবায়ে কেরাম অনেক ক্ষেত্রে একই সাথে দু’প্রকার ওসিলা ব্যবহার করেছেন। এর কয়েকটি প্রমাণ আমরা আলোচনা করছি।
বুখারী শরীফে রয়েছে, হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
ﻋﻦ ﺃﻧﺲ ﺑﻦ ﻣﺎﻟﻚ - ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ - ﻗﺎﻝ : ﻛﻨﺎ ﺇﺫﺍ ﻗﺤﻄﻨﺎ ﺍﺳﺘﺴﻘﻰ ﻋﻤﺮ ﺑﻦ ﺍﻟﺨﻄﺎﺏ - ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ - ﺑﺎﻟﻌﺒﺎﺱ ﺑﻦ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻤﻄﻠﺐ - ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ - ﻓﻘﺎﻝ : ﺍﻟﻠﻬﻢ ﺇﻧﺎ ﻛﻨﺎ ﻧﺘﻮﺳﻞ ﺇﻟﻴﻚ ﺑﻨﺒﻴﻨﺎ ﻓﺘﺴﻘﻴﻨﺎ , ﻭﺇﻧﺎ ﻧﺘﻮﺳﻞ ﺇﻟﻴﻚ ﺑﻌﻢ ﻧﺒﻴﻨﺎ ﻓﺎﺳﻘﻨﺎ , ﻗﺎﻝ : ﻓﻴﺴﻘﻮﻥ .
অর্থ: আমরা যখন অনাবৃষ্টির স্বীকার হতাম, তখন হযরত উমর রা. হযরত আব্বাস রা. এর মাধ্যমে বৃষ্টির দুয়া করতেন। হযরত উমর রা. বলেন, হে আল্লাহ, নিশ্চয় আমরা আমাদের নবী রাসূল স. এর মাধ্যমে আপনার কাছে ওসিলা করতাম, আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করতেন, এখন আমরা আপনার কাছে আমাদের নবীজীর চাচাকে ওসিলা করছি, আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন। হযরত আনাস বলেন, এরপর বৃষ্টি হত।
- বুখারী শরিফ, হাদীস নং ৫১১
এই হাদীস জীবিত ব্যক্তির ওসিলার সুস্পষ্ট প্রমাণ। এই হাদিসে হযরত উমর রা. এর দুয়াটি ব্যক্তির মাধ্যমে ওসিলা প্রমাণ করছে। আর হযরত উমর রা. যখন হযরত আব্বাস রা. কে ওসিলার দুয়া করতে বলছেন, তখন এটি নেককার লোকের কাছে দুয়ার প্রমাণ। মূল কথা হল, হযরত উমর রা. এই দুয়াটিতে স্পষ্ট ওসিলা রয়েছে। আমাদের কাছে হযরত উমর রা. এর নিজের এই দুয়া যেমন ওসিলার প্রমাণ, একইভাবে হযরত আব্বাস রা. কে দুয়া করার জন্য যখন তিনি অনুরোধ করেছেন, সেটাও আরেক প্রকার ওসিলার প্রমাণ। হযরত উমর রা. এর নিজের দুয়াটি লক্ষ্য করুন,
ﺍﻟﻠﻬﻢ ﺇﻧﺎ ﻛﻨﺎ ﻧﺘﻮﺳﻞ ﺇﻟﻴﻚ ﺑﻨﺒﻴﻨﺎ ﻓﺘﺴﻘﻴﻨﺎ , ﻭﺇﻧﺎ ﻧﺘﻮﺳﻞ ﺇﻟﻴﻚ ﺑﻌﻢ ﻧﺒﻴﻨﺎ ﻓﺎﺳﻘﻨﺎ
হে আল্লাহ, নিশ্চয় আমরা আমাদের নবী রাসূল স. এর মাধ্যমে আপনার কাছে ওসিলা করতাম, আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করতেন, এখন আমরা আপনার কাছে আমাদের নবীজীর চাচাকে ওসিলা করছি, আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন।
উমর রা. এখানে আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্য দুয়া করেছেন। এই দুয়ার মধ্যে হযরত আব্বাস রা. কে ওসিলা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হযরত উমর রা. দুয়াটি ব্যক্তির মাধ্যমে ওসিলার প্রমাণ। এবং হযরত আব্বাস রা.কে দুয়া করতে বলাটা কোন নেককার ব্যক্তির মাধ্যমে ওসিলার প্রমাণ। এখানে দু’প্রকার ওসিলা এক সাথে হয়েছে। একে এক প্রকার বানাবার চেষ্টার কোন সুযোগ নেই।
এই হাদিসের অন্য বর্ণনা থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় স্পষ্ট হয়। বর্ণনাটি শায়খ নাসিরুদ্দিন আল-বানী তার আত-তাওয়াসসুল কিতাবের ৬২ পৃষ্ঠায় এনেছেন এবং একে সহীহ বলেছেন। হযরত আব্বাস রা দুয়া করেছেন,
ﺍﻟﻠﻬﻢ ﺇﻧﻪ ﻟﻢ ﻳﻨﺰﻝ ﺑﻼﺀ ﺇﻻ ﺑﺬﻧﺐ ، ﻭﻟﻢ ﻳﻜﺸﻒ ﺇﻻ ﺑﺘﻮﺑﺔ ، ﻭﻗﺪ ﺗﻮﺟﻪ ﺍﻟﻘﻮﻡ ﺑﻲ ﺇﻟﻴﻚ ﻟﻤﻜﺎﻧﻲ ﻣﻦ ﻧﺒﻴﻚ ، ﻭﻫﺬﻩ ﺃﻳﺪﻳﻨﺎ ﺇﻟﻴﻚ ﺑﺎﻟﺬﻧﻮﺏ ﻭﻧﻮﺍﺻﻴﻨﺎ ﺇﻟﻴﻚ ﺑﺎﻟﺘﻮﺑﺔ ﻓﺎﺳﻘﻨﺎ ﺍﻟﻐﻴﺚ .
অর্থ: হে আল্লাহ, প্রত্যেক বালা মুসীবতই গোনাহের কারণে আসে, আর তৌবা ছাড়া এটি দূর হয় না, হে আল্লাহ, আমার জাতি আমার মাধ্যমে আপনার শরণাপন্ন হয়েছে, কারণ আপনার প্রিয় নবীর সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে (নবীজীর চাচা)। আপনার সামনে আমাদের গোনাহগার হাতগুলো উপস্থিত, আর উপস্থিত আমাদের তৌবার কপাল, আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন।
- আত-তাওয়াসসুল, পৃ.৬২
হযরত আব্বাস রা. এখানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কথা বলেছেন।
১. তিনি আল্লাহর কাছে দুয়ার সময় বলেছেন, আমার জাতি আমার মাধ্যমে হে আল্লাহ আপনার কাছে আবেদন করেছে। এখানে স্পষ্টভাবে হযরত আব্বাস রা. এর ওসিলা প্রমাণিত। হযরত আব্বাস রা. এর এই বক্তব্যের দ্বিতীয় কোন ব্যাখ্যার সুযোগ নেই।
২.সাহাবায়ে কেরাম রা. হযরত আব্বাস রা. এর ওসিলা গ্রহণের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, হযরত আব্বাস রা. এর সাথে রাসূল স. এর আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে। কারণ তিনি রাসূল স. এর চাচা ছিলেন। রাসূল স. এর সাথে এই সম্পর্কের কারণে তার ওসিলা গ্রহণ পরোক্ষভাবে রাসুল স. এর ওসিলা গ্রহণ। হযরত উমর রা. তার দুয়ার মধ্যেও এই সম্পর্কের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, হে আল্লাহ, আমাদের নবীজীর চাচার মাধ্যমে আপনার কাছে আবেদন করছি। উমর রা. এর কথা থেকেও সম্পর্কের গুরুত্ব স্পষ্ট। সুতরাং এখানে হযরত আব্বাস রা. ও হযরত উমর রা. এর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, মূলত: এখানে রাসূল স. এর ওসিলা দিয়ে দুয়া করা হয়েছে।
সম্পূর্ণ ঘটনা থেকে যেসকল বিষয় প্রমাণিত হয়,
১. হযরত উমর রা. তার দুয়ার মধ্যে হযরত আব্বাস রা. এর ওসিলা করেছেন। এবং পরোক্ষভাবে হযরত আব্বাস রা. এর ওসিলার কারণ হল, তিনি রাসূল স. এর চাচা।
২.হযরত আব্বাস রা. এর নিজের বক্তব্য থেকে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, সাহাবায়ে কেরাম তার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আবেদন করেছে। হযরত আব্বাস রা. এর স্বীকারোক্তিতে বিষয়টি প্রমাণিত।
৩. হযরত উমর রা. হযরত আব্বাসকে দুয়া করার কথা বলেছেন। এর মাধ্যমে কোন নেককার লোকের কাছে দুয়া চাওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত।
৪. হযরত উমর রা. ও অন্যান্য সাহাবী হযরত আব্বাস রা. এর ওসিলা গ্রহণের মূল কারণ হল, হযরত আব্বাস হলেন রাসূল স. এর আপন চাচা। রাসূল স. এর সাথে তার সম্পর্কের কারণে এই ওসিলা করা হয়েছে। সুতরাং মূল ওসিলা করা হয়েছে রাসূল স. এর মাধ্যমে। হযরত আব্বাস রা. এর স্পষ্ট বক্তব্য থেকে বিষয়টি প্রমাণিত। হযরত আব্বাস বলেছেন, “হে আল্লাহ, আমার জাতি আপনার কাছে আমার মাধ্যমে আবেদন করেছে, কারণ আপনার নবীর সাথে আমার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে”। হযরত আব্বাস রা. এর এই স্পষ্ট বক্তব্য থেকে রাসূল স. এর ইন্তেকালের পরে রাসূল স. এর মাধ্যমে ওসিলা দেয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ।
হযরত উমর রা. এর ঘটনায় মোট তিন প্রকারের ওসিলা প্রমাণিত হয়েছে।
১. কোন ব্যক্তির ওসিলায় দুয়া করা। (বুখারীতে বর্ণিত, হযরত উমর রা. এর নিজের দুয়া)।
২.কোন নেককার লোকের কাছে দুয়ার আবেদন করা। (হযরত আব্বাস রা. কে উমর রা. দুয়ার অনুরোধ করেছেন)।
৩. মৃত ব্যক্তির ওসিলা দেয়া। (হযরত আব্বাস রা. দুয়ার সময় রাসূল স. এর সাথে তার সম্পর্কের কথা বলে দুয়া করেছেন)
এই তিন প্রকারের ওসিলা উক্ত সহীহ বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে। বক্তব্যগুলো সালাফীদের নিজেদের বানানো আকিদার বিরোধী হওয়ার কারণে তারা বিভিন্নভাবে এগুলোর অপব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। সালেহ আল-মুনাজ্জিদ, শায়খ আলবানীসহ অন্যান্যরা ঘটনাকে বিকৃত করার চেষ্টা করলেও বাস্তবতা সকলের কাছে স্পষ্ট। তারা এক্ষেত্রে একটা ভিত্তিহীন দাবী করেছে যে, হযরত উমর রা. হযরত আব্বাস রা.কে বলেছেন, হে আব্বাস, আপনি উঠুন। আল্লাহর কাছে দুয়া করুন। এই বক্তব্যের মাধ্যমে দাবী করেছে যে, এখানে শুধু হযরত আব্বাস রা এর কাছে দুয়া চাওয়া হয়েছে। এছাড়া আর কিছুই নয়। এটা সালেহ আল-মুনাজ্জিদ ও শায়খ আলবানীর স্পষ্ট বিকৃতি। নীচের লিংকে শায়খ মুনাজ্জিদের বিকৃতির নমুনা দেখতে পাবেন, https://islamqa.info/ar/118099
আমরা সহীহ দু’টি হাদিসের আলোকে তাদের এই বিকৃতির জওয়াব উল্লেখ করেছি আল-হামদুলিল্লাহ। হযরত উমর রা. হযরত আব্বাসকে দুয়া করতে বলেছেন। এটা অন্য প্রকারের ওসিলার তো বিরোধী নয়। সুতরাং এটা দিয়ে বাকী দুই প্রকারের ওসিলা অস্বীকারের অপচেষ্টা নিতান্ত হাস্যকর। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন।
.
দ্বিতীয় দলিল:
ওসিলার বিষয়ে হযরত উসমান বিন হানিফ রা. এর বিখ্যাত হাদীস রয়েছে। হাদিসটি সহীহ হওয়ার বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সালাফী আলেমগণও হাদিসটিকে সহীহ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।
হযরত উসমান বিন হানিফ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
ﻋﻦ ﻋﺜﻤﺎﻥ ﺑﻦ ﺣﻨﻴﻒ ﺃﻥ ﺭﺟﻼً ﺿﺮﻳﺮ ﺍﻟﺒﺼﺮ ﺃﺗﻰ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ، ﻓﻘﺎﻝ : ﺍﺩﻉ ﺍﻟﻠﻪ ﺃﻥ ﻳﻌﺎﻓﻴﻨﻲ . ﻓﻘﺎﻝ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ : ( ﺇﻥ ﺷﺌﺖ ﺩﻋﻮﺕ ﻟﻚ ، ﻭﺇﻥ ﺷﺌﺖ ﺃﺧّﺮﺕُ ﺫﺍﻙ ، ﻓﻬﻮ ﺧﻴﺮ ﻟﻚ . [ ﻭﻓﻲ ﺭﻭﺍﻳﺔ : ( ﻭﺇﻥ ﺷﺌﺖَ ﺻﺒﺮﺕَ ﻓﻬﻮ ﺧﻴﺮ ﻟﻚ [( ، ﻓﻘﺎﻝ : ﺍﺩﻋﻪُ . ﻓﺄﻣﺮﻩ ﺃﻥ ﻳﺘﻮﺿﺄ ، ﻓﻴﺤﺴﻦ ﻭﺿﻮﺀﻩ ، ﻓﻴﺼﻠﻲ ﺭﻛﻌﺘﻴﻦ ، ﻭﻳﺪﻋﻮ ﺑﻬﺬﺍ ﺍﻟﺪﻋﺎﺀ : ﺍﻟﻠﻬﻢ ﺇﻧﻲ ﺃﺳﺄﻟﻚ ، ﻭﺃﺗﻮﺟﻪ ﺇﻟﻴﻚ ﺑﻨﺒﻴﻚ ﻣﺤﻤﺪ ﻧﺒﻲ ﺍﻟﺮﺣﻤﺔ ، ﻳﺎ ﻣﺤﻤﺪ ﺇﻧﻲ ﺗﻮﺟﻬﺖُ ﺑﻚ ﺇﻟﻰ ﺭﺑﻲ ﻓﻲ ﺣﺎﺟﺘﻲ ﻫﺬﻩ ، ﻓﺘﻘﻀﻰ ﻟﻲ ، ﺍﻟﻠﻬﻢ ﻓﺸﻔّﻌﻪ ﻓﻲَّ ﻭﺷﻔّﻌﻨﻲ ﻓﻴﻪ ) . ﻗﺎﻝ : ﻓﻔﻌﻞ ﺍﻟﺮﺟﻞ ﻓﺒﺮﺃ
অর্থ: ক্ষীণ দৃষ্টির এক ব্যক্তি রাসূল স.কে এর কাছে এসে বললেন, আল্লাহর কাছে আমার চোখের সুস্থতার জন্য দুয়া করুন। রাসূল স. বললেন, তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য দুয়া করবো, আর চাইলে দুয়াকে বিলম্বিত করবো। এটা তোমার জন্য উত্তম। সে বলল, আপনি আল্লাহর কাছে দুয়া করুন। রাসূল স. তাকে ওজু করার নির্দেশ দিলেন। তাকে উত্তম রূপে উজু করে দু’রাকাত নামায পড়ার আদেশ দিলেন এবং এই দুয়া পড়তে বললেন। হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি, আপনার নবী, রহমতের নবীর ওসিলায় আপনার কাছে চাচ্ছি, হে মুহাম্মাদ, আমি আপনার মাধ্যমে আমার প্রভুর কাছে আমার এই প্রয়োজনে আবেদন করেছি যেন এটি পূরণ হয়। হে আল্লাহ, রাসূল স.কে আমার ব্যাপারে সুপারিশকারী হিসেবে গ্রহণ করুন এবং রাসূল স.এর মাধ্যমে আমার এই দুয়াকে কবুল করেন।
হযরত উসমান বিন হানিফ রা. বলেন, লোকটি এই দুয়া করলো। এরপর সে ভালো হয়ে গেলো।
(মুসনাদে আহমাদ, খ.৪, ১৩৮ পৃ, তিরমিযী শরীফ, খ.৫, পৃ.৫৬৯, ইবনে মাজা খ.১, পৃ.৪৪১, সহীহ ইবনে খোজাইমা, খ.২, পৃ.২২৫)
উক্ত সহীহ হাদীস থেকে কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত।
১. রাসূল স. এর কাছে এসে লোকটি দুয়ার আবেদন করেছে। এটি এক ধরণের ওসিলা।
২. রাসূল স. এর ওসিলায় দুয়া করার শিক্ষা দিয়েছেন স্বয়ং রাসূল স.। কারণ উক্ত দুয়াটি রাসূল স. এর শেখানো।
৩. ঐ সাহাবী ব্যক্তি রাসূল স. এর ওসিলা দিয়ে দুয়া করেছে।
এই তিনটি বিষয় মূল হাদিসের বক্তব্য থেকেই প্রমাণিত। এখানে কারও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুযোগ নেই। নাসিরুদ্দিন আলবানী সাহেবে তার আত-তাওয়াসসুল কিতাবে বিভিন্নভাবে দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত বিষয়টাকে অপব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। তার আত-তাওয়াসসুল কিতাবে তিনি যেসব হাস্যকর অপব্যাখ্যা উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর সাথে হাদিসের দূরতম সম্পর্ক নেই। এগুলো শুধু কিতাবের কলেবর বৃদ্ধি করেছে। বাস্তবে কোন দলিল হয়নি। কারণ হাদিসের মূল বক্তব্যে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট ওসিলা রয়েছে।
সাহাবী যখন বলেছেন,
ﺍﻟﻠﻬﻢ ﺇﻧﻲ ﺃﺳﺄﻟﻚ ، ﻭﺃﺗﻮﺟﻪ ﺇﻟﻴﻚ ﺑﻨﺒﻴﻚ ﻣﺤﻤﺪ ﻧﺒﻲ ﺍﻟﺮﺣﻤﺔ
অর্থ: হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি, আপনার কাছে আপনার নবী, রহমতের নবীর ওসিলায় আবেদ করছি।
এধরণের স্পষ্ট ওসিলা থাকার পরে আমাদের আলবানী সাহেবের অপব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন নেই। রাসূল স. এর হাদিসের বিপরীতে তিনি যদি পূর্ণ একটি কিতাবও লিখেন, সেটা কখনও আমাদের কাছে দলিল হবে না।
সত্যকথা হল, শায়খ আলবানী বিভিন্ন অপব্যাখ্যা করে শেষে লিখতে বাধ্য হয়েছেন যে, রাসূল স. এর স্বত্বার ওসিলায় দুয়া প্রমাণিত হলেও সেটা শুধু রাসূল স. এর সাথে খাস। অন্য কারও ক্ষেত্রে নয়।
অথচ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন অপব্যাখ্যা, যুক্তি ও সন্দেহ ঢুকিয়ে এরপরে এটাকে রাসূল স. এর সাথে খাস করার কী উদ্দেশ্য? আর তিনি বিষয়টিকে রাসূল স. এর সাথে খাস করার দলিল কোথায় পেলেন?
শায়খ আলবানী বা সালেহ আল-মুনাজ্জিদসহ অন্যান্য যারা নিজেদের মতের বিরোধী হওয়ার কারণে হাদিসটি অপব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে, তাদেরকে আমরা বলবো, সহীহ হাদিসের মূল বক্তব্য দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পর আপনাদের যুক্তি ও ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন নেই। হাদিসের বক্তব্যকেই আমরা গ্রহণ করবো। আর আপনাদের কোন একটা বক্তব্য যদি গ্রহণযোগ্য হত, তাহলেও সেটা বিবেচনা আসতো। এই হাদিসের স্পষ্ট বক্তব্যের বিপরীতে তারা যা লিখেছেন, সবই অসার ও ভিত্তিহীন যুক্তি। আল্লাহ ক্ষমা করুন।
তৃতীয় দলিল:
ﻋﻦ ﺳﻠﻴﻢ ﺑﻦ ﻋﺎﻣﺮ ﺍﻟﺨﺒﺎﺋﺮﻱ , ﺃﻥ ﺍﻟﺴﻤﺎﺀ ﻗﺤﻄﺖ، ﻓﺨﺮﺝ ﻣﻌﺎﻭﻳﺔ ﺑﻦ ﺃﺑﻲ ﺳﻔﻴﺎﻥ - ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻬﻤﺎ - ﻭﺃﻫﻞ ﺩﻣﺸﻖ ﻳﺴﺘﺴﻘﻮﻥ ﻓﻠﻤﺎ ﻗﻌﺪ ﻣﻌﺎﻭﻳﺔ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﻤﻨﺒﺮ ﻗﺎﻝ : ﺃﻳﻦ ﻳﺰﻳﺪ ﺑﻦ ﺍﻷﺳﻮﺩ ﺍﻟﺠﺮﺷﻲ؟، ﻓﻨﺎﺩﺍﻩ ﺍﻟﻨﺎﺱ , ﻓﺄﻗﺒﻞ ﻳﺘﺨﻄﻰ ﺍﻟﻨﺎﺱ، ﻓﺄﻣﺮﻩ ﻣﻌﺎﻭﻳﺔ ﻓﺼﻌﺪ ﺍﻟﻤﻨﺒﺮ ﻓﻘﻌﺪ ﻋﻨﺪ ﺭﺟﻠﻴﻪ، ﻓﻘﺎﻝ ﻣﻌﺎﻭﻳﺔ : ﺍﻟﻠﻬﻢ ﺇﻧﺎ ﻧﺴﺘﺸﻔﻊ ﺇﻟﻴﻚ ﺍﻟﻴﻮﻡ ﺑﺨﻴﺮﻧﺎ ﻭﺃﻓﻀﻠﻨﺎ، ﺍﻟﻠﻬﻢ ﺃﻧﺎ ﻧﺴﺘﺸﻔﻊ ﺇﻟﻴﻚ ﺍﻟﻴﻮﻡ ﺑﻴﺰﻳﺪ ﺑﻦ ﺍﻷﺳﻮﺩ ﺍﻟﺠﺮﺷﻲ , ﻳﺎ ﻳﺰﻳﺪ , ﺍﺭﻓﻊ ﻳﺪﻳﻚ ﺇﻟﻰ ﺍﻟﻠﻪ، ﻓﺮﻓﻊ ﻳﺰﻳﺪ ﻳﺪﻳﻪ، ﻭﺭﻓﻊ ﺍﻟﻨﺎﺱ ﺃﻳﺪﻳﻬﻢ، ﻓﻤﺎ ﻛﺎﻥ ﺃﻭﺷﻚ ﺃﻥ ﺛﺎﺭﺕ ﺳﺤﺎﺑﺔ ﻓﻲ ﺍﻟﻐﺮﺏ، ﻛﺄﻧﻬﺎ ﺗﺮﺱ , ﻭﻫﺒﺖ ﻟﻬﺎ ﺭﻳﺢ، ﻓﺴﻘﻴﻨﺎ , ﺣﺘﻰ ﻛﺎﺩ ﺍﻟﻨﺎﺱ ﺃﻥ ﻻ ﻳﺒﻠﻐﻮﺍ ﻣﻨﺎﺯﻟﻬﻢ .
অর্থ: হযরত সুলাইম ইবনে আমের আল-খাবাইরী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আকাশে অনাবৃষ্টি দেখা দিলো। হযরত মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান রা. ও দামেশকের লোকেরা বৃষ্টির জন্য দুয়া করতে বের হল। হযরত মুয়াবিয়া রা. যখন মেম্বারে বসলেন, তিনি বললেন, ইয়াজীদ বিন আসওয়াদ জুরাশী কোথায়? লোকেরা তাকে ডাক দিলো। সে লোকদের ভিড় ঠেলে আসতে লাগলো। হযরত মুয়াবিয়া রা. তাকে নির্দেশ দিলেন। তিনি মেম্বারে উঠে হযরত মুয়াবিয়া রা. এর পায়ের কাছে বসলেন। হযরত মুয়াবিয়া রা. বললেন, হে আল্লাহ, আমরা আজ আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ও সবোর্ত্তম ব্যক্তির ওসিলায় আপনার কাছে দুয়া করছি। হে আল্লাহ, আমরা আপনার কাছে আজ ইয়াজীদ বিন আসওয়াদ জুরাশীর ওসিলায় আবেদন করছি।
হে ইয়াজীদ, আল্লাহর উদ্দেশ্যে, তুমি তোমার হাত উত্তোলন করো। ইয়াজীদ ইবনে আসওয়াদ তখন হাত উঠালেন। লোকেরাও তার সাথে হাত উঠালো। কিছুক্ষণের মধ্যে পশ্চিম আকাশে ঢালের মতো মেঘের ঘনঘটা দেখা দিলো। চার দিকে বাতাস বইতে শুরু করল। আমাদের উপর এমন বৃষ্টি হল যে, লোকেরা তাদের বাড়ীতে যেতে পারছিল না।
ইরওয়াউল গালীল, হাদীস নং ৬৭২,
একইভাবে শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী তার আত-তাওয়াসসুল কিতাবে হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।
শায়খ আলবানী তার দু’টি কিতাবে এই বর্ণনাকে সহীহ বলেছেন।
এই বর্ণনায় আমাদের মূল দলিল হল, হযরত মুয়াবিয়া রা. এর দুয়াটি। দুয়াতে তিনি স্পষ্টভাবে হযরত ইয়াজীদ বিন আসওয়াদের ওসিলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুয়া করেছেন। এই হাদিসে দু’প্রকারের ওসিলা প্রমাণিত হয়েছে।
১. হযরত মুয়াবিয়া রা. ইয়াজীদ বিন আসওয়াদ এর সত্ত্বার ওসিলা দিয়ে দুয়া করেছেন।
২. হযরত ইয়াজীদ বিন আসওয়াদকে দুয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন।
এছাড়াও হাদিসে হযরত মুয়াবিয়া রা. এর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, তিনি বলেছেন, হে আল্লাহ, আমাদের মাঝে সবচেয়ে উত্তম ও সবচেয়ে ভালো ব্যক্তির ওসিলা দিয়ে আপনার কাছে আবেদন করছি। এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, ওসিলা দেয়ার ক্ষেত্রে মূল হল, আল্লাহর প্রিয়ভাজন ব্যক্তির ওসিলা দেয়া। ইয়াজীদ ইবনে আসওয়াদকে আল্লাহর প্রিয় পাত্র মনে করেই ওসিলা করা হয়েছে।
আরও অনেক দলিল রয়েছে। সেগুলো আমরা অন্য কোন আলোচনায় লিখবো ইনশা আল্লাহ।
সর্বশেষ সালাফীদের অবস্থান সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই।
শরীয়তে কোন বিষয়কে হারাম, না-জায়েজ, মাকরুহ বা শিরক বলতে হলে অবশ্যই এর পক্ষে দলিল লাগবে। আমরা এখানে রাসূল স. এর শিক্ষা, হযরত উমর রা. এর মতো খলিফায়ে রাশেদ এর দুয়া, রাসূল স. এর সম্মানিত চাচা হযরত আব্বাসের দুয়া, হযরত মুয়াবিয়া রা. এর দুয়া থেকে দিনের আলোর মতো সহীহ দলিলের মাধ্যমে প্রমাণ দিয়েছি আল-হামদুলিল্লাহ।
সালাফী ভাইয়েরা যখন এটাকে না-জায়েজ বলবেন, তাদেরকে অবশ্যই এধরণের স্পষ্ট দলিল দিতে হবে। আমরা তাদের কাছ থেকে দলিল চাচ্ছি, যেখানে রাসূল স. বলেছেন, তোমরা ওসিলা করো না। কেননা ওসিলা শিরক।
হারাম, না-জায়েজ বা শিরকের মাত্র একটা হাদীস বা আয়াত দেখাতে হবে। আপনাদের নিজস্ব গবেষণা, যুক্তি বা ব্যাখ্যা নয়। আমাদের মতো স্পষ্ট দলীল। মনে রাখবেন, আপনাদের শরীয়তের দলিল ছাড়া আপনাদের গবেষণা, যুক্তি আমাদের কিছু বিন্দুমাত্র কোন মূল্য রাখে না। সুতরাং যখন ওসিলাকে না-জায়েজ বলবেন, তখন ওসিলা নাজায়েজ হওয়ার স্পষ্ট দলিল দিবেন, যখন শিরক বলবেন, তখন শিরক হওয়ার স্পষ্ট দলিল দিবেন। শরীয়তের দলিল ছাড়া কোন ব্যক্তির গবেষণা বা যুক্তি আনবেন না আশা করি। আপনাদের গবেষণাটি ইবনে তাইমিয়া রহ. এর হোক, কিংবা আলবানী সাহেবের, শরীয়তের দলিল ছাড়া শুধু তাদের নিজস্ব বক্তব্য আমাদের কাছে দলিল নয়।
-----
শাইখ মুফতি ইযহারুল ইসলাম আল-কাউসারি